বিয়ে হচ্ছে একটি কন্ট্রাক্ট বা চুক্তিপত্র। অন্যান্য যেকোন "কন্ট্রাক্টের" মতোই এতেও কিছু শর্ত থাকে, চুক্তিবদ্ধ অবস্থায় সেইসব শর্ত মেনে চলা অবশ্য কর্তব্য। শর্ত ভাঙ্গা হলে সেটি হবে নৈতিক ও সামাজিক অপরাধ। কাজেই, পরকীয়া একটি অপরাধ। একে কোন ভাবেই জাস্টিফাই করা যাবেনা। গ্লোরিফাই করারতো প্রশ্নই উঠেনা।
এই পর্যন্ত সব ঠিক আছে?
এখন আপনি হয়তো বিয়ের পরে অন্য কারোর প্রেমে পড়ে গেছেন। এমনটা হতেই পারে। শরীরের চাহিদাকে উপেক্ষা করা আসলেই কঠিন। এবং অনেক ক্ষেত্রেই দেখা যায় মানসিক সাপোর্টও নিজের পার্টনার থেকে না এসে অন্য কারোর থেকে আসছে। তখন আপনি কী করবেন?
আপনার উচিৎ দুই সম্পর্ককে ইভালুয়েট করা। যার সাথে আপনি বৈবাহিক সম্পর্কের মধ্যে আছেন, তাঁর চেয়ে কী নতুন পার্টনারকে আপনি বেশি ভালবাসেন? এক্ষেত্রে অবশ্যই বিবেচনায় নিবেন, এই বর্তমান পার্টনারের সাথে জীবনের চরমতম বন্ধুর পথ পেরিয়ে বর্তমান অবস্থানে পৌঁছেছেন। নতুন পার্টনার কী আপনার দুঃসময়ে বর্তমান সঙ্গীর মতন পাশে থাকবে? আপনার কাছে ইমোশনের মূল্য বেশি, নাকি শরীরের চাহিদার?
তারপরে আপনি সিদ্ধান্ত নিলেন, না, অনেকদিন হলো। একঘেয়ে জীবনে একটু ফ্রেশ স্টার্ট করতে হবে। আপনার উচিৎ পার্টনারের সাথে আলোচনা করে কন্ট্রাক্ট থেকে বেরিয়ে আসা। সহজ ভাষায় ডিভোর্স। এটিই সুস্থ এবং একমাত্র সঠিক প্রক্রিয়া। এখন পর্যন্ত যা লিখলাম, সত্য লিখলাম, সবাই মানেনতো?
এখন, আমাদের দেশে ডিভোর্সের নাম শুনলেই অনেকেই ছিঃছিঃ করে। হায় হায় করে। লোকে কী বলবে? ছেলেকে নিয়ে লোকে বলবে, একটা বৌকে পোষ মানাতে পারলো না? কেমন পুরুষ সে? তাঁর নিশ্চই শারীরিক ত্রুটি আছে।
আর মেয়েকে নিয়ে লোকে বলবে, নিশ্চই মেয়েটার কোন দোষ। এর ওর সাথে শুতে চায়, তাই ডিভোর্স হয়ে গেছে।
কথাগুলো সত্য বললাম কিনা বলেন দেখি? জ্বি, আপনি স্বীকার করেন বা না করেন, এই কথা লোকে বলে, এবং ক্ষেত্র বিশেষে আপনিও তাদের একজন। আজ পর্যন্ত খুব কম বাঙালিকে দেখেছি যারা অন্যের পার্সোনাল বিষয়ে নাক না গলায়। অন্যের হাড়ির ঢাকনা খুলে দেখতে হবে ওতে কী রান্না হচ্ছে। এইটা আমাদের মজ্জাগত স্বভাব।
যাই হোক, উপরোক্ত কারনে বাঙালি ডিভোর্স না নিয়ে অনৈতিক সম্পর্ক চালিয়ে যায়। অথবা সব সহ্য করে যায়।
স্বামী সাইকো, মানসিক অত্যাচার করে, মারধর করে, তারপরেও মেয়েদের দেখেছি সংসার টিকিয়ে রাখতে আপ্রাণ চেষ্টা করতে। এই ক্যানভাসেই একটা জনপ্রিয় হারামজাদা টাইপ লেখককে আমি নিজের হাতে ব্যান করেছি। সে ব্যাটা স্ত্রীকে মারধর করতো। অন্য মেয়ের সাথে সম্পর্ক ছিল। স্ত্রী প্রমানসহ পোস্ট দিয়েছিল। তার ভক্তকূল উল্টো ওর হয়েই সেই স্ত্রীকে শাঁসালো। বাঙালি ফেসবুকীয় বিচারকদের বিচারে তাই কোনকালেই আমার শ্রদ্ধা নাই। অদ্ভুত ব্যাপার, মার সহ্য করেও সেই স্ত্রী শেষ পর্যন্ত লড়ে গেছেন সংসার টিকিয়ে রাখতে!
আরেক ভাইকে চিনতাম, স্ত্রী ওপেনলি আরেকজনের সাথে প্রেম করে বেড়াতো। তারপরেও সেই স্ত্রীর প্রতি মমতার শেষ নেই। বা স্ত্রী তীব্র মানসিক টর্চার করেন, তারপরেও সোনামুখ করে সংসার করে যাচ্ছেন। অদ্ভুত জাতি আমরা!
কারোর কারোর মতে, লোকের অপমান সহ্য করার চেয়ে আত্মহত্যা করা ভাল। যেমন, এই ডাক্তার আকাশ করেছে।
আফসোস, ভুল এই সিদ্ধান্তের ঘটনাকে গ্লোরিফাই করা হচ্ছে। তাঁকে শহীদ বানিয়ে দেয়া হচ্ছে। একই সাথে তাঁর স্ত্রীকে বানানো হচ্ছে ভ্যাম্প। এই কিছুদিন আগেই ইন্ডিয়াতে "ডাইনি" অভিযোগে এক মহিলাকে তাঁর শিশুসহ পুড়িয়ে মারা হলো। আমি নিশ্চিত, এই মেয়েটিকে সামনে পেলে ফেসবুকের চরিত্রবান বাঙালি একই কাজ করতো।
কেসটিকে একটু খতিয়ে দেখুন, আত্মহত্যা করার সাথে সাথেই ছেলেটি হিরো হয়ে গেছে। লাখে লাখে পুরুষ ওর মাধ্যমে নিজের ক্ষোভ ঝাড়ছে। অপরাধীর দোষ পরকীয়া ছাড়াও সে সুন্দরী এবং আকর্ষনীয়া। এখন যারা যারা গালাগালি করছেন, এদেরকে যদি এই মেয়ে কিছুদিন আগেও ইনবক্সে ইশারা ইঙ্গিত দিত, কয়জন নিজের জিহ্বা সংযত রাখতে পারতেন? আমি প্র্যাক্টিক্যাল কথা বলছি। আমি বাঙালি, আমি পুরুষ, আমি জীবনের একটা বড় অংশ বাঙালি পুরুষদের সাথেই কাটিয়ে বড় হয়েছি, এবং এখনও ইনবক্সে অনেক আপু, ভাবি, মেয়েরা আমাকে "বিবাহিত ভদ্রলোকেদের" ম্যাসেজ স্ক্রিনশট করে পাঠায়। ওদের ফেসবুকের কমেন্টেরগুলো পড়ে মাথা চুলকে ভাবছি, এত চরিত্রবান আমাদের দেশের মানুষ! এরা কই ছিল এতদিন? আনন্দে চোখে পানি চলে আসে।
আমার অবাক লাগছে এজন্যই যে, কিছুদিন আগেই যখন এক দাড়িওয়ালা চাইল্ড মলেস্টারের ভিডিও ভাইরাল করার চেষ্টা করলাম, কেউই আগ্রহ দেখালেন না। মাত্র পয়ঁতাল্লিশটা লাইক পড়েছিল। শেয়ারের ঘটনা মাত্র ১৩! আমার নাস্তায় ডিমের ছবিতেই যেখানে লাইক সংখ্যা ২৭১! অথচ এই মেয়েটির ক্ষেত্রে সবাই সত্যবান যুধিষ্ঠির হয়ে গেছেন। এইটাতো সেই আদিকাল থেকে আমাদের জন্য সত্য - পুরুষ পরকীয়া করলে সমস্যা নাই, বাচ্চাদের শরীর স্পর্শ করলে সমস্যা নাই, ধর্ষণ করলে সমস্যা নাই - নারী পরকীয়া করলেই "মাগি।" বাড়ির মালিক যদি বুয়াকে প্রেগন্যান্ট করে দেয়, তাহলে বুয়ার চাকরি যায়, মালিকের সংসারে কিছুই অদল বদল ঘটেনা। সে "ভদ্রলোক" হয়েই ভদ্রসমাজে টিকে থাকে।
আল্লাহ কী কোথাও বলেছেন নাকি পরকীয়ায় নারীর দ্বিগুন দোষ হবে, এবং পুরুষকে বেকসুর খালাস দেয়া হবে? তাহলে ফাজিলের মতন আচরণে আমরা কেন বিশ্বসেরা?
স্ত্রীর পরকীয়ার কিছু প্রমান দিয়ে সে নিজেকে শেষ করেছে। ঘটনাটা দুঃখজনক। একটি প্রাণের নিদারুন অপচয়। সমস্যা হচ্ছে, মাত্র কয়েকটি ফেসবুক পোস্ট পড়েই পুরো দেশ অবিবেচকের মতন বিচারালয় বসিয়ে স্ত্রীকে ক্রুশবিদ্ধ করছে। এমনভাবে লোকে ওয়াক থু করছে, যেন এই দম্পতিকে তাঁরা সবাই ব্যক্তিগতভাবে চেনেন। একটি দাম্পত্য জীবনে প্রতিদিন, প্রতি মুহূর্তে হাজারটা ঘটনা ঘটে, সব আউট অফ কন্টেক্স্ট রেখে কেবলমাত্র কয়েকটি পোস্টের উপরে ভরসা করে জাজমেন্টে পৌঁছানো কতটুকু যৌক্তিক? "আমাদের দেশ গরু ছাগলে স্বয়ংসম্পূর্ণ" - পত্রিকার সংবাদটির সত্যতা কী ফেসবুকেই দিতে হবে?
সবার আচরণে মনে হচ্ছে যেন আমাদের দেশে কেউ এতদিন পরকীয়া করেনি। এই মেয়েটির মাধ্যমেই শুরু হলো। ফেসবুক ছেয়ে গেল চরিত্রবান বান্দাদের কমেন্টে। সবাই চায় মেয়েটিকে তাঁর মা সহ শূলে চড়াতে। আচ্ছা, দেশে যদি সবাই চারিত্রিকভাবে এতই ভাল হয়, তাহলে ঢাকা শহরের আবাসিক হোটেলগুলো টিকে আছে কাদের ভরসায়? পতিতালয়গুলোর কাস্টমার কারা? নিউমার্কেট, গাউছিয়া, বা যেকোন ভিড়ে মেয়েদের শরীর হাতড়ে বেড়ায় কারা? বড় বড় কর্পোরেশনে সেক্সুয়াল হ্যারাসমেন্ট করে কারা? যারা মেয়েটিকে গালাগালি করছে, বলছে যে সমাজ উচ্ছন্নে যাচ্ছে, খোঁজ নিয়ে দেখুন, প্রতি রাতে পর্ন ওয়েবসাইট ঘুরাঘুরি করে এই এরাই। গুগলের তথ্যমতে পর্ন ওয়েবসাইটগুলোতে সবচেয়ে বেশি আনাগোনা করা দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশ অন্যতম শীর্ষে। আমরা এতই ভদ্রলোক হলে সার্চ মেশিনে টাইপ করে কারা? জ্বিন ভূতে?
যারা আমাকে চেনেন, তাঁরা ভাল করেই জানেন, আমি অন্ধভাবে কারোর পক্ষ বা বিপক্ষ নেই না। আমার যতই কাছের লোক হোক না কেন। চেষ্টা থাকে যা সত্য, তার পক্ষে থাকার।
আমার কথা হলো,
১. হ্যা, মহিলা পরকীয়া করেছেন। অন্তত হোটেলরুমের ছবিগুলো, মোবাইল ফোনের ম্যাসেজগুলো থেকে তাই মনে হয়। বিবাহিত অবস্থায় মেয়েটি নৈতিক ও সামাজিক কন্ট্রাক্ট ভঙ্গ করেছে। এখন সেজন্য যদি বিচার করতে হয় সেই দায়িত্ব আদালতের। তোমার আমার মতন ফেসবুকীয় বান্দাদের না। কাজেই অফ যাই।
২. আত্মহত্যায় প্ররোচনা করেছে কিনা, সেটা তদন্তের ভার পুলিশের। পুলিশ তদন্ত করে বের করুক আসল ঘটনা। আপনি সাহায্য করতে চাইলে পুলিশে যোগ দিন। ফেসবুকে আউল ফাউল কথা বলে শুধুশুধু নিজের মূর্খতা প্রমান দিবেন না।
৩. ছেলেটির মানসিকভাবে কতটা সুস্থ ছিল, সেটাও আশা করি বিবেচনা করা হবে। বৌকে পেটানো (ভিডিওটি দেখলে একটা ছাগলও বুঝতে পারবে), সন্দেহ করা, চরিত্রহীন জেনেও (ছেলেটিরই ভাষ্যমতে) লেগে থেকে এই মেয়েকেই বিয়ে করা, ইত্যাদি কোন সুস্থ মাথার ছেলেরতো করার কথা না। (বিয়ের কার্ড ছাপা না হলে বিয়ে করতো না - are you serious?) "ভালবেসেছিল, তাই বিয়ে করেছে" - জাতীয় সস্তা, ফালতু থিওরি সাইকোলজিতে চলেনা, আশা করি জানেন।
৪. আপনি আমি কেউ না কেবল একদিক দেখেই বিচার করে বসার। ভিকটিম ব্লেমিং, বা মেয়েটির পক্ষ কোনটাই নিচ্ছি না। শুধু চাইছি সত্য ও সুষ্ঠু বিচার হোক। যতক্ষণ না হচ্ছে, ফেসবুকে আজেবাজে গালাগালি বন্ধ করেন। নোংরা ভাষায় নিউজফিড ভরে গেছে। বইমেলার ছবি, বন্ধুবান্ধবের বইয়ের প্রচারনা দেখতে যাই, শুধু গালাগালি আর গালাগালি দেখি। আপনাদের হয়তো ভাল লাগে। এই লেভেলের গালাগালি শুনলে আমার মাথা ধরে যায়। আল্লাহর ওয়াস্তে অফ যান।
৫. মেয়েটির জীবন এই মুহূর্তে দোজখ বানানো হয়ে গেছে। পুরো দেশের মানুষ এখন এর বিরুদ্ধে। এখন মেয়েটিকে যদি কেউ রেপ করে, লোকে বলবে খুব ভাল হয়েছে। এখন মেয়েটিকে যদি খুন করা হয়, লোকে হাততালি বাজাবে। আদালত যদি মেয়েটিকে কোন শাস্তি না দেয় - তাহলে লোকে বিচারকের গুষ্ঠি উদ্ধার করবে। বড় অদ্ভুত আমাদের আচরণ! শিক্ষিত হয়ে গেছি, পয়সাও পকেটে চলে এসেছে - কিন্তু "মানুষ" হতে পারিনি।
আল্লাহর ওয়াস্তে, বিচারটা আদালতকে করতে দিন। ছেলেটি মারা গেছে, তাঁর পরিবারকে শোক যাপন করতে দিন। আপনি আমি আপাতত দূরে থাকি। এখন মেয়েটাও যদি নিজেও আত্মহত্যা করে সেই দায়ভার কিন্তু আপনার আমারও নিতে হবে।
*ইহা কোন নারীবাদী-পুরুষবাদী-হিজরাবাদী পোস্ট নহে। ইহা একটি সত্যবাদী পোস্ট।
*কোন মন্তব্য করার আগে ভাল করে লেখাটি পড়ুন। দ্বিমত, ত্রিমত, চতুৰ্মত থাকতেই পারে - আপনি আপনার অপিনিয়ন ধারণ করবেন, আমারও আমার অপিনিয়ন ধারণ করার স্বাধীনতা আছে। আপনি যদি মেয়েটির শাস্তি চান, সভ্যতার লিমিটেশনের মধ্যে থেকে করুন। আপনার আচরণেই বুঝা যায় আপনার পারিবারিক শিক্ষা কেমন। নিজের না হোক, পরিবারের দিকে খেয়াল করে হলেও কমেন্টে সচেতন হন।
মাথায় রাখুন, এই ছেলেটি যেমন আপনার পরিবারের কেউ হতে পারতো, তেমনি এই মেয়েটিও আপনার পরিবারেরই কেউ হতে পারতো।
ধন্যবাদ।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা ফেব্রুয়ারি, ২০১৯ রাত ১:৪৬