স্বাধীনতা কী সেটা বুঝতে হলে পরাধীন দেশের মানুষের সাথে মিশতে হবে। তাঁদের দুঃখ, তাঁদের জ্বালা উপলব্ধি করতে হবে।
বর্তমান সিরিয়ার কথাই ধরুন।
দশটা বছর আগে সিরিয়ার ছবি দেখুন, আর বর্তমানের। চোখে পানি আসতে বাধ্য।
তাঁদের রিফিউজি ক্যাম্পের লোকজনের সাথে কথা বলুন। বেশিরভাগই ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, প্রফেসর পাবেন - আপনার আমার চেয়ে শিক্ষিত, উচ্চশ্রেণীর লোকজন। অথচ ভাগ্যের নিষ্ঠুর খেয়ালে আজ বস্তির মানুষের মতন জীবন কাটাচ্ছেন। পরিবার নিয়ে দুইটা দিন শান্তিতে বেঁচে থাকার আশায় চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ভিনদেশে আশ্রয় নিয়েছেন।
নৌকায় চেপে সমুদ্রপথ পাড়ি দিতে গিয়ে ডুবে মরেছেন তাঁদের অনেকেই। পিতা শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সন্তানের হাত আঁকড়ে ভেসে ছিলেন, বুঝতেও পারেননি কখন হাত ছুটে গেল। সন্তানের মৃতদেহ পরদিন সৈকতে আবিষ্কৃত হয়েছে। এইতো, সেদিনের ঘটনা এটা। ভুলে গেলেন?
রোহিঙ্গাদের কথাও ধরুন। আমাদের দেশে এসে তাঁরা বনাঞ্চল ধ্বংস করে দিয়েছে। আমাদের দেশে এসে আরও অনেক ক্ষতি করেছে। কিন্তু কয়েক শ বছর ধরে যে দেশে তাঁদের বাস, জন্মগতভাবে যে দেশে তাঁদের থাকার অধিকার, সেখান থেকে উৎখাত করলে তাঁদের কিই বা করার আছে?
বাঁচতে কে না চায়? ছোটছোট ছেলেমেয়েদের চোখের সামনে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে তাঁদের পিতা মাতাদের। আগুনে পুড়িয়ে ছাই করা হয়েছে গ্রামের পর গ্রাম। মাটি কামড়ে থাকবে কিভাবে?
এখন জেনে রাখুন, এসবের সবকিছুর মধ্য দিয়ে যেতে হয়েছে আমাদের পূর্ব পুরুষদের। যাদের অনেকেই এখনও জীবিত।
রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক সবদিক দিয়েই দুই যুগের ভয়াবহ শোষণের পর একরাতে বাংলার নিরীহ জনগনের উপর লেলিয়ে দেয়া হয় দেশের সশস্ত্র মিলিটারি শক্তিকে। অপরাধ? ওরা বাঙালি, ওরা স্বাধীনতা চায়!
দাউ দাউ করে জ্বলতে থাকে ঢাকা নগরী, বুলেটে ছিন্নভিন্ন হয়ে মরতে থাকেন সাধারণ নাগরিক।
সে ছিল এক বিভীষিকাময় রাত্রি, এক ভয়াল দুঃস্বপ্নময় রাত্রি।
হাজারে হাজার মানুষের রক্তে স্নাত হয়ে পরদিন ঠিকই ভোরে সূর্য উঠে। আমাদের আশ্বাস দেয়, রাত্রি যতই ঘোর নিশীথ হোক না কেন, পরদিন সূর্য উঠবেই।
২৬শে মার্চ ১৯৭১, বাংলাদেশ নামের রাষ্টের জন্ম হয়।
আগের রাতেই পাকবাহিনীর হাতে গ্রেপ্তারের আগে এর জনক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র লিখে বিশ্বস্তদের হাতে পৌঁছে দেয়ার ব্যবস্থা করেন। বেতারে যা প্রচারও হয়।
ভয়াবহ গণহত্যায় লোকজন দিশেহারা হয়ে যান। শহরের লোক গ্রামের দিকে ছুটেন। সেখানেও চলে গণহত্যা। গুজব রটে মিলিটারি নাকি পানি ভয় পায়। তাই সড়ক থেকে নৌপথই নিরাপদ। দেখা গেল গানবোট নিয়ে হায়েনার দল নদীতেও নেমে এসেছে। গুলি করে মারছে মানুষ।
গলিত লাশ ভাসছে জলে, তার উপর বসে ঝিমুচ্ছে শকুন, এ ছিল খুবই সাধারণ দৃশ্য।
নদীর মাছ নর মাংস ভোজে হৃষ্টপুষ্ট হয়ে গেছিল বলে বাঙালি মাছ খাওয়া বন্ধ করে দিয়েছিল।
রাতের অন্ধকারে দেশ ছেড়ে পালাবার পথে মিলিটারির সাথে দেখা। সবাই তড়িঘড়ি পাশের ধানক্ষেতে গিয়ে আশ্রয় নেন। মায়ের কোলের শিশু কেঁদে উঠলে মিলিটারি টের পেয়ে যাবে মানুষের অস্তিত্ব। তাই মা নিজের হাতে শিশুর মুখ চেপে ধরেন। মিলিটারি যেতে যেতে মা হাত সরিয়ে দেখেন নিথর হয়ে পড়ে আছে শিশু। নিজের হাতে দম বন্ধ করে হত্যা করেছেন তিনি নিজেরই সন্তানকে। সম্ভিত জননী উন্মাদিনী হয়ে যান এর পরে।
এ ঘটনা আমাদেরই দেশে ঘটেছিল। কী নিষ্ঠুর! কী অমানবিক!
মাত্র নয় মাসের যুদ্ধ শেষে আমরা দখলদার মুক্ত হই।
এর প্রতিটা দিন, প্রতিটা ক্ষণ রক্তে লেখা। পতাকার ঐ লাল বৃত্ত, সেটা শহীদের খুনে রাঙ্গা।
আমাদের মুক্তিযুদ্ধ বিশ্বের কাছে এক বিস্মিত বিস্ময়ের নাম।
এত কম সময়ে এত শক্তিশালী ও সুশৃঙ্খল সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে সাধারণ জনতা লড়াই করে পরাজিত করার উদাহরণ দ্বিতীয়টি নেই।
ভারতের ইন্দিরা গান্ধীজি, এবং তাঁদের জনগণ সেসময়ে আমাদের সাহায্য করেছিল, আমাদের পাশে এসে দাঁড়িয়েছিল, তাঁদের ধন্যবাদ।
একাত্তুরের অনেক অনেক বীর মুক্তিযোদ্ধা, রথী, মহারথী মহানায়কদের অনেকেই একাত্তুর পরবর্তী সময়ে ভুল পথে পা বাড়িয়েছেন। দেশ স্বাধীন হবার পরে আমাদের মিত্রদেশ ভারতের সাথেও আমাদের অনেক কিছু নিয়েই ঝামেলা হয়েছে।
ব্যাপারগুলো দুঃখজনক।
তবে তাই বলে মুক্তিযুদ্ধে সেইসব বীরদের এবং ভারতের অবদান অস্বীকার করাটাও অকৃতজ্ঞতা হয়ে যায়। যা আমাদের দেশে এখন হয়ে আসছে।
তাঁদের এই চরিত্রবদলকে ইতিহাসের উপহাস হিসেবেই ধরে নেয়া যাক।
মুক্তিযুদ্ধে অংশ নেয়া প্রতিটা সশস্ত্র গেরিলা, তাঁদেরকে দেশের নামে কোরবান করা তাঁদের পিতামাতা, তাঁদের লুকিয়ে লুকিয়ে সাহায্য করা দেশের আম জনতা - সবার প্রতি রইলো বিনম্র শ্রদ্ধা।
শুভজন্মদিন বাংলাদেশ! দেখতে দেখতে বয়স আটচল্লিশ বছর হয়ে গেল। তোমার অমরত্ব কামনা করি।
দেশ আমাকে কী দিল সেটা নিয়ে হাহুতাশ না করে আমি বরং এই নিয়ে চিন্তা করি আমি দেশকে কী দিয়েছি। এখন পর্যন্ত অশ্বডিম্ব ছাড়া কিছুই খুঁজে পাচ্ছি না।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে মার্চ, ২০১৯ রাত ৮:৪৬