আমার জীবনে আমি বেশ কয়েকবার কাছ থেকে মৃত্যুকে দেখেছি। তার একটা লিখি আজকে। কিছু স্মৃতি থাকা দরকার।
.
এপ্রিল ২০১৬। আমি তখন বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমির ক্যাডেট। আমাদের ফাইনাল এক্সারসাইজ শেষ হবার পর আমরা কক্সবাজার বেড়াতে গিয়েছিলাম। কলাতলী বিচে গিয়ে সোজা সমদ্রে ঝাঁপ দিলাম পুরো কোর্স। আবহাওয়া বেশ ভাল ছিল। অনেক বড় বড় ঢেউ আসছিল। একেকটা ঢেউ আসছিল, আর আমরা ঢেউ এর দিকে লাফিয়ে পড়ছিলাম। এগুতে এগুতে যতই গভীরের দিকে যাচ্ছিলাম, ততই কেমন যেন একটা বাঁধন ছেঁড়া স্বাধীনতার অনুভূতি পাচ্ছিলাম। এই শেকল পরা জীবনে শেকল ছেঁড়ার আনন্দ কেমন তা আমাদের থেকে ভালো করে আর কে জানে!
.
এগুতে এগুতে প্রায় বুক সমান পানিতে চলে গেলাম। ঢেউগুলো যখন আসছিল তখন লাফ দিতে হচ্ছিল ঢেউ এর উপরে ভেসে থাকার জন্য। এভাবে লাফাতে লাফাতে হঠাৎ করে খেয়াল করলাম আমার পায়ের নিচে আর মাটি খুঁজে পাচ্ছি না। বুঝতে পারলাম আমি বেশ খানিকটা গভীরে চলে এসেছি। আশেপাশে তাকালাম। ঐতো আমার কোর্সমেটদের দেখা যাচ্ছে খানিকটা দূরে। সবাই ঢেউ এর সাথে লাফ দিতে ব্যস্ত। তার মানে মাটি বেশি দূরে নয়। সাঁতরে খানিকটা যেতে পারলেই আপাতত এই ফাঁড়া থেকে বের হওয়া যায়।
.
সাঁতরাতে গিয়ে আবিষ্কার করলাম আমি যতই সাঁতরাতে চাই, ততই গভীরের দিকে চলে যাচ্ছি। ঢেউগুলো আছড়ে পড়ার পর পিছিয়ে পড়ার সময় আমাকেও সাথে নিয়ে যাচ্ছে। এবার কিছুটা ভয় পেলাম। স্রোতের প্রতিকূলে সাঁতরানোর মত ভাল সুইমার না আমি, তাও আবার সমুদ্রের স্রোত। আরো কিছুক্ষণ চেষ্টা চালিয়ে গেলাম তীরের দিকে ফেরার। কিন্তু কোন সুবিধা করতে পারছিলাম না।
.
ভয় পেলেও মাথাটা পরিষ্কার কাজ করছিল। বুঝতে পারছিলাম কোর্সমেটদের ডেকে আপাতত তেমন কোন লাভ হবে না। পোলাপান যে হারে চিল্লাচিল্লি করছে, আমি ডাকলেও ওরা শুনতেই পাবে না। তাছাড়া যে আমাকে বাঁচানোর জন্য এখানে এগিয়ে আসবে সেও আমার মত একই পরিস্থিতিতে পড়বে। একসাথে দুজনকে বিপদে ফেলার কোন মানে হয় না।
.
এর চেয়ে একা একাই ঢেউ এর সাথে দাপাদাপি করে যাচ্ছিলাম। ফলাফল হচ্ছে যেখানে দাঁড়িয়ে ছিলাম মোটামুটি এর আশেপাশেই ঘুরছি আমি, আগাচ্ছিও না পিছাচ্ছিও না। কিন্তু এটাও বুঝতে পারছিলাম, এভাবে আর বেশিক্ষণ টিকে থাকতে পারবো না।
হঠাৎ আমাদের প্লাটুন কমান্ডার মেজর জুনায়েদ স্যার আমাকে দেখতে পেলেন। দেখেই রেগে গেলেন, কারণ আমি সবার থেকে আলাদা হয়ে আরো গভীরের দিকে চলে গিয়েছি। তিনি চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মাশনুর গেট ব্যাক! আই সেইড গেট ব্যাক!’
.
আমি তো গেট ব্যাক করারই চেষ্টা করছি তখন, চেষ্টা করতে করতে টায়ার্ডও হয়ে পড়ছি। তখন উনাকে সেটা বোঝাবে কে?! আমি কোন কথা না বলে আমার মত চেষ্টা করে যাচ্ছিলাম। ওনার কমান্ডের কোন প্রগ্রেস না দেখে জুনায়েদ স্যার আবার চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘মাশনুর?! কি বলছি তোমাকে আমি?!’ আমি শান্ত গলায় স্যার কে বললাম, ‘স্যার আই অ্যাম ট্রাইং, বাট আই ক্যাননট মেক ইট।’ ঐ সময়ে ঐরকম শান্ত ছিলাম কিভাবে কে জানে!
.
যাই হোক, জুনায়েদ স্যার বুঝতে পারলেন যে আমি বিপদে পড়েছি। উনি আশেপাশে আমার যত কোর্সমেট ছিল, সবাইকে একসাথে করে হিউম্যান চেইন বানিয়ে আমার কাছে পাঠালেন। সেই হিউম্যান চেইন গিয়ে অনেক কসরত করে আমাকে তুলে নিয়ে আসলো অবশেষে। ওখানে কে কে ছিল সেটা খুব একটা মনে নেই, তবে Syed Shawon, Masud Rana আর Rayan Alif ছিল, এটুকু মনে আছে।
.
আমি পড়েছিলাম একটা ছোটখাট ঘূর্ণির মধ্যে, আর কখন যে ভাটার টান শুরু হয়ে গিয়েছিল আনন্দের চোটে সেদিকে খেয়াল ছিল না কারো। যাই হোক, ঐ দিন জুনায়েদ স্যার আর আমার ঐ কোর্সমেটগুলো না থাকলে আজকে বসে বসে এই কাহিনী লেখা হত না। মজার ব্যাপার হচ্ছে, আমি যখন বুঝতে পেরেছিলাম যে আমি মোটামুটি বড়সড় একটা বিপদে পড়েছি এবং সম্ভবত মারা যাচ্ছি, কেন যেন খুব বেশি একটা ভয় লাগেনি, বরং কেমন যেন একটা দুঃখ এসে ভর করেছিল। মনে হচ্ছিল, অনেক কিছুই রয়ে গেছে যা করার কথা ছিল কিন্তু করতে পারিনি। তবে সেই দুঃখের অনুভূতিটা, আসলে দুঃখ না ঠিক, কেমন যেন ফাঁকা ফাঁকা লেগেছিল বুকের মধ্যে। কেমন প্রাচীন একটা অনুভূতি, সেই শূন্যতার অনুভূতির সাথে এ জগতের আর কোনকিছুর কোন মিল নেই।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:১৪