পাসিং আউট প্যারেড বাংলাদেশ মিলিটারি একাডেমীর সবচেয়ে বর্ণাঢ্য অনুষ্ঠান। ২ বছর ট্রেনিং শেষে কিছু ক্যাডেট সামরিক অফিসার হবে - দিনটি সবার জন্যই অনেক আনন্দের। আমার পাসিং আউটের কথা বলি। প্রথমত, বিএমতে ঢোকার আগে থেকেই আমার এই দিনটা নিয়ে অনেক জল্পনা-কল্পনা ছিল। এরপর ট্রেনিং-এ যখনই কষ্ট হয়েছে, স্টাফ থেকে শুরু করে প্লাটুন কমান্ডার সবাই আমাদেরকে ‘ওয়ান ফাইন মর্নিং’ এর স্বপ্ন দেখাতেন। রূপকথার সেই ফাইন মর্নিং হচ্ছে এমন একটা দিন, যেদিন আমরা এখান থেকে বের হতে পারব, আর এরপর আমাদের জীবনের আর কোন কষ্ট থাকবে না। কাউকে শর্তহীন খাটাতে চাইলে তার সামনে একটা মূলা ঝুলিয়ে দিতে হয়। ওয়ান ফাইন মর্নিং ছিল আমাদের জন্য সেই মূলা।
বিএমতে যাবার পর পোডিয়ামটাকে মাঝেসাঝে দেখেটেখে রাখতাম। কয়েক ধাপের দু’মাথাওয়ালা একটা সিঁড়ি, সেটাকেই অন্য জগতের কোন কিছু মনে হত। রাতের বেলা ইআরসি করার সময় মাঝেমাঝে স্টাফ যখন পোডিয়াম টাচ অ্যান্ড ব্যাকে পাঠাতেন, পোডিয়ামটার গায়ে হাত বুলিয়ে দেখে আসতাম আসলেই জিনিসটা সত্যি নাকি। হতেও পারে ব্যাপারটা অপটিক্যাল ইলিউশন, কোন কিছুই বলা যায় না!
ফার্স্ট টার্মের মোটামুটি শেষের দিকে ৭০ লং কোর্সের পাসিং আউট প্যারেড। আমরা ফার্স্ট টার্ম হিসেবে প্যারেডে মিলতে পারলাম না, গ্যালারিতে বসে সবাইকে হাততালি দিয়ে গেলাম। হাতের তালি কেন তালে তালে হল না সেটা নিয়েও অবশ্য একটা পাঙ্গা খেয়েছিলাম, কারণ পোলাপান ওখানে বসেও ঘুমিয়ে পড়েছিল। প্যারেড শেষে পোডিয়ামের ওপাশে ফাইনাল টার্মের সেই বাঁধভাঙ্গা উচ্ছ্বাস, আমার গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠেছিল, মনে আছে এখনো।
এরপর আরো ৩ টা পাসিং আউট প্যারেড দেখেছি। কিভাবে কিভাবে সবগুলো প্যারেডেই মিলতে হয়েছে আমাকে। এক পার্টি ছিল যারা এই প্যারেডের মৌসুম এলেই কিভাবে কিভাবে যেন হসপিটাল থেকে নানান রেস্ট ম্যানেজ করে ফেলত। আমি বোকাসোকা মানুষ, আমি এগুলো বুঝতাম না, আমি বলদের মত প্যারেড করেই যেতাম। অবশ্য প্যারেড করতে যে খারাপ লাগত তা না, তবে টানা ১ মাস রোদে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমাকে অন্ধকারেও আর দেখা যেত না, এটাই সমস্যা। অবশ্য এই প্যারেড করতে করতেই কিভাবে দাঁড়িয়েও ঘুমিয়ে পড়া যায় সেটা আবিষ্কার করেছিলাম। সেটা একটা বড়সড় অ্যাচিভমেন্ট বলা যায়।
কষ্ট লেগেছিল ৭৩ লং কোর্সের প্যারেডে। আমার সাথে আমার মত আর যারা ছিল তারা কেউই এই প্যারেডে মেলেনি। আমি ওখানেও কিভাবে যেন আটকে গেলাম, প্যারেডটা করাই লাগল। ৭৩ যখন লাস্ট মার্চটা করে বের হয়ে যাচ্ছিল পোডিয়ামের দিকে, আমি তখন দাঁড়িয়ে ছিলাম জুনিয়র ডিভিশনের সাথে। অনুভূতিটা একটু অন্যরকম, যাই হোক, সেটা নিয়ে আফসোস করে লাভ নেই, সময়টা পেরিয়ে গেছে।
দেখতে দেখতে আমাদেরও পাসিং আউটের সময় চলে আসল। ১ মাস ধরে এপ্রিল-মে মাসের কড়া রোদে স্টাফদের সাথে অনেক খেলাধুলা হল। ঘাপলা পার্টি এখানেও ঘাপলা। একজনের নাকি চোখের ক্লোরোফিল বেড়ে গেছে, রোদে দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছে না। ভাবটা এমন যে, রোদে দাঁড়িয়ে থাকলে তার চোখের মধ্যেই খাবার উৎপাদন শুরু হয়ে যাচ্ছে। স্টাফরা এত কিছু বুঝত না, তাদের হিসাব ছিল হসপিটালের চিট। হসপিটালের চিট থাকলে ক্লোরোফিল পার্টিও মাফ, না থাকলে ডেঙ্গু-ম্যালেরিয়া হলেও লাভ নাই। কোনমতে হসপিটালের একটা চিট দেখাতে পারলেই তারা খুশি। পাসিং আউটের দিন সকালে ঘুম থেকে উঠে মনে হচ্ছিল, গত দুই-আড়াই বছর ধরে আমরা যে ওয়ান ফাইন মর্নিং এর কথা শুনে আসছি, আজই কি সেই দিন? ব্যাপারটা আসলে বিশ্বাস হতেই চাচ্ছিল না।
পুরো প্যারেডটা জুড়েই বাদক দল নানান বাজনা বাজায়। প্যারেডের শেষ পর্যায়ে যখন আমরা পোডিয়ামের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলাম, তখন ট্রাম্পেটের সুরে পুরোনো সেই দিনের কথা শুনতে শুনতে কখন যে চোখ ভিজে গিয়েছিল তা বলতে পারি না। শুধু খেয়াল করলাম পোডিয়ামের সিঁড়ির ধাপগুলো কেমন ঝাপসা হয়ে যাচ্ছে। আর পোডিয়ামটা পেরোনোর পরে সেই বাঁধন ছেঁড়া উচ্ছ্বাস, সেই কথা কি ভোলা যায়?
শেষ করি। গ্রাজুয়েশন শেষ করলাম কয়েকদিন আগে। ভার্সিটিতে নাকি কনভোকেশনও হয়ে গেছে। মানুষজন বগল বাজাতে বাজাতে গিয়ে কনভোকেশন করে আসল। আর আমি এখানে বসে ওদের ছবি দেখি আর ওয়াও রিয়্যাক্ট দিয়ে যাচ্ছি। তবে কথা হচ্ছে, আমি কনভোকেশন দেখিনি, কালো রোব পরে হাতে সার্টিফিকেটটা নিয়ে গ্রাজুয়েশন ক্যাপটা উপরে ছুঁড়ে মারার অনুভূতি কেমন আমি জানি না। কিন্তু পোডিয়াম পেরোনোর পর মাথার সবুজ বেরেটটা উপরে ছুঁড়ে মারার যে অমানুষিক আনন্দ, সেটা পেয়েছি। এক জীবন পার করে দেবার জন্য এই স্মৃতিটাই যথেষ্ট, কনভোকেশন না হলেও চলবে আমার।
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে এপ্রিল, ২০১৮ রাত ৮:৩১