ব্রেন্ডা মায়ার্স-পাওয়েল
অনুবাদঃ মাসউদুর রহমান রাজন
১৯৭০ এর দিকে যখন তিনি পতিতাবৃত্তির সাথে যুক্ত হন, তখন ব্রেন্ডা মায়ার্স ছিলেন নিতান্তই শিশু। এখানে তিনি বর্ণনা করেছেন কিভাবে তাকে একাজের জন্য রাজপথে নামিয়ে দেয়া হয় এবং কেন, তিন দশক পরে, তিনি তার জীবনকে উৎসর্গ করেছেন যাতে অন্য মেয়েরা একই রকম ফাঁদে পা না দেয় - সেটা নিশ্চিত করার কাজে। কারো কারো কাছে ব্রেন্ডার এই বর্ণনা খুবই বিপর্যস্তকর মনে হবে।
শুরু থেকেই জীবন আমার হাতে কেবল লেবুটাই তুলে দিয়েছে আর আমি সবসময় চেষ্টা করেছি কিভাবে তা দিয়ে সবচেয়ে ভালো শরবৎটা বানানো যায়।
আমি ১৯৬০-এর দশকে শিকাগোর পশ্চিম অংশে বেড়ে উঠেছি। আমার বয়স যখন মাত্র ৬ মাস তখন আমার মা মারা যায়। সে সময় তার বয়স ছিলো ১৬ এবং আমি কখনোই জানতে পারিনি ঠিক কী কারণে সে মারা গিয়েছিল। আমার নানী, যিনি মাত্রাতিরিক্ত পানাসক্ত একজন মহিলা, তিনিও আমাকে তা জানাতে পারেননি। তার মৃত্যুর অফিসিয়াল ব্যাখ্যা ছিলো এই - তার মৃত্যু হয়েছিলো “প্রাকৃতিক কারণে”।
আমি অবশ্য তা বিশ্বাস করি না। ১৬ বছর বয়সে কার মৃত্যু হয় প্রাকৃতিক কারণে? আমি বরং এটা ভাবতেই পছন্দ করি যে, ঈশ্বর আসলে তার জন্য প্রস্তুত ছিলেন। আমি অনেক গল্প শুনেছি যে, তিনি অনেক সুন্দরী ছিলেন এবং তার রসবোধও ছিলো অসাধারণ। আমি জানি এটা সত্যি কারণ এমন একটা গুণ তো আমারও আছে।
আমার নানীই আমার দেখা শোনা করতেন। আর তিনি কোন খারাপ মানুষ ছিলেন না - সত্যি বলতে কি, একদিক থেকে তিনি অসাধারণ মহিলাই ছিলেন। তিনি আমাকে পড়ে শোনাতেন, রুটি সেঁকে দিতেন, সবচে ভালো মিষ্টি আলু তিনি আমার জন্য রান্না করতেন। তার শুধুমাত্র একটাই বদঅভ্যাস ছিলো- মদ্যপান। তিনি বার থেকে মদপানের সঙ্গী ঘরে নিয়ে আসতেন আর মদ খেয়ে তিনি পুরোপুরি বেহুঁশ হয়ে যাওয়ার পর সে মানুষগুলো আমার সাথে নানান কিছু করতো। এসবের শুরু হয়েছিল যখন আমার বয়স ছিলো মাত্র ৪ কি ৫ এবং তা নিত্য-নৈমিত্তিক ব্যাপারে পরিণত হয়ে গিয়েছিল। আমি নিশ্চিত যে, আমার নানী এ ব্যাপারে কিছুই জানতেন না।
তিনি শহরতলীতে গৃহপরিচারিকার কাজ করতেন। যাওয়া-আসায় তার দুইয়ে দুইয়ে চার ঘণ্টা সময় লাগতো। আমি ছিলাম সেই চাবিওয়ালা বাচ্চাদের একজন - যারা গলায় ঘরের চাবি ঝুলিয়ে রাখতো। একা একাই স্কুলে যেতাম আর দিনের শেষে একাই ঘরে ফিরে আসতাম। উত্যক্তকারীরা ব্যাপারটা জানতো এবং এর সুযোগও নিতো।
আমি আমাদের ঘরের বাইরের রাস্তায় সুন্দর চুলওয়ালা ও চকমকে পোশাক পরা অনেক মহিলাকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখতাম। আমি তখনো পর্যন্ত জানতাম না- তারা আসলে কী। আমি শুধু ভাবতাম - তারা কত্তো ঝলমলে! যেহেতু আমি ছিলাম একটা বাচ্চা মেয়ে, তাই আমিও সবসময় ঝলমলে হতে চাইতাম।
একদিন আমি আমার নানীকে জিজ্ঞাসা করলাম ঐ মহিলারা কী করে, উত্তরে তিনি বললেন, “ওরা ওদের প্যান্টি খোলে আর পুরুষেরা এ জন্য ওদেরকে টাকা দেয়।” এবং আমার মনে পড়ে, আমি তখন নিজেকে নিজে বলেছিলাম, “আমিও সম্ভবত এটাই করবো।” কেননা পুরুষেরা ইতিমধ্যে অনেকবার আমার প্যান্টি খুলেছে।
পেছন ফিরে তাকালে, এই পুরো ব্যাপারটাকে আমি অত্যন্ত ভালোভাবেই মোকাবিলা করেছি। ঘরে যখন একা থাকতাম, আমার কাল্পনিক বন্ধুরা থাকতো আমাকে সঙ্গ দেয়ার জন্য। একটা কাল্পনিক এলভিস প্রিসলি, কাল্পনিক ডায়ানা রস্, এমনকী দেবতাদের সাথে গান গেয়ে আর নেচে কাটিয়ে দিতাম। এটা মনে হয় আমাকে এ সব ব্যাপার মোকাবিলা করতে সাহায্য করেছে। আমি সত্যিই একটা প্রাণচঞ্চল মেয়ে ছিলাম - খুব হাসতাম আমি।
একইসাথে আমি খুব ভীতুও ছিলাম, সবসময়ই ভয় পেতাম। আমি জানতাম না, যা ঘটছে - তাতে আমার কোন ভুল আছে কিনা। আমি ভাবতাম, সম্ভবত আমার সাথে অন্যায় কিছু করা হচ্ছে। যদিও আমি খুব চটপটে মেয়ে ছিলাম, আমি স্কুলে যাওয়া বন্ধ করে দিলাম। সত্তরের দশকের শুরুতে, আমি এমন একটা মেয়ে হয়ে গেলাম, যে জানতো না - কিভাবে “না” উচ্চারণ করতে হয়। যদি পাড়ার ছোট ছোট ছেলেরাও এসে আমাকে বলতো যে, ওরা আমাকে পছন্দ করে অথবা আমার সাথে একটু ভালো ব্যবহার করতো, তারা যা চাইতো আমার সাথে করতে পারতো।
১৪ বছর বয়সে পাড়ার ছেলেদের ঔরসে আমার দু’টি সন্তান হয়, কন্যা সন্তান। তখন থেকে আমার নানী আমাকে বলতে শুরু করলেন, এই বাচ্চাদের ভরণ-পোষণের জন্য আমার টাকা রোজগার করা উচিৎ। কারণ ঘরে তখন কোন খাবারই ছিলো না, আমাদের কিছুই ছিলো না।
তাই এক সন্ধ্যায় - সেটা ছিলো গুড ফ্রাইডে (যীশুখ্রীষ্ট্রের ক্রুশবিদ্ধ হওয়ার দিন) - আমি ডিভিশন স্ট্রীট এবং ক্লার্ক স্ট্রীটের মধ্য দিয়ে গেলাম এবং মার্ক টোয়েন হোটেলের সামনে গিয়ে দাঁড়ালাম। আমি একটা আমি একটা টু পিস জামা পরেছিলাম যার দাম ছিল ৩.৯৯ ডলার, সস্তা প্লাস্টিকের জুতা আর ঠোঁটে মেখেছিলাম কমলা লিপস্টিক, আমি ভেবেছিলাম - এতে হয়তো আমাকে আরো বয়স্কা দেখাবে।
আমার বয়স তখন ১৪ এবং আমি এই সবকিছুর জন্যই কেঁদেছিলাম। কিন্তু তবু আমি এটা করেছিলাম। আমি সে কাজটি পছন্দ করিনি, কিন্তু সে পাঁচজন পুরুষ যারা সে রাতে আমার কাছে এসেছিল, তারা দেখিয়ে দিয়েছিল আমাকে কী করতে হবে। তারা জানতো আমি ছোট আর এ কারণেই তারা আরো বেশি উত্তেজিত ছিল।
সে রাতে আমি ৪০০ ডলার কামাই করেছিলাম কিন্তু বাড়ি ফেরার জন্য আমি কোন ক্যাব পাইনি। আমি ট্রেনে করে ফিরে আসি এবং প্রায় পুরো অর্থই আমি আমার নানির হাতে তুলে দিই। এ টাকা কোত্থেকে এলো - এ বিষয়ে একটি কথাও তিনি আমাকে জিজ্ঞেস করেননি।
পরের সপ্তাহের ছুটির দিনেও আমি ডিভিশন এন্ড ক্লার্ক স্ট্রিটে যাই, আর এটাও বুঝতে পারছিলাম আমার নানী খুব খুশিই হচ্ছিলেন যখন আমি টাকা হাতে ঘরে ফিরে আসতাম।
কিন্তু তৃতীয়বার যখন আমি সেখানে গেলাম, দু’জন ব্যক্তি পিস্তল দিয়ে আমাকে আঘাত করলো এবং তাদের গাড়ির ট্রাংকে ভরে নিয়ে গেল। তারা আমার কছে আগেও এসেছিল, কেননা তাদের ভাষায় এই জায়গায় আমার ‘অনধিকার প্রবেশ’ ছিল। ট্রাংকের ভেতর আমি শুধু মৃদু আলো দেখতে পাচ্ছিলাম। প্রথমে তারা আমাকে একটা বিশাল ভুট্টা ক্ষেতের মাঝখানে নিয়ে গেল আর আমাকে ধর্ষণ করলো। তারপর ওরা আমাকে একটা হোটেল রুমে নিয়ে পায়খানায় তালাবদ্ধ করে রাখল।
ঠিক এ কাজটাই দালালেরা করে থাকে একটা মেয়ের মনের জোর ভেঙ্গে দেয়ার জন্য। তারা সেখানে আমাকে একটা দীর্ঘ সময় ধরে বন্দী করে রাখে। আমি তাদের কাছে করজোরে প্রার্থনা করতাম আমাকে চলে যেতে দেয়ার জন্য কেননা আমি খুবই ক্ষুধার্ত ছিলাম, কিন্তু তারা শুধু তখনই আমাকে বের হতে দিল যখন আমি তাদের হয়ে কাজ করতে রাজী হলাম।
তারা আমাকে নিয়ে ব্যবসা করেছিল কিছুদিনের জন্য, সেটা ছ’মাসের মতো সময়। আমি ঘরে ফিরে যেতে সক্ষম ছিলাম না। আমি পালানোর চেষ্টা করেছি কিন্তু ওরা আমাকে ধরে ফেলেছিল আর তখন ওরা আমাকে খুব নিষ্ঠুরভাবে পিটিয়েছিল। এরপর আমাকে নিয়ে অন্য মানুষেরাও ব্যবসা করেছিল। শারীরিক নির্যাতনটা ছিল বিভীষিকাময়, কিন্তু সত্যিকারের নির্যাতনটা ছিল মানসিক নির্যাতন - যে অকথ্য কথাগুলো তারা বলতো সেগুলো সোজা গিয়ে হৃদয়ে বিদ্ধ হতো। তুমি সব ভুলতে পারো কিন্তু সে সব কথা তুমি কখনোই মন থেকে মুছতে পারবে না।
দালালেরা খুব ভালোই নির্যাতন করতে জানে, তারা খুব ভালো হাতের ব্যবহার জানে। কেউ কেউ এমন করতো যে, মধ্য রাত্রিতে তোমাকে ঘুম থেকে জাগিয়ে তুলবে তোমার মাথায় একটা বন্দুক তাক করে। আবার অনেকে এমন একটা ভাব ধরবে যে, সে তোমাকে খুবই মূল্য দেয়, আর তোমার এমন মনে হবে যে, “আমি হলাম সিন্ডারেলা আর এই এলো আমার প্রিন্স চার্মিং।” তাদের খুবই মনোমুগ্ধকর এবং আদুরে মনে হবে এবং তারা তোমাকে বলবে, “তোমাকে শুধু আমার জন্য এ কাজটি করে দিতে হবে। আর তারপরেই ভাল যা কিছু সব তোমার কাছে পৌঁছে দেব।” আর তখন তুমি ভাববে, “আমার জীবনে তো ইতিমধ্যেই অনেক কষ্ট সহ্য করেছি, আর একটু কষ্ট না হয় করলাম, কী হবে?” কিন্তু তুমি কখনোই সেই ভালটুকুর দেখা পাবে না।
যখন মানুষ পতিতাবৃত্তিকে খুব আকর্ষণীয়, অভিজাত কিছু একটা বলে বর্ণনা করে, Pretty Woman সিনেমার গল্পের মতো, আসলে এটা তার কাছাকাছি কোন ব্যাপারও না। একজন পতিতা একদিনে ৫ জন পুরুষের সাথে শুতে পারে। সে হিসেবে, বছরে ১৮০০-এর বেশি পুরুষের সাথে সে যৌনসঙ্গম অথবা ওরাল সেক্স করছে। এর কোনটাকেই তুমি “সম্পর্ক” বলতে পারবে না, কেউই আমার জন্য হাতে করে কোন ফুল নিয়ে আসছে না, আমার কথা বিশ্বাস করতে পারো। তারা আমার দেহটাকে স্রেফ একটা শৌচাগার হিসেবেই ব্যবহার করছে।
আর ওসব খদ্দেরগুলো - এক কথায় হিংস্র। আমাকে পাঁচবার গুলি করা হয়েছে, ১৩ বার ছুরিকাঘাত করেছে ওরা। আমি জানি না কেন তারা আমাকে আক্রমণ করেছে, শুধু এটুকু জানি যে, এ কাজ করার জন্য সমাজ তাদেরকে স্বাচ্ছন্দ্য-সুযোগ তৈরী করে দিয়েছে। তারা তাদের ক্রোধ বা মানসিক অশান্তি - তা যা-ই হোক - নিয়ে আসত আর একজন পতিতার উপর সেই ঝাল ঝাড়ার সিদ্ধান্ত নিয়ে আসতো এটা জেনে যে, আমি তো কখনোই পুলিশের কাছে যেতে পারবো না, আর যদি যাইও, আমার কথায় তারা কান দেবে না।
আমি সত্যি সত্যিই নিজেকে খুব সৌভাগ্যবান মনে করি। আমি কয়েকজন সুন্দরী মেয়ের কথা জানি - যাদেরকে রাস্তার উপর খুন করা হয়েছিল।
কোন ধরণের মাদকে আসক্ত হওয়ার আগেই আমি ১৪ কি ১৫ বছর পতিতাবৃত্তি করেছি। তার কিছু পরে, তোমার টিকে থাকার সব কৌশল শেষ হয়ে যাওয়ার পর, নিঃশ্বাস রুদ্ধ হয়ে যাওয়ার পর, তোমার গলায় কেউ ছুরি রাখার পর অথবা তোমার মাথার উপর কেউ বালিশ চেপে ধরার পর, কিছু না কিছু তো তোমার প্রয়োজন যেটা তোমার চলন প্রক্রিয়ায় কিছুটা হলেও সাহস যোগাবে। ২৫ বছর ধরে আমি এই পেশা চালিয়ে গেছি, এই দীর্ঘ সময়ের মধ্যে একবারের জন্যও এ পেশা থেকে বেরিয়ে আসার একটি উপায়ও খুঁজে পাইনি। কিন্তু ১৯৯৭ সালের এপ্রিলের ১ তারিখ, তখন আমার বয়স প্রায় ৪০, এক খদ্দের আমাকে তার গাড়ি থেকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিলো। আমার জামা আটকে ছিলো গাড়ির দরজার সাথে, ৬টা ব্লক সে আমাকে মাটিতে হিঁচড়ে নিয়ে গেল, আমার মুখ আর শরীরের এক পাশের চামড়া পুরোই ছিলে গেলো।
(চলবে)
সর্বশেষ এডিট : ১৩ ই মে, ২০২১ দুপুর ১২:২৮