somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কোরবানীর ঈদের জন্য লিখিত সুপ্রাচীন এক ফান-গল্প : উট-কো ঝামেলা

০৬ ই নভেম্বর, ২০১১ রাত ১১:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(২০০৮ সালের কোন এক দিন রস+আলোর কার্যালয়ে বসে ছিলাম, কোরবানীর ঈদের আগে আগে। বি.স. ভাই আইসা বলল, গল্প কই মিয়া! আমি বললাম, বস, গরু আর খাসি, এগুলা নিয়া এত গল্প লেখা হইছে, যাই লেখি-কমন পইড়া যাইবো।
সে আমার কথা গায়ে মাখলো না। বললো, সন্ধার মইধ্যে কিছু একটা দিয়া যান!শেষে কোনমতে একটা খসড়া গল্প লিখলাম, কমন যাতে না পড়ে এ জন্য পাত্র পাল্টে উটকো ঝামেলা নিয়াসলাম। অনেকদিন পর রস+আলোয় প্রকাশিত সেই গল্পটার কথা মনে পড়লো। গুগলায়া দেখি এক বাংলা জোকস সাইটে সেইটা এখন বিদ্যমান। দেইখা আকাশ থেকে পড়লাম এবং যথেষ্ট শংকিত হইলাম। কারন গুগলে রস+আলোর কোন সাইন নাই, যেন জোকস সাইটই গল্পের একমাত্র ধারক, অথচ এইটা কার সাইট আমি জানিই না!
অবশ্য সেই কারনেই গল্পটা আবার পাইলাম, ২০০৮ এর পত্রিকা এখন নেটে নাই মনে হয়। তারে থ্যাংকস! )



সেবার ঈদ ঘনিয়ে আসতেই আমার অতিব্যস্ত কাকা গরুর বাজারের হালহকিকত নিয়ে ব্যাপক ব্যতিব্যস্ত হয়ে উঠলেন। বৈধ হোক আর অবৈধ হোক, টাকা-পয়সার অভাব তাঁর কোনোকালেও ছিল না। তাই বরাবরই পাড়ার সেরা গরুটা তাঁর বাড়ির সামনে বাঁধা থাকত। কিন্তু গতবার তাঁর শোচনীয় পরাজয় ঘটে পাড়ার জগলুল মিয়ার কাছে। জগলুল মিয়ার গরুর তুলনায় পাক্কা এক ইঞ্চি উচ্চতায় ও দুই ইঞ্চি প্রস্থে কম ছিল কাকার গরুটা। এবার তাই কাকা আদাজল খেয়ে নেমেছেন তাঁর সেই অপমানের শোধ তুলতে। তা ছাড়া কাকার গরুটা নিয়ে নিন্দুকেরা নানা কথা ছড়াচ্ছিল-সেবার গরুটার নাকি একটা চোখ ট্যারা, আর দাঁতের মধ্যে কয়েকটা বাঁধানো দাঁতও নাকি ছিল। কাকার ধারণা, বদমাশ জগলুল মিয়াই এসব নিন্দুকের নিন্দার বন্দুকে রসদ জোগাচ্ছে।
তাই এবার এক হাত দেখে নিতে কাকা হাত খুলে খরচ করা শুরু করলেন। কোরবানির বাজারে আগেই কয়েকজন স্পাই নিয়োগ দিয়ে বসলেন; যারা প্রতি ঘণ্টায় বাংলাদেশের চ্যানেলগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বাজারের আপডেটেড নিউজ জানাচ্ছিল কাকাকে। এভাবে বেশ কিছুদিন কেটে গেল। স্পাইরা নতুন আসা গরুদের দৈর্ঘ -প্রস্থ মেপে রিপোর্ট করতেই কাকা একে একে নাকচ করতে থাকেন। নাহ্‌, ওতে চলবে না, আরও বড় সাইজের নিশ্চয়ই হাজির হবে দুই দিন পর।
এভাবে ঈদের সপ্তাহখানেক বাকি থাকতে শোনা গেল জগলুল মিয়া একটি গরু কিনে ফেলেছে। তা সেটাকে গরু না বলে শুঁড় ছাড়া আর শিংওয়ালা হাতি বললেই বোধ হয় মানানসই হয়। ‘হাম্বা’ করে ডাক দিলে পাড়ার বিল্ডিংগুলোর সব জানালা ঝনঝন করে ওঠে। চারজন জওয়ান লোক রীতিমতো হিমশিম খেয়ে যায় ওটাকে শান্ত রাখতে।
দেখেশুনে তো কাকার মাথায় হাত! তাঁর বাকি সম্মানটুকুও দেখি পাংচার হয়ে মাটির সঙ্গে মিশে যাওয়ার দশা। রেগেমেগে তিনি তাঁর নিয়োজিত স্পাইদের সেই দণ্ডেই বরখাস্ত করলেন, সবাইকে একসঙ্গে। ‘নিমক হারামের দল, এত দিন দানাপানি খাইয়ে রাখলাম, আর শেষমেশ চোখের সামনে দিয়ে বড় গরুটা ওই ব্যাটা নিয়ে নিল।’ কাকা ফোঁস ফোঁস করতে থাকেন।
সেই দণ্ডে আমি ভয়ে ভয়ে একটা প্রস্তাব দিয়ে বসি কাকাকে। টিভিতে কোরবানির হাটের নিউজ দেখে দেখে আমিও বাজারের আপডেটেড নিউজটা জানতাম। বললাম, ‘কাকা, না হয় একটা উটই কিনে ফেলেন, সঙ্গে একটা ছাগল ফ্রি দিচ্ছে।’
শুনে কাকা প্রথমে ধমকান, পরে থমকান এবং সবশেষে চমকান। তাঁর মুখে যেন ১০০ ওয়াটের ফুল রেঞ্জের বাতি জ্বলে ওঠে।
‘ভালো বলেছিস তো মন্টু। উটের গুরুত্ব তো গরুর গরুত্বকেও হার মানায়। তা ছাড়া গলা লম্বা করে দাঁড়ালে কতটা লম্বাও হয় তা ভেবেছিস মন্টু, সে তুলনায় ওর গরুটা তো নেহাত···নেহাত···।’ কাকা ভাষা খুঁজে পান না, ‘মানে নেহাত গরু।’ কাকা থামেন। কিন্তু পা আর থেমে থাকে না। শেষ দণ্ডে কোরবানির পশুর হাটে রওনা হয়ে যান আমাকে সঙ্গে করে। হাটে গিয়েই আমরা আস্ত এক অ্যারাবিয়ান উটের অর্ডার দিয়ে আসি। তিন দিন আগে অর্ডার দিলেই তবে পাওয়া যায়। দাম যদিও খানিকটা বেশিই পড়ল। কিন্তু দামের সঙ্গে কাকার হাসির জেল্লাও বাড়তে থাকে।
বাড়ি ফিরেই কাকা বহু লোক লাগিয়ে দেন উটের থাকার জায়গার ব্যবস্থা করতে। বাড়ির সামনের গ্যারেজটা বালি দিয়ে উঁচু করে বেড তৈরি করেন, আর সেখানে যাতে সূর্যের আলো ঠিকভাবে পড়ে তার জন্য গ্যারেজের চালটালও খুলে ফেলেন। দুই দিন পর ফ্রি খাসিসহ হাজির হয় লম্বা গ্রীবার উট।


দেখে আমাদের উৎসাহ তো আর ধরে না;
যদিও নিন্দুকে এবারও ছড়াতে থাকে-এ নির্ঘাত রাজস্থানি উট, মোটেও অ্যারাবিয়ান নয়। কিন্তু তাতেও কাকার বিশেষ গায়ে লাগল না। ‘নাহ্‌, এবার সত্যি সত্যিই জগলুল মিয়াকে হেনস্তা করা গেছে।’ কাকার আত্মতৃপ্তি থামে না; কিন্তু ঝামেলাটা বাধল ঈদের আগের দিন। গ্যারেজে গিয়ে দেখি কাকা, চাচাতো ভাই ঝন্টু আর বোন বিনুকে নিয়ে হতবিহ্বল দৃষ্টিতে উটটাকে দেখছেন। ঝন্টু মাথা নেড়ে নেড়ে কাকাকে যেন কী বোঝাচ্ছে, ওর এত মায়াময় কণ্ঠ আগে শুনেছি বলে মনে পড়ল না। কাছে গিয়ে আমিও কিছুটা শুনি। যা বুঝলাম তা হলো, ঝন্টু শুধু পাড়ার ছোট ছেলেদের পটিয়ে নানা ফাইফরমাশ খাটায় তাই-ই নয়, বরং কাকার মতো রাশভারী লোককেও পটাতে ওস্তাদ। ও বোঝাচ্ছে, ‘দেখেন আব্বা, এই উটটা সুদূর মরুর দেশ থেকে এই বঙ্গভূমে এসেছে, কত বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে বন্ধুর খোঁজেই হয়তো, অথচ আমরা এটাকে এ দেশের হাওয়া-জলে আর কিছুদিন না চরিয়ে অকাল মৃত্যুর দিকে ঠেলে দিচ্ছি-কাজটা কি ঠিক হচ্ছে?’ সঙ্গে সঙ্গে ঝন্টুর বোন বিনুর সীমাহীন সমর্থনে আমার কাকাও যে গলছে এর অন্যতম কারণ বোধ হয় তাঁরও এই তিন দিনে উটটার প্রতি ব্যাপক মায়া পড়ে গেছে। তাঁর চোখ দেখি ঝন্টুর বক্তব্যে অশ্রুসিক্ত।
আমি অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে উটের মাংস চাখার এমন সুযোগটা হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে সেই আশঙ্কায় বলে উঠি, ‘কাকা, যত মায়া পড়বে ততই ভালো।’
কিন্তু আমার এ বক্তব্য ঝন্টু-বিনুর কলকাকলিতে ঢাকা পড়ে যায়। তাই শেষমেশ উটটি পোষার জন্যই কাকা রেখে দিলেন।
সেবারও তাই জগলুল মিয়ার কাছে আমাদের এক রকম হারই হলো। উটের সঙ্গে ফ্রি পাওয়া প্রমাণ সাইজের ছাগলটা দিয়েই ঈদের আনন্দ উদ্‌যাপিত হলো-আর সে আনন্দে উটটাও যে যোগ দিয়েছিল, তা বলার অপেক্ষা রাখে না।

প্রথম প্রকাশ: রস+আলো, ১ ডিসেম্বর ২০০৮

৭টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

পরিণতি - ৩য় পর্ব (একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস)

লিখেছেন সাখাওয়াত হোসেন বাবন, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১২:২৮



( পরিণতি ৬১ পর্বে'র একটি মনস্তাত্ত্বিক রহস্য উপন্যাস ।)

তিন


আচানক ঘুম ভেঙ্গে গেলো ।

চোখ খুলে প্রথমে বুঝতে পারলাম না কোথায় আছি । আবছা আলোয় মশারির বাহিরে চারপাশটা অপরিচিত... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইফতার পার্টি মানে খাবারের বিপুল অপচয়

লিখেছেন রাজীব নুর, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৩



গতকাল সরকারি ছুটির দিন ছিলো।
সারাদিন রাস্তাঘাট মোটামুটি ফাকাই ছিলো। ভাবলাম, আজ আরাম করে মেট্রোরেলে যাতায়াত করা যাবে। হায় কপাল! মেট্রো স্টেশনে গিয়ে দেখি গজব ভীড়! এত ভিড়... ...বাকিটুকু পড়ুন

গণতন্ত্র আর বাক-স্বাধীনতার আলাপসালাপ

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৪:২৩


একাত্তর সালে আওয়ামী লীগের লোকজন আর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা ছিল পাকবাহিনীর প্রধান টার্গেট। যদিও সর্বস্তরের মানুষের ওপর নিপীড়ন অব্যাহত ছিল। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধা আর তাদের পরিবারের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×