somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

মাসউদুর রহমান রাজন
আমি মাসউদুর রহমান, আব্বা আম্মা ডাকেন রাজন নামে। একটা বিশ্ববিদ্যালয়ে পারফর্মিং আর্টস-এর শিক্ষক। ফিল্মমেকিং, অভিনয়, পাবলিক স্পিকিং, প্যান্টোমাইম- এইসব বিষয় পড়াই। এর আগে স্কুলে মাস্টারি করতাম। শিক্ষকতা আমার খুব ভালোবাসার কাজ।

কেন গাজার গল্প বলতে গিয়ে আমি আমাকে বিপদের দিকে ঠেলে দিই

২৯ শে মে, ২০২১ বিকাল ৫:০৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আমিরা হারুদা, অনুবাদ: মাসউদুর রহমান রাজন



(আমিরা হারুদা একজন ফিলিস্তিনি সাংবাদিক ও মধ্যস্থতাকারী। ২০১৬ সালে TED Conference-এ তিনি এই বক্তৃতাটি প্রদান করেন।)


হ্যালো, এটা আমার প্রথম ভ্রমণ, আমার জীবনে এই প্রথমবার আমি গাজার দেয়ালগুলোর বাইরে। এখানে আসতে পেরে আমি খুবই খুশি।

আমার জীবনের লক্ষ্য ছিল একজন পাইলট হওয়ার, প্লেন চালানোর, আকাশে উড়াল দিয়ে মুক্ত-স্বাধীন অনুভব করা, আকাশকে স্পর্শ করা। কিন্তু তা হয়নি। সোজাসাপ্টা কথা হলো, আমি গাজায় বসবাস করি, সেখানে কোন এয়ারপোর্ট নেই। সব সীমান্ত বন্ধ, সব দিক থেকে। আমরা বসবাস করি পৃথিবীর সবচেয়ে বড় একটি জেলখানায়। শুধুমাত্র একটা কাজই আমি করতে পারি- শুধু আকাশের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারি। কোন কোন দিন, আমরা নিজেদের খুবই সৌভাগ্যবান মনে করি যদি আমাদের ঘরে চার বা পাঁচ ঘণ্টা বিদ্যুৎ থাকে। যখন খুব ঠাণ্ডা পড়ে, আমরা ঘরের সামনে বা ছাদে আগুন জ্বালাই। হ্যাঁ, মাঝে মাঝে আমরা খাবারও রান্না করি।

গাজায় আমার পেশা হলো বাইরে থেকে যে সব সাংবাদিক আমার মাতৃভূমিতে আসে গাজায় কী ঘটছে সে গল্প বলার জন্য, তাদের জন্য প্রয়োজনীয় সব কিছুর ব্যবস্থা করে দেয়া। প্রায় দিন সকালে, আমাকে সীমান্ত এলাকায় যেতে হয়েছে কোন না কোন সাংবাদিককে নিয়ে আসার জন্য। যদি সেই সাংবাদিকের কিছু হয়, অথবা যদি সেই সাংবাদিক এমন কোন গল্প বলার সিদ্ধান্ত নেয় যা সরকার চায় না যে প্রকাশিত হোক, আমার কপালে খারাপ কিছু ঘটতে পারে।

সাংবাদিক, চলচ্চিত্রনির্মাতা, সংবাদকর্মীদের নিয়ে আমার দেশের আনাচে কানাচে ঘুরে বেড়ানোই হলো আমার কাজ। আমি বিশ্বাস করি আমার কাজের সফলতা শুধুমাত্র সাংবাদিক আর সংবাদকর্মীর সাথে সম্পর্ক তৈরী করার মধ্যেই নয়, বরং গাজা স্ট্রিপের জনগোষ্ঠির সাথেও সম্পর্ক তৈরী করার মধ্যেও। এই জনগোষ্ঠি যারা কখনোই চায় না তাদের গল্পগুলো বলা হোক, আমি কখনোই তাদেরকে গল্প বা কোন সংখ্যা হিসেবে দেখিনি। বরং আমার মতো, তারাও মানুষ।

গত ১০ বছরে আমি এমন অনেক সম্পর্কই তৈরী করেছি। আর এটা আমাকে মানুষের ভেতরে, তাদের এমনসব গল্পের ভেতরে ঢোকার সুযোগ করে দিয়েছে যা অন্যরা পারেনি। কিছু কিছু পরিস্থিতিতে, আমি অনুভব করি, একজন নারী হিসেবে, আমার সামর্থটা একটু বেশিই। আমাদের এখানে অনেক পুরুষ সাংবাদিক আছেন যারা আমার দেশে মাদকাসক্তি নিয়ে একটা রিপোর্ট করতে চান। এই সমস্যাটা শুরু হয়েছিল যখন গাজা টানেল নির্মাণ করা হয়েছিল। গাজা অবরোধ চলাকালীন, জনগণের সকল নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিসপাতি যেমন, খাদ্য, নির্মাণ সামগ্রী, অন্যান্য আরো যা প্রয়োজন হতো তা টানেলের মধ্য দিয়েই আনা হতো। কিন্তু এখন আর সেটা হয় না, কারণ টানেলের মিশরের অংশটি তারা পানি দিয়ে ভরিয়ে দিয়েছে, টানেল আর কোন কাজে আসছে না। সে সময় অবৈধভাবে মাদকদ্রব্য আসতো এবং অনেক যুবকই এতে আসক্ত হয়ে গিয়েছিল। ফিলিস্তিনি সামাজিক রীতি অনুযায়ী বাইরের পুরুষমানুষের ঘরে প্রবেশ নিষিদ্ধ। তাই কেউই এ নিয়ে রিপোর্ট করার জন্য কোন গল্পই পায়নি, কিন্তু আমি পেয়েছিলাম।

আমি স্বামী হিসেবে একজন অসাধারণ মানুষকে পেয়েছি, অসাধারণ একজন স্বামী যে সমাজের না সমালোচনা সত্ত্বেও আমাকে প্রতিনিয়ত সমর্থন দিয়ে যায়। সে এই মুহুর্তে আমার দুই সন্তানের সাথে ঘরে আছে, আর আরেকজন এখানে আমার ভেতর বেড়ে উঠছে।
আমি যখন কাজে থাকি, আমি তাকে প্রতি দুই ঘণ্টা অন্তর ফোন দেই। আর সেও জানে যদি সে আমার ফোন না পায়, তাহলে যে আমাকে তার সঙ্গে কাজে নিয়ে গেছে, তার সাথে ফোনে যোগাযোগ করতে হবে।

একবার গাজায়, ব্রিটিশ সাংবাদিক এলান জনস্টন অপহরণ হবার সময়টাতে, আমেরিকার একটি ম্যাগাজিন আমাকে অপহরণকারীদের সাথে একটি মিটিংএর ব্যবস্থা করে দিতে বলেছিল, আর আমি সেটা করেছিলামও।
সাংবাদিক স্টোরি কাভার করছিলেন এবং আমাকে বলা হলো তার হোটেলের বাইরে সাক্ষাৎ করার জন্য। তারা আসলো, আমাদেরকে একটা কালো ভ্যানে উঠিয়ে নিয়ে গেলো যার জানালাগুলোও কালো, সেদিন ওরা সবাই কালো মাস্ক পরে ছিলো।
তারা গাড়িতে করে আমাদের অনেক দূরে নিয়ে গেল, একটা বিশাল মাঠের মাঝখানে। তারা আমাদের সেলফোনগুলো নিয়ে গেলো এবং আমরা মাঠে অপহরণকারীদের ইন্টারভিউ নিলাম। সেদিন আমি খুব ভয় পেয়েছিলাম, এমন একটা দিন যা আমি কখনোই ভুলব না।

তো, আমি যা করি তা কেন আমি করি? আমি এটা করি কারণ আমি বিশ্বাস করি যদি আমি তা না করি, তাহলে গাজার গল্পের বিশাল একটা অংশ হারিয়ে যাবে। আরো অনেকগুলো গল্প আছে আমার দেশ সম্পর্কে যা আমি আপনাদের বলতে পারি। আর তার সবগুলোই খারাপ নয়। আমি আমার দেশকে ভালোবাসি, এতসব ভয়ঙ্কর পরিস্থিতিতে বসবাস করা সত্ত্বেও—অবরোধ, দারিদ্র, বেকারত্ব—তবুও সেখানে জীবনের অস্তিত্ব আছে।

সেখানে মানুষ আছে যারা স্বপ্ন দেখে এবং প্রাণপ্রাচুর্যে পরিপূর্ণ অসাধারণ সব মানুষ। আমাদের অপূর্ব সঙ্গীত আছে, সঙ্গীতের বিশাল ধারা আছে। আমাদের পার্কার ডান্সারও আছে যারা তাদের ঘরের ভাঙা দেয়াল-পাথরের মধ্যে নাচে। আর পুরো আরবের মধ্যে গাজা হলো একমাত্র জায়গা যেখানে মুসলিম আর ক্রিশ্চানেরা দৃঢ় ভ্রাতৃত্ববোধ নিয়ে বসবাস করে।

যুদ্ধের সময়গুলোতে, আমার জন্য সবচেয়ে কঠিন ব্যাপার হলো প্রতিদিন সকালে ঘর ছেড়ে বের হওয়া, আমার সন্তানদেরকে রেখে বের হওয়া। আমি প্রতিদিন তাদের একটা করে ছবি তুলি কারণ আমি জানি না আবার আমি তাদের কাছে ফিরে আসতে পারবো কিনা। গাজার মতো একটা জায়গায় একজন মধ্যস্থতাকারি এবং একজন সাংবাদিক হওয়া খুব কঠিন এবং বিপজ্জনক। কিন্তু যখনই আমি গোলাগুলি কিংবা বোমাবর্ষণের শব্দ পাই, আমি সোজা সেদিকে ছুটে যাই, কারণ আমিই সেখানে সবার প্রথমে যেতে চাই, কারণ এই গল্পগুলো সবাইকে জানানো উচিৎ।

আমার বাচ্চারা যখন ছোট ছিল আর তখন যদি আমরা যুদ্ধের শব্দ শুনতাম, আমি তাদের বলতাম এসব হচ্ছে আতশবাজির শব্দ। এখন ওরা বড় হয়েছে, ওরা সব বুঝে। যা আমি প্রত্যক্ষ করেছি যুদ্ধের সময়ে, বিশেষ করে শিশুদের ঐসব প্রাণহীন নিথর দেহ, এসব কিছুর কারণে আমি ভয়ঙ্কর সব দুঃস্বপ্ন দেখি। আমার এখনো মনে পড়ে একটা ছোট্ট বাচ্চা মেয়ের কথা, ওর নাম হালা। তার পরিবারের মধ্যে একমাত্র সে-ই বেঁচে গিয়েছিল।
তার ছবিটা আমার সাথে থাকবে যতদিন বেঁচে থাকবো। আমি কখনোই তাকে ভুলবো না।

আমি খুব গর্বিত আমি আজকে আপনাদের সাথে এখানে দাঁড়িয়ে। আমি গর্বিত আমি আপনাদের দুঃখের এবং সুখের গল্প শোনাতে পারছি, পৃথিবীর ছোট্ট একটা কোনা, আমার গাজার গল্প। আমি গর্বিত আমি হলাম গাজার প্রথম নারী মধ্যস্থতাকারী। আর মজার ব্যাপার হচ্ছে তারা সবাই আমাকে গাজার মিঃ র‌্যাম্বো বলে ডাকে।

আমি আশা করি একদিন আমি আমার দেশের আর সব নারীদের গল্প, আর সব অনন্যসাধারণ নারীদের গল্প আপনাদের শোনাবো। আমি আশা করি একদিন আমি আমার দেশের আর সব নারীদের আমার মতো মধ্যস্থতাকারী হতে সাহায্য করতে পারবো। আর অবশ্যই মাঝে মাঝে, আমারো মনে হয় এই কাজ আর আমার পক্ষে চালিয়ে নেয়া সম্ভব না, এখন আমার জন্য এটা বেশি বেশি হয়ে যাচ্ছে। আমার তখন কেবল এই কথাগুলোই মনে পড়ে: “তোমার চ্যালেন্জকে সীমাবদ্ধ করো না, বরং তোমার সীমাবদ্ধতাকে চ্যালেন্জ করো। তোমার স্বপ্নের সামনে কাউকে দাঁড়াতে দিও না।”

সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে মে, ২০২১ বিকাল ৫:০৩
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডালাসবাসীর নিউ ইয়র্ক ভ্রমণ

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ২:৪৪

গত পাঁচ ছয় বছর ধরেই নানান কারণে প্রতিবছর আমার নিউইয়র্ক যাওয়া হয়। বিশ্ব অর্থনীতির রাজধানী, ব্রডওয়ে থিয়েটারের রাজধানী ইত্যাদি নানান পরিচয় থাকলেও আমার কাছে নিউইয়র্ককে আমার মত করেই ভাল ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

ধর্ম ও বিজ্ঞান

লিখেছেন এমএলজি, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ ভোর ৪:২৪

করোনার (COVID) শুরুর দিকে আমি দেশবাসীর কাছে উদাত্ত আহবান জানিয়ে একটা পোস্ট দিয়েছিলাম, যা শেয়ার হয়েছিল প্রায় ৩ হাজারবার। জীবন বাঁচাতে মরিয়া পাঠকবৃন্দ আশা করেছিলেন এ পোস্ট শেয়ারে কেউ একজন... ...বাকিটুকু পড়ুন

তালগোল

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫


তু‌মি যাও চ‌লে
আ‌মি যাই গ‌লে
চ‌লে যায় ঋতু, শীত গ্রীষ্ম বর্ষা
রাত ফু‌রা‌লেই দি‌নের আ‌লোয় ফর্সা
ঘু‌রেঘু‌রে ফি‌রে‌তো আ‌সে, আ‌সে‌তো ফি‌রে
তু‌মি চ‌লে যাও, তু‌মি চ‌লে যাও, আমা‌কে ঘি‌রে
জড়ায়ে মোহ বাতা‌সে ম‌দির ঘ্রাণ,... ...বাকিটুকু পড়ুন

মা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৩


মায়াবী রাতের চাঁদনী আলো
কিছুই যে আর লাগে না ভালো,
হারিয়ে গেছে মনের আলো
আধার ঘেরা এই মনটা কালো,
মা যেদিন তুই চলে গেলি , আমায় রেখে ওই অন্য পারে।

অন্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

কপি করা পোস্ট নিজের নামে চালিয়েও অস্বীকার করলো ব্লগার গেছে দাদা।

লিখেছেন প্রকৌশলী মোঃ সাদ্দাম হোসেন, ২৫ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ২:১৮



একটা পোস্ট সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে বেশ আগে থেকেই ঘুরে বেড়াচ্ছে। পোস্টটিতে মদ্য পান নিয়ে কবি মির্জা গালিব, কবি আল্লামা ইকবাল, কবি আহমদ ফারাজ, কবি ওয়াসি এবং কবি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×