আমাদের অফিসের তেইশ বছরের এক যুবক মারা গেল কোভিডে আক্রান্ত হয়ে। ইন্ডিয়া অফিসে কাজ করতো সে। সুস্থ সবল ছেলে, হঠাৎ কাশি আর জ্বর এলো, তারপরে পরীক্ষায় কোভিড পজিটিভ ধরা পড়লো, শ্বাসকষ্ট এবং মৃত্যু। কয়েকদিনের ব্যবধান মাত্র। সব শেষ!
ওদের অবস্থা কতটা খারাপ সেটা কল্পনা করা কঠিন। শ্মশানে একটা দুইটা না, গণহারে চিতা পুড়ছে। শ্মশানে জায়গা হচ্ছেনা, তখন রাস্তার পাশে, খেলার মাঠে, ফাঁকা রাস্তার উপর, যে যেখানে পারছে গণহারে চিতা পুড়াচ্ছে। ইন্ডিয়ান এক কো-ওয়ার্কারের থেকে শোনা। যে মাঠে ওরা ক্রিকেট খেলতো, ওখানে প্রতিদিন চিতা পুড়ছে। তবু লাশ আসা শেষ হয়না। মুসলিম গোরস্থানেও জায়গা ফুরিয়ে যাচ্ছে। গণ কবর হচ্ছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি মেডিক্যাল অক্সিজেন সিলিন্ডার প্রস্তুতকারী দেশগুলোর অন্যতম এবং করোনা টিকা প্রস্তুতকারী দেশ হবার পরেও ইন্ডিয়াতেই অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছেন শত শত রোগী। হাসপাতালে স্থান হচ্ছেনা, স্থান হলেও পর্যাপ্ত অক্সিজেন সিলিন্ডার নেই। দিল্লি হাসপাতালে শুধুমাত্র অক্সিজেন না পাওয়ায় মারা গেছেন পঁচিশ রোগী, এমনটা আমাদের দেশের সংবাদপত্রেই এসেছে। ব্ল্যাক মার্কেটে চড়া দামে অক্সিজেন কিনতে হচ্ছে। প্রতিদিন হাজারে হাজারে ভারতীয় মরছে, সংখ্যায় এতটাই যে আজ পর্যন্ত কোন দেশেই কোভিড-১৯ এ আক্রান্ত হয়ে এক দিনে এত মৃত্যুর রেকর্ড কেউ করতে পারেনি। সবাইকে ছাড়িয়ে ওরা প্রতিদিন নতুন নতুন রেকর্ড (সংক্ৰমণ এবং মৃত্যু দুইই) গড়েই যাচ্ছে। ভারতের ঘনবসতি, দেশজুড়েই অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ, নতুন স্ট্রেইনের (বেঙ্গল স্ট্রেইন, নাম শুনেই বুক শুকিয়ে যায়) সংক্রমণের হার, গতি এবং প্রভাব ইত্যাদি বিবেচনায় নিলে ধরে নেয়া যেতে পারে মহাপ্রলয়ের এ কেবল শুরু। আরও বহু মৃত্যু দেখা বাকি আছে। একের পর এক পরিবার কয়েকদিনের ব্যবধানে হারিয়ে যাবে। টিকা আবিষ্কার করে যুদ্ধজয়ের আনন্দ করা মানব সম্প্রদায় আবারও অসহায়ভাবে তাকিয়ে প্রত্যক্ষ করবে ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র এক জীবাণুর তান্ডবলীলা। এটা করোনা ভাইরাসের দ্বিতীয় ঢেউ না, এটি সুনামি। সবাইকে ডুবিয়ে ছাড়ছে।
ভাইরাসটা কত ক্ষুদ্র জানেন? যদি পুরো পৃথিবীতে ছড়ানো সমস্ত করোনা ভাইরাসকে জড়ো করে একত্র করি, তাহলেও সেটা এক ফোঁটা পানির সমান হবে না। অথচ এই জীবাণুই কিনা আমাদের হাজার বছরের দম্ভ, অহংকারকে হুমকির সম্মুখীন করে দিল! ওর চোখ রাঙানির জবাব আমরা দিতে পারছি না!
হঠাৎ ভারতে এইভাবে ছড়ানোর কারন কি? কুম্ভের মেলা, নির্বাচন, লক-ডাউনের তোয়াক্কা না করা, বেপরোয়া চলাফেরা, সরকারের গা ছাড়া ভাব, মানুষের কুসংস্কার কোনটাকে দোষ দিবেন? তারচেয়ে বড় কথা, একই ঘটনা আমরা ঘটাতে যাচ্ছি নাতো? ভারত এমন কি করেছে যা আমরা করছি না? পশ্চিমবঙ্গে উৎপত্তি যে স্ট্রেইনের, সেটা পূর্বে মোড় নিতে কত সময় অপেক্ষা করবে? নাকি এখনই নিয়ে নিয়েছে?
ইউকে ট্রাভেল ব্যান করেছে ভারতের উপর। পৃথিবীর অনেক দেশই তা করেছে। ভারতের সাথে যোগাযাগ আপাতত বন্ধ। আমাদের দেশ কি সেটা করেছে? আসন্ন ঈদ উপলক্ষ্যে প্রতিদিন কত হাজার মানুষ ভারতে যাচ্ছে, ফেরত আসছে সেই হিসাব রাখা হচ্ছে? বর্ডার বন্ধ করা হবে? বিমান যোগাযোগ? আমাদের দেশে হঠাৎ করেই শ খানেক লোক মরতে শুরু করলো, সাধারণ মানুষ থেকে বড় বড় সেলিব্রেটি, কেউই বাঁচতে পারছেন না, এসব কি অশনি সংকেত নয়? লকডাউন ঘোষণা করলে লোকে বিচার দেয় সাধারণ মানুষ বাঁচবে কিভাবে? সাধারণ মানুষের জন্য লকডাউন খুলে দিলেই আমরা হোটেল বুকিং দিচ্ছি কক্সবাজার, সিলেট, সাজেক! কক্সবাজার, সিলেট, সাজেক না গেলে আমরা বাঁচতে পারতাম না? দিন আনি দিন খাই লোকদের বাইরে বেরুতেই হয়, আমাদের এই বিলাসিতা তাঁদের অপরিহার্যতায় ব্যাঘাত সৃষ্টি করছে, এই যুগে এসেও আমরা সেটা বুঝি না?
এইসব বলে লাভ নেই, আমার নিজেরই আত্মীয়স্বজন বন্ধুবান্ধবরা মানছে না স্বাস্থ্যবিধি। অন্য কাউকে কি বলবো? বাড়িতে বসে ইফতার করা, অযথা বাইরে ভিড় না করা, মাস্ক, স্যানিটাইজার ইত্যাদি কি এতই কঠিন? আমার বোন থাকে অস্ট্রেলিয়ায়। কত নিশ্চিন্তে ওরা আছে। সরকার এবং জনগণ, সবাই মিলে কি সুন্দর এখন পর্যন্ত ঠেকিয়ে রেখেছে প্রাণঘাতী ভাইরাসটাকে। আরেক আত্মীয় থাকেন নিউজিল্যান্ড। উনাদের ওখানে নাকি নাইই। অস্ট্রেলিয়ায় বেড়াতে যাবেন? আপনার নিজের খরচে পনেরদিন কোয়ারেন্টিনে থেকে তারপরে ওদের ভূমিতে পা রাখতে পারবেন। এত ঝামেলায় কেউই যেতে চাইছে না ঐ দেশে। ওরাও গা করছে না। দুই চার পয়সার জন্য নিজের দেশের মানুষ মারবে নাকি? বরং বিশ্ব আবার শান্ত হোক, তারপরে পর্যটন খাত নিয়ে ভাবা যাবে।
আমাদের দেশে করোনা রোগী এয়ারপোর্টে এসে খোলাখুলি বলে উনার টেস্ট পজিটিভ হয়েছে, টিকিট পিছানো যাবে কিনা। ভাইয়ের বৌয়ের চোখের সামনের ঘটনা। এই বেয়াক্কেল লোকটার থেকে যে অন্যের সংক্ৰমণ হবে, এই বিবেচনাই মাথায় নাই! কেমন মানুষ আমরা?
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে এপ্রিল, ২০২১ রাত ১১:৩৫