অক্সিজেনের অভাবে মারা যাচ্ছে আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। বায়ুসমুদ্রে ডুবে থাকি আমরা, বাতাস ভর্তি পর্যাপ্ত অক্সিজেন, প্রতি মুহূর্তে কত সহজেই বুক ভরে শ্বাস নিচ্ছি, অথচ আজকে সেটাই টেনে নেয়ার ক্ষমতা অনেকের ফুসফুস হারিয়েছে। চোখের সামনে ছটফট করতে করতে মারা যাচ্ছে স্বজন, শোক করারও সুযোগ নেই। বাবা চলে গিয়েছেন এখন কিছু করার নেই, মাকে বাঁচাতে হবে। এক সন্তান মারা গেছে তো কি হয়েছে? অন্যগুলিকে বাঁচানোর চেষ্টা করো। শোক পরে করা যাবে। ছুটে যাও অন্য কোন হাসপাতালে, দেখ বেড পাও কিনা। অন্য কেউ নিয়ে নেয়ার আগে দ্রুত ভর্তি হও। নিজেকে বাঁচাও! নিজের করোনা হয়নিতো? নাহলে এই গরমেও কেন শীত শীত লাগে? কেন গলা খুশখুশ করে?
শ্মশানের বাইরে কাতারে কাতারে লাশ, জ্বালানোর জন্য কাঠ নেই। শ্মশানেও স্থান নেই। দিন রাত কেবল চিতা পুড়ছে। "দিওয়ালির" দেশ ভারত আলোকিত হয়ে আছে চিতার আগুনে।
ক্রিকেটের দেশ ভারতের খালি মাঠেও পুড়ছে চিতা, যেখানে স্বাভাবিক সময়ে ব্যাটে বলের লড়াই হতো। লাশের গন্ধে ভরা বাতাসে পালিয়ে যাবেনতো কোথায় যাবেন?
হাসপাতালের বাইরে প্রচন্ড ভিড়, রাস্তায় স্বজনের আহাজারি। সবার কেবল এক আকুতি, "অক্সিজেন! অক্সিজেন!!"
সুস্থ সবল মানুষটা কয়েকদিনের ব্যবধানেই দুনিয়ার অধ্যায়ের ইতি টেনে ফেলছেন। কারোর পরিবারের একমাত্র উপার্জনক্ষম ব্যক্তিটি চলে যাচ্ছেন, কারোর পরিবারের স্বপ্নের ধারক বাহক ব্যক্তিটিও। আমাদের ইন্ডিয়া অফিসে এক ছেলে কাজ করে (বয়স ছাব্বিশ), ওর আয়ের উপর ওর পুরো পরিবার নির্ভর করে। বৃদ্ধ বাবা মায়ের ওষুধ, ছোট ভাইয়ের পড়াশোনা, ছোট বোনের বিয়ে ইত্যাদি সব ঐ যুবকের দুর্বল কাঁধের উপর নির্ভরশীল। ওর যদি কিছু হয়ে যায়? কারন ওর চেয়েও বয়সে কম একই অফিসের আরেকটি ছেলে কিছুদিন আগেই মারা গেল। ভারতের ঘরে ঘরে একই কাহিনী, একই দৃশ্য। আমাদের বাংলাদেশেও কি নয়?
ইসলাম ধর্মানুযায়ী কেয়ামতের দিন সবার ইয়া নফসি অবস্থা হবে। বাবা ভুলে যাবে ছেলেকে, মা সাক্ষ দিবে সন্তানের বিরুদ্ধে। ভারতের অবস্থাও এখন তাই হয়ে গেছে। দিল্লির হাসপাতালে অক্সিজেন সিলিন্ডার শেষ। শেষ মানে শেষ, একটাও নেই। করোনার প্রথম ধাক্কাতেই এই অবস্থা, সামনে কি হবে কিছুই জানেনা কেউ। কোন নতুন রোগী ভর্তি করা যাচ্ছেনা। বাড়ছে লাশের সংখ্যা। হাসপাতালের সিইও কাঁদতে কাঁদতে নিজের নিরুপায় অবস্থার কথা জানিয়ে বলেন, "রোগীদের সবচেয়ে বড় সংকটেই তিনি নির্বল।"
এই ভিডিও দেখে সুস্মিতা সেন মুম্বাই থেকে কয়েক সিলিন্ডার অক্সিজেন পাঠিয়ে দিয়েছেন। এতে মুম্বাইবাসী ক্ষেপে উঠেছেন। কেন দিল্লিতে পাঠালেন? যখন মুম্বাইয়ে শেষ হবে, তখন? অক্সিজেনের অভাবে যে লোকটার বাবা/মা/মেয়ে/ছেলে/স্ত্রী মারা যাবে মুম্বাইয়ের লীলাবতী হাসপাতালের বাইরে, সে কি তখন সুস্মিতাকে দুষবে না?
সুস্মিতাকে তখন দিল্লির সেই রোগীর আশীর্বাদ বাঁচাবে যে তাঁর দেয়া অক্সিজেনের কারনে বেঁচে উঠবে।
বিপদের সময়ে মানুষ আসলেই বড় স্বার্থপর হয়ে যায়। আবার বিপদের সময়েই বন্ধু চেনা যায়। চৌদ্দমাস আগে দিল্লিরই মুসলিম পাড়ায় হামলা করেছিল উগ্রবাদী কিছু হিন্দু। অসহায় সেসব মুসলিমদের আশ্রয় দিয়েছিলেন তাঁদের প্রতিবেশী অন্যান্য হিন্দু পরিবারগুলো। আজকে সেই মুসলিমরাই "রমজান মাসে" তাঁদের মসজিদের স্থান ছেড়ে দিয়েছেন। ভিন্নধর্মের মানুষজন হয়তো বুঝতে পারছেন না এ কত বড় আত্মত্যাগ। করোনারোগীর চিকিৎসা হোক, মানুষ বাঁচুক। বেঁচে থাকলে জুম্মা হবে, তারাবীহ হবে, ঈদ হবে। বেঁচে থাকাটা জরুরি। যেভাবেই হোক, বেঁচে থাকতে হবে।
কে জানে, যে লোকটা একদিন মসজিদে আগুন দিয়েছিল, সেই লোকটারই হয়তো চিকিৎসা হবে সেই একই মসজিদেই। এতেই সে শিখতে পারবে ঘৃণার জোর যত শক্তিশালীই হোক না কেন, জয় সবসময়ে ভালবাসারই হয়।
রমজান মাস চলছে। ইবাদতের মাস, দোয়া কবুলের মাস। সারাদিনের রোজা শেষে বান্দা ইফতারের আগে আল্লাহর দরবারে যা চায় তাই কবুল হয়। কে জানে, আল্লাহ হয়তো এই কারণেই এই বিপদের জন্য এই মাসটাই বেছে নিয়েছেন যাতে আমরা এর সুযোগ তুলতে পারি! আসুন আমরা আমাদের প্রতিবেশীর জন্য দোয়া করি। মন থেকে দোয়া করি যাতে এই অন্ধকার দ্রুত দূর হয়। আবার আলোকিত হয় পৃথিবী। বাতাস থেকে লাশের গন্ধভরা ধোঁয়া কেটে যায়। পৃথিবী ফিরে পাক তার পুরানো রূপ। খেলার মাঠের কবরস্থান বা শ্মশান হয়ে ওঠা বন্ধ হোক! হে আল্লাহ! আমাদের প্রতিবেশীদের প্রতি রহম কর। হে আল্লাহ, তুমি আমাদের সবার প্রতি রহম কর!
যে অন্যের জন্য দোয়া করে, ফেরেশতারা তখন সেই দোয়ায় সামিল হয়। আল্লাহর কাছে তাঁরা নিজে থেকেই দোয়া করে বলে যে এই লোকটা অন্যের মঙ্গলের জন্য দোয়া চাইছে, হে আল্লাহ, এর অমঙ্গল তুমি হতে দিও না।
আমাদের নিজেদের জন্য হলেও এই মুহূর্তে ভারতের সুস্থতা প্রার্থনা করতে হবে।
এই বিপদ একদিন কেটে যাবে। অবশ্যই কাটবে। আমি আপনি বেঁচে থাকতে পারি, নাও পারি। কিন্তু আমাদের কার্যকলাপ দিয়ে আমাদের বিচার হবে। মানুষের কষ্টে আমি ব্যথা পেয়েছি, নাকি আনন্দ - এর উপরই আমার মনুষত্ব নির্ভরশীল, এর উপরও আমার পরকাল নির্ভরশীল।
সর্বশেষ এডিট : ২৬ শে এপ্রিল, ২০২১ সকাল ৮:৪১