somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

এরকুল পোয়ারো: ১০০ নট আউট

২৯ শে এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



১৯৭৫ সালের ৬ আগস্ট। নিউ ইয়র্ক টাইমস পত্রিকার প্রথম পাতার নিচের দিকে ছাপা হলো একটি খবর। শিরোনাম—
'এরকুল পোয়ারো ইজ ডেড; ফেইমড বেলজিয়ান ডিটেকটিভ!'
খবরটা পড়ে কেঁপে উঠল দুনিয়ার তাবত রহস্য-কাহিনি পাঠকদের মন। এই প্রতিবেদনের মাধ্যমেই এরকুল পোয়ারো হয়ে উঠলেন প্রথম কাল্পনিক চরিত্র, যার মৃত্যুসংবাদ ছাপা হয় খবরের কাগজের প্রথম পাতায়।

এরকুল পোয়ারোর পরিচয়
বই আকারে এরকুল পোয়ারোর প্রথম আবির্ভাব ১৯২০ সালের অক্টোবর মাসে। আমেরিকা থেকে জন লেইন কর্তৃক প্রকাশিত সে বইটির নাম ছিল—দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস। লেখকের নাম আগাথা ক্রিস্টি।
উপন্যাসটির নায়ক এরকুল পোয়ারো, বেঁটেখাটো গড়নের মানুষ। টেনেটুনে পাঁচ ফুট চার ইঞ্চি লম্বা হবেন। মাথাটা ঠিক ডিমের মতো। উত্তেজিত হয়ে গেলে দুই চোখে সবুজ আভা চকচক করতে থাকে—ঠিক বেড়ালের মতো। নাকের নিচে পেল্লায় একজোড়া গোঁফ। প্রখর ব্যক্তিত্বের অধিকারী। সারাক্ষণ পরিপাটি থাকেন, ঠিক যেন ফুলবাবু। পরিচ্ছন্নতা নিয়ে শুচিবাই আছে তার। জামাকাপড়ে বিন্দুমাত্র ভাঁজ কিংবা ধূলিকণা সহ্য করতে পারেন না—সঙ্গে সঙ্গে লেগে যান সাফসুতরো করতে। এমনকি মুরগি কেন ভিন্ন আকৃতির ডিম পাড়বে, এ নিয়েও অনুযোগ করতে দেখা যায় তাকে। হরহামেশাই ভুলভাল উদ্ধৃতি দেন শেকস্পিয়ার থেকে। ইংরেজিও বলেন ভুলভাল। উত্তেজিত হলেই ফরাসির ফুলঝুরি ছোটে মুখে।
প্রবল জাত্যাভিমানী মানুষ এরকুল পোয়ারো। কেউ তাকে ফ্রেঞ্চ বললে, ভুরু কুঁচকে ভুলটা শুধরে দিয়ে বলেন: তিনি ফ্রেঞ্চ নন, বেলজিয়ান।
পায়ের ছাপ কিংবা সিগারেটের ছাই দেখে গোয়েন্দাগিরি করতে তার নিদারুণ অনীহা। তার বিশ্বাস, মস্তিষ্কের 'ছোট্ট ধূসর কোষগুলোকে' কাজে লাগিয়ে যেকোনো সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।
এরকুল পোয়ারোর সমাপ্তিটা নাটকীয় হলেও, তার গল্পটা কিন্তু 'ভিনি, ভিডি, ভিসি' (এলাম, দেখলাম, জয় করলাম) নয়। ১৯২০ সালে বই আকারে প্রকাশের আগে কমসে-কম ৬জন প্রকাশক ফিরিয়ে দিয়েছিলেন 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'-এর পাণ্ডুলিপি। বইটি ক্রিস্টি লিখেছিলেন তার বোনের সঙ্গে বাজি ধরে। বোন তাকে বলেছিলেন, পুরুষ লেখকদের মতো রহস্য-কাহিনি লেখার সাধ্য তার নেই। তাই বোনকে দেখিয়ে দেয়ার তাগিদ থেকেই তিনি লিখে ফেললেন 'দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস'। ৫ বছর ঘোরাঘুরি করেও যখন কোনো প্রকাশক পেলেন না, তখন দ্য টাইমস পত্রিকায় দিলেন উপন্যাসটি ধারাবাহিকভাবে ছাপার জন্য। মনে আশা, হয়তো কোনো প্রকাশকের চোখে পড়লে ছাপতে রাজি হবেন। তার আশা পূরণ হলো। দ্য টাইমস-এ ছাপা উপন্যাস পড়েই তাকে বই প্রকাশের প্রস্তাব দেন জন লেইন। কিন্তু রহস্য-সাহিত্যের নতুন অধ্যায় খুলে বসেছিল যে চরিত্র, তাকে নিয়ে লেখা প্রথম বইটি লিখে ক্রিস্টি পারিশ্রমিক পেয়েছিলেন মাত্র ২৫ পাউন্ড! সেইসাথে বইটির স্বত্বও ছেড়ে দিতে হয়েছিল তাকে।
তবে প্রথম বই প্রকাশের পরই বদলে যেতে থাকে দৃশ্যপট। ধীরে ধীরে চড়তে থাকে এরকুল পোয়ারোর জনপ্রিয়তার পারদ। শার্লক হোমসের তুঙ্গস্পর্শী জনপ্রিয়তার মাঝেও স্বতন্ত্র জায়গা দখল করে নিলেন এরকুল পোয়ারো।
আগাথা ক্রিস্টির মাথায় গোয়েন্দা গল্প লেখার চিন্তা আসে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে। তখন তিনি কাজ করতেন এক ডিসপেনসারিতে। সেই সময় ইংল্যান্ডের টর্কি-তে একদল বেলজিয়ান শরণার্থীকে দেখে ক্রিস্টি ঠিক করেন, তার গোয়েন্দাটি হবে একজন বেলজিয়ান। তাকে যেহেতু অপরাধ নিয়ে কাজ করতে হবে, তাই সে হবে অপরাধের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল। কাজেই লোকটা অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ হলে মন্দ হয় না। বেলজিয়াম সরকারের 'ফরেন অ্যাফেয়ার্স, ফরেন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট'-এর সাম্প্রতিক গবেষণা অনুসারে, বাস্তবে জ্যাক হর্নেস নামের এক উদ্বাস্তু বেলজিয়ান পুলিশ অফিসারের দ্বারা অনুপ্রাণিত হয়েই পোয়ারোকে গড়ে তুলেছিলেন ক্রিস্টি। তথ্যটির সত্যতা নিয়ে অবশ্য সন্দেহ রয়েছে।
ক্রিস্টি তার গোয়েন্দার নামের প্রথমাংশ নিয়েছেন গ্রিক পুরাণের বীর হারকিউলিসের নাম থেকে। নামের শেষাংশটি বানিয়েছেন দুটো কাল্পনিক গোয়েন্দার চরিত্রের নাম থেকে— Hercule Popeau ও Monsieur Jules Poiret.
পোয়ারোকে আসলে কার আদলে সৃষ্টি করেছেন, তা বলে যাননি ক্রিস্টি। আত্মজীবনীতে শুধু লিখেছিলেন, 'সহসাই বেলজিয়ান উদ্বাস্তুদের কথা মনে পড়ল আমার।...তাহলে আমার গোয়েন্দা একজন বেলজিয়ানই হোক না কেন? রিফিউজি পুলিশ অফিসার হলে কেমন হয়?'
ব্যস, সৃষ্টি হয়ে গেলেন একজন উদ্বাস্তু গোয়েন্দা—এবং চিরকালের মতো নিজের জায়গা পাকা করে নিলেন বিশ্বসাহিত্যে।
পোয়ারোর প্রথম উপন্যাসেই অবশ্য বাঁধা ছক থেকে বেরোতে পারেননি ক্রিস্টি। দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলসে পোয়ারোর ওয়াটসন রূপে দেখা গেল ক্যাপ্টেন হেস্টিংসকে। দুঁদে গোয়েন্দার পাশে যুদ্ধফেরত এই সৈনিক বুদ্ধির ছটায় একেবারেই নিষ্প্রভ, হাস্যকর। হেস্টিংসের পাশাপাশি শার্লকীয় কেতায় লেস্ট্রেড-মার্কা গোয়েন্দা হিসেবে হাজির হলো স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের ইন্সপেক্টর জ্যাপ। অবশ্য ধীরে ধীরে এই খোলস ছেড়ে বেরিয়ে এসেছেন ক্রিস্টি। প্রতিষ্ঠা করেছেন নিজের স্বতন্ত্র ধারা, যা দৃশ্যমান হয়েছে দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড, ফাইভ লিটল পিগস, মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস-সহ আরো অনেকগুলো উপন্যাসে।
ঘুরতে পছন্দ করতেন ক্রিস্টি। প্রত্নতাত্ত্বিক স্বামীর সঙ্গে ঘুরে বেড়িয়েছেন বহু জায়গায়। প্রত্নতত্ত্বের প্রতি ক্রিস্টির ছিল আলাদা টান। তার ভ্রমণপিপাসু মন ও প্রত্নতত্ত্ব-প্রেমের ছাপ রয়েছে 'মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস', 'অ্যাপয়েন্টমেন্ট উইথ ডেড', 'ডেথ অন দ্য নাইল', 'মার্ডার ইন মেসোপটেমিয়া'-সহ আরো অনেক উপন্যাসে।
এরকুল পোয়ারোর অনেক উপন্যাসের প্লটই ক্রিস্টি নিয়েছেন বাস্তব ঘটনা থেকে। প্রথমেই ধরা যাক মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস-এর কথা। এ উপন্যাসের কাহিনি ফাঁদা হয়েছে ১৯৩২ সালে মার্কিন পাইলট চার্লস লিন্ডবার্গের বিশ মাস বয়সি ছেলের অপহরণ ও তার পরবর্তী ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে।
১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডের কর্নওয়ালের এক গ্রামের কয়েকজন বাসিন্দাকে খুন করা হয় বিষ খাইয়ে। এ ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে ক্রিস্টি লেখেন স্যাড সাইপ্রেস। কুখ্যাত খুনি জ্যাক দ্য রিপারের খুনের ঘটনা থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে লেখেন দি এবিসি মার্ডারস।
প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময় স্বেচ্ছাসেবী নার্স হিসেবে কাজ করেছিলেন ক্রিস্টি। সে সময় বিস্তর অভিজ্ঞতা অর্জন করেন হরেক পদের বিষের ওপর। সেই জ্ঞানের সদ্ব্যবহার দেখা যায় তার উপন্যাসগুলোতে। পোয়ারোর বহু গল্পেই তিনি বিষ ব্যবহার করেছেন খুনের অস্ত্র হিসেবে (দ্য মিস্টিরিয়াস অ্যাফেয়ার অ্যাট স্টাইলস, থ্রি অ্যাক্ট ট্র্যাজেডি, ফাইভ লিটল পিগস, স্যাড সাইপ্রেস)। বলা যায়, ক্রিস্টির বই পড়লে নানা ধরনের বিষের ব্যাপারে রীতিমতো বিশেষজ্ঞ হয়ে উঠবেন আপনি।

জনপ্রিয়তার নেপথ্যে
প্রথম আবির্ভাবের ১০০ বছর পর আজও অমলিন এরকুল পোয়ারোর আবেদন। এই চরিত্রটির আবেদন কেমন, তা আঁচ করা যায় আগাথা ক্রিস্টির বিক্রিত বইয়ের সংখ্যা থেকে। গিনেস বুক রেকর্ডের তথ্যানুসারে, বাইবেল ও শেকস্পিয়ারের পর সারা বিশ্বে আগাথা ক্রিস্টির বই-ই সবচেয়ে বেশি বিক্রি হয়েছে, এবং হচ্ছে। এর মাঝে বেশিরভাগ বই-ই এরকুল পোয়ারো সিরিজের।
পোয়ারোকে নিয়ে ক্রিস্টি ৩৩টি উপন্যাস ও ৫০টিরও বেশি গল্প লিখেছেন। প্রশ্ন জাগতেই পারে, কেন আজও এতটুকু ফিকে হয়নি এ গোয়েন্দার জনপ্রিয়তা? কারণ বহুবিধ।
প্রথম কারণ, ক্লাসিক 'হুডানিট' ঘরানার সংজ্ঞাই নতুন করে লিখিয়েছিলেন এই দুঁদে বেলজিয়ান গোয়েন্দা। ১৯২৬ সালে প্রকাশ পায় 'দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড'। কাহিনির শুরু শান্ত নিরিবিলি গ্রাম কিংস অ্যাবট-এ এক মহিলার অস্বাভাবিক মৃত্যু দিয়ে। গুজব আছে, নিজের স্বামীকে খুন করেছিলেন মহিলা, কারণ তার সঙ্গে গ্রামের ধনকুবের রজার অ্যাকরয়েডের গোপন সম্পর্ক ছিল। গুজব ছড়িয়ে পড়ে, ব্ল্যাকমেইলের ভয়েই আত্মহত্যা করেছেন মহিলা। কিন্তু অচিরেই খুন হন অ্যাকরয়েডও। সম্পত্তির উত্তরাধিকার, গোপন সম্পর্ক, চুরি—ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা রহস্যের সমাধানে নামলেন পোয়ারো। সমাধানও করলেন। আর সে সমাধান রহস্য-সাহিত্যের জগতকে এমনই ধাক্কা দিল যে, নতুন করে সংজ্ঞায়িত হলো 'হুডানিট' ঘরানাটি।
১৯৩৪ সালে মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস এবং ১৯৩৬-এ দি এবিসি মার্ডারস প্রকাশের পর ফের ঝাঁকি খেল রহস্য-সাহিত্যের জগত। আবার নতুন করে সংজ্ঞায়িত হলো 'হুডানিট'। একের পর এক দুর্দান্ত সব রহস্যের সমাধান করে চলেন পোয়ারো, আর বেড়ে চলে তার জনপ্রিয়তা।
পোয়ারোর জনপ্রিয়তার আরেকটি কারণ তার অসাধারণ ধীশক্তি। কোনো কেসই তিনি অমীমাংসিত রাখেন না। যে-করেই হোক রহস্যের সমাধান তিনি করেনই। অন্য গোয়েন্দাদের মতো সূত্রের সন্ধানে তিনি এখানে-ওখানে ছুটে বেড়ান না। বরঞ্চ চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চিন্তা করেন, মাথা খাটান। তাতেই পেয়ে যান রহস্যের সমাধান। পোয়ারোর বিশ্বাস (আফটার দ্য ফিউনারেল), কোনো মানুষকে দিয়ে যদি দীর্ঘক্ষণ কথা বলানো যায়, তাহলে তার আসল চরিত্র একসময়-না-একসময় বেরিয়ে আসবেই। বলা বাহুল্য, এ পদ্ধতি খাটিয়ে প্রতিবারই সফল হন তিনি।
বেলজিয়ান গোয়েন্দার জনপ্রিয়তার আরেকটি বড় কারণ, তিনিও আমাদের মতোই বহিরাগত হিসেবেই যেকোনো রহস্যের সমাধানে নামেন। যেকোনো তথ্য-প্রমাণ তিনি নির্মোহ দৃষ্টিতে বিশ্লেষণ করেন। পোয়ারো যেসব সূত্র পান, সেসব সূত্র পেয়ে যান পাঠকরাও। অন্যান্য গোয়েন্দার মতো পাঠকরা সূত্র সম্পর্কে অন্ধকারে থেকে যান না। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, 'ফাইভ লিটল পিগস' উপন্যাসটির কথা। ১৬ বছর আগের এক হত্যারহস্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব পড়ে পোয়ারোর কাঁধে। এ কেস তিনি সমাধান করেন স্রেফ পুরনো নথিপত্র ও সাক্ষীদের জবানবন্দি ঘেঁটে। এর ফলে পোয়ারো যে যে তথ্য পান, ঠিক সে তথ্যই হাজির হয় পাঠকের হাতেও। পাঠকের সামনেও সমান সুযোগ থাকে গোয়েন্দা বনে যাওয়ার। এভাবে কাহিনি ও পোয়ারোর সাথে নিমেষেই একাত্ম হয়ে যেতে পারে যেকোনো পাঠক।
সত্যের প্রতি এরকুল পোয়ারোর একনিষ্ঠ আনুগত্য তার জনপ্রিয়তায় রেখেছে উল্লেখযোগ্য অবদান। তার মতে, 'সত্য—তা সে যতই কুৎসিত হোক না কেন—সবসময়ই সুন্দর ও আকর্ষণীয়।'
রহস্য সমাধানের ধরনের জন্যও পোয়ারোর জনপ্রিয়তা আজও অমলিন। তার কাজের ধারা অন্যান্য গোয়েন্দার চেয়ে একেবারেই আলাদা। ছোটখাটো এই মানুষটির রহস্য সমাধানের মূল অস্ত্র 'সুশৃঙ্খল চিন্তা'।'ফাইভ লিটল পিগস'-এ নিজের তদন্তের 'মেথডিক্যাল অ্যাপ্রোচ' নিয়ে তিনি বছেন, রহস্যের সমাধানের জন্য 'পায়ের ছাপের মাপ নেওয়া, সিগারেটের টুকরো খোঁজা বা ঘাস পরীক্ষার প্রয়োজন নেই আমার। চেয়ারে হেলান দিয়ে বসে চিন্তা করাটাই যথেষ্ট।' আবার 'দ্য মিস্ট্রি অফ দ্য ব্লু ট্রেন'-এ আত্মম্ভরী পোয়ারো ঘোষণা করেন, 'আমার নাম এরকুল পোয়ারো, সম্ভবত আমিই পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ গোয়েন্দা'! রহস্য সমাধানে চিন্তাসূত্র উল্টেপাল্টে দেখা বা এই 'নির্মল' আত্মম্ভরিতা ছাড়াও আরো অনেকগুলো কারণ পোয়ারোর তুমুল জনপ্রিয়তায় অনুঘটকের কাজ করেছে। পরিবারজীবনের প্রতি 'দায়বদ্ধতা' (প্রথম উপন্যাসেই যার প্রকাশ ঘটে), নবীনদের প্রতি, বিশেষ করে নবীন যুগলের প্রতি তাঁর প্রচ্ছন্ন স্নেহ ('এলিফ্যান্টস ক্যান রিমেম্বার', 'থ্রি অ্যাক্ট ট্র্যাজেডি', 'মিসেস ম্যাকগিন্টি'জ ডেড' ) ব্যক্তি-শ্রেণি নির্বিশেষে নির্দোষের পাশে দাঁড়ানো ('কার্ডস অন দ্য টেবল', 'ফাইভ লিটল পিগস' ) সহ একাধিক বিষয় জড়িয়ে আছে পোয়ারোর আবেদনের সঙ্গে।
রহস্যের সমাধান করতে পোয়ারো যে কেবল খুনির মনস্তত্ত্বে ঢুকে পড়েন তা নয়, উঁকি মারেন ভিক্টিমের মনস্তত্ত্বেও। মানবচরিত্র নিখুঁতভাবে পড়তে পারেন তিনি। আর মানবচরিত্র ১০০ বছর আগে যেমন ছিল, আজও কমবেশি তেমনি আছে। ফলে আজ ১০০ বছর পরও প্রাসঙ্গিকতা হারাননি এ বেলজিয়ান গোয়েন্দা।

পর্দায় পোয়ারো
অসংখ্য সিনেমা ও টিভি সিরিয়ালে হাজির হয়েছেন পোয়ারো। তার চরিত্রে অভিনয় করেছেন চার্লস লটন, অ্যালবার্ট ফিনে, অরসন ওয়েলস, পিটার উস্তিনভ, ইয়ান হম, ডেভিড সুশের মতো নামীদামি তারকারা। পোয়ারোর চরিত্রে প্রথম অভিনয় করেন চার্লস লটন, 'দ্য মার্ডার অফ রজার অ্যাকরয়েড' অবলম্বনে নির্মিত নাটক 'অ্যালিবাই'-তে। রুপালি পর্দায় প্রথম পোয়ারো হিসেবে হাজির হন অস্টিন ট্রেভর। তবে এ দুঁদে গোয়েন্দার চরিত্রে অভিনয় করে সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়তা ও খ্যাতি কুড়িয়েছেন পিটার উস্তিনভ ও ডেভিড সুশে।
১৯৭৮ সালে নির্মিত 'মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস'-এ তো রীতিমতো তারার হাট বসিয়েছিলেন নির্মাতা সিডনি লুমেট। শন কনোরি, ইনগ্রিড বার্গম্যান, লরেন ব্যাকল, মাইকেল ইয়র্কের মতো বাঘা বাঘা সব অভিনেতারা কাজ করেছিলেন এ ছবিতে। এ ছবির জন্য সেরা পার্শ্ব-অভিনেত্রীর জন্য অস্কারও বাগিয়ে নিয়েছিলেন ইনগ্রিড বার্গম্যান। পোয়ারো রূপে সবচেয়ে বেশিবার পর্দায় হাজির হয়েছেন ডেভিড সুশে। প্রায় ২৫ বছর ধরে অন্তত ৭০টি টিভি মুভিতে পোয়ারোর ভূমিকায় অভিনয় করেছেন তিনি। ২০১৭ সালে পোয়ারো রূপে পর্দায় হাজির হন পরিচালক ও অভিনেতা কেনেথ ব্রানাগ, 'মার্ডার অন দি ওরিয়েন্ট এক্সপ্রেস'-এ। এ ছবির সাফল্যের পর আবার তিনি হাজির হচ্ছেন 'ডেথ অন দ্য নাইল' নিয়ে।

দেশে দেশে পোয়ারো
এরকুল পোয়ারোর জনপ্রিয়তা আন্দাজ করার জন্য বিশ্বের সর্বাধিক অনূদিত বইয়ের লেখিকার নাম জানাই যথেষ্ট—আগাথা ক্রিস্টি। গোটা বিশ্বে ১০৩টিরও বেশি ভাষায় ৭ হাজারবারেরও বেশি অনূদিত হয়েছে আগাথা ক্রিস্টির বই। এর মধ্যে বড় একটা অংশ পোয়ারো সিরিজের বই। গত শতকের মাঝামাঝিতে ক্রিস্টির বইগুলো আরবিতে অনুবাদ হওয়ার পরই চড়চড় করে বেড়ে যায় তার জনপ্রিয়তার পারদ। আলজিয়ার্স থেকে কায়রো, আম্মান থেকে দামেস্ক—সর্বত্রই মুড়িমুড়কির মতো বিক্রি হতে থাকে তার বই। সে জনপ্রিয়তার ঢেউ এসে লাগে বাংলা ভাষায়ও। কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী অনুবাদ করেন পোয়ারোর একটি বই—'দ্য বিগ ফোর'।
বাংলাদেশে আগাথা ক্রিস্টি তথা এরকুল পোয়ারো চর্চায় পথ দেখায় সেবা প্রকাশনী। সেই সত্তরের দশক থেকে তারা একে একে প্রকাশ করে আসছে অনেকগুলো ক্রিস্টির বইয়ের অনুবাদ ও অ্যাডাপ্টেশন। তাদের হাত ঘুরে ক্রিস্টি-চর্চার মশাল এখন নবীন প্রকাশক ও অনুবাদকদের হাতে। বিবলিওফাইল প্রকাশনীর উদ্যোগে এই প্রথম বাংলা ভাষায় প্রকাশিত হচ্ছে আগাথা ক্রিস্টির সমস্ত লেখার অনুমোদিত অনুবাদ।

পোয়ারোর প্রয়াণ
প্রায় সব বিখ্যাত চরিত্রের স্রষ্টাই একসময় নিজের সৃষ্টি করা চরিত্রের ওপর তিতিবিরক্ত হয়ে ওঠেন। নিজের সৃষ্ট চরিত্রকে নিজের চেয়ে বেশি বিখ্যাত হয়ে উঠতে দেখেই বোধহয় এমনটা হয়। আগাথা ক্রিস্টিও এর ব্যতিক্রম নন। এক পর্যায়ে পোয়ারোকে তার কাছে বিরক্তিকর, অহংকারী, অসহ্য মনে হতে থাকে। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষ দিকে মেরে ফেললেন পোয়ারোকে। তখনই অবশ্য সে বই প্রকাশ করেননি, তালাবন্ধ করে রাখেন। তার প্রায় ৩০ বছর পর, ১৯৭৫ সালে বইটি প্রকাশ পায় 'কার্টেন: পোয়ারো'স লাস্ট কেস' নামে। এ কাহিনিতে পোয়ারো ও হেস্টিংসকে আবার ফিরিয়ে নেওয়া হয় স্টাইলসে। যে ইতিহাস শুরু হয়েছিল ১৯২০-এ স্টাইলস-এ, সে বৃত্ত সম্পূর্ণ হলো সেই স্টাইলসেই।
বিদায় নিলেন পোয়ারো, কিন্তু তার আগে রহস্য-কাহিনির মর্যাদা বাড়িয়ে দিয়ে গেলেন কয়েক ধাপ।

শেষ হয়েও হলো না শেষ
ক্রিস্টি তার গোয়েন্দাকে মেরে ফেললেও, তার পরিবারের অনুরোধে পোয়ারোকে ফিরিয়ে আনেন লেখিকা সোফি হানা। ১৯৩০-এর দশকের প্রেক্ষাপটে ফেলে লিখে ফেলেন 'দ্য মনোগ্রাম মার্ডারস'। এ বইয়ের সাফল্যের ধারাবাহিকতায় তারপর লিখে ফেলেছেন আরো ৩টি বই। এ বছরই বেরিয়েছে এ সিরিজের নতুন বই 'দ্য কিলিংস অ্যাট কিংফিশার হিল'।
রহস্য-কাহিনিতেও যে সাহিত্যগুণ থাকতে পারে, এ ধারার লেখাও যে সময়কে জয় করে টিকে থাকতে পারে সগর্বে, তা-ই প্রমাণ করেছেন প্রথমে স্যার আর্থার কোনান ডয়েল এবং তারপর আগাথা ক্রিস্টি। তাদের সৃষ্টি করা চরিত্র, শার্লক হোমস ও এরকুল পোয়ারোর হাত ধরে রহস্য-সাহিত্য পেল সম্মানের আসন। ১৯২০ সালে রহস্য-সাহিত্যের যে ঝাণ্ডা উড়িয়েছিলেন গুঁফো গোয়েন্দা এরকুল পোয়ারো, তা আজও উড়ে চলেছে সগর্বে।

(লেখাটি ইংরেজি দৈনিক দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড-এর অনলাইন বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত।)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০২১ দুপুর ২:০৫
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×