somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোম্পানি বেগম মিসেস মীর জাফর

২৪ শে মে, ২০২১ রাত ৯:১৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


নবাব মীর জাফরের স্ত্রী, মুন্নী বেগমের জীবনেতিহাস তার সমসাময়িক বিখ্যাত সার্ধনার রাজকন্যা বেগম সামরুর মতোই রোমাঞ্চকর। চরম দারিদ্র্যের মাঝে বেড়ে ওঠা এ নারী পরবর্তীতে বাংলার রাজপ্রতিনিধি এবং গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের বিশ্বস্ত বন্ধুতে পরিণত হন।
তার জন্ম নীচু ঘরে। তিনি ছিলেন সম্রাট আকবরের সমাধিস্থল সিকান্দ্রার নিকটবর্তী গ্রাম বালকুন্ডার এক গরিব বিধবার মেয়ে। ভরণপোষণ করার সামর্থ্য না থাকায় তার মা তাকে সাম্মেন আলি খানের ক্রীতদাসী, বিশুর কাছে বিক্রি করে দেয়। বিশু ৫ বছর দিল্লিতে ছিল। এ সময় সে নাচ শিখিয়ে মুন্নীকে নৃত্যশিল্পী হিসেবে গড়ে তোলে। বিশুর নাচের দলের সদস্য হিসেবে ভারতের বিভিন্ন রাজদরবারে যেতেন মুন্নী। অপরূপ সৌন্দর্য এবং নৃত্যপ্রতিভার জন্য দূর-দূরান্তে তার খ্যাতি ছড়িয়ে পড়ে। নবাব শাহমাত জং (নওয়াজিশ মুহাম্মদ খান) তার পোষ্যপুত্র ইকরাম-উদ-দৌলার (সিরাজ-উদ-দৌলার ছোট ভাই) বিয়েতে, ১০,০০০ রুপি সম্মানী দিয়ে, বিশুর নাচের দলের মেয়েদের মুর্শিদাবাদে ডেকে নেন। সেখানে মুন্নী বেগম তার সৌন্দর্য, সংগীত ও নৃত্যশৈলীতে অভিজাতদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। মুর্শিদাবাদে নৃত্যশিল্পীদের ভালো কদর থাকায় অনুষ্ঠান শেষে নাচের দলটি সেখানেই থেকে যায়। মুর্শিদাবাদ সে সময় লন্ডনের মতোই বড়, জনাকীর্ণ ও সমৃদ্ধ শহর ছিল। মীর জাফর দলটিকে মাসিক ৫০০ রুপিতে ভাড়া করেন। মুন্নী বিবির রূপ আর নৃত্যপ্রতিভা অচিরেই তার মন কেড়ে নেয়। তাকে তিনি নিজের হারেমে নিয়ে যান। পরবর্তীতে সাম্মেন আলি খানের মেয়ে বাবুও তার জেনানা মহলে জায়গা করে নেয়।
মুন্নী বেগমের গুণ, চাতুর্য আর মনিবের জন্য তার আন্তরিক ভালোবাসা তাকে মীর জাফরের হারেমের প্রধান বেগমে পরিণত করে। মুন্নীর দাপটে আড়ালে চলে যান মীর জাফরের বৈধ পত্নী শাহ খানমও। এই ক্ষমতার বদৌলতে পরবর্তীতে সিরাজ-উদ-দৌলার প্রাসাদ হীরা ঝিল থেকে মীর জাফরের নিয়ে আসা সমস্ত ধন-সম্পদের অধিকারী হন মুন্নী। মীর জাফরের ঔরসে তার গর্ভে দুই ছেলে জন্মায়—নাজম-উদ-দৌলা ও সাইফ-উদ-দৌলা। বাবু বেগমের ছিল এক ছেলে—মোবারক-উদ-দৌলা।


মোতি ঝিলের প্রাসাদ

১৭৬৫ সালের ৫ ফেব্রুয়ারি মুর্শিদাবাদে মারা যান মীর জাফর। তার মৃত্যুর পর নিজের ছেলেকে মসনদের উত্তরাধিকারী বানানোর জন্য ইংলিশ কোম্পানিকে বিস্তর ঘুস দেন মুন্নী বেগম। মীর জাফরের একমাত্র বৈধ সন্তান মিরনের দাবি নাকচ করে দিয়ে মুন্নী বেগমের ১৫ বছর বয়সি পুত্র নাজম-উদ-দৌলাকে সিংহাসনে বসায় কলকাতার কাউন্সিল। তার রাজত্বকালেই মীর জাফরের রেখে যাওয়া ৫ লক্ষ রুপি রবার্ট ক্লাইভের হাতে তুলে দেন মুন্নী বেগম। ৩ লাখ ৫০ হাজার রুপি দেওয়া হয় নগদ টাকায়, ৫০ হাজার দেওয়া হয় রুপিতে এবং বাকি এক লাখ দেওয়া হয় স্বর্ণমুদ্রায়।
ক্লাইভ এই টাকা দিয়ে একটা ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করেন। সেই ট্রাস্ট থেকে কোম্পানির চাকরিরত অবস্থায় আহত হওয়া কর্মচারীদের ও মৃত সৈন্যদের বিধবা স্ত্রীদের সাহায্য করা হতো। এছাড়াও নানা দুর্যোগে ত্রাণের ব্যবস্থাও করা হতো ট্রাস্ট থেকে।
১৭৬৬ সালের ৮ মে জ্বরে আক্রান্ত হয়ে মারা যায় নাজম-উদ-দৌলা। এরপর সিংহাসনে বসে তার ছোট ভাই। তারও অকালমৃত্যু হয় (১৭৭০ সালের মার্চে)। তারপর সিংহাসনে বসানো হয় বাবু বেগমের ১২ বছর বয়সি পুত্র মোবারক-উদ-দৌলাকে।
দুই ছেলের শাসনকালে সত্যিকার অর্থে প্রাসাদের ওপর ছড়ি ঘোরাতেন মুন্নী বেগম। প্রাসাদের যাবতীয় ব্যয় নির্বাহের দায়িত্ব পালন করতেন তিনি। কর্মচারীদের বেতন, জেনানা মহলের ভরণ-পোষণ, অতিথি আপ্যায়ন এবং ধর্মীয় বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের জন্য প্রতি মাসে তাঁর মাধ্যমে প্রায় ২৩ হাজার রুপি খরচ হতো। সে সময় বাবু বেগম ছিলেন একেবারেই অন্তরালে। কিন্তু সৎ ছেলে মোবারক-উদ-দৌলা মসনদে বসতেই মুন্নী বেগমের সমস্ত কর্তৃত্বের ইতি ঘটে। তার মাত্রাতিরিক্ত দম্ভ ও খবরদারিতে ভীষণ অপমানিত বোধ করেছিলেন নায়েব রেজা খান। এবার তিনি মুন্নীর জায়গায় বাবু বেগমকে বসানোর চেষ্টা করতে লাগলেন। দুই বেগমের মাঝে তিনি এমন দ্বন্দ্ব সৃষ্টি করলেন যে তাদের মুখ দেখাদেখি পর্যন্ত বন্ধ হয়ে গেল। নবাবির ওপর নিজের ছেলের দখল দাবি করে বাংলার তৎকালীন গভর্নর কার্টিয়ারের কাছে আবেদন করলেন বাবু।
তিনি যে শোচনীয় অবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছিলেন, তা জানা ছিল না কার্টিয়ারের। তার ধারণা ছিল মুন্নী বেগমের মতোই আরাম-আয়েশ ও ঐশ্বর্যের মাঝেই দিন কাটছে বাবুরও। অভিযোগ পাওয়ার সাথে সাথে দুই বেগমের অবস্থা সম্পর্কে জানতে চেয়ে তিনি মুর্শিদাবাদে, নায়েব দিওয়ানের কাছে চিঠি লেখেন। জবাবে রেজা খান জানান নবাবির ওপর বৈধ অধিকার বাবু বেগমের। তিনি পরামর্শ দেন দুই বেগমকে সমান ক্ষমতা ও মর্যাদা দেওয়াই সবচেয়ে ভালো হবে।
এ পরামর্শ গভর্নরের পছন্দ হলো না। তার মনে হলো, এই ব্যবস্থায় দুই বেগমের দ্বন্দ্ব দূর তো হবে না-ই, উল্টো রেষারেষি আরও বেড়ে যাবে। তিনি সিদ্ধান্ত নিলেন, প্রকৃত ক্ষমতা বাবু বেগমকে দেওয়া হবে, তবে শিষ্টাচার ও আনুষ্ঠানিকতা হিসেবে মুন্নী বেগমকে তিনি গুরুজন হিসেবে সম্মান করে চলবেন। এই আদেশ দিয়ে ১৭৭০ সালের ৭ জুন তিনি মুন্নী বেগমের কাছে চিঠি পাঠান। তাতে লেখেন, বর্তমানে নিজামতের মসনদে যেহেতু মোবারক-উদ-দৌলা অধিষ্ঠিত আছেন, তাই প্রাসাদের নিয়ন্ত্রণও তার মায়ের হাতে ছেড়ে দেওয়াই ভালো। মুহাম্মদ রেজা খান ও মি. বেচার (মুর্শিদাবাদে কোম্পানির প্রতিনিধি) কেল্লায় গিয়ে বাবু বেগমের সঙ্গে দেখা করেন। গভর্নরের হুকুমমতো প্রাসাদের সমস্ত ক্ষমতা তুলে দেন তার হাতে।


মীর জাফর ও তার পুত্র মীরন

এভাবে বাবু বেগমকে কর্তৃত্বে অধিষ্ঠিত করলেন রেজা খান। চতুর মুন্নী ভান করলেন এই পরিবর্তন যেন তার চোখেই পড়েনি। মনে ভীষণ কষ্ট পেলেও কারো কাছে কোনো ব্যাখ্যা দাবি করেননি। মুখে একেবারে কুলুপ এঁটে দিলেন তিনি। কিন্তু বাবু বেগমের কর্তৃত্বও বেশিদিন টিকল না।
মুহাম্মদ রেজা খান আগে ছিলেন ঢাকার গভর্নর এবং লর্ড ক্লাইভের বন্ধু। অপ্রাপ্তবয়স্ক নবাব নাজম-উদ-দৌলার শাসনামলে তাকে বাংলার নায়েব নাজিম, অর্থাৎ সহকারী-শাসক নিয়োগ দেওয়া হয়। তার উপাধি হয় মোজাফফর জং। একাধারে নায়েব দিওয়ান ও নায়েব নাজিম হিসেবে সাইফ-উদ-দৌলা ও মোবারক-দৌলা উভয়ের আমলেই কার্যত বাংলার গভর্নরে পরিণত হন তিনি। ধীরে ধীরে তিনিই প্রশাসনের সবগুলো বিভাগের নিয়ন্ত্রকে পরিণত হন।
তবে রেজা খানের প্রশাসনকে অযোগ্য মনে করা হয়। তার সময়ে জুলুম ও অবিচারের চাপে পিষ্ট হয়ে গুমরে মরছিল চাষিরা। কমে গিয়েছিল ফসলের ফলন। ১৭৬৯-৭০ সালের দুর্ভিক্ষ ও মহামারিতে বাংলার এক-তৃতীয়াংশ জনসংখ্যা মারা যায়। এরকম দুর্ভিক্ষ ও মৃত্যুর ঘটনা বাংলার ইতিহাসে নজিরবিহীন। তাছাড়া ব্রিটিশবিরোধী সন্ন্যাসীদের তৎপরতার কারণেও গোটা দেশ অস্থির হয়ে উঠেছিল। এ ছিল বাংলার ইতিহাসে সবচেয়ে কালো অধ্যায়। কোম্পানির কর্মচারীরা তখন সীমাহীন ক্ষমতা ভোগ করত। দায়িত্ব বা জবাবদিহির বালাইও ছিল না তাদের জন্য। স্থানীয়দেরকে বিদেশি অত্যাচারীদের হাত থেকে বাঁচানোর মতো কেউ ছিল না। পরিস্থিতি দেখে ইংল্যান্ডের পরিচালকরা শঙ্কিত হয়ে ওঠেন। ওয়ারেন হেস্টিংসকে বাংলার গভর্নর করে পাঠানো হয় সমস্যার সমাধান করার জন্য। ১৭৭২ সালের এপ্রিলে তিনি কার্টিয়ারের কাছ থেকে দায়িত্ব বুঝে নেন। কলকাতায় পৌঁছেই তিনি জালিয়াতি ও অর্থ আত্মসাতের অভিযোগে রেজা খানকে গ্রেপ্তার করে কলকাতায় এনে বিচার করার হুকুম দেন। তদন্তে রেজা খান দোষী সাব্যস্ত হন এবং তাঁকে পদচ্যুত করা হয়।
রেজা খানকে বাংলার প্রশাসকের পদ থেকে সরিয়ে কোম্পানি এবার নিজস্ব কর্মচারী দিয়ে এ কাজ চালানোর সিদ্ধান্ত নেয়। স্থির হয়, রাজস্বও তারা নিজেরাই সংগ্রহ করবে। বিভিন্ন জেলায় জায়গায় বসেই তৎক্ষণাৎ ভূমি রাজস্বের সমস্যা মীমাংসা করার জন্য হেস্টিংসকে সভাপতি করে একটা সার্কিট কমিটি গঠন করা হয়। কমিটি যখন কাশিমবাজারে ছিল, হেস্টিংস তখন নবাবের প্রাসাদে যান। ৫০ বছর বয়সি মুন্নী বেগমকে বাৎসরিক ১ লক্ষ ৪০ হাজার রুপি ভাতার বিনিময়ে নবাবের মহলের তত্ত্বাবধান ও তার অভিভাবকত্বের দায়িত্ব নেওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হয়। তার সহকারী করা হয় নন্দ কুমারের ছেলে রাজা গুরুদাসকে। এর আগে মুন্নী বেগম মাসিক ৬,০০০ রুপি ভাতা পেতেন।
কিন্তু নবাবের নিজের মায়ের বদলে মুন্নী বেগমকে তার অভিভাবক নিয়োগ দেওয়াটা ছিল অস্বাভাবিক ও ব্যতিক্রমী ঘটনা। পদক্ষেপটাকে বৈধতা দেবার জন্য হেস্টিংসকে ব্যবস্থা নিতে হয়েছিল। ১৭৭২ সালের ৮ অক্টোবর তিনি এ ব্যবস্থার সমর্থনে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এক পরিচালক, জোসিয়াস ডুপ্রে-কে লেখেন:
'এই পদক্ষেপ অত্যন্ত সূক্ষ্মভাবে বিচার-বিবেচনা করে নিতে হয়েছে। ...তবে নবাবকে সহজেই বুঝিয়ে-শুনিয়ে এ প্রস্তাবে রাজি করানো গেছে—তিনি কোনো আপত্তি করেননি। ...পরে দুই ভদ্রমহিলার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দিতে এবং দুজনকে মুখোমুখি বসিয়ে কথা বলাতেও সমর্থ হয়েছি আমি।'
গুজব ছড়িয়েছিল মুন্নী বেগমের টাকার বিনিময়েই তার পক্ষে সমর্থন দেন হেস্টিংস। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে তার উদ্দেশ্য ছিল দুই বেগমের ক্ষমতার দ্বন্দ্ব মিটিয়ে দেওয়া। টানা সাত বছর নিজামতের প্রতিটা অলি-গলিতে একচ্ছত্র ক্ষমতার অধিকারী ছিলেন রেজা খান। রাজ্যের অঘোষিত নাজিম ছিলেন তিনি। বর্তমানে বেকায়দায় থাকলেও নবাবের প্রাসাদ ও রাজধানীতে তার প্রভাব তেমন একটা কমেনি বললেই চলে। মূলত তার 'প্রভাব-প্রতিপত্তি নির্মূল করার জন্যই' মুন্নী বেগম ও রাজা গুরুদাসকে নবাবের অভিভাবক নিযুক্ত করা হয়। দুজনেই রেজা খানের শত্রুতে পরিণত হন। নবাবের নিজের মা, বাবু বেগমকে ক্ষমতার কেন্দ্র থেকে সরিয়ে দেওয়ার এটিও একটা কারণ। মনে-প্রাণে রেজা খানের মিত্র ও শুভাকাঙ্ক্ষী ছিলেন তিনি।
মুন্নী বেগমকে কেন নবাবের অভিভাবক নিয়োগ দিলেন, তা ব্যাখ্যা করে ১৭৭২ সালের ১ সেপ্টেম্বর ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে চিঠি লেখেন হেস্টিংস:
'মুন্নী বেগমকে নিয়োগ দেওয়ার ফলে, আমার বিশ্বাস, পস্তাতে হবে না। এটি ছিল সর্বসম্মত সিদ্ধান্ত। আর আমার যদি জনসাধারণের মতামত বুঝতে ভুল না হয়ে থাকে, তাহলে এই সিদ্ধান্তে মোটের ওপর সবাই-ই খুশি হয়েছে।'
তিনি আরও লেখেন, এ পদে মুন্নী বেগম ছাড়া কেবল ইহতিশাম-উদ-দৌলাই ছিলেন নিয়োগ পাওয়ার মতো। তিনি ছিলেন মীর জাফরের ভাই। কিন্তু এ দায়িত্ব পেলে ইহতিশাম-উদ-দৌলা সিংহাসনের খুব কাছাকাছি চলে আসতেন। সেক্ষেত্রে তিনি কিছু না করলেও তার ছেলেদের কেউ সুবার ওপর নিজের অধিকার দাবি জানিয়ে বসতে পারত। ফলে অনাকাঙ্ক্ষিত ঝামেলা সৃষ্টি হতো।
অন্যদিকে নারী হিসেবে চারপাশের বাধা অতিক্রম করা বেগমের পক্ষে সম্ভব ছিল না। এরচেয়ে বেশি সম্মানজনক পদ পাবার সুযোগও তার ছিল না। জীবিত কোনো পুত্রও তার ছিল না যাকে মসনদে বসাবার জন্য তিনি বিশ্বাসঘাতকতা করতে পারেন। বস্তুত বেগমের প্রকৃত ক্ষমতার পুরোটাই নির্ভর করছে নবাবের জীবনের ওপর। কাজেই নবাবের জীবনকে ঝুঁকির মুখে ফেলার মতো কোনো কাজই তিনি করবেন না। নবাব যতদিন প্রাপ্তবয়স্ক না হচ্ছে, ততদিন সবদিক থেকেই তিনি কোম্পানির ওপর নির্ভরশীল। আবার প্রাপ্তবয়স্ক হবার পর নবাবই হয়ে উঠবেন তার কর্তা। কাজেই কোম্পানির সমস্ত কাজে সমর্থন দেওয়াই হবে মুন্নী বেগমের মুখ্য উদ্দেশ্য।
ওয়ারেন হেস্টিংস গভর্নর-জেনারেল হিসেবে নিয়োগ পান ১৭৭৪ সালের ২০ অক্টোবর। সেইসাথে চার সদস্যের নতুন কাউন্সিলও গঠন করা হয়। তাদের মধ্যে তিনজন কাউন্সিলর—মি. ফ্রান্সিস, জেনারেল ক্লেভারিং ও কর্নেল মনসন—একই মাসে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে আসেন। তারা পৌঁছানোর পর কাউন্সিলে প্রবল মতবিরোধ দেখা দেয়। হেস্টিংসের দলে তার সঙ্গে ছিলেন রিচার্ড বারওয়েল। নবাগত তিনজনের সাথে হেস্টিংসের দলের বিরোধ এমনই চরমে পৌঁছায় যে প্রকাশ্য কেলেঙ্কারি বেধে যাওয়ার উপক্রম হয়। এই বিরোধের ফলে গভর্নর-জেনারেলের পুরনো শত্রুরা তার ওপর প্রতিশোধ নেওয়ার সুবর্ণ সুযোগ পেয়ে যায়। হেস্টিংসের বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও অত্যাচারের অভিযোগ এনে সুপ্রিম কাউন্সিলের কাছে নালিশ করে বসেন মহারাজা নন্দ কুমার। এসবের মাঝে মুন্নী বেগমের কাছ থেকে দেড় লাখ রুপি ঘুষ খেয়ে তাকে নবাবের অভিভাবক নিয়োগ দেওয়ার অভিযোগও আনা হয় হেস্টিংসের বিরুদ্ধে। কিন্তু বেগম দাবি করেন, টাকাটা গভর্নর-জেনারেলকে আপ্যায়নের জন্য পাঠানো হয়েছিল। আপ্যায়নের এই প্রথা বহু প্রাচীন—মুর্শিদাবাদে এর আগেও যত গভর্নর এসেছেন তাদের সবাইকে দৈনিক ২,০০০ রুপি দিয়ে আপ্যায়ন করা হয়েছে।
কিন্তু তিনজন থাকায় বিরোধীপক্ষ দলে ভারী ছিল। মুন্নী বেগমের প্রাসাদ-পরিচালনায় তারা সন্তুষ্ট ছিলেন না। তাই ১৭৭৫ সালের মে মাসে তাকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেন তারা। সমস্ত কর্তৃত্ব দেওয়া হয় রাজা গুরুদাসকে। বেগমকে দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ার পক্ষে সাফাই দিতে গিয়ে ১৭৭৫ সালের ১৫ সেপ্টেম্বরে কোর্ট অফ ডিরেক্টরসদের কাছে লেখা চিঠিতে তিন কাউন্সিলর বলেন:
'…তিনি নবাবের আপন মা নন। জন্মসূত্রেও কোনো সম্ভ্রান্ত ঘরের মহিলা নন। সূত্রমতে, তিনি প্রকৃতপক্ষে একজন ক্রীতদাসী ও নর্তকী। আমাদের বিবেচনায় তিনি স্রেফ নবাবের রাজস্ব সংগ্রহের জন্য গভর্নরের হাতের পুতুল।
'…নবাব ও তার পরিবারের বর্তমান বেহাল দশা, তার পাওনাদারদের উৎপাত এবং যে শোচনীয় ও অসম্মানজনক অবস্থায় তাকে রাখা হয়েছে, এসব দেখেই স্পষ্ট বোঝা যায় তার রাজস্বের কেমন দেখভাল করেছেন এই মহিলা। …মি. গ্রান্টের পেশ করা হিসাব খতিয়ে দেখা হচ্ছে। ১৭৭২ সালে নবাবের পেনশনের হিসাবে ১৪ লাখ রুপি বেশি লেখা আছে। একে তথ্যগত ত্রুটি বলে স্বীকার করে নিয়েছেন মি. হেস্টিংস। ধারণা করা হচ্ছে, বর্তমানে নবাবের দেনা ৯ লক্ষ রুপি...।'

মুন্নী বেগমকে সরিয়ে দেওয়ায় ভীষণ মুষড়ে পড়েন হেস্টিংস। ১৭৭৬ সালের ২১ মার্চ মি. লরেন্স সুলিভানের (পরবর্তীতে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির চেয়ারম্যান) কাছে লেখা চিঠিতে তিনি নিজেকে নির্দোষ দাবি করেন। বলেন, তিনি যা করেছিলেন তা কোম্পানির স্বার্থ রক্ষার্থেই করেছিলেন।
সমস্ত বিপদে-আপদেও আজীবন হেস্টিংসের বিশ্বস্ত বন্ধু ছিলেন মুন্নী বেগম।
হেস্টিংসের প্রতি মুন্নী বেগমের কৃতজ্ঞ থাকার পেছনে যুক্তিসংগত কারণও ছিল। যতদিন ভারতে ছিলেন, ততদিন বেগমের স্বার্থ রক্ষার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন হেস্টিংস। ১৭৮৩ সালের ৩ নভেম্বর, ভারত ছাড়ার প্রাক্বালে, বেগমের প্রশংসা করে কোর্ট অফ ডিরেক্টরসের কাছে চিঠি লেখেন তিনি। তাদের কাছে অনুরোধ করেন, শেষ বয়সে যেন বেগমকে স্বাচ্ছন্দ্যে জীবনযাপন করার জন্য মোটা টাকা ভাতা দেওয়া হয়। বেগমের আর্জি সমেত, কাউন্সিলকে কিছু না জানিয়েই, চিঠিখানা কোর্টের কাছে পাঠান হেস্টিংস।
ডিরেক্টররা বেগমের আর্জি সমেত হেস্টিংসের চিঠির একটা অনুলিপি পাঠিয়ে দেন গভর্নর-জেনারেল ও কাউন্সিলের কাছে। সাথে নির্দেশ দেন মীর জাফরের সব আত্মীয়-স্বজনের দুর্দশা যেন যথাসম্ভব দূর করা হয়। আর নবাব ও তার পরিবারকে যেন এমন আর্থিক ব্যবস্থা করে দেওয়া হয় যাতে তারা আরাম-আয়েশে জীবন কাটাতে পারেন।
মুন্নী বেগমকে রাজপ্রতিনিধির দায়িত্ব থেকে সরিয়ে দেওয়ায় নামমাত্র স্বাধীনতা পান মোবারক-উদ-দৌলা। হাতে বিপুল সম্পত্তি ও লোকজন থাকায় দায়িত্ব থেকে অব্যাহতি পাওয়ার পরও নবাবের সম্পূর্ণ পরিবারের ওপর নিয়ন্ত্রণ ছিল বেগমের। তাছাড়া তার টাকা ও রত্নভাণ্ডার পাবার স্বপ্নও ছিল মোবারক-উদ-দৌলার। তার এই দুর্বলতার সুযোগ নিতেন বেগম। নবাবকে তিনি প্রায়শই হুমকি দিতেন, তার কথা না শুনলে সমস্ত ধন-সম্পদ গরিব আর ফিরিঙ্গিদের মাঝে বিলিয়ে দেবেন। এ ভয়ে তার সব কথা মেনে চলতেন নবাব। দেখা যাচ্ছে, বেগমকে কেউ ভালো না বাসলেও ভয় পেত ঠিকই। মাসে ১২,০০০ রুপি ভাতায় মুর্শিদাবাদে রাজকন্যার সম্মান নিয়ে আয়েশি জীবনযাপন করতে থাকেন তিনি।
১৭৮৩ সালের ৬ সেপ্টেম্বর মোবারক-উদ-দৌলা মারা যান। এরপর মসনদে বসেন তার ছেলে বাবর আলি খান ওরফে দ্বিতীয় মোবারক-উদ-দৌলা। তার সময়ে (১৮০৪) লর্ড ভ্যালেনশিয়া এসেছিলেন মুর্শিদাবাদ সফরে। নবাব ও মুন্নী বেগম উভয়ের সঙ্গেই দেখা করেন তিনি। তার বর্ণনা থেকে জানা যায়, এক একর জমির ওপর তৈরি ছোট একটা বাগানবাড়িতে থাকতেন বেগম। মীর জাফরের স্মৃতির সম্মানে টানা চল্লিশ বছর এখানে থাকেন তিনি। ভ্যালেনশিয়ার সঙ্গে কথা বলেছিলেন একটা টকটকে লাল রেশমের পর্দার আড়াল থেকে। যে কামরায় বসে কথা বলেছেন, সেটি ছিল জাঁকজমকপূর্ণ। তার কণ্ঠস্বর ছিল চড়া ও কর্কশ—তবে মাঝে মাঝে কাঁপা গলায় কথা বলতেন। অল্পতেই প্রচণ্ড রেগে উঠলেও তিনি ছিলেন সমঝদার মানুষ। সাংঘাতিক ধনী ছিলেন তিনি, কিন্তু তার মৃত্যুর পর এ সম্পত্তির কী ব্যবস্থা হবে তা ঠিক হয়নি। কিছুতেই তাকে উইল করতে রাজি করানো যায়নি। আভাসে-ইঙ্গিতেও মৃত্যুর কথা তুললে উন্মত্তের মতো হয়ে যেতেন বেগম। ভ্যালেনশিয়ার বর্ণনানুসারে, সত্তর বছর বয়স্ক মুন্নী বেগম ছিলেন খাটো ও স্থূলকায়। হুঁকার নেশা ছিল তার। ব্যক্তিগত কর্মচারীদেরকে কর ফাঁকি দিয়ে চোরাচালান ও মাদক ব্যবসায় উৎসাহ দিতেন তিনি।
১৮১০ সালের ২৮ এপ্রিল মারা যান বাবর আলি খান। তার মৃত্যুর পরই শুরু হয় মসনদ নিয়ে দ্বন্দ্ব। মোবারক-উদ-দৌলার দ্বিতীয় পুত্র ও বাবর আলির ভাই সৈয়দ আবুল কাশিমকে সমর্থন দেন মুন্নী বেগম। লোকে তাকে মুংলি সাহেব বলে ডাকত। বেগম তাকে মসনদে বসানোর জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করেন। কিন্তু গভর্নর-জেনারেল লর্ড মিন্টো সমর্থন দেন বাবর আলির জ্যেষ্ঠ পুত্র আলী জাহকে। ১৮১০ সালের ৫ জুন তাকেই বসানো হয় মসনদে।
অল্প যে কজন নারী শাসক পৃথকভাবে দেওরি বা ভাতা পেয়েছিলেন, মুন্নী বেগম ছিলেন তাদেরই একজন। এই নারীরা পরিচিত ছিলেন গাদিনাশিন বেগম নামে। তিনি ও বাবু বেগম দুজনেই এই শ্রেণিভুক্ত ছিলেন। বাবু বেগমের মাসিক ভাতা ছিল ৮,০০০ রুপি। ১৮০৯ সালের ১৮ নভেম্বর মারা যান তিনি।
মুর্শিদাবাদ প্রাসাদের দক্ষিণ-পুবে অবস্থিত সুদৃশ্য চক মসজিদটি মুন্নী বেগমের স্মৃতিচিহ্ন ধারণ করে দাঁড়িয়ে আছে। ১৭৬৭ সালে নবাব সুজা খানের চেহেল সেতুনের দক্ষিণে তিনি তৈরি করেন শহরের সবচেয়ে বড় এই মসজিদ। চেহেল সেতুনের ভেতরে ছিল দরবারকক্ষ, নহবতখানা, কাছারি, আর আস্তাবল। আর ছিল চল্লিশ থামওয়ালা একটি কনফারেন্স হল।
মুন্নী বেগমকে 'কোম্পানি মাতা' বা 'মাদার অফ দ্য কোম্পানি' উপাধি দেওয়া হয়। স্বামীর মৃত্যুর পর তিনি যখন শোকে-তাপে জর্জরিত, তখন লর্ড ক্লাইভ এসে তাকে বলেন, 'এ কথা সত্যি যে মৃত নবাবকে আমি ফিরিয়ে আনতে পারব না; কিন্তু অন্তরের গভীর থেকে বলছি, আমি বিশ্বাস করি যে আমি এবং সব ইংরেজ ভদ্রলোকই আপনার সন্তান। আপনাকে আমরা নিজেদের মা গণ্য করি। আমরা আপনার সব ইচ্ছা মেনে চলব, কখনো আপনার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কিছু করব না।'
ক্লাইভ ও হেস্টিংসের সঙ্গে দারুণ বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ছিল তার। কথিত আছে, তাদেরকে দেওয়া অঢেল উপহারের বিনিময়েই তিনি 'কোম্পানি মাতা' উপাধি বাগিয়ে নেন। উপাধিলাভের পর রানি ভবানির কাছ থেকে একটা পাল্কি উপহার পান তিনি। সে পাল্কি টানার জন্য ৩০জন বেহারা লাগত। পাল্কির সঙ্গে বেহারাও উপহার দিয়েছিলেন নাটোরের রানি ভবানি। বেহারাদের ভরণ-পোষণের জন্য একটা জমিও উপহার দেন রানি।
মুন্নী বেগম ছিলেন উদারচিত্ত মানুষ। একবার তার এক চাকরানি প্রবল অর্থসংকটে পড়ে যায়। টাকার অভাবে মেয়ের বিয়ে দিতে পারছিল না সে। খবরটা কানে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে তার বাড়িতে ৭০/৮০টি স্বর্ণমুদ্রা সমেত অন্যান্য প্রয়োজনীয় জিনিস পাঠিয়ে দেন বেগম। এছাড়াও এতিম মেয়ে এবং বিধবাদেরকে সাহায্য করতেন তিনি।
প্রবল উদ্যমী ও বুদ্ধিমতী এই নারী ছিলেন প্রচণ্ড উদ্ধত ও কর্তৃত্বপরায়ণ স্বভাবের মানুষ। তবে সেইসাথে ভীষণ একনিষ্ঠ আর বিশ্বস্তও ছিলেন। কোনো বন্ধু বা তার ওপর নির্ভরশীল কারো সঙ্গে কখনো প্রতারণা করতেন না। বনেদি ঘরে জন্ম না নিলেও তিনি ছিলেন অসাধারণ গুণী মানুষ। একবার কোনো কাজে হাত দিলে তাতে সফল হওয়ার কোনো না কোনো উপায় ঠিকই বের করে ফেলতেন। কাজ উদ্ধার হওয়ার আগে কিছুতেই হাল ছাড়তেন না। কিন্তু এত গুণ থাকা সত্ত্বেও শাসক হিসেবে ব্যর্থ ছিলেন তিনি। তার সহকারী ছিল ইতবর আলি নামে এক নীচু মানসিকতার লোক। বেগমের সমস্ত কাজকর্মের দায়িত্ব এই বর্বর, জড়বুদ্ধি লোকটার ওপরই ন্যস্ত ছিল। এই লোকটি বিস্তর সমস্যা ও বিব্রতকর পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিল। বেগম যদি ইতবর আলির ওপর দায়িত্ব না দিয়ে নিজে পর্দার আড়ালে বসে সব কাজের তদারকি করতেন, সবার অভিযোগের খোঁজখবর নিতেন, তাহলে মুর্শিদাবাদের শাসনভার কখনো তার হাতছাড়া হতো না।
শেষ বয়সেও স্থিতধী বজায় রেখে, প্রচণ্ড বুদ্ধিমত্তার সাথে কাজকর্ম করে যান মুন্নী বেগম। স্বামীর মৃত্যুর পর নিজামতের সমস্ত নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবস্থাপনা তিনি নিজের হাতে রেখেছিলেন। প্রশাসনের সাথে জড়িত প্রতিটা বিষয়ের দেখভাল করতেন তিনি। এভাবে স্বামীর মৃত্যুর পর প্রায় অর্ধশতাব্দীকাল ধরে তিনি নিজামত শাসন করেন।
বেগমের দীর্ঘ জীবন ছিল উত্থান-পতনে ভরপুর। স্বামীকে ব্রিটিশদের সাহায্যে মুর্শিদাবাদের মসনদে বসতে দেখেছেন তিনি, তাকে মারা যেতে দেখেছেন। ক্ষমতার কেন্দ্রে এসেছেন, সেখান থেকে আস্তাকুঁড়েও নিক্ষিপ্ত হয়েছেন। নিজের ছেলেকে পেনশনভোগী হতে দেখেছেন। সাধারণ এক নর্তকী থেকে ক্ষমতার শীর্ষে উঠেছেন। কিন্তু একসময় মৃত্যুর কাছে ধরা দিতেই হয়েছে সিকান্দ্রা থেকে উঠে আসা এই নারীকে। ১৮১৩ সালের ১০ জানুয়ারি, শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করেন মুন্নী বেগম। মারা যাবার সময় তার ব্যক্তিগত সম্পত্তির মূল্য ছিল ১৫ লাখ রুপি। জাফরগঞ্জে, প্রাসাদ থেকে মাইল দেড়েক দূরে, মীর জাফরের পারিবারিক কবরস্থানে সমাহিত করা হয় তাকে।
তার মৃত্যুকালীন ও মৃত্যুপরবর্তী ঘটনার বিবরণ পাওয়া যায় পারস্য সরকারের সচিবের কাছে লেখা নিজামতের সুপারিন্টেনডেন্ট মি. টি. ব্রুকের একটা চিঠিতে। সে চিঠিতে তিনি জানান, একেবারেই আকস্মিকভাবে মৃত্যু হয় বেগমের। মারা যাওয়ার আগের রাতেও তিনি মহররমের উৎসব উদযাপনে অংশ নিয়েছিলেন। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠেও অসুস্থ বোধ করছেন বলে কোনো অভিযোগ করেননি। রোজকার মতোই বিভিন্ন কাজকর্মের হুকুম দিচ্ছিলেন। সকাল দশ কি এগারোটার দিকে একেবারেই আকস্মিকভাবে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন তিনি। কারো কাছে কিছু বলে যাবার সুযোগটা পর্যন্ত পাননি। সন্ধ্যা ছয়টার দিকে প্রাসাদ থেকে বেগমকে সমাহিত করার জন্য শবযাত্রা বের হয়। নবাব এবং সুপারিন্টেনডেন্টও যোগ দেন শেষকৃত্যের। প্রথমে মসজিদে জানাজা পড়ানো হয়, সেখান থেকে মৃতদেহ নিয়ে যাওয়া হয় জাফরগঞ্জের পারিবারিক গোরস্থানে। সেখানে রাত ৯টার খানিক আগে সমাধিস্থ করা হয় বেগমকে।
পারিবারিক সূত্রমতে, ধারণা করা হয়, মৃত্যুর সময় বেগমের বয়স হয়েছিল সাতানব্বই বছর।
সুপারিন্টেনডেন্ট মি. ব্রুকের আন্তরিক ইচ্ছা ছিল বেগমকে চিরবিদায় জানাবার সময় ব্রিটিশ সরকারের পক্ষ থেকে যথাযোগ্য মর্যাদা জানানো হবে। কিন্তু বেগমের আকস্মিক মৃত্যু সে সুযোগ দেয়নি না। তারপরও বারহামপুর থেকে মিলিটারি ডিটাচমেন্ট ও কোম্পানির বড় কর্তারা আসার আগ পর্যন্ত শেষকৃত্য স্থগিত রাখার প্রস্তাব করা হয়। কিন্তু প্রবল প্রতিবাদ আর অসন্তুষ্টির মুখে সে প্রস্তাব হালে পানি পায়নি।
বেগমের স্মৃতির প্রতি সম্মান দেখিয়ে ১৮১৩ সালের ১৪ জানুয়ারি সন্ধ্যায় ফোর্ট উইলিয়ামে নব্বইবার তোপধ্বনি করা হয়—অর্ধনমিত রাখা হয় ব্রিটিশ পতাকা।

তথ্যসূত্র: 'Begams of Bengal: Mainly Based on State Records' by Brajendra Nath Banerjee
[লেখাটি ইংরেজি দৈনিক 'দ্য বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড'-এর অনলাইন বাংলা সংস্করণে প্রকাশিত।]
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে মে, ২০২১ দুপুর ১২:৩২
৪টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বরিষ ধরা-মাঝে শান্তির বারি

লিখেছেন বিষাদ সময়, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:১৬





মাসের আধিক কাল ধরে দাবদাহে মানব প্রাণ ওষ্ঠাগত। সেই যে অগ্নি স্নানে ধরা শুচি হওয়া শুরু হলো, তো হলোই। ধরা ম্লান হয়ে, শুষ্ক হয়, মুমূর্ষ হয়ে গেল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=নীল আকাশের প্রান্ত ছুঁয়ে-৭ (আকাশ ভালোবেসে)=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ০৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:১৯

০১।



=আকাশের মন খারাপ আজ, অথচ ফুলেরা হাসে=
আকাশের মন খারাপ, মেঘ কাজল চোখ তার,
কেঁদে দিলেই লেপ্টে যাবে চোখের কাজল,
আকাশের বুকে বিষাদের ছাউনি,
ধ্বস নামলেই ডুবে যাবে মাটি!
================================================
অনেক দিন পর আকাশের ছবি নিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

পানি জলে ধর্ম দ্বন্দ

লিখেছেন প্রামানিক, ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫২


শহীদুল ইসলাম প্রামানিক

জল পানিতে দ্বন্দ লেগে
ভাগ হলোরে বঙ্গ দেশ
এপার ওপার দুই পারেতে
বাঙালিদের জীবন শেষ।

পানি বললে জাত থাকে না
ঈমান থাকে না জলে
এইটা নিয়েই দুই বাংলাতে
রেষারেষি চলে।

জল বললে কয় নাউযুবিল্লাহ
পানি বললে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সমস্যা মিয়ার সমস্যা

লিখেছেন রিয়াদ( শেষ রাতের আঁধার ), ০৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:৩৭

সমস্যা মিয়ার সিঙ্গারা সমুচার দোকানে প্রতিদিন আমরা এসে জমায়েত হই, যখন বিকালের বিষণ্ন রোদ গড়িয়ে গড়িয়ে সন্ধ্যা নামে, সন্ধ্যা পেরিয়ে আকাশের রঙিন আলোর আভা মিলিয়ে যেতে শুরু করে। সন্ধ্যা সাড়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

এই মুহূর্তে তারেক জিয়ার দরকার নিজেকে আরও উন্মুক্ত করে দেওয়া।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৬ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:২৬


তারেক জিয়া ও বিএনপির নেতৃত্ব নিয়ে আমি ব্লগে অনেকবারই পোস্ট দিয়েছি এবং বিএনপি'র নেতৃত্ব সংকটের কথা খুব স্পষ্টভাবে দেখিয়েছি ও বলেছি। এটার জন্য বিএনপিকে সমর্থন করে কিংবা বিএনপি'র প্রতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×