somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিখ্যাত শিল্পী মৃনাল হকের সাথে কিছুক্ষন

৩০ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ১১:৩২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"ইনি কে?"
শিল্পী এক গাল হেসে বললেন, "এনাকে চিনলা না? ইনি হচ্ছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।"
আমি আরও গভীরভাবে লক্ষ্য করে বললাম, "কিন্তু তাঁর গলা গেল কই? মনে হচ্ছে কচ্ছপের মতন খোলস থেকে বেরুচ্ছিলেন, শুধু মাথাটা বেরিয়েছে আর অমনি সেই মোমেন্ট ক্যাপচার করে আপনি ভাস্কর্য বানিয়ে ফেলেছেন। গলা বের হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করেন নি।"
শিল্পী হাহা করে হেসে বললেন, "ভাল রসিকতা করেছো হে। আসলে আমি রবীন্দ্রনাথকে পড়ে, তাঁকে আত্মস্থ করে, অনুধাবন করে তাঁর এই ভাষ্কর্য নির্মাণ করেছি। তাঁর সেই বিখ্যাত কবিতা পড়নি?"
তিনি দরাজ কণ্ঠে আবৃত্তি করে ওঠেন, "মোর গলে দিওনা তুমি পুস্পমাল্যখানি / ভালবাসিলে, ঠাঁই দিও তব, মননে একটুখানি।"
আমি মাথা চুলকে বললাম, "এই কবিতা ভদ্রলোক কবে লিখলেন?"
তিনি চোখ পাকিয়ে বললেন, "তুমি আমাকে চ্যালেঞ্জ করতে চাও? তুমি কী রবীন্দ্র রচনাবলী মুখস্ত করে বসে আছো? তুমি বলতে চাও দীর্ঘ আশি বছরের জীবনে রবীন্দ্রনাথ এমন দুই লাইন লিখতে পারেননি? তাঁর সেই যোগ্যতা ছিল না? নোবেল তাঁকে এমনি এমনিই দেয়া হয়েছে?"
আমি শিল্পীকে আর না রাগাতে বললাম, "না, আসলে আমি মুখ্যুসুখ্য মানুষ। রবীন্দ্রনাথ পড়ার সৌভাগ্য বা বিদ্যা কোনটাই হয়নাই। শুধু জিজ্ঞাসা ছিল, সেই কবিতার সাথে এই ভাস্কর্যের কী সম্পর্ক?"
শিল্পী নিজের রক্তচাপ কমিয়ে বললেন, "তিনি বলেছিলেন, তাঁর গলায় মালা না দিয়ে, তাঁকে মনে ঠাঁই দিয়ে তাঁকে শ্রদ্ধা জানাতে। কিন্তু বাঙালি সেটা বুঝলেতো। তাই গলাই রাখলাম না। এখন মালা দিবি কই? হুহু বাবা! বুদ্ধিটা দেখেছো? সব শিল্পী আমার মতন বুদ্ধিমান হলে আজ পৃথিবীর চেহারাই পাল্টে যেত।"
কিছু না বলে উপর নিচ মাথা নেড়ে সামনে এগোই।
"এইটা কে?" আরেকটা ভাষ্কর্যের সামনে দাঁড়িয়ে অবাক হয়ে বলি।
শিল্পী আমার চেয়েও অবাক হয়ে বলেন, "একে চিনলে না? এ হচ্ছে বোম্বের কিং খান, শাহরুখ খুন।"
কোন মিল খুঁজে না পাওয়ায় অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলাম।
তিনি হেসে বললেন, "শিল্পকর্ম দেখতে হয় শিল্পীর মানসচক্ষু দিয়ে। চোখ বন্ধ করো, গভীর শ্বাস নাও। আমাকে নিজের মধ্যে ধারণ করো। এখন চোখ খোল। বল তুমি কী দেখছো?"
আমি গভীরভাবে সামনের ভাষ্কর্য দেখি। আমার কাছে আগের মতই লাগে। শাহরুখ খানের ভুখা নাঙ্গা সস্তা ডুপ্লিকেট ছাড়া আর কিছুই মনে হয়না। তবুও শিল্পীর সামনে ভাব নিতে বিজ্ঞের মতন ব্যাখ্যা শুরু করি।
"মনে হচ্ছে শাহরুখ খান পেটের পীড়ায় জর্জরিত। এই কারনে তাঁর কপাল কুঁচকে আছে। ঠিক এইসময়ে মিডিয়া এসে উপস্থিত হয়েছে। তাই ক্যামেরার সামনে হেসে দিয়েছেন। কিন্তু কপালের ভাজ দূর হয়নি। আপনি সেটাই তুলে ধরেছেন। ঠিক বলেছি?"
তিনি হতাশ স্বরে বললেন, "তোমাকে দিয়ে হবেনা। তুমি তাঁর চুল খেয়াল করো। দেখে কী মনে হচ্ছে?"
আমি সরাসরি বললাম, "বিড়ালকে ভেজানো হয়েছিল, সে গা ঝাড়া দিয়েছে।"
শিল্পী চোখ বড় বড় করে বললেন, "একজ্যাক্টলি! ব্রাভো! আসলে আমি বুঝাতে চেয়েছি, পুরুষমানুষ বাইরে যতই কিং ফিং হোক না কেন, বাড়িতে বৌয়ের সামনে সবাই ভেজা বেড়াল। এই ছবির মাধ্যমে আমি ভূরাজনীতির যাঁতাকলে নিষ্পেষিত প্রলেতারিয়েত নারী সমাজ দ্বারা শোষিত, নিপীড়িত, কনজুমারিজমের দাসত্বে শৃঙ্খলিত পুরুষ সমাজের দুঃখ কষ্টের কাহিনী ফুটিয়ে তুলেছি। কান পাত, তুমি কী এই শিল্পকর্ম থেকে সেই লক্ষ বছরের হাহাকার শুনতে পাও না?"
কী বললেন পুরোটাই মাথার উপর দিয়ে গেল। আমি বললাম, "আপনি কী ভ্যান গগের স্টারি নাইটের মতন কিছু একটা করছেন?"
তিনি চোখ মুখ খিঁচিয়ে জানতে চাইলেন, "ঐ ব্যাটা আবার কে?"
কথা পাল্টাতে বললাম, "না, তিনি হার্ভার্ড ইউনিভার্সিটির মহিলা হলের সামনের ফুটপাথে চটপটি ফুচকার ঠ্যালা নিয়ে বসেন। নারী মহলে সে বেশ জনপ্রিয়।"
তিনি আবারও চোখ রক্তলাল করে বললেন, "তুমি এক ফুচকাওয়ালার সাথে আমার তুলনা করলা!"
মুখ তেলতেলে করে বললাম, "মিস্টেক হয়েছে ভাই। ক্ষমাপ্রার্থী! জানতে চাইছিলাম শিল্পীদের মধ্যে আপনার আদর্শ কে?"
তিনি গর্বের সাথে বললেন, "মেসার্স ছগির এন্ড কোংয়ের কর্ণধার, জনাব ছগির আলী!"
আমি তাঁর সাথে তাল মিলাতে বললাম, "বলেন কী! কে এই বিখ্যাত শিল্পী?"
তিনি পরম শ্রদ্ধায় নিজের চোখ বুজে বললেন, "ওস্তাদজি সাইনবোর্ড পেইন্টিং করেন। সুনামগঞ্জে যেকোন ভাতের হোটেল থেকে কসাইর দোকান পর্যন্ত যেকোন বিজনেসের সাইনবোর্ড পেইন্টিংয়ের জন্য ওস্তাদজীর সমকক্ষ কেউ নেই।"
সামনের ভাস্কর্যে দেখে জানতে চাইলাম, "জেলের ভিতর ওটা কাকে পুড়েছেন?"
তিনি গর্বিত স্বরে বললেন, "এটি বিখ্যাত অভিনেতা কাজী নজরুল ইসলামের ভাষ্কর্য।"
আমি চোখ কপালে তুলে বললাম, "ইনি অভিনয় করতেন কবে?"
তিনি আমার চেয়েও অবাক হয়ে বললেন, "কেন তুমি 'আজ রবিবার' নাটকে তাঁর অভিনয় দেখোনি? তিতলি ভাইয়া, কংকা ভাইয়া? বড় চাচা? বা 'মফিজ পাগলের' চরিত্রে তাঁর অনবদ্য অভিনয়? টেলিভিশন নামের যন্ত্র কী তোমার বাসায় নেই নাকি খোকা?"
আমি বললাম, "তিনিই যে নজরুল ইসলাম সেটা আপনাকে কে বলেছে?"
তিনি খুবই ক্যাজুয়ালি বললেন, "কেন, বদরুল বলেছে।"
"বদরুলটা কে?"
শিল্পী সিগারেট ধরাতে ধরাতে বললেন, "আমার তথ্য উপদেষ্টা। ভাষ্কর্য নির্মাণে আমার যাবতীয় তথ্যাবলী সেই আমাকে প্রোভাইড করে।"
"ও আচ্ছা।"
কিছু বলার নাই।
শিল্পী অনেক আগ্রহের সাথে বললেন, "তুমি সামনে আসো, আরও বাদবাকি ভাষ্কর্যগুলো দেখো। ঐ যে সামনেই মেসিকে দেখা যাচ্ছে। তাঁর পাশেই প্রিন্সেস ডায়ানা। ওদের দেখো।"
আমি তাকিয়ে "মেসিকে" এবং প্রিন্সেসকে দেখলাম। একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললাম, "থাক ভাই। বাদ দেন। আরেকটু সময় এখানে থাকলে অরিজিনালদের চেহারাই ভুলে যাব।"
যেন খুব উচ্চমার্গের রসিকতা হয়েছে এমনভাবে হোহো করে হেসে শিল্পী বললেন, "হাহাহা, আরে, তুমি নাম নিয়ে চিন্তা করছো কেন? বদরুল বলেছে, "নামে কিই বা যায় আসে?""
আগেরবার রবীন্দ্রনাথের কোটে ধরা খেয়েছি, এইবার চাপাবাজি ধরে ফেললাম। সাথে সাথে বললাম, "জ্বি, ওটা শেক্সপিয়ার বলেছিলেন। বদরুল নয়।"
তিনি বেশ অবাক হলেন। রিকনফার্ম করলেন। "এই কথা শেক্সপিয়ার বলেছিলেন?"
আমি দন্ত বিকশিত করে বললাম, "জ্বি, কথাটা শেক্সপিয়ার বলেছিলেন।"
"শিওর?"
"শিওর।"
"'বিদ্যা' বল!"
আমি বিদ্যার কসম খেলাম।
তিনি বললেন, "ও আচ্ছা। তাহলে শেক্সপিয়ার বদরুলকে বলেছিলেন হয়তো, বদরুল আমাকে বলেছে। তাই বদরুলের নাম নিয়েছি। আমি ভাই কারোর ক্রেডিট মারতে চাই না।"
এমন সময়ে তাঁর ফোনে কল এলো। তিনি রিসিভ করলেন, এবং মুহূর্তেই তাঁর চেহারা ফ্যাকাসে হয়ে গেল। ফোন রাখলে পরে আমি জানতে চাইলাম, "কী হয়েছে?"
তিনি ফ্যাসফ্যাসে স্বরে বললেন, "পুলিশ বদরুলকে দশকেজি গাঁজা সহ এরেস্ট করেছে। এখন তার থেকে তথ্য নিয়ে আমার ঘরের দিকেই আসছে।"
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, "তাহলে দাঁড়িয়ে আছেন কেন? পালান!"
তিনি অশ্রুসিক্ত স্বরে বললেন, "গ্রেপ্তারের পরোয়া আমি করিনা, কিন্তু পুলিশ আমার গাঁজা জব্দ করলে আমার শিল্পকর্মের কী হবে!"

সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে জানুয়ারি, ২০১৯ রাত ২:০৫
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

চুরি করাটা প্রফেসরদেরই ভালো মানায়

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৩


অত্র অঞ্চলে প্রতিটা সিভিতে আপনারা একটা কথা লেখা দেখবেন, যে আবেদনকারী ব্যক্তির বিশেষ গুণ হলো “সততা ও কঠোর পরিশ্রম”। এর মানে তারা বুঝাতে চায় যে তারা টাকা পয়সা চুরি... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিব নারায়ণ দাস নামটাতেই কি আমাদের অ্যালার্জি?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৫:৫৭


অভিমান কতোটা প্রকট হয় দেখেছিলাম শিবনারায়ণ দাসের কাছে গিয়ে।
.
গত বছরের জুন মাসের শুরুর দিকের কথা। এক সকালে হঠাৎ মনে হলো যদি জাতীয় পতাকার নকশাকার শিবনারায়ণ দাসের সঙ্গে দেখা করা সম্ভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঘুষের ধর্ম নাই

লিখেছেন প্রামানিক, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:৫৫


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

মুসলমানে শুকর খায় না
হিন্দু খায় না গাই
সবাই মিলেই সুদ, ঘুষ খায়
সেথায় বিভেদ নাই।

হিন্দু বলে জয় শ্র্রীরাম
মুসলিম আল্লাহ রসুল
হারাম খেয়েই ধর্ম করে
অন্যের ধরে ভুল।

পানি বললে জাত থাকে না
ঘুষ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×