somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

শিক্ষকের মর্যাদা/অমর্যাদা?

২৯ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ১১:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দেশে হঠাৎ করেই স্কুল, কলেজ ইউনিভার্সিটিগুলো থেকে শিক্ষক/প্রিন্সিপাল/হেডমাস্টারদের জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করা হচ্ছে। তা এ নিয়ে কিছু কথা বলা যাক।
আমার জীবনের একটা বড় অংশ কেটেছে সিলেটের ব্লুবার্ড হাই স্কুলে। আমাদের প্রিন্সিপাল টিচারের নাম ছিল রাবেয়া খান আহমেদ। ভদ্রমহিলা তাঁর দলবল নিয়ে একটা সাধারণ স্কুলকে সিলেটের সেরা স্কুলে পরিণত করেছিলেন। ব্লুবার্ডের ছাত্রছাত্রী হিসেবে আমাদের গর্ব আর অহংকার ছিল ব্যাপক। বৃত্তিপরীক্ষা ও এসএসসি রেজাল্টে ব্লুবার্ডের রেজাল্ট ছিল ঈর্ষণীয়।
তো আমাদের প্রিন্সিপাল টিচার ছিলেন ডিসিপ্লিনের ডিব্বা। মিলিটারি না হয়েও ভদ্রমহিলা মিলিটারি কায়দায় স্কুল চালাতেন। ইউনিফর্ম ঠিকঠাকভাবে না পড়লে, সাদা জুতার বদলে অন্য রংয়ের জুতা পরলে, ছেলেদের চুল সামান্য একটু লম্বা হলেই কঠিন শাস্তি নেমে আসতো। বিকালবেলা শহরের মার্কেটে একটা ছেলে সিগারেট খেয়েছিল, সেটা প্রিন্সিপাল টিচার দেখে ফেলায় পরেরদিন এসেম্বলিতে কেয়ামত নামায় ফেলেছিলেন। টহল দিতে উনি যখন যে রাস্তা দিয়ে হেঁটে যেতেন আমরা রীতিমতন ঠ্যাকায় না পড়লে সেই রাস্তা মাড়াতাম না। তাহলেই বুঝেন, পড়া শিখে না আসলে বা হোমওয়ার্ক না করলে কি ঘটনা ঘটতো!
তা এই টিচারকে যে আমরা যমের মতন ভয় পেতাম কথাটাতো বুঝতে কোন অসুবিধা হচ্ছেনা, নাকি?
সাথে এও জেনে রাখুন, উনাকে মায়ের মতোই শ্রদ্ধা করতাম, ভালবাসতাম। মা যেমন আমাদের ভালোর জন্যই বকাঝকা করেন, আমরা জানতাম আমাদের রাবেয়া টিচারও তাই, ব্লুবার্ড স্কুলের প্রতিটা শিক্ষক শিক্ষিকাও তাই, এমনকি আমাদের স্কুলের সবচেয়ে ভয়ংকর টিচার, লেজেন্ডারি কেমেস্ট্রি মাস্টার মিরা টিচারও তাই। কলেজে গিয়ে অস্ত্র ধরে সন্ত্রাসী হয়েছে, এমন গুন্ডা ছেলেও মিরা টিচারকে রাস্তায় দেখলে ছুটে এসে পা ছুঁয়ে সালাম করতো, আশীর্বাদ নিত। উনার মৃত্যু সংবাদ যেদিন শুনি, বাচ্চাদের মতন কেঁদেছিলাম।
আমাদের টিচারদের আমরা ভালবাসতাম। তাঁদের সম্মানের জন্য জীবন দিতেও পারতাম। মোটেই বাড়িয়ে বলছি না, আসলেই তাই।
তাই স্টুডেন্টদের বিক্ষোভে ব্লুবার্ডের latest প্রিন্সিপাল টিচারের পদত্যাগ এবং একটা স্যারকে দৌড়ানি দিতে দেখে ভীষণ খটকা জেগেছিল। দুই টিচারের কাউকেই চিনলাম না।
স্কুল ছেড়েছি আজকে তেইশ বছর হয়ে গেছে, স্মৃতিশক্তি কি ধোঁকা দিচ্ছে? এমনতো হওয়ার কথা না। আজও বিজন স্যার, সাঈদ স্যাররা সামনে এসে দাঁড়ালে ঠিকই চিনতে পারবো।
পুরানো বন্ধুবান্ধবদের কেউও চিনতে পারেনি।
পরে খোঁজ নিয়ে জানলাম এই মহিলা দলীয় প্রভাবে নিয়োগ পাওয়া।
দলীয় সমর্থন কোন ব্যাপার না। রাবেয়া টিচারও বঙ্গবন্ধুর বিশেষ ভক্ত ছিলেন। একবার স্পোর্টসে "যেমন খুশি তেমন সাজো" প্রতিযোগিতায় একটা বড় আপু বঙ্গবন্ধুর ঘোড়ার আন্ডার সাজ (মুজিব কোট ছাড়া কিছুই হয়নি, পাঞ্জাবি থেকে শুরু করে মাথার চুল, গোঁফ কোনটাই তাঁর ধারেকাছেও ছিল না) নিয়েও ফার্স্ট প্রাইজ জিতে গিয়েছিল আমাদের তখনকার প্রিন্সিপাল টিচারের কারণেই।
কিন্তু সমস্যা ছিল এই যে এই প্রিন্সিপাল নাকি দলবল নিয়ে দুর্নীতি করেছেন। সাধারণ শিক্ষকদের সাথে চাকরবাকর মতন আচরণ করেছেন (টিচারদেরই দেয়া ভাষণে জানলাম), স্কুলের নানান প্রজেক্ট থেকে টাকা খেয়েছেন, ছাত্রছাত্রীদের প্রতিও জুলুম করেছেন এবং উনার সবচেয়ে বড় অপরাধ, সিলেটের এককালের সেরাদের সেরা স্কুলটিকে রেজাল্টের দিক দিয়ে ৪/৫/৬ নম্বরে নামিয়ে এনেছেন। আমার সাথে পড়ালেখা করেছে এক মেয়ে, সে নিজেই নিজের মেয়েকে ব্লুবার্ডে পড়তে দেয়নি, কারন লেখাপড়ার মান এতটাই নাকি নেমে গেছে।
তাহলে দেখা যাচ্ছে, ছাত্রছাত্রীরা বেহুদা কারনে উনাকে বিদায় করেনি।
কমন সেন্সও একই কথাই বলে, স্কুলের এতগুলি শিক্ষক, অনেকেই সিনিয়র আছেন, তাঁদের কারোর বিরুদ্ধেই কেউ কোন টু শব্দ করলো না, স্পেসিফিক এই টিচার এবং উনার সাঙ্গপাঙ্গদের বিরুদ্ধেই কেন খেপলো সবাই?
আপনি ক্ষমতায় থাকলে, ক্ষমতার অপব্যবহার করলে, একটা সময়ে যখন সেই ক্ষমতা যাবে, তখনতো এর ফল ভোগ করতেই হবে।
তো যা বলছিলাম, সোশ্যাল মিডিয়ায় লোকজন শিক্ষকের মর্যাদা নিয়ে অনেক হাহাকার করছেন। আমি যদি ব্লুবার্ডেরই উদাহরণ ধরি, গণিত শিক্ষককে কিছু বদমাইশ দৌড়ানি দিয়েছে ঠিকই, উনাকে বাঁচিয়েছেও একই স্কুলেরই সাধারণ ছাত্ররাই। একটি রিক্সায় তুলে দিয়ে উনাকে নিরাপদে পার করে দিয়েছে।
আর প্রিন্সিপাল টিচারের ঘর ঘেরাও করে উনাকে পদত্যাগে বাধ্য করাতে ঠিক কোথায় "মর্যাদাহানী" ঘটেছে? উনাকে গালাগালি করা হয়েছে? চড় থাপ্পড়? জামা ধরে টানাটানি? জুতার মালা পরানো? উনি যে শিক্ষার্থীদের হকের টাকা মেরেছেন, ওদের ভবিষ্যৎ নষ্ট করেছেন, জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ সময়টা, যখন আমাদের ভবিষৎ জীবনের ফাউন্ডেশন তৈরী হয়, সেটা বরবাদ করে দিয়েছেন, এর বিনিময়ে সামান্য চিৎকার চ্যাচ্যামেচি শোনা কি খুব বেশিই হয়ে গেছে? উনার কি উচিত ছিল না কুকর্ম করার আগেই এর পরিণতি নিয়ে ভাবা?
আমার মা, শ্বশুর শ্বাশুড়ি সবাই শিক্ষকতা পেশার সাথে যুক্ত। তিনজনই প্রিন্সিপাল হিসেবেই রিটায়ার করেছেন। কিন্তু সেসব চোরদের জায়গায় উনাদের কল্পনা করতে পারছি না। কারন উনারা ওদের মতন দুর্নীতি করেন নাই। শিশুদের জীবন বরবাদ করে নাই। অভিভাবকরা উনাদের হাতে নিজেদের সবচেয়ে বড় সম্পদকে তুলে দিয়ে যে আস্থার পরিচয় দিয়েছেন, সেটার সাথে বেইমানি করেন নাই। উনাদের ছাত্রছাত্রীরা এখনও উনাদের ভালমন্দের খোঁজ নেয়। হঠাৎ দেখা হয়ে গেলে সম্মান করে।
যদি আমার মা বাবাও চোর হতো, তাহলে এই যে এখনকার চোরগুলিকে যে অপমানের মধ্য দিয়ে যেতে হচ্ছে, ওদের অবস্থানে বসিয়ে কল্পনা করে দুঃখ প্রকাশ করতে পারতাম।
আমি বরং আমাকে ওদের ভিক্টিমের অবস্থানে বসিয়ে দেখি আর আফসোস করি, আহারে! ওদের এত বড় ক্ষতি করে ফেলল!
শিক্ষকের কি তখনই মর্যাদা পাওয়া উচিত না যখন সে আসলেই শিক্ষকের (নৈতিক থেকে শুরু করে যাবতীয় শিক্ষার গুরু) ভূমিকা পালন করবে? যে চোর, ধান্দাবাজ, দুর্নীতিবাজ, ও কি সম্মানের দাবিদার?

আমার মনে হয় সোশ্যাল মিডিয়ার লোকজনের একটু জেনে বুঝে দুঃখিত হওয়া উচিত। জালিমের প্রতি সহানুভূতি দেখানোর আগে মজলুমের প্রতি জুলুমের মাত্রাটা দেখে নিন। হজ্বে গিয়ে শয়তানকে পাথর মারার সময়ে যদি আপনি বলেন "হজ্বের পক্ষে ছিলাম, কিন্তু একজন বুজুর্গকে পাথর মারার পক্ষে নই। দেশে আইন, আদালত আছে। জেল হোক। বেন্ধে রেখে পাথর মারা কেন?" এমন মন্তব্য করলে চলবে?
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে আগস্ট, ২০২৪ রাত ১১:২৪
৮টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

J K and Our liberation war১৯৭১

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:০৯



জ্যাঁ ক্যুয়ে ছিলেন একজন ফরাসি মানবতাবাদী যিনি ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের একটি বিমান হাইজ্যাক করেছিলেন। তিনি ৩ ডিসেম্বর, ১৯৭১ তারিখে প্যারিসের অরলি... ...বাকিটুকু পড়ুন

এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ

লিখেছেন এ আর ১৫, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ৯:৪০



এবার ইউনুসের ২১শে অগাষ্ঠ ২০০৪ এর গ্রেনেড হামলার তদন্ত করা উচিৎ


২০০৪ সালের ২১ শে অগাষ্ঠে গ্রেনেড হামলার কারন হিসাবে বলা হয়েছিল , হাসিনা নাকি ভ্যানেটি ব্যাগে... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

লিখেছেন এস.এম. আজাদ রহমান, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:৪৪



বাংলাদেশের রাজনীতিতে নতুন ছায়াযুদ্ধ: R থেকে MIT—কুয়াশার ভেতর নতুন ক্ষমতার সমীকরণ

কেন বিএনপি–জামায়াত–তুরস্ক প্রসঙ্গ এখন এত তপ্ত?
বাংলাদেশের রাজনীতিতে দীর্ঘদিন ধরে একটি পরিচিত ভয়–সংস্কৃতি কাজ করেছে—
“র”—ভারতের গোয়েন্দা সংস্থা নিয়ে রাজনীতিতে গুজব,... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিশ্চিত থাকেন জামায়েত ইসলাম এবার সরকার গঠন করবে

লিখেছেন সূচরিতা সেন, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৪২


আমাদের বুঝ হওয়ার পর থেকেই শুনে এসেছি জামায়েত ইসলাম,রাজাকার আলবদর ছিল,এবং সেই সূত্র ধরে বিগত সরকারদের আমলে
জামায়েত ইসলামের উপরে নানান ধরনের বিচার কার্য এমন কি জামায়েতের অনেক নেতা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×