ইহুদি, খ্রিষ্টান এবং ইসলাম, এই তিন ধর্মই একই ঈশ্বরের উপাসনা করে, আল্লাহ।
তিন ধর্মই নবী রাসূলে বিশ্বাসী। ইহুদি ধর্মে ঈসা (আঃ) এবং মুহাম্মদকে (সঃ) নবী মানে না, খ্রিষ্টানরা মুহাম্মদকে (সঃ) নবী মানে না, এবং মুসলিমরা ঈসাকে (আঃ) নবী মানলেও খ্রিষ্টানদের মতন "আল্লাহর পুত্র" মানে না।
আমাদের ধর্মে আল্লাহ অতি পবিত্র, জৈবিক চাহিদার ঊর্দ্ধে। তিনি সবাইকে অন্ন বস্ত্র বাসস্থানের মতোই সন্তানও দান করেন। তাঁর নিজের কোন সন্তান নেই, সন্তানের প্রয়োজনও নেই। সূরা ইখলাস মূলত তাঁর পরিচয়ই তুলে ধরে।
যাই হোক, নবী (সঃ) যখন মদিনায় ধর্মপ্রচারে আসেন, তখন দেখেন ইহুদিরা একটি বিশেষ দিনে রোজা রাখছেন। তিনি জিজ্ঞেস করলে জানতে পারেন যে এটি পবিত্র আশুরার ( দশই মহররমের ) রোজা। এই দিনে মুসার (আঃ) মাধ্যমে বনি ইস্রাঈল সম্প্রদায় ফেরাউনের কব্জা থেকে মুক্তি লাভ করে। এই দিনটির স্মরণেই ইহুদিরা রোজা রাখে।
নবী (সঃ) তাঁর উম্মতদের বলেন, "আমরা নবী মুসাকে (আঃ) আরও বেশি ভালবাসি। আমরাও এই দিনে রোজা রাখবো।"
মুসলিমদের জন্য আশুরার দিনে রোজা রাখা ফরজ হয়ে যায়।
পরে আল্লাহর নির্দেশে পুরো রমজান মাস ব্যাপী রোজা ফরজ হলে এই দিনটির রোজা সুন্নতে বদলে যায়। রাখতে চাইলে রাখুন, বহু সাওয়াব পাবেন। না রাখলে গুনাহ হবেনা।
আমাদের অনেকেই কারবালায় হজরত হোসেনের মর্মান্তিক হত্যার ঘটনাকে এই দিনের সাথে মিলিয়ে ফেলেন। তাঁরা ভাবেন, এই দিবসটির কারণেই বুঝিবা আমরা আশুরার দিনে রোজা রাখি, আশুরা পালন করি। আসলে তা নয়। কারবালা ট্রাজেডি এই দিনটির সাথে স্রেফ কাকতালীয় একটি দুর্ঘটনা। এর সাথে এই দিনটির মাহাত্মের কোন সম্পর্ক নেই। নবীজির (সঃ) মৃত্যুর বহু বছর পরে হজরত হোসেনের মৃত্যু হয়, তাই এই দিবসে সেই দুর্ঘটনাকে ঘিরে ইবাদতের নির্দেশ নবী (সঃ) দিয়ে যাননি। যা তিনি বলে যাননি, সেটি করা আমাদের ধর্মে নিষেধ। আমাদেরকে এই দুইয়ের পার্থক্য বুঝতে হবে।
এখন একটি ব্যাপার কী কেউ লক্ষ্য করেছেন, আমরাই পৃথিবীর একমাত্র জাতি, যারা অন্য সম্প্রদায়ের মানুষের মুক্তির আনন্দে আনন্দিত হই? ভাল করে ঘটনাটির গভীরতা উপলব্ধি করুন। বনি ইসরাঈলীদের ওপর ভয়াবহ নির্যাতন জারি রেখেছিল মিশর অধিপতি ফেরাউন।
এতটাই অত্যাচারী ছিল যে তাঁদের শিশু সন্তানদের ধরে ধরে হত্যা করার পরেও ওরা কেউ টু শব্দ পর্যন্ত করতে পারতো না। আধুনিক সাইকোলজির ভাষায় একেই মেন্টাল ট্রমা বলে। অধিক শোকে বোধশক্তি লুপ্ত হওয়া। মানুষ রোবটের মতন আচরণ করেন। ফেরাউনের শাসন তাঁদের সম্প্রদায়কে এতটাই ট্রমাটাইজড করে ফেলেছিল।
সেই সম্প্রদায়কে একজন মহামানব তার কবল থেকে মুক্ত করে আনেন, স্বাধীনতা দান করেন। কয়েক হাজার বছর পরেও সেই জাতি তাঁদের সেই মুক্তির দিনটিকে স্মরণ করে আনন্দ উৎসব করে।
এবং মুসলিমদেরও বলা হয়েছে "অপরের" আনন্দে শরিক হতে। আমরাও তাই সেই আনন্দেই আনন্দিত হই। মুসা (আঃ) যে আমাদেরও নবী, তাঁর বিজয় আমাদেরও বিজয়!
মুসলিমদের বলা হয়েছে, যখন কোথাও কোন অন্যায় দেখবে, হোক অন্যায়কারী আমার নিজের আত্মীয় বা আমি নিজে, এবং যার প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে, সেই ব্যক্তিটি আমার শত্রু - তারপরও আল্লাহর কথা চিন্তা করে আমাকে অন্যায়ের বিরুদ্ধে অবস্থান নিতেই হবে। নাহলে, আমি মুসলিম হতে পারবো না।
আমার কথায় সন্দেহ হচ্ছে? বাড়িতে শেলফে তুলে রাখা কুরআন শরিফটি বের করুন, সূরা আন নিসা (৪ নম্বর সূরা) বের করে ১৩৫ নম্বর আয়াতটিতে চোখ বুলান। আল্লাহ আমাদের নির্দেশ দিচ্ছেন, "হে ঈমানদারগণ, তোমরা ন্যায়ের উপর প্রতিষ্ঠিত থাক; আল্লাহর ওয়াস্তে ন্যায়সঙ্গত সাক্ষ্যদান কর, তাতে তোমাদের নিজের বা পিতা-মাতার অথবা নিকটবর্তী আত্নীয়-স্বজনের যদি ক্ষতি হয় তবুও। কেউ যদি ধনী কিংবা দরিদ্র হয়, তবে আল্লাহ তাদের শুভাকাঙ্খী তোমাদের চাইতে বেশী। অতএব, তোমরা বিচার করতে গিয়ে রিপুর কামনা-বাসনার অনুসরণ করো না। আর যদি তোমরা ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে কথা বল কিংবা পাশ কাটিয়ে যাও, তবে আল্লাহ তোমাদের যাবতীয় কাজ কর্ম সম্পর্কেই অবগত।"
আশা করি কুরআনে আল্লাহর নির্দেশ সবাই বুঝতে পারছেন। ঘুরিয়ে-পেঁচিয়ে পাশ কাটাবারও কোন সুযোগ তিনি দেননি। বিস্তারিত ব্যাখ্যায় গেলাম না।
মূল পয়েন্টে আসি, আজ থেকে চার বছর আগে আমাদের দেশে হোসেনী দালানে শোক মিছিলে গ্রেনেড হামলা চালায় জঙ্গিরা।
আপনার শিয়াদের "আকিদার" সাথে বিরোধ আছে? অসুবিধা নাই। তাজিয়া মিছিলে সমস্যা আছে? অসুবিধা নাই। ওদের অনেক কিছুর সাথেই সুন্নিদের বিশ্বাস সাংঘর্ষিক? কোনই সমস্যা নাই। সব সমস্যা নিয়ে শান্তিপূর্ণ যুক্তি তর্ক ও আলোচনায় বসা সম্ভব।
কিন্তু কোন অবস্থাতেই তাঁদের মিছিলে বোমা হামলা করে তাঁদের মৃত্যুকে জাস্টিফাই করা উচিৎ না। কোন অবস্থাতেই আপনি বলতে পারেননা, "শিয়া মরেছে? সমস্যা নাই। ওরাতো মুসলিম না।"
পত্রিকায় এসেছে, গত চার বছরে ৪৬ জন সাক্ষীর মধ্যে কেবলমাত্র এগারোজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষ যে কতটা আন্তরিক, সেটাতো বুঝাই যাচ্ছে। আমরা কতটা আন্তরিক, সেটাই হচ্ছে মূল কথা।
একটা ব্যপার শুধু মনে রাখবেন, আজকে যদি আপনি কারোর বিরুদ্ধে কোন রকম অন্যায়কে প্রশ্রয় দেন, কালকে একই রকম অন্যায়ের শিকার আপনি নিজেই হবেন। আমাদের উপরে থেকে যিনি আমাদের নিয়ন্ত্রণ করেন, তাঁর বিচার এমনই।
একটি কঠিন বাস্তব উদাহরণ দেই।
সত্তুর দশকের শেষের দিকের ঘটনা, ইরানে শাহর স্বৈরশাসনের অবসান ঘটায় ইরানের সাধারণ জনগণ।
এতে প্রতিবেশী দেশ ইরাকের সুন্নি প্রেসিডেন্ট সাদ্দাম হোসেন চিন্তায় পড়ে যান। তাঁর আশঙ্কা, এ বিপ্লব তাঁর দেশেও ঘটতে পারে। কারণ ইরাকের সিংহভাগ নাগরিক শিয়া। তাঁর ভয়, ইরানের শিয়ারা তাঁর দেশের শিয়াদেরও বিগড়ে দিবে।
এই ভয় থেকেই ১৯৮০ সালে তিনি ইরান আক্রমন করে বসেন। সীমান্তের দিকে কিছুটা জায়গা দখল করে নেন।
অন্যায় ছিল? অবশ্যই। তবে আমি নিশ্চিত, বাংলাদেশিরা ইরাকের পক্ষেই ছিল। কারন তিনি সুন্নি।
ইরান তৎক্ষণাৎ কিছু না করলেও, দুই বছর পর ঠিকই পাল্টা আক্রমন করে ইরাকিদের নিজ সীমানায় ঠেলে দেয়। কিন্তু বিজয়ে মজা পেয়ে ইরাকের ভেতর হানা দেওয়ার চেষ্টা চালায় তাঁরা।
শুরু হয় দুই প্রতিবেশীর সীমান্ত যুদ্ধ, যা বিশ্বের ইতিহাসে রক্তক্ষয়ী এক ন্যক্কারজনক যুদ্ধ হিসেবে পরিচিত। আমাদের সিম্প্যাথি কার পক্ষে ছিল? অবশ্যই সাদ্দাম হোসেন!
ভয়াবহতার দিক দিয়ে অনেক বিশ্লেষক এ যুদ্ধকে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সঙ্গে তুলনা করে থাকেন। আট বছর ধরে চলা এই যুদ্ধে প্রায় ১০ লাখ লোক হতাহত হয়।
সংখ্যাটা লক্ষ্য করুন, দশ লাখ!
এখন কিছু পয়েন্ট লক্ষ্য করুন।
ইরাক এ সময় ইরানের বিরুদ্ধে "রাসায়নিক অস্ত্র" ব্যবহার করে। এমনকি দেশের উত্তরাঞ্চলের কুর্দিদের বিরুদ্ধে সাদ্দাম এই অস্ত্র ব্যবহার করেন। অ্যামেরিকা প্রথম দিকে নিরপেক্ষ ভূমিকা রাখলেও, একটা সময়ে ইরাকের পক্ষ নিয়ে ইরানকে মার খাওয়ায়। দশ লাখের বেশি মানুষ মারা গিয়েছিল সাদ্দামের অমন বেপরোয়া এক সিদ্ধান্তে। ফায়দা তুলেছে অ্যামেরিকা। নিহত অসহায় কুর্দিদের বিচার পাইয়ে দিবে কে?
একদিন এই অ্যামেরিকা ইরাক দখলে নেয়, সাদ্দামকে পাকড়াও করে বিচার করে ফাঁসিতে ঝুলায়। যে ব্যাপক বিধ্বংসী অস্ত্রের সন্ধানে এত বিরাট যুদ্ধ হলো, সেই অস্ত্রের সন্ধান পাওয়া গেল না। একজন জনপ্রিয় নেতার অসহায় ও বিচার বহির্ভূত মৃত্যুতে কোটি কোটি মানুষ সেদিন কেঁদেছিল। কিন্তু ঐ যে দশ লাখ মানুষের মৃত্যু ও অসহায় দুর্বল কুর্দিদের নির্বিচারে হত্যা, তার শাস্তি পেতে হবেনা?
এখন মনে প্রশ্ন আসতেই পারে, তাহলে অ্যামেরিকার বিচার হবেনা? কে বলেছে হবে না? এক কালে যাদের সাম্রাজ্যে সূর্যাস্ত হতো না, সেই ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের আজকের অবস্থা দেখুন, ছোট্ট একটি দ্বীপ দেশে পরিণত হয়েছে। অ্যামেরিকার প্রেসিডেন্ট পদে ট্রাম্পের মতন একটা লোক বসে আছে। এতো কেবল শুরু, এইরকম কত হাজারো ট্রাম্প যে লাইনে দাঁড়িয়ে আছে, কয়জন জানেন? আড়াইশো বছর ধরে একটি জাতিকে উন্নতির শিখরে পৌঁছে দিতে একের পর এক গ্রেট প্রেসিডেন্ট কাজ করে গেছেন। তাঁদের কীর্তি ধূলিস্যাৎ করতে দুই তিনটা ট্রাম্পই যথেষ্ট।
মাথায় গেঁথে রাখুন, যেকোন অন্যায়ের বিচার এই পৃথিবীতেই হবে। আপনিও চিরস্থায়ী হবেন না, আমিও না, দোর্দন্ড প্রতাপশালী কোন বিশ্বনেতাও না, কোন রাষ্ট্রও না। কাজেই যখন কোন অন্যায় হতে দেখবেন, ভুলেও চোখ বুজে সবল দুর্বল, আত্মীয় অনাত্মীয় ইত্যাদি হিসেব কষতে বসবেন না। যে ন্যায়, তাঁর পক্ষে অবস্থান নিন। সে যদি নিজের পরিবারও হয়ে থাকে, এমনকি নিজেও হয়ে থাকেন, তারপরেও। মুসলিম হলে, এছাড়া আপনার আর কোন অপশন নেই।
সবাইকে পবিত্র আশুরার শুভেচ্ছা।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই সেপ্টেম্বর, ২০১৯ সকাল ৯:৫২