একটা সময়ে দুনিয়ার কোনো অঞ্চলেই পানি ফুটিয়ে খাওয়ার রেওয়াজ ছিল না। আমাদের দেশেই, আমাদের বাবা-মায়েরা যখন ছোট ছিলেন, তখনো মানুষ পুকুর ও নদীর পানি সরাসরি পান করতেন। কলেরা, টাইফয়েড, ডায়রিয়ায় আক্রান্ত হয়ে হাজার হাজার মানুষ মারা যেতেন।
আমরা যখন ছোট ছিলাম, তখনো বিটিভিতে প্রতিদিন কয়েকবার বিজ্ঞাপন প্রচারিত হতো কীভাবে ফুটিয়ে পানি পান করতে হয়। কীভাবে ফিটকিরি দিয়ে পানি বিশুদ্ধ করতে হয়। কীভাবে এক মুঠ খাওয়ার গুড় ও এক চিমটি লবণ দিয়ে খাবার স্যালাইন তৈরি করতে হয়।
এটা খুব বেশি পুরোনো কথা নয়। নব্বইয়ের দশকের ঘটনা।
ডায়রিয়া ঠেকাতে দেশব্যাপী প্রচার করা হলো ‘নলকূপের পানি পান করুন’।
‘গহিন কুয়ার জল পান করুন’।
‘ফুটিয়ে পানি পান করুন’।
কিন্তু একই সঙ্গে আমাদেরই দেশের কিছু অঞ্চলে আর্সেনিক দূষণ মাথাচাড়া দিয়ে উঠল। সেখানে কিন্তু এই সব নলকূপ, কুয়া ইত্যাদির পানি ফুটিয়ে পান করলেও নিরাপদ নয়। আর্সেনিক ঠেকাতে হয় বৈজ্ঞানিক উপায়ে। কয়লার ফিল্টার বা অন্য মাধ্যমে।
গেল পানির কথা।
এবার আসি মলমূত্রের বিষয়ে।
একটা সময়ে আমাদের দেশে টয়লেট কনসেপ্ট ছিল না। লোকজন বাড়ির পাশের ঝোপঝাড়, ধানখেত বা পাটখেতে যেতেন প্রাকৃতিক কর্ম সারতে। বাড়ির সঙ্গে লাগোয়া বাথরুম কেউ কল্পনাই করতে পারতেন না।
যেই পুকুরের পানি খেতেন, থালাবাসন ধুতেন, সেই একই পুকুরের পাশেই প্রস্রাব-পায়খানা করতেন। এ সব বর্জ্য বেশির ভাগ পুকুরের পানিতে মিশত। প্রস্রাব-পায়খানার বর্জ্য পানিতে মেশার সঙ্গে সঙ্গে মাছেরা ছুটে আসত সেগুলো খেতে।
এ অবস্থায় আমরা কলেরা-টাইফয়েডে মরব নাতো কারা মরবে?
এরপরে সরকারি পর্যায়ে ব্যাপক প্রচারণা ও এনজিওর কর্মীদের নিরলস চেষ্টার ফলে আমাদের গ্রামে গ্রামে স্যানিটারি টয়লেটের ব্যবস্থা হয়েছে। ভারতে এখনো অবস্থা ভয়াবহ। অক্ষয় কুমারকে ‘টয়লেট’ নির্মাণ করতে হয়েছে এই কারণেই!
শুধু তা-ই না, খাওয়ার আগে ও টয়লেট শেষে অবশ্যই সাবান দিয়ে হাত ধোয়া জরুরি। এই সাধারণ জ্ঞানটি ব্যাপকভাবে প্রচারণার পরও কজন মেনে চলেন, সেটির খোঁজই-বা কজন রাখেন? ভালো করে লক্ষ করবেন, কেউ যখন বাথরুমে যায়, কমোড ফ্ল্যাশের শব্দ শোনা গেলেও বেসিনে পানির শব্দ কিন্তু সব সময়ে শোনা যায় না।
যে কারণে কথাগুলো বললাম, তা হচ্ছে, ভালো কিছুর জন্য কিছু বদভ্যাস যদি ত্যাগ করতে হয়, সেটাকে সংস্কৃতির দোহাই না দেওয়ার অনুরোধ রইল।
চীনে এখন ব্যাপক হারে করোনাভাইরাস ছড়িয়ে গেছে। লোকজন সোশ্যাল মিডিয়ায় চীনাদের খাদ্যাভ্যাসের বিরুদ্ধে কটাক্ষ করছেন। আবার একদল তেড়েফুঁড়ে আসছেন এই যুক্তিতে যে, ওটা ওদের কালচার বা সংস্কৃতি। এই নিয়ে কোনো কথা বলা যাবে না।
কুতর্ক করার আগে আমাদের দেখতে হবে, কীভাবে ভাইরাসগুলো মানব শরীরে আসছে। বাদুড়ের দেহে এই সব ভাইরাস থাকছে। আপনি বাদুড় খেয়ে ফেলছেন। ফলে ভাইরাস আপনার শরীরে ঢুকে যাচ্ছে। তারপরে বিস্তীর্ণ জনপদে ছড়িয়ে গিয়ে মহামারি সৃষ্টি করছে।
আফ্রিকাতে এর আগে ইবোলা ভাইরাসও এইভাবেই ছড়িয়েছিল। লোকজন বাদুড় খেয়ে নিজের শরীরের ভেতর এই রোগ টেনে আনে। এইডস রোগটিও শিম্পাঞ্জি খাওয়ার ফলেই আমাদের শরীরে আসে।
"যেহেতু মুসলিমদের জন্য শূকর খাওয়া নিষেধ, তাই খেতে হবে" মনোভাব নিয়ে একজন পরিচিত লোক শূকর খেয়ে সোয়াইন ফ্লু বাধিয়ে মরতে মরতে বেঁচে ফিরেছিলেন।
একই যুক্তিতে "ম্যাড কাউ ডিজিজ" এড়াতে আক্রান্ত গরুর মাংস ও "বার্ড ফ্লু" রোগাক্রান্ত কোন মুরগি খাওয়া সম্পূর্ণ এড়িয়ে চলতে হবে।
খাদ্যাভ্যাসে সাবধানী না হলে, ভবিষ্যতে অবশ্যই আমাদের দেহে আরও বহু রোগ দানা বাঁধবে এবং সমাজে মহামারি আকারে ছড়িয়ে পড়বে।
এক সময়ে ঝোপঝাড়ে প্রাকৃতিক কর্ম সারা ছিল আমাদের কালচার।
এক সময়ে দূষিত পানি পান করা ছিল আমাদের কালচার।
আমরা বৃহত্তর স্বার্থেই সেই সব বদভ্যাস ত্যাগ করে কালচারের পরিবর্তন করেছি।
আফ্রিকান চীনাদের সঙ্গে পৃথিবীর যেকোনো জনগোষ্ঠীকেই বৃহত্তর স্বার্থে নিজেদের কালচারের পরিবর্তন করতে হবে।
আমাদের দেশেই শীতকালে খেজুরের রস খাওয়ার রেওয়াজ প্রচলিত। কিন্তু কাঁচা খেজুরের রস খেতে গেলে নিপাহ ভাইরাসে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা প্রচুর। কারণ সেখানে বাদুড়ের লালা লাগতে পারে। তাহলে আমাদের কী করতে হবে?
বুঝে নিন।
একটি তথ্য দিয়ে উপসংহার টানি।
আমরা সবাই জানি, বিলেত-আমেরিকায় তথা পশ্চিমা দেশগুলোয় টয়লেটে বদনা ও পানির কোনো ব্যবস্থা নেই। টয়লেট টিস্যুই ভরসা। অভ্যাসটা অতি ঘেন্নাকর ও রোগজীবাণু সৃষ্টিকারী। প্রতিবছর অসংখ্য আমেরিকান কেবল এই বদভ্যাসের কারণেই নানান রোগের শিকার হন।
উপমহাদেশীয় ও মুসলিম সভ্যতার মানুষেরা এই দেশে বদনার প্রচলন শুরু করেন। তাদের বাড়িতে বাড়িতে বদনার উপস্থিতি লক্ষণীয়। তারপরে যুগ পাল্টাতে শুরু করে। বদনার স্থান দখল করে নেয় পুশ শাওয়ার বা জেট স্প্রে।
এখন আরও আধুনিক টেকনোলজি চলে এসেছে। ‘Tushy’ নামের এক বস্তু এখন বাজারে চলে এসেছে। যা টয়লেট বোলে ফিট করা হয় এবং যার বোতাম চাপ দিলে নিচ থেকে জায়গামতো পানি স্প্রে করে। টয়লেট শেষে যা ‘ডিজিটাল’ বদনার কাজ করে।
আমেরিকায় Tushy নামের এই বস্তুর ব্যাপারে ফেসবুক ও অনলাইনে ব্যাপক হারে প্রচারণা চালানো হচ্ছে। মডেল হচ্ছেন খোদ আমেরিকান সাদা/কালো চামড়ার মানুষেরাই। পানির বদলে ‘টয়লেট-টিস্যু’ ব্যবহারের আমেরিকান সংস্কৃতি ধ্বংস করাই এর মূল উদ্দেশ্য।
সর্বশেষ এডিট : ০৯ ই ফেব্রুয়ারি, ২০২০ সকাল ১০:২৮