বাবা গল্পের বই পড়া দেখতেই পারতেন না। তার কাছে মনে হত গল্পের বই পড়া মানে হচ্ছে সময়ের অপচয়। এই সময়টা পড়াশোনা করে কাটালে ক্লাসে ফার্স্ট সেকেন্ড কিছু একটা হয়ে যাওয়া যাবে। স্কুলের টিফিন বা হাতখরচের টাকা বাঁচিয়ে লুকিয়ে গল্পের বই কিনতাম তখন। বন্ধুদের কাছ থেকে “পড়ে ফেরত দেব” নাম করে কত বই যে গায়েব করে দিয়েছি তার কোন হিসাব নেই। দোকানে সাজানো বইগুলো দেখে আজও ভিতরে সেই পুরোনো প্রেম জেগে উঠলেও সেগুলো আর ছুঁয়েও দেখা হয়ে ওঠেনা। প্রশ্নটা হচ্ছে, কেন?
.
যুগ বদলেছে। দিনদিন আমরা আরো আধুনিক টেকনোলজির পথে এগিয়ে যাচ্ছি। ছেলেবেলায় ঐ এক বিটিভির ক্যাপ্টেন প্লানেট, গডজিলা আর জুমানজি-ই ছিল বিনোদনের একমাত্র মাধ্যম। সে তুলনায় বইয়ের জগৎটা ছিল আরো অনেক বিশাল এবং বিস্তৃত। তিন গোয়েন্দার সাথে আমাজনের গহীন জঙ্গলে আমিও ঘুরে বেড়িয়েছি, পাহাড়ি সেই বাচ্চাটার সাথে টি-রেক্সের সন্ধানে সাঙ্গু নদীতে আমিও ছুটে চলেছি। কখনও বা শঙ্খনীল কারাগারের জানালার ওপাশের অন্ধকার থেকে ডাক শুনে বিষাদে হাহাকার করে উঠেছে বুক। কেউ কি এই তীব্র বিষাদের অনুভূতিটা অন্য যে কোন কিছুর বিনিময়ে ফিরিয়ে এনে দিতে পারবে? পারবে কি ক্লিওপেট্রার পিছু পিছু ফায়ার অফ ইয়োথ আবিষ্কারের অ্যাডভেঞ্চার এনে দিতে?
.
আজ আমাদের হাতে স্মার্টফোন, সবখানে ওয়াই-ফাইয়ের ছড়াছড়ি। আছে ফেসবুক-ইনস্ট্রাগ্রামের মত সোশাল নেটওয়ার্ক। ঘরে বসেই দেড়-দু’হাজার মানুষের সাথে কানেক্টেড আমি। সিরিজের যে পর্বটা দেখার জন্য আগে এক সপ্তাহ অপেক্ষা করে থাকা লাগত, এখন সেটা ডাউনলোড করে নিতে সর্বোচ্চ ঘন্টাখানেক সময়ের প্রয়োজন। ইউটিউবের অমোঘ আকর্ষণের কথা তো বাদই দিলাম।
.
জীবনযাত্রার মান এরকম সহজ হয়ে পড়ার কারণে এখন আমাদের আর কষ্ট করতে ভাল লাগে না। ছোট্ট একটা উদাহরণ দেই, কবিতার কথা বলি। আমাদের আগের জেনারেশনেই কবিতাকে সাহিত্যের খুবই মূল্যবান একটি শাখা হিসাবে বিবেচনা করা হত। ভার্সিটির ছেলেরা চুল-দাঁড়ি বড় রেখে কাঁধে চটের ব্যাগ নিয়ে ঘুরত। সেটাই ছিল ঐ সময়ের বিশাল ফ্যাশন। আর বর্তমানে কবিতা দেখলে দুইশ গজ নিরাপদ দূরত্ব দিয়ে চলে যাই। ছেলে কবি শুনলেই মনে হয় নির্ঘাত গাঞ্জা খেয়ে পড়ে থাকে টিএসসিতে। মোর্দা কথাটা হচ্ছে, যে জিনিস একবার পড়ে মাথামুন্ডু কিছু বোঝা যায় না, সেটা নিয়ে এত মাথা ঘাঁটাবে কে বল দেখি বাবা?! তার নাকি আবার নানান ভাবার্থও আছে, মাফ চাই!
.
একইভাবে গদ্যের প্রতিও আমাদের নিরাসক্তি চলে আসছে। ইন্টারনেটের মত সহজ বিনোদন মাধ্যম থাকতে একটা বই হাতে নিয়ে কষ্ট করে পৃষ্ঠার পর পৃষ্ঠা উল্টিয়ে পুরোটা পড়া, সাথে সাথে আবার চরিত্রগুলো মনে মনে কল্পনা করে নেয়া – অনেক কষ্টকর মনে হচ্ছে আমাদের কাছে। এর মধ্যে ফ্রেন্ডস এর তিন-চারটা এপিসোড দেখে ফেলাই বুদ্ধিমানের কাজ।
.
লেখা আর বেশি দীর্ঘায়িত করব না, এমনিতেই অনেক হয়ে গেছে। গদ্যের লেভেলে চলে গেলে এই লেখাও পড়বে না কেউ। তবে, সে দিন আর বেশি দূরে নয়, যেদিন আমাদের বই পড়ার অভ্যাস এমন হবে যে প্রাইমারি লেভেল পরীক্ষায় “মাই হবি” প্যারাগ্রাফ এলে বিলুপ্তপ্রায় ‘গার্ডেনিং’ এর মত ‘বুক রিডিং’-ও একই কাতারে স্থান পাবে।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:০৬