আমার নাম ইমি (গল্প)
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
রাস্তার পাশের ফার্মেসীতে সময় দেখলাম সন্ধ্যা ৬:৩০ বাজে। আমার হাতে ঘড়ি নেই, পরিনা। প্রয়োজন মনে হয়না। অথবা বলা যায় কেউ আমার বয়েসী কেউ আজকাল ঘড়ি পড়েনা দেখে আমিও পরিনা। ইতস্তত হাটছি। ভাল লাগছে বেশ। ঢাকার রাস্তায় সন্ধ্যেবেলা হাটার মজাই আলাদা। রাতে মজটা আরো বেশি যদিও। হাটতে হাটতে একটা গলির মাথায় চলে এসেছি। চায়ের দোকানে পাশে একজন মুড়িওয়ালা মুড়ি মাখা বিক্রি করছে। আমি ৫ টাকার মুড়ি নিলাম। এখন মনে হয় আর ৫ টাকার কমে মুড়ি মাখা কিনতে পাওয়া যায় না। চায়ের দোকানের সামনে বেঞ্চে বসে আয়েশ করে খাচ্ছি। শীত পড়ছে ধীরে ধীরে। আর কয়েকদিনের মধ্যে পুরোপুরি শীত পরে যাবে। আমার পড়নে একটা লাল টি শার্ট। হিসেবে একটু ঠান্ডা ঠান্ডা লাগার কথা! কিন্তু লাগছে না। আমার সামনে ১২-১৩ বছরের একটা বাচ্চা এসে দাড়াল। বলল- ভাইজান খিদা লাগসে। সকাল থিকা খাইনাই। কিছু টাকা দেন না। আমি ছেলেটাকে ভাল করে দেখলাম। হাড্ডিসার, করূন চেহারা। পাজরের হাড় গুলো আলাদা করে গোনা যাচ্ছে। চোখে-মুখে স্পষ্ট মলিনতা। এসব ক্ষেত্রে যা সাধারণত হয়, ভিক্ষা করাটা এদের পেশা হয়। যে কারণে মানুষের দৃষ্টি আকর্ষনের জন্যই শরীরের এ হাল। তবে এই ছেলেটাকে দেখে সেরকম মনে হল না। এ মনে হয় সত্যি কথা বলছে। আমি জিজ্ঞেস করলামঃ নাম কি আপনার? ছেলেটা মনে হয় “আপনি” শুনে অবাক হয়েছে। ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে আছে। আবার জিজ্ঞেস করলামঃ কি ভাইজান, নাম কি?
ছেলেটা বললঃ ভাইজান কি আমার সাথে মজা লইতাসেন?
না! মজা নিব কিসের জন্য?
-তাহলে আমারে আপনি ডাকতাসেন কিসের জইন্য?
কেউ আপনি ডাকে না?
-না।
তাহলে সবাই কী ডাকে?
-তুই।
আমিও কি তুই ডাকব।
-জ্বী। ডাকলে ভাল হয়।
আচ্ছা ঠিক আছে। এখন বল তোর নাম কি?
-মনির।
ছেলেটা বেশ আগ্রহ ভরে আমার সাথে কথা বলছে। এর প্রধান উদ্দেশ্য যদি ভিক্ষা করা হত, তাহলে এতক্ষন কথা বলত না। দুই তিনটা কথার পর বলত, এত প্যাচালের টাইম নাই। টাকা দিলে দ্যান, না দিলে যাইগা।
মনির মিয়া তার বাসা কোথায়, মা-বাবা কি করে, কয় ভাই বোন ইত্যদি বলে ফেলল। এখন সে আমার পাশে বেঞ্চে বসে চা আর কেক খাচ্ছে। আমি বললামঃ মনির মিয়া! তুই যে গ্যারেজে কাজ করিস, তার মহাজন কি তোরে মারসে নাকি?
মনির মিয়া বিষম খেল। কারণ সে যে গ্যারেজে কাজ করে, এই কথাটা সে এখনো আমকে বলে নি।
সে বিস্মিত হয়ে জিজ্ঞেস করলঃ আপনে কিভাবে জানলেন যে আমি গাড়ীর গ্যারেজে কাম করি?
অনুমানে বলেছি। (পুরোটা অনুমানে বলিনি। ছেলেটার সারা গায়ে গ্রীজ জাতীয় কিছু একটা লেগে আছে। শুকিয়ে গেছে।)
ছেলেটা আমাকে বিশ্বাস করতে পারছে না। ঘোর কাটিয়ে বললঃ জ্বী মারছে।
কেন মারসে?
-চুরির জইন্য। আমি নাকি গাড়ীর কোন পার্টস চুরি কইরা বেইচা দিসি। বিশ্বাস করেন ভাইজান, আমি চুরি করি নাই।
আমি জানি তুই করিসনি। তোকে কি কাজ থেকে বের করে দিসে?
-জ্বী।
তো এখন কি করবি? খাবি কি?
-জানিনা ভাইজান। উপরে আল্লাহ আছে, কিছু না কিছু তো হবেই।
যাবি নাকি আমার সাথে? কাজ করবি?
-জ্বী যামু।
মনির মিয়া চট করে রাজি হয়ে গিয়ে আমাকে বিপদে ফেলে দিল। কথাটা আমি এমনি বলেছি। ব্যাচেলর মানুষ, আমার নিজেরই থাকা খাওয়ার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। এখন এই ছেলেটা কে আবার কই নিয়ে যাব? কিন্তু কথা যখন দিয়ে ফেলেছি... দেখা যাক।
বিল মিটিয়ে দিয়ে আমি আর মনির হাটা শুরু করলাম। ওকে জিজ্ঞেস করলামঃ আর কিছু খাবি?
-জ্বী না। আপাতত এতেই চলব। রাইতে একটু ভাত পাইলেই হইব।
মনির বললঃ আপনের নাম কি?
নাম জেনে কি করবি?
-নাম জানা লাগব না? এইযে আপনে আমারে খাওয়াইলেন, এখন চিন পরিচয় হবে না?
চিন পরিচয়? বেশ। আমার নাম ইমি।
-এইডা কেমন নাম! মাইয়া মানুষের নামের মত!
আমি দীর্ঘশ্বাস ফেললাম। আমার আসল নামটা আমি কাউকে বলিনা। এই নামটা দিয়েছে অনিতা। নামটা আমার বেশ ভাল লাগে।
নাম টা আমার বান্ধবী দিয়েছে।
মনির কিছু বলল না, হাসল।
-যে আপায় নাম টা দিসে, আপনি কি উনারে পছন্দ করেন?
আমি কোন উত্তর দিলাম না।
-ভাইজান আপনে কি করেন?
কিছু করিনা।
-না মানে আপনের পেশা কি?
আমার কোন পেশা ফেশা নাই। হন্টক বলতে পারিস।
-হন্টক... মানে কি?
যে শুধু হাটে তাকে হন্টক বলে।
-আপনের কথাবার্তা বেতালা লাগতেসে।
আমি একটা অর্থহীন হাসি দিলাম।
হাটতে হাটতে আমরা বড় রাস্তায় চলে এসেছি। আচ্ছা, আমার সাথে হিমুর কোন মিল খুজে পাচ্ছেন কেউ? হুমায়ূন স্যারের হিমু? হঠাত হিমুর প্রসংগ কেন এল? এল কারণ আমার পরিচিত কারো কারো ধারণা আমি নাকি হিমু হয়ে যাচ্ছি! এ কথা শুনতে শুনতে আমি বিরক্ত। হিমুর সাথে আমার কোনই মিল নেই। হিমু হলুদ পাঞ্জাবী পড়ে, আমি যা খুশি তাই পড়ি। হিমুর পায়ে স্যান্ডেল থাকে না, আমার পায়ে থাকে। হিমুর পাঞ্জাবীর পকেট নেই, আমার পকেট আছে, মানিব্যাগ ও আছে। হিমুর বুদ্ধিমত্তা অসাধারণ, আমার শ্যূণ্যের কোঠায়। একটা ব্যাপারে অবশ্য হিমুর সাথে আমার কিছু মিল আছে, সেটা হল আমার অনুমান ক্ষমতা ভাল।
*
কোথাও উচ্চ স্বরে গান বাজছে। ঘুম ভাংতে বুঝলাম আমার সেলফোন। সকালে আমি জীবনেও ঘুম থেকে উঠতে পারিনা। আমার ভোর হয় সকাল আটটায়। এখন বাজে সাড়ে সাতটা। কে আমার ঘুম ভাঙ্গাল? মিসড কল অনিতার। দিক ফোন। আমি ধরব না। আমি আটটার আগে কারো ফোন ধরি না। আবার বাজছে। আমি কেটে দিলাম। অনিতা আর ফোন দেবে না। ও জানে, আমি কেটে দিলে সারা দিন কল করেও লাভ নেই। আমি যখন কল করব, তখনি কেবল কথা বলা যাবে।
নিচে নেমে আশরাফ মামুর চায়ের দোকানে চলে আসলাম। সকাল বেলা খালি পেটে এক কাপ রঙ চা আর দুইটা সলটেস বিস্কুট, এটা আমার নাস্তা। আমাকে দেখেই আশরাফ মামু ৩২ দন্ত বিকশিত করে একটা হাসি দিল। আমিও একটা হাসি দিলাম। হাসি বিনিময় আরকি!
চা খেতে খেতে বললামঃ মামু চায়ে চিনি কম হইসে। আমার চায়ে আদা-চিনি বেশি। এতদিন পরেও তোমার মনে থাকেনা!
আশরাফ মামু ভ্রুকুটি করে তাকাল। মামা আপনার কি হইসে? চায়ে আইজকা ৩ চামচ চিনি দিসি! অন্যদিন আড়াই চামচ দেই।
তাই নাকি!
-হ।
চিন্তায় পড়ে গেলাম। আমার জিহ্বার কর্মক্ষমতা কি নষ্ট হয়ে গেল! তাই মনে হয়... সলটেস বিস্কিট মুখে দিয়ে কেমন মিষ্টি মিষ্টি লাগল। আমি মামুর দিকে ভয়ে ভয়ে তাকালাম। মামুর মুখে হাসি!
হাসেন কেন?
-মিষ্টি লাগতেসে না বিস্কুট?
হুম! কেন?
-এইটা তো সলটেস বিস্কুট না! এইটা মিষ্টি বিস্কুট। সল্টেস পাশের কৌটায়।
ও! তুমি না সবসময় এই কৌটাতেই সল্টেস বিস্কিট রাখো?
-আজকে কৌটা চেঞ্জ করসি।
বাড়ির পথে হাটা ধরলাম। আশরাফ মামুর সাথে মাসকাবারী চুক্তি আমার। বিল দেয়ার ঝামেলা নাই।
এর পরে আর লেখা হয়নাই! লিখতে আলসী লাগে! পড়ার জন্য ধন্যবাদ!
২টি মন্তব্য ১টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ক- এর নুডুলস
অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।
ক
একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন
কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???
কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???
আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন
স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১
বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু
২-১ : আলিফ-লাম-মীম
আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন
কুরসি নাশিন
সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন
বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!
যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।
কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!
ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন