somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রমজান মাস নিয়ে খোলামেলা কিছু কথা

১১ ই মার্চ, ২০২৪ সকাল ১১:০৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রমজান মাস শুরু হয়ে গেছে। কিছু কথা খোলামেলা বলবো। বেশিরভাগেরই অপছন্দ হবে, তবু বলবো, কারন দরকার আছে।
১. শুরুতেই "রমজান" নাকি "রামাদান" এই নিয়ে ক্যাঁচাল লাগানোর চেষ্টা করবেন না। একটা আমাদের দেশীয় উচ্চারণ (ফার্সি, উর্দু, হিন্দি ও বাংলা চারটাতেই রমজান বলে), অন্যটা বিশুদ্ধ আরবি। কেউ যদি রমজান উচ্চারণ করে, এর মানে এই না যে এতে রামাদানের রহমত, বরকত সব নষ্ট হয়ে যাবে। আর কেউ যদি "রামাদান" উচ্চারণ করতে চায়, তাহলেও "আমাদের দেশীয় ভাষা ও সংস্কৃতি ধ্বংসের অপচেষ্টা/কালো থাবা" ইত্যাদি উদ্ভট, উজবুকীয় যুক্তি দাঁড় করাবার চেষ্টা নিবেন না। কেউ যদি ইস্কুল, ইস্টার, কিলাস ইত্যাদির সঠিক ইংলিশ উচ্চারণ "স্কুল" "স্টার" "ক্লাস" ইত্যাদি চর্চা করে তাহলে ও কি ভুল? এখানেও ঘটনা একই।
একই যুক্তিতে রোজা, সিয়াম, নামাজ ইত্যাদি শব্দ নিয়েও ক্যাঁচাল এড়িয়ে যাবেন। নামাজকে সালাত বললেই আমি বেহেস্তে চলে যাব, আর নামাজ বললে সেই ইবাদত কবুল হবেনা, ঘটনা এমন না। মূল বিষয় হচ্ছে আপনি সূরাগুলো সঠিক উচ্চারণে, তাকওয়ার সাথে পড়ছেন কিনা। এখন সালাতকে নামাজ বললেন, প্রার্থনা বললেন নাকি prayer, কিচ্ছু যায় আসেনা।
২. তারাবীহ ৮ রাকাত নাকি ২০ রাকাত এই নিয়ে ক্যাঁচাল প্রতিবার ক্যাচাল লাগে, এবং মূর্খগুলিই লাগায়। এই নিয়ে ক্যাচালেরও কোন কারনই নাই। কারন সহীহ বুখারীর হাদিস হচ্ছে নবী (সঃ) আট রাকাত নামাজ পড়তেন এবং তিনিই বলেছেন যে যত বেশি রাকাত পড়বে, তত ভাল। এখন আপনি আট রাকাত পড়লেন, ২০ রাকাত, নাকি ১০০ রাকাত, সেটার কোন নির্দিষ্ট সীমারেখা নেই। সারারাত জেগে ১০০০ রাকাত পড়েন, আরও ভাল হবে। কেউ যদি নাও পড়ে, তাতেও ক্ষতি নেই। কারন এটি কোন "ফরজ" নামাজ না। ওর সওয়াব কামানোর ইচ্ছা নাই, বা ও অন্য কিছুতে ব্যস্ত, সেটা ওর ব্যাপার। আপনি চিন্তা করবেন আপনার নিজের আমল নিয়ে।
যারা ২০ রাকাত পড়েন, ওরা দাবি করে যারা ৮ রাকাত পড়েন, ওদের নাকি নামাজই হয়না। অথচ ওরা জানেই না মালেকীরা ৩৮ রাকাত তারাবীহ পড়েন। ওদের তুলনায় ২০ রাকাতওয়ালারাতো শিশু।
মূল বিষয় রাকাত সংখ্যা না, এখানেও মূল বিষয় তাকওয়ার সাথে সুন্দরভাবে নামাজ আদায়। রেলগাড়ির গতিতে ২০ কেন, ১০০ রাকাতও যদি পড়েন, সেটাও তিরস্কৃত। বরং সময় নিয়ে ধীরে সুস্থে নামাজ আদায়ের নিয়ম। ইমাম যে সূরা পাঠ করছেন, এর প্রতিটা শব্দ যেন নামাজী বুঝতে পারেন, সেটাই মূল উদ্দেশ্য। এই মূল বিষয় বাদ দিয়ে যারা রাকাত সংখ্যা নিয়ে ফাত্রামি করে, জাতির মধ্যে বিভক্তি টানে, ওদেরকে চিকন বেত দিয়ে বেতরানো উচিত।
কিছু মূর্খ দাবি করে "বুখারী শরীফের হাদিসটি তাহাজ্জুদের হাদিস।" - এগুলিকে বলেন, "তাহলে "তারাবীহ" শব্দটা আছে, এমন একটা হাদিস দেখারে বেকুব!" তখন দেখবেন ঠনঠন করে বাজনা বাজতে শুরু করেছে। মানে, ওদের হাতে কোন এভিডেন্সই নাই। শুধু বলবে, হজরত উমর (রাঃ) ২০ রাকাত চালু করেছিলেন।
ঘটনা হচ্ছে, তারাবীহ শব্দটা কয়েক শতাব্দী পরে এসেছে। নবীর (সঃ) বা সাহাবীদের সময়ে কয়েক জেনারেশন পর্যন্ত একে "কিয়ামুল লাইল" বা "রাত্রিকালীন সালাত" বলা হতো। এটিই তারাবীহ, এটিই তাহাজ্জুদ। পরে একে ভাগ করা হয়েছে যে তাহাজ্জুদ রাত্রির শেষ ভাগে পড়া উত্তম আর আমরা আমাদের সুবিধার জন্য এশার পর তারাবীহ পড়ি। অথবা এশার পরে ঘুমিয়ে তাহাজ্জুদের আগে জেগে উঠে নামাজ পড়া উত্তম ইত্যাদি। আমি যদি চাই এশার পর থেকে শুরু করে এক নামাজেই ফজর পড়তে পারবো। সেক্ষেত্রে এটা তারাবীহ নাকি তাহাজ্জুদ হবে? দেখবেন ফেৎনাকারী বেকুবরা মাথা চুলকে আমতা আমতা শুরু করবে।
তাই মূল বিষয় হচ্ছে, এগুলি সবই কিয়ামুল লাইলের অন্তর্ভুক্ত। এ নিয়েও ক্যাঁচালের কোন সুযোগ নেই। যে করে, সে জাতির মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করতেই করে।
৩. "খেজুর খেতে পারছি না" বলে ফেসবুকে কান্নাকাটি না করে বরং আল্লাহর কাছে শুকরিয়া আদায় করেন এই বলে যে "আলহামদুলিল্লাহ, আল্লাহ তুমি আমাদের ইফতার করার, সেহরি করার সুযোগ দিয়েছো।"
গাজার শিশুরা অনাহারে মারা যাচ্ছে। ওদের বাবা মায়েরা নিজেদের শিশুদের কিছু দিতে পারছেন না। এক গ্লাস বিশুদ্ধ পানিও না। দুনিয়ার বহু দেশের বহু মুসলিম খেয়ে না খেয়ে দিন কাটাচ্ছেন। কোথাও দুর্ভিক্ষ চলছে (সোমালিয়া) কোথাও যুদ্ধ (গাজা, সিরিয়া, ইয়েমেন ইত্যাদি) - আমেরিকার মতন ধনী দেশেও বহু মুসলিম সামান্য ডিম কিনে খেতে পারছে না, আফ্রিকার বাচ্চারা মাটি দিয়ে বিস্কিট তৈরী করে খাচ্ছে, আর আমরা আল্লাদি কান্না শুরু করেছি খেজুরের জন্য!
হ্যা, এর অর্থ এই না যে মজুতদারদের ক্ষমা করে দিবেন, দুর্নীতিবাজ ব্যবসায়ী, ও সিন্ডিকেটের সামনে লুলা সরকারি কর্মকর্তাদের ব্যর্থতা নিয়ে কিছুই বলবো না। এসব নিয়ে আলোচনা আর ফেসবুকে খেজুরের জন্য কান্নাকাটি করা এক না। আশা করি বুঝতে পারছেন।
৪. অপচয় বন্ধ! অপচয় বন্ধ!! অপচয় বন্ধ!!!
রমজান আসলেই লোকজন ইচ্ছা মতন অপচয় করেন। বাফে রেস্টুরেন্টে গিয়ে রাক্ষসের মতন প্লেট ভর্তি করে নিয়ে অর্ধেকের বেশি খাবার নষ্ট করে। "সৌদিরা এইভাবে আস্ত উট রোস্ট করে খায়, আর অপচয় করে" - ফেসবুকে এমন পোস্ট করা বাঙালকে দেখা যায় বাফে রেস্টুরেন্টে গিয়ে কাঙ্গালের মতন খাবারের উপর ঝাপায় পড়তে। তখন আর নিজের অপচয় চোখে পড়েনা।
মনের ভিতর কিছুটা লজ্জাবোধ জাগান, খাবার নষ্ট করবেন না। যেটুকু খেতে পারেন, ততটুকু নিন, খান, শেষ হলে আরেক প্লেট নিন। খাবার পালিয়ে যায় না, ওসব ওখানেই থাকে। রমজানের মূল শিক্ষার অন্যতম হচ্ছে অভুক্তের কষ্ট যেন আমরা উপলব্ধি করি, সারাদিন রোজা রেখে তাই ইফতারে ও সেহরিতে ইচ্ছা মতন খাবার নষ্ট করা হিপোক্রেসি হয়ে যায়। দয়া করে এই কাজটা করবেন না।
৫. একটু সহমর্মী হন। চেষ্টা করেন। মোটেই কঠিন কিছু না, কিন্তু অনেকের আচরণ অত্যন্ত দৃষ্টিকটুভাবে চোখে বিঁধে।
একবার ডালাসে এক মসজিদে ইফতার করতে গেলাম। আমাদের সামনে খেজুর, সিঙ্গারা আর পানি দেয়া হয়েছে। আজান দিয়ে দিয়েছে। আমরা ইফতার শুরু করেছি। একটা লোক তখন দৌড়ে মসজিদে ঢুকেছে। সামনে পানির বোতল পেয়েছে, ওটা দিয়ে রোজা ভেঙেছে। ভদ্রলোক পানির সাথে কিছু খেতে চাইছেন, সেটা উনার চোখের চাহনি দেখলেই বুঝা যায়। আমার সামনেই এক বাঙালি ভদ্রলোক ছিলেন। তিনি নিজের সিঙ্গারা নিজের একেবারে কলিজার কাছে টেনে আনলেন। যেন ঐ ভদ্রলোক না নিয়ে নেয়।
আমি আমারটা এগিয়ে দিলাম। ভদ্রলোক ধন্যবাদ দিলেন ঠিকই কিন্তু সিঙ্গারা নিলেন না। উনি খেজুরেই খুশি।
মূল বিষয় হচ্ছে, ঐ এক সিঙ্গাড়ায় আমাদের মতন এডাল্টদের কতটুকুই বা পেট ভরে? সারাদিন রোজা রেখেছি, এখন পানি ও খেজুরতো পাচ্ছিই। একটা সিঙ্গারা না খেলে কিই বা ক্ষতি হয়ে যাবে? কিন্তু কিছু মানুষ এমন ভাব করে যেন ওদের পকেট থেকে কোহিনূর হীরা কেড়ে নিচ্ছে। একটা মুরগির রোস্ট, একটা কাবাব, এক পিস্ গরুর মাংসের জন্য জীবন দিয়ে দিতে প্রস্তুত।
এমন ছাগ্লামি করবেন না। রোজার অন্যতম পরীক্ষা এটিই যে আপনি অন্যের প্রতি কতটা সহমর্মী হয়েছেন। নিজে পেট পুড়ে খেলাম, আর প্রতিবেশী অভুক্ত ঘুমালো, ভাইরে, তাহলে আল্লাহর দৃষ্টিতে আমি মুসলিমই না।
শেষ করি প্রিয় নবীর (সঃ) জীবনীর একটি ঘটনা দিয়ে।
আমাদের নবীজির (সঃ) জীবনে এমনও দিন গেছে যখন খাবারের অভাবে তাঁকে পেটে দুইটা পাথর বেঁধে থাকতে হয়েছিল।
ক্ষুধার কষ্টে বাড়ির বাইরে এসে দেখেন আবু বকর (রাঃ) ও উমর (রাঃ)ও একই কারনে পথে দাঁড়িয়ে আছেন।
ইসলামের ইতিহাসের অন্যতম শ্রেষ্ঠ তিন মহাপুরুষ সেদিন অভুক্ত!
এক সাহাবী তাঁদের এই অবস্থায় দেখে বাড়িতে দাওয়াত দিয়ে নেন, ছাগল জবাই করে খাওয়ান। নবীজি (সঃ) তখন খেয়ে বলেন, "আল্লাহর দরবারে একদিন এই নিয়ামতের জন্যও আমাদের জবাবদিহি করতে হবে।"
চিন্তা করতে পারেন? কিছুক্ষন আগে ছিলেন অভুক্ত, আল্লাহ তাঁদের জন্য মাংসের ব্যবস্থা করেন, এবং নবীজি (সঃ) সাবধান করে বলেন, এই যে আল্লাহ আমাদের রহমত করেছেন, সেজন্য আমরা কি শুকরিয়া আদায় করেছি?
এখন নিজের জীবনের রহমত-বরকতের দিকে একটু দেখেন। একই সাথে অন্যান্যদের দিকেও একটু নজর ফেরান। আমি আপনি কি আল্লাহর নিয়ামত ঠিকভাবে স্বীকার করছি?
এই রমজান মাসটা আমাদের এই নিয়ামত স্বীকারের প্রচেষ্টাতেই কাটুক।
"রামাদান কারীম!"
সর্বশেষ এডিট : ১১ ই মার্চ, ২০২৪ সকাল ১১:০৬
৬টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। আমের খাট্টা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৪



তাতানো গরমে কাল দুপুরে কাচা আমের খাট্টা দেখে ব্যাপারটা স্বর্গীয় মনে হল । আহা কি স্বাদ তার । অন্যান্য জিনিসের মত কাচা আমের দাম বাড়াতে ভুল করেনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ডাক্তার ডেথঃ হ্যারল্ড শিপম্যান

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০৪



উপরওয়ালার পরে আমরা আমাদের জীবনের ডাক্তারদের উপর ভরশা করি । যারা অবিশ্বাসী তারা তো এক নম্বরেই ডাক্তারের ভরশা করে । এটা ছাড়া অবশ্য আমাদের আর কোন উপায়ই থাকে না... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার ইতং বিতং কিচ্ছার একটা দিন!!!

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:০৩



এলার্ম এর যন্ত্রণায় প্রতিদিন সকালে ঘুম ভাঙ্গে আমার। পুরাপুরি সজাগ হওয়ার আগেই আমার প্রথম কাজ হয় মোবাইলের এলার্ম বন্ধ করা, আর স্ক্রীণে এক ঝলক ব্লগের চেহারা দেখা। পরে কিছু মনে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিসিএস শুধু দেশের রাজধানী মুখস্ত করার পরীক্ষা নয়।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:১৪

"আমার বিসিএস এক্সামের সিট পরেছিলো ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট এ, প্রিপারেশন তো ভালোনা, পড়াশুনাও করিনাই, ৭০০ টাকা খরচ করে এপ্লাই করেছি এই ভেবে এক্সাম দিতে যাওয়া। আমার সামনের সিটেই এক মেয়ে,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কে কাকে বিশ্বাস করবে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৯


করোনার সময় এক লোক ৯৯৯ এ ফোন করে সাহায্য চেয়েছিল। খবরটা স্থানীয় চেয়ারম্যানের কানে গেলে ওনি লোকটাকে ধরে এনে পিটিয়েছিলেন। কারণ, ৯৯৯ এ ফোন দেওয়ায় তার সম্মানহানি হয়েছে।

সমাজে এমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×