
পাকিস্তানি সৈন্যরা হাত বাঁধা অবস্থাতেই মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিনকে বাঘের খাঁচায় ছুড়ে ফেলল। সালাহউদ্দিন খাঁচার মধ্যে পড়ে গিয়েও ৪/৫ সেকেন্ড পরেই উঠে বসলেন। একটা চিতাবাঘ গরগর শব্দ করে তাঁর চারিপাশে ঘুরে গেল। খাঁচার গ্রিলে পিঠ রেখে উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করলেন সালাহউদ্দিন। চোখের পলকে একটি ক্ষুধার্ত চিতাবাঘ তাঁর ওপর ঝাপিয়ে পড়লো! ধারালো থাবা আর দাঁত বসিয়ে দিল তাঁর গলায়। সাথে যোগ দিল দ্বিতীয় বাঘটিও। থাবায় আর কামড়ে ক্ষতবিক্ষত সালাহউদ্দিনের নিথর দেহটি লুটিয়ে পড়লো মাটিতে। অবুঝ ক্ষুধার্ত শাবকদুটিও যোগ দিল বড়দের সাথে। সবাই মিলে টেনে ছিঁড়ে ছিঁড়ে খেতে থাকলো মুক্তিযোদ্ধা সালাহউদ্দিন কে....।
ঠাকুরগাঁওয়ের পীরগঞ্জ থানার কোষারানিগঞ্জ গ্রামের সালাহউদ্দিন। ১৯৭১ সালে তিনি দিনাজপুর সুরেন্দ্রনাথ কলেজে উচ্চ মাধ্যমিকের ছাত্র ছিলেন। ২৯ এপ্রিল মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের উদ্দেশ্যে সীমান্ত পেরিয়ে মলয় যুব শিবিরে যোগ দেন। পরে তাঁকে পানিঘাট প্রশিক্ষণ শিবিরে পাঠানো হয়। প্রশিক্ষণ শেষে মুক্তিযোদ্ধা দলের সাথে বিভিন্ন অপারেশন শুরু করেন।
১০ নভেম্বর জাবরহাট হাইড আউটে থাকাকালে সালাহউদ্দিন খবর পান যে - তাঁর বাবাকে পাকিস্তানি সৈন্যরা ধরে নিয়ে গেছে। সেদিন রাতেই তিনি বাড়ির দিকে রওনা হন। দীর্ঘ ৭ মাস পর বাড়ি ফিরে বাবা-মাকে স্বাভাবিক অবস্থায় দেখে বুঝতে পারেন, কেউ তাঁকে মিথ্যা খবর দিয়ে বাড়ী এনেছে। সিদ্ধান্ত নেন, সারাদিন বাড়িতে লুকিয়ে থেকে রাতের বেলা রওনা হয়ে হাইড আউটে ফিরে যাবেন। সালাহউদ্দিন টেরও পাননি যে, ওৎ পেতে থাকা রাজাকাররা তাঁকে দেখে ফেলেছে। কিছুক্ষণ পরই একদল পাকিস্তানি সৈন্য আর কয়েকজন রাজাকার তাঁদের বাড়ি ঘেরাও করে ফেলে। গ্রেফতার হন সালাহউদ্দিন! তাঁকে পিঠমোড়া করে বেধেঁ ঠাকুরগাঁও সদর ছাউনিতে নিয়ে যায় পাকিস্তানিরা।
শুরু হয় সালাহউদ্দিনের ওপর অমানবিক নির্যাতন! বুটের লাথি, চাবুকের আঘাত, চড় কিল ঘুষি...। তবু মুখ খোলেন না তিনি। তাঁর হাত ও পায়ের সবগুলো আঙুলে পেরেক ঠুকে দেয় বর্বর পাকিস্থানিরা! সুতীব্র যন্ত্রণা সহ্য করেও সহযোদ্ধাদের কোন খবর দেননি তিনি। অতঃপর পাকিস্তানিরা মাইক যোগে শহরে ঘোষনা করে যে, বিকালে সেনা ছাউনিতে এক আকর্ষণীয় অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। ঠাকুরগাঁও সেনা ছাউনিতে সার্কাস পার্টি থেকে তুলে আনা ২ টি চিতা বাঘ ও ২ টি ক্ষুদে শাবক ছিল।
তখন প্রায় বিকাল। দড়ি দিয়ে পেছনে হাত বাধা সালাহউদ্দিনকে দাঁড় করানো হলো বাঘের খাঁচার সামনে। পরনে একটি লুঙ্গি, রক্তাক্ত শরীর। নির্মম অত্যাচারে, ক্ষুধায়, তৃষ্ণায় কাতর তিনি। তবু সালাহউদ্দিন দাঁড়িয়ে আছেন মাথা উঁচু করে, দৃঢ় মনোবল ঠিকরে পড়ছে তাঁর চোখে মুখে।
পাকিস্তানি হিংস্র নরপশু মেজর মাহমুদ হাসান বেগ বেরিয়ে এলো কামরা থেকে। সালাহউদ্দিনকে উর্দুতে বললো - তোমার সামনে দুটি পথ খোলা, হয় মুক্তিবাহিনীর সমস্ত গোপন তথ্য দাও নতুবা ক্ষুধার্ত বাঘের খাবারে পরিনত হও।
সালাহউদ্দিন অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলেন। তাঁর সেই দৃষ্টিতে এমন কিছু ছিল যে, পাকিস্তানিরা সহজেই বুঝে গেল - তিনি কোন তথ্য দেবেন না।
এরপর তাঁকে ছুঁড়ে ফেলা হলো ক্ষুধার্ত বাঘের খাঁচায়!
সামনে নিশ্চিত মৃত্যু, তবু কি অসম সাহস! নিজেকে বিলিয়ে দেয়া এ কি ভীষণ দৃঢ় মনোবল!
কি অতুলনীয় দেশপ্রেম!
তথ্যঋণ-
১. জীবন্ত সালাহউদ্দিনকে ছিঁড়ে খায় বাঘ, মজিবর রহমান খান, প্রথম আলো
২. উইকিপিডিয়া
৩. বাঘের খাঁচায় মুক্তিযোদ্ধার প্রাণোৎসর্গ
সর্বশেষ এডিট : ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৩ সকাল ১১:৪৪

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



