somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ঠগির জবানবন্দি—পর্ব ০১

১০ ই মার্চ, ২০১৯ বিকাল ৩:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


[ভারতবর্ষের কুখ্যাত দস্যু সম্প্রদায় ঠগিদের কার্যকলাপ নিয়ে সত্য ঘটনার ওপর ভিত্তি করে ফিলিপ মিডোয টেলর, ১৮৩৯ সালে, লিখেছিলেন ‘কনফেশন্স অভ আ থাগ’ উপন্যাসটি। সেই বইটির বাংলা অনুবাদ—ঠগির জবানবন্দি—শীঘ্রই প্রকাশিত হচ্ছে সেবা প্রকাশনী থেকে, আমার অনুবাদে। চমৎকার এই বইটির বেশ কিছু পরিমার্জিত অধ্যায় (মূল অনুবাদ বই থেকে কিছুটা কাটছাঁট করে) প্রকাশ করার ইচ্ছে আছে এই ব্লগে। আজ, প্রথম পর্বে, প্রকাশ করা হলো মুখবন্ধ এবং প্রথম অধ্যায়ের অর্ধাংশ।]

মুখবন্ধ
এ-বইয়ে বর্ণিত বেশিরভাগ অপরাধ-কাহিনীই সত্য। আমির আলির জীবনকাহিনী আরেকটু আকর্ষণীয়ভাবে তুলে ধরার জন্যে কিছু-কিছু জায়গায় সামান্য কল্পনার আশ্রয় নেয়া হয়েছে মাত্র।
আমির আলির সঙ্গে আমার পরিচয় ১৮৩২ সালে। সে-সময় যেসব ঠগি ধরা পড়ে রাজসাক্ষী বা সরকারি চর বনে যায়, সে তাদেরই একজন। এদের পৈশাচিক হত্যাকাণ্ড ও লোমহর্ষক দস্যুতার কাহিনী সারা দেশে হইচই ফেলে দিয়েছিল।
আমির আলি নিজমুখে স্বীকার করেছে, দস্যুজীবনে নিজহাতে সাতশো উনিশজন মানুষকে খুন করেছে সে। সে যে একবিন্দুও বাড়িয়ে বলেনি, তা প্রমাণ হয়েছে তার সঙ্গীদের সাক্ষ্যে।
প্রাচীনকাল থেকে অনেকগুলো খণ্ড-খণ্ড রাজ্যে বিভক্ত বিশাল ভারতবর্ষ। রাজ্যগুলোর বেশিরভাগের শাসকই ছিলেন অদক্ষ। প্রত্যেকে নিজের খেয়াল-খুশিমত রাজ্য পরিচালনা করতেন। ছিল না কোন পুলিসবাহিনীও। ফলে রাজপথগুলোতে নিরাপদে চলাফেরা করার নিশ্চয়তাও ছিল না। অল্প কয়েকজন শাসক নিপুণভাবে রাজ্য পরিচালনা করলেও, এরকম সুশাসন সামগ্রিকভাবে প্রাচীন ভারতবর্ষের ভাগ্যে কখনও জোটেনি।
পথঘাটের অবস্থাও ভাল ছিল না। দূরদেশে যেতে হলেও পদযাত্রা কিংবা ঘোড়াই ছিল একমাত্র সহায়। পথিমধ্যে কোন পথিকদল আরেকদল পথিকের দেখা পেলে নিঃসঙ্কোচে মিশে যেত তাদের সঙ্গে। কারণ দল-বেঁধে না চললে তস্করদের আক্রমণ থেকে প্রাণ বাঁচানো সম্ভব ছিল না।
সমতল মাঠ, বন ও অকর্ষিত জমির বুকে লোক-চলাচলের ফলে যে আঁকাবাঁকা রেখা তৈরি হত, সেটাই ছিল ‘রাজপথ’। চলতে-চলতে মাঝেসাঝে এক-আধটা গ্রামের দেখা পাওয়া যেত কেবল। এই নির্জনতার সুযোগ নিয়ে সারাদেশে অসংখ্য ডাকাতদল ঘুরে বেড়াত নির্বিঘ্নে। এদের মধ্যে ঠগিদের দলটাই ছিল সবচেয়ে বড়, নিষ্ঠুর এবং সুসংগঠিত।
কোন নগর পেরোবার সময় পথচারীরা নগরের সাথে কোন যোগাযোগ রাখত না। মাঝেসাঝে শহরে ঢুকত বটে, কিন্তু বেশিরভাগ সময়ই শহরের বাইরে, গাছের ছায়ায় বা মাঠে তাঁবু খাটিয়ে বিশ্রাম নিত। ফলে কে কখন কোন্ গাঁ থেকে কোন্ গাঁয়ে যাচ্ছে, তা বোঝার জো ছিল না।
অসংখ্য জাতি, ধর্ম ও পেশার লোকের বাস ভারতবর্ষে। কাজেই, ইচ্ছেমত ছদ্মবেশ ধরে জনস্রোতে মিশে যেতে পারত লুটেরাদের দল। তাছাড়া এক রাজ্য থেকে আরেক রাজ্যে সোনা-রুপা পাঠানো হত আর্থিক লেনদেনের জন্যে। এ-কথা সবাই-ই জানত। তাই ছদ্মবেশী ডাকাতদলের সঙ্গে বিপুল ধন-রত্ন থাকলেও বিন্দুমাত্র সন্দেহ করত না কেউ। নতুন কোন রাজ্যে প্রবেশ করার সময় সীমান্তে কর্মরত রাজকর্মচারীরা পথিকদের মালসামান তন্ন-তন্ন করে তল্লাশি করে উপযুক্ত শুল্ক আদায় করে নিত। কাজেই, কোন জিনিস লুকিয়ে রাখবার উপায় ছিল না। অনেক শুল্ক-কর্মচারীর সঙ্গে দস্যুদলের যোগাযোগ থাকত। অতএব, পথিকদের কার কাছে কী আছে, সে-খবর নিমেষে পৌঁছে যেত ডাকাতদের কাছে।
নানা কিংবদন্তি ও গুজবের আড়ালে চাপা পড়ে গেছে ঠগি সম্প্রদায়ের উৎপত্তির ইতিহাস। কর্নেল স্লিম্যানের অনুমান: মোঘল ও তাতাররা ভারত আক্রমণ করার বহুদিন পর, অনেক যাযাবর মুসলমান ছোট-ছোট দলে ভাগ হয়ে ভারতজুড়ে লুটপাট চালাত। খুব সম্ভব এ-সম্প্রদায়গুলো থেকেই ঠগিদের উৎপত্তি। হিন্দুদের দাবি: ঠগিদের উৎপত্তি ভবানী দেবী থেকে। দাবিটাকে অবশ্য উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ হিন্দু বা মুসলিম, যে-ধর্মাবলম্বীই হোক না কেন, ভবানী বা কালীর পুজো করত প্রত্যেক ঠগি।
আকবরের রাজত্বকালের আগে এদের অস্তিত্বের কোন ঐতিহাসিক প্রমাণ পাওয়া যায় না। তাঁর আমলে অনেক ঠগি ধরা পড়ে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত হয়েছিল। এ-ঘটনার পর, ১৮১০ সাল অবধি এদের অস্তিত্বের ব্যাপারে আর কিছু জানা যায়নি।
১৮১০ সালে, কর্মস্থল থেকে বাড়ি এবং বাড়ি থেকে কর্মস্থলে ফেরার সময় অনেক সৈন্য নিখোঁজ হয়ে যায়। তাদের কোন খবর না পেয়ে সন্দেহের উদ্রেক হয় কমাণ্ডার-ইন-চিফের মনে। এদিকে ১৮১২ সালে লেফটেন্যাণ্ট মনশেল নিহত হন ঠগিদের হাতে।
প্রথম এদের খোঁজ পাওয়া গেল মধ্যপ্রদেশগুলোতে। ধীরে-ধীরে জানা গেল, এরা ছড়িয়ে রয়েছে গোটা ভারতবর্ষে। হিমালয়ের পাদদেশ থেকে কন্যাকুমারী, কচ্ছ থেকে আসাম অবধি সব জায়গায়।
সে-সময় (১৮৩১-৩২) তামাম ভারতে এই ঠগি-কাণ্ড যে চাঞ্চল্য ও আতঙ্ক সৃষ্টি করেছিল, তা ভাষায় বর্ণনা করা দুঃসাধ্য। অনেক জেলার ম্যাজিস্ট্রেটরা কিছুতেই বিশ্বাস করতে চাইলেন না, তাঁদের অজান্তে, তাঁদেরই এলাকায় এতদিন ধরে নিঃশব্দে চলেছে এমনতর লুটতরাজ আর হত্যাকাণ্ড।
ঠগিদের দুঃসাহসিক কর্মকাণ্ডের ব্যাপারে স্ষ্টপ ধারণা পাবার জন্যে একটা ঘটনার উল্লেখ করা যায়।
হিঙ্গোলির সেনানিবাসে থাকত জেলাটির ঠগি-সর্দার, হরি সিং। লোকটা ওখানকার সুপরিচিত ব্যবসায়ী, সবার শ্রদ্ধাভাজন। একদিন বোম্বে থেকে কিছু কাপড় আমদানির জন্যে অনুমতিপত্র চেয়ে আবেদন করল সে। তখনই পাশের একটা শহরের এক কাপড় ব্যবসায়ী কাপড়চোপড় নিয়ে ফিরছিল।
যা-ই হোক, অনুমতিপত্র নিয়ে চলে গেল হরি সিং। পথিমধ্যে অনুচর-সহ খুন করল সেই ব্যবসায়ীকে। এরপর হিঙ্গোলিতে ফিরে, সেই অনুমতিপত্র দেখিয়ে, ওসব কাপড়চোপড় প্রকাশ্যে বিক্রি করল সেনানিবাসে।
হরি সিং আর তার সাঙ্গপাঙ্গরা সেনানিবাসের বাজারেই অনেককে খুন করেছে। বাজারটা সৈন্যদের মূল বাসভবন থেকে বড়জোর একশো গজ তফাতে। হত্যা করার পর নিরীহ মানুষগুলোর লাশ পুঁতেছিল ওখান থেকে বড়জোর পাঁচশো গজ দূরে।
ঠগিদের এসব নিষ্ঠুর, বীভৎস ব্যাপার জানার পর ব্যাপারটা খুব গুরুত্বের সাথে নিলেন তৎকালীন গভর্নর-জেনারেল লর্ড উইলিয়াম বেণ্টিঙ্ক। চৌকস অফিসারদের নিয়োগ দেয়া হলো ঠগি-আক্রান্ত জেলাগুলোতে।
ঠগিদের নৃশংস খুনের কাহিনী জনসম্মুখে আসবার পর, স্রোতের মত চিঠি আসতে শুরু করল ঠগি-দমন বিভাগের অফিসারদের কাছে। এসব চিঠিতে তারা লিখেছে, অনেকদিন ধরে তাদের আত্মীয় বা বন্ধু লাপাত্তা। নিশ্চয়ই ঠগিদের হাতে বলি হয়েছে তারা। স্বজনদের মৃতদেহ ওরা কোথায় পুঁতেছে, সরকার যদি দয়া করে তাদের জানায়, তা হলে অন্তত আপনজনের শেষকৃত্যটুকু করতে পারার সান্ত্বনা পাবে তারা।
এ-বইয়ে ঠগিদের লুটপাটের যেসব পদ্ধতির কথা বলা হয়েছে, সেগুলো ছাড়াও আরও অনেক উপায়ে দস্যুতা করে বেড়াত লুটেরার দল। সেরকম একটা পদ্ধতি ছিল গঙ্গার বুকে নৌযাত্রীদের সর্বস্ব লুটে নেয়া। এসব দস্যুরা নৌকাতেই থাকত। শিকারের আশায় ছদ্মবেশে ঘুরে বেড়াত গঙ্গার বুকে। কোন নৌযাত্রী দেখলে খাতির জমিয়ে ফেলত তাদের সঙ্গে। তারপর সুযোগ বুঝে লুটে নিত তাদের সর্বস্ব। কিন্তু সবচেয়ে জঘন্য যে-ডাকাতি প্রচলিত ছিল, তা হলো: ছেলেধরা। বাবা-মাকে খুন করে তস্করের দল ছেলেদের বেচে দিত ক্রীতদাস হিসেবে—অল্পবয়েসী মেয়েদের বেচে দিত পতিতাদের কাছে।
পাঠকদের মনে অহেতুক আতঙ্ক সৃষ্টির উদ্দেশ্যে ঠগিদের বীভৎস কর্মকাণ্ডের বর্ণনা দিইনি আমি এ-বইয়ে। আমার উদ্দেশ্য হচ্ছে: এই ভয়ঙ্কর তস্করদের রীতিনীতি, আচার-অনুষ্ঠান ও নির্মম হত্যাযজ্ঞ সম্পর্কে পাঠকদের অবহিত করা।
এ-বইয়ে বর্ণিত স্থান-কাল-পাত্র প্রায় সবই সত্য। বইটি ঠগি সম্প্রদায়ের সম্পর্কে পাঠকদের জানার তৃষ্ণা যদি এতটুকুও মেটাতে পারে, তা হলেই বুঝব আমার পরিশ্রম সার্থক।

কর্নেল ফিলিপ মিডোয টেলর
লণ্ডন, জুলাই, ১৮৩৯



এক


‘সাহেব, তুমি আমার জীবন-কাহিনী শুনতে চেয়েছ। অনেকদিন ধরে আমাদের দেশে আছ তুমি। তাই আমার দেশের আচার-সংস্কৃতি খুব ভালমতই জানো। তাই আমার জীবনের ঘটনা পরম্পরা বুঝতে তোমার কোন অসুবিধে হবে না,’ বলল আমির আলি। ‘আমার জীবন-কাহিনী তুমি নিজের দেশের লোকদের জানাতে চাও—তাতে আমার কোন আপত্তি নেই। আমি ইউরোপিয়ানদের বশ্যতা স্বীকার করে নিলেও, অতীতের সেই গৌরবোজ্জ্বল দিন আর নিজের দুঃসাহসিক কাজ-কর্মের কথা মনে পড়লে বুকটা গর্বে ভরে ওঠে। সেসব দিনের কথা মনে পড়লেই ইচ্ছে করে, আবার ফিরে যাই সেই বাঁধ-ভাঙা, স্বাধীন জীবনে। দেশে-বিদেশে ডাকাতি করে বেড়াই পুরনো বন্ধুদের সাথে।
কালের গর্ভে হারিয়ে গেছে সেসব দিন। তোমাদের আদালত আমাকে ফাঁসির দণ্ড দিয়েছিল। কিন্তু, সাহেব, জীবন সবার কাছেই ভীষণ প্রিয়। আর কেবল সেই জীবন বাঁচানোর জন্যেই রাজি হয়েছি আমার পুরনো সহচর ও বন্ধুদের ধরিয়ে দিতে। আমার দলের সিংহভাগ ঠগিই ধরা পড়ে শাস্তি পেয়েছে। যারা এখনও ধরা পড়েনি, তাদের বেশিরভাগই পালিয়ে বেড়াচ্ছে ফেরার হয়ে। ওদেরকে তাড়া করে ফিরছে তোমার লোকেরা।
ধরা ওরা পড়বে বটে, কিন্তু এই ঠগিদল একেবারে নির্মূল করা সম্ভব হবে না কিছুতেই। দেখ, কত শত-সহস্র ঠগি শাস্তি পাচ্ছে তোমাদের হাতে। কিন্তু কয়েদির সংখ্যা কি কমছে? উহুঁ, উল্টো দিন-দিন বাড়ছে। ঠগিবৃত্তি এক ছোঁয়াচে রোগ, সাহেব। এ-রোগের প্রভাবে প্রায়-উন্মাদ হয়ে ওঠে লোকে। বাঘ একবার নরমাংসের স্বাদ পেলে এরকম উন্মত্ত হয়ে ওঠে।
ফাঁসির দণ্ড থেকে রেহাই দিয়ে যেসব দস্যুকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছ, তারা তো প্রতিদিনই কত-শত নতুন-নতুন নাম-ধাম দিচ্ছে তোমাদের। এত দস্যুর নাম আমিও জানতাম না। দেশের এমনসব রাজ্যেও ঠগির খোঁজ পাওয়া গেছে যে, ওখানে যে ঠগিদলের অস্তিত্ব থাকতে পারে, তা কল্পনাও করতে পারেনি কেউ। সব দলের খোঁজ তো এখনও পাওয়াই যায়নি।’
‘ঠিকই বলেছ, আমির আলি,’ বললাম আমি। ‘তোমাদের দস্যুতা এখনও আগের মতই জোরকদমে চলছে। তবে এভাবে বেশিদিন চলবে না। তোমার দলের লোকেদের বুনো জন্তুর মত তাড়িয়ে বেড়াচ্ছে পুলিস। যাকে ধরতে পারছে, তাকেই লটকে দিচ্ছে ফাঁসিকাঠে। তারচেয়েও ভয়াবহ ব্যাপার হচ্ছে, কালাপানিতে নির্বাসন দেয়া হচ্ছে অনেককে। তোমার দলের লোকেরা আর বেশিদিন পালিয়ে বেড়াতে পারবে না।’
‘ভুল বললে, সাহেব। ঠগিবৃত্তি মানুষকে যেরকম উন্মত্ত ও রক্তলোলুপ করে তোলে, তা তুমি কল্পনাও করতে পারবে না। আমার বিশ্বাস: যতদিন পর্যন্ত একজন ঠগিও বেঁচে থাকবে, ততদিন সে নতুন সঙ্গী জুটিয়ে আবার ডাকাতি শুরু করবে। আমার জীবনের কাহিনী শুনলেই এ-কথার সত্যতা টের পাবে। তোমরা ইংরেজরা তো শিকার খুব পছন্দ কর। কত দিন-মাস কাটিয়ে দাও শিকারের উত্তেজনায়। একটা বাঘ, চিতাবাঘ, মোষ, বা শুয়োর মারবে বলে আনন্দে-উত্তেজনায় উন্মাদপ্রায় দশা হয় তোমাদের। এমনকী জীবনের ঝুঁকি নিতেও পিছপা হও না প্রাণীটা শিকার করার জন্যে। তাহলে ভেবে দেখ, সে-তুলনায় একজন ঠগির জীবন কতটা রোমাঞ্চকর! ঠগির শিকার: মানুষ। শিশু থেকে বৃদ্ধ—সবাইকে হত্যা করার শপথ নিয়ে অস্ত্র ধরেছে ওরা।’
‘তোমরা তো মানুষ নও, পিশাচ! সাক্ষাৎ পিশাচ!’ শিউরে উঠলাম আমি। ‘প্রতিদিন তোমাদের হাজার-হাজার খুনের তথ্য পাচ্ছি। যাক গে, এখন তোমার নিজের কাহিনী বলতে শুরু করো।’
‘বেশ, বলছি তাহলে,’ বলল আমির আলি। ‘কিছুই লুকাব না তোমার কাছে। একেবারে গোড়া থেকে শুনতে চাও সব?’
‘নিশ্চয়ই,’ জবাব দিলাম। ‘তোমার জীবন-কাহিনী মানুষকে জানানোর জন্যে বই লিখব আমি। পাঠক নিশ্চয়ই খুব আগ্রহের সাথে তোমার রোমাঞ্চকর জীবনের গল্প শুনবে। নাও, এবার শুরু করো।’
শুরু হলো আমির আলির জীবনের গল্প। পাঠকদের সুবিধার্থে পুরো কাহিনীটি তুলে ধরছি আমির আলির বয়ানে।

ছোটবেলার কথা খুব পষ্ট মনে নেই আমার। আবছা-আবছা কেবল মনে পড়ে, হোল্কার রাজ্যের এক গ্রামে আমার জন্ম। বাপ-মায়ের কথা কিছু বলতে পারি না। তবে যদ্দূর মনে পড়ে, খুব সম্ভ্রান্ত ছিল আমাদের পরিবার। কেননা লম্বা, সুন্দরী এক মহিলাকে আমি মা ডাকতাম। আর এক বৃদ্ধা দাই ছিল আমার দেখাশোনা করার জন্যে। ছোট একটা বোন ছিল আমার। খুব ভালবাসতাম ওকে। এছাড়া শৈশবের আর কিছু মনে নেই। এরপরের যে-ঘটনাটি মনে পড়ে, সেটি চিরস্থায়ী ছাপ ফেলে গেছে মনে। সে-ঘটনাই বর্তমান জীবনে নিয়ে আসে আমাকে।
হঠাৎ একদিন অস্বাভাবিক ছুটোছুটি, হইচই শুরু হলো বাড়িতে। কাপড়চোপড়, দরকারি জিনিসপত্র গোছাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল সবাই। ধারণা করলাম, বাড়ি ছেড়ে কোথাও যেতে হবে বোধহয় আমাদের। পরদিন সকালে—আমার ধারণাকে সত্যি প্রমাণ করে দিয়ে—বাড়ি ছাড়লাম আমরা। মা আর আমি উঠলাম একটা ডুলিতে। বৃদ্ধা ডাই, চম্পা উঠল আমার টাট্টুঘোড়ায়—বাবা তাঁর বড় ঘোড়াটিতে। পাড়ার বেশ কয়েকজন লোক চলল আমাদের সঙ্গে। সবাই সশস্ত্র। আমাদেরকে পাহারা দিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল বোধহয়।
গ্রাম ছাড়ার তৃতীয় কি চতুর্থ দিনে, একটা শহরে পৌঁছুলাম আমরা। দিনটা ওখানে কাটানোর জন্যে আস্তানা গাড়লাম বাজারের একটা খালি দোকানঘরে। কী একটা কাজে মা আর আমাকে রেখে বাইরে গেলেন বাবা। স্ত্রীলোক বলে মায়ের পক্ষে দোকান থেকে বেরোনো সম্ভব ছিল না। তাই বার-বার আমাকে বেরোতে মানা করে, ভেতরের কামরায় গিয়ে শুয়ে পড়লেন। চম্পা ব্যস্ত হয়ে পড়ল রান্না-বান্না নিয়ে। পাহারা দিয়ে নিয়ে আসা লোকগুলো ইতস্তত ঘুরে বেড়াচ্ছে। ফাঁক পেয়ে, টুক করে বেরিয়ে পড়লাম আমি।
কয়েকটা বাচ্চা খেলছিল রাস্তায়। চট করে ভিড়ে গেলাম ওদের দলে। হঠাৎ এক মধ্যবয়স্ক, সুদর্শন লোক এসে ডেকে নিয়ে আমার নাম-ধাম জিজ্ঞেস করল। বাচ্চাগুলোর মধ্যে দামি জামাকাপড় ছিল একমাত্র আমার পরনেই। গলায়-হাতে সোনা-রুপার গয়নাও ছিল বেশ কিছু। সেজন্যেই বোধহয় আমার ওপর নজর পড়েছিল তার। যা-ই হোক, লোকটাকে বললাম, আমার বাবার নাম ইউসুফ খান। তারপর জানালাম, আমরা সপরিবারে ইন্দোর যাচ্ছি।
‘আচ্ছা, কাল তাহলে পথে তোমাদের সঙ্গেই দেখা হয়েছিল আমার,’ বলল লোকটা। ‘তোমার মা গরুর গাড়িতে করে আসছিলেন, তাই না?’
‘মোটেও না!’ রেগে গেলাম আমি। ‘মা পাল্কি চড়ে যায়। সঙ্গে থাকি আমি। বাবা বিরাট একটা ঘোড়ায় চড়েন। চম্পা আর আরও বেশ কয়েকজন জোয়ান লোক আছে সঙ্গে। আপনার কি মনে হয় আমার মা চাষার বউয়ের মত গরুর গাড়িতে করে যাবে?’
‘ওহ্, হ্যাঁ, তা-ই তো। তুমি তো বড় ঘোড়ায়ই চড়বে। সঙ্গে থাকবে আমার মত ঢাল-তলোয়ার। যাক গে, মিষ্টি পছন্দ কর না তুমি? ওই দেখ, দোকানটাতে কী সুন্দর জিলাপি সাজানো! চলো, জিলাপি কিনে আনি।’
আমার বয়েসী বাচ্চার পক্ষে গরম-গরম সুস্বাদু জিলিপির লোভ সামলানো অসম্ভব। ভয়ে-ভয়ে মা যে-দোকানে ঘুমোচ্ছে সেদিকে একবার তাকিয়ে, লোকটার সঙ্গে গেলাম মিষ্টির দোকানে। অনেকগুলো জিলিপি কিনে দিল সে আমাকে। ওগুলো রুমালে বেঁধে ফিরতি পথ ধরলাম। যে-ছেলেগুলো আমার সঙ্গে খেলছিল, আমার সঙ্গে মিষ্টি দেখে লোভ হলো ওদের। লোকটা আমাকে বিদেয় দিয়ে কিছু দূর যেতেই, আমার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ছেলেগুলো। জিলিপিগুলো কেড়ে নিল সবাই মিলে। তাতেও সন্তুষ্ট হতে না পেরে, আমার গলার সোনার মালাটাও কেড়ে নেবার চেষ্টা করল ওরা। এবার গলা ফাটিয়ে চেঁচিয়ে উঠলাম আমি। চিৎকার শুনে দৌড়ে ফিরে এল লোকটা। তাকে দেখে ছুটে পালাল ছেলেগুলো। এবার আমাকে বাসা পর্যন্ত এগিয়ে দিতে এল লোকটা। চম্পার হাতে সোপর্দ করে, আমাকে একা-একা বেরোতে দিতে নিষেধ করে দিল।
ফুঁপিয়ে-ফুঁপিয়ে কাঁদছিলাম আমি। অচেনা গলার আওয়াজ শুনে মা আমাকে ভেতরে ডাকলেন। জানতে চাইলেন, কী হয়েছে। সব খুলে বলতে, যে-লোক আমাকে বাঁচিয়েছে, পর্দার আড়াল থেকে তাকে ধন্যবাদ জানালেন। তারপর বললেন, আর দু’ঘণ্টা পরে এলে বাবার সঙ্গে দেখা হবে। ছেলের প্রাণ যিনি বাঁচিয়েছেন, তাঁর সঙ্গে দেখা হলে নিশ্চয়ই খুব খুশি হবেন বাবা। সন্ধ্যায় আসবে বলে চলে গেল লোকটা।
খানিক বাদেই ফিরলেন বাবা। ঘটনা শুনে হালকা উত্তম-মধ্যম লাগালেন আমাকে।
সন্ধেবেলায় আর একটা লোককে সঙ্গে নিয়ে বাসায় এল সেই লোকটা। নিজেদের মধ্যে অনেক কথা বলল তারা আমাকে নিয়ে। সবকিছু মনেও নেই। তবে এটুকু মনে আছে যে, ঠগ শব্দটা প্রথম এদের মুখেই শুনেছিলাম। লোক দুটোর আলাপ থেকে বুঝলাম, আমরা যেখানে আছি, সেখান থেকে ইন্দোরে যাবার পথে ঠগদের খুব উৎপাত। বাবাকে বার-বার সাবধান করে দিল ওরা। বলল, ওরা নাকি সৈন্য। একটা কাজে ইন্দোর থেকে পাঠানো হয়েছে ওদের। অনেক লোক আছে তাদের দলে। আমাদের প্রহরী হিসেবে সঙ্গে যাবার প্রস্তাব দিল।
আমার বন্ধুটি খুব হেসে-হেসে কথা বলল আমার সঙ্গে। তার অস্ত্র নিয়ে খেলতে দিল। কথা দিল, পরদিন আমাকে তার ঘোড়ায় তুলবে। এমন একটা বন্ধু পেয়ে তো খুশিতে রীতিমত আটখানা হয়ে গেলাম। তবে সঙ্গের লোকটাকে পছন্দ হলো না। লোকটা দেখতে বীভৎস। যাক গে, এর ব্যাপারে সামনে আরও অনেক কথা বলব।

(চলবে...)

পুনশ্চ ১: চূড়ান্ত সম্পাদিত অনুবাদটি এখানে প্রকাশ করা হয়নি, তাই কিঞ্চিৎ ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। সেজন্য আমি ক্ষমাপ্রার্থী।
পুনশ্চ ২: অনুবাদটি উৎসর্গ করা হয়েছে বাংলা থ্রিলার সাহিত্যের নক্ষত্র, কাজী আনোয়ার হোসেন-কে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই মার্চ, ২০১৯ দুপুর ১২:০৮
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×