কে যাস্ রে ভাটি নাও বাইয়া, আমার ভাইবোনরে কইয়ো নাইওর নিতে বইলা - গানটা এমনই তো মনে হয়। গানের কথা আর আগের মতো মনে থাকে না, ইসাবেলার। গান শোনার সময় ই বা কোথায়! এখন শুধু দে দৌড়। কোথায় ভাই বোন, কোথায় কি! গত এগারো বারো বছরে নিজের বাবা-মাকে ঈদের সালাম ঈদের দিন করে উঠতে পারেনি, ভাই বোন তো অনেক দূরের ব্যাপার। নিজেকে নিজে বুঝিয়েছে এটাই নিয়ম। ঈদের পরদিন বাবার বাড়ী যেতে পারলে সেটা সৌভাগ্য ছাড়া আর কি!
রাস্তায় বাতাসও জ্যামে আটকে আছে এমনই জবরজং অবস্থা। বাসে বসে ভাবা ভিন্ন অন্য উপায় নেই। যাকাতের কাপড় কিনতে বের হয়েছে। আদৌ কেনার জায়গা পর্যন্ত পেঁৗছতে পারবে বলে ইসাবেলার মনে হচ্ছে না। রাতে মাত্র দু'বার দু' ঘণ্টার জন্যে ইলেকট্রিসিটি এসেছিলো, ঘুমের দফারফা। সেহরী খাওয়া যায়নি ঠিকঠাক, রোজা মুখে কেমন জানি অবসাদ লাগে ইসাবেলার। এই অক্টোবরে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা না কি চৌত্রিশ ডিগ্রী! তাপমাত্রারও উন্নয়ন ঘটেছে বলতে হবে। ও নিজের মনেই হাসে। যাকাত ফাকাত আসলে ওর নিজেরই লাগবে, বাঁচতে হলে। একটা ইউপিএস কেনা জরুরী, কিনতে পারছে কই! ভদ্রলোকের অনেক হ্যাপা, পেটে ক্ষুধা থাকলেও বলার জো নেই। পেটে-বুকে পাথর বেঁধে স্বাভাবিকতার অভিনয় করতে হবে। ইসাবেলার বাবা- মা দুজন মিলে এই উপার্জন করতো না ওর মেয়েবেলায় ও একা এখন যতটা আয় করে। বাড়ী ভাড়া দেবার পর ওদের তিনজনের সংসারে যা থাকে তা নিয়ে আর যাই হোক ঈদ উপল েক্ষ বিশেষ নাচানাচি করার কোন অবকাশ থাকে না।
অজগরের লেজে সামান্য দোলা লেগেছে, বাস নড়ছে। অবশেষে মার্কেটে পৌঁছে ইসাবেলা। মানুষ ছুটছে। আঁতকে উঠছে কেউ কাপড়ের দাম শুনে। কেউবা নির্বিকার কিনে নিচ্ছে। যে টাকা নিয়ে এসেছিলো ইসাবলো তাতে পাঁচটার জায়গায় তিনটা শাড়ী কিনেই সন্তুষ্ট থাকতে হয়। মিনার এই নিয়ে তিনবার ফোন করেছে বাসায় কখন যাবে জানতে। যেন ইসাবেলা একটা নির্দিষ্ট সময় বললেই সেই সময়ের মাঝে পৌঁছতে পারার সিওরিটি আছে! এখান থেকে বের হলে সিএনজি ট্যাক্সি চালকরা মিটার নামিয়ে রাখবে, বলবে চুক্তিতে যাবে। বাসের জন্য তো কিউতে কতক্ষণ দাঁড়াতে হবে তা ভাগ্যই বলতে পারে।
জমজমাট মেলা মানুষের, ঘন শরের মতো গায়ে গা লাগানো ভিড় দেখে ইসাবেলার ভালো লাগে। এটাই তো বেঁচে থাকার মোক্ষম টনিক। পরিস্থিতি যাই হোক আনন্দের সময়টুকুতে যোগদান করা। ঈদ তো সেই আনন্দই। ইস্, পাশে যদি এখন কেউ থাকতো তাহলে এমনিই ও জিজ্ঞেস করতো ঈদ কি সার্বজনীন? সার্বজনীন শারদীয় দুর্গাপূজার মতো সার্বজনীন হেমন্তীয় ঈদ উৎসব। আবারও হাসি পায় ইসাবেলার নিজের উল্টাপাল্টা চিন্তাতে।
দেয়াল লিখনে চোখ পড়তে ওর ভাবনা ডানা ঝাপ্টায় তরাসে। 'নারীদের ঈদগাহে কিংবা মসজিদে গিয়ে নামায পড়া হারাম' - প্রচারে আল-বাইয়্যিনাত। ঈদের জামায়াতে ইসাবেলা কখনো যেতে পারেনি কিন্তু ওরা ওদের ছোটবেলায় সবাই ঈদের নামাযের মাঠ পর্যন্ত যেত। এ এক অন্য আনন্দ। নারীদের জন্যে সব খোলামেলা বিচরণ, আনন্দের উৎস কেন যে শূকর না খাওয়া মুসলমানরা হারাম করার জন্যে উঠে পড়ে লেগেছে তা কোনভাবেই ইসাবেলার মাথায় ঢোকে না। মহানবীর জমানায় নারীরা ইমামতিও করেছে, করেছে যুদ্ধ। এখন ইসলামী সভ্যতার ধ্বজাধারীরা তার সবই নিষিদ্ধ করে দিচ্ছে নিজেদের সুবিধামতো। কবে যে ওর লিমিনকেও ইসলামী লেবাসে ঢেকে দিতে হবে কে জানে!
ত্রিশ মিনিটের দূরত্ব এক ঘণ্টা ত্রিশ মিনিটে অতিক্রম করে ক্লান্ত শ্রান্ত ইসাবেলা অন্ধকার ঘরে ঢোকে ভাগ্যকে অভিসম্পাত করতে করতে। কারেন্ট নেই। গরমে নেতিয়ে ওর দুবছরের লিমিন ঘুমিয়ে পড়েছে এই অন্ধকারেই। পাওয়ার সেক্টরকে পুরোপুরি বেসরকারীকরণের জন্যে কি অভিনব চাল! যত যাই হোক গিলোটিনে মাথাটা ইসাবেলাদের মতো নিরীহ মানুষদেরই দিতে হচ্ছে। বাঁচার জন্যে কত টাকা লাগে! একজনেরই যদি 250কোটি ডলার বাজেয়াপ্ত হয় এবং সে বহাল তবিয়তে বেঁচে থাকে কোনরকম শোক ছাড়া (বলতে নেই তিনমাস আগে ইসাবেলার 2000টাকা ছিনতাই হয়েছিলো তাতেই ও একমাস ঝুম মেরে ছিল) তাহলে তার আসলে কত টাকা আছে? তারপরও টাকার দরকার? কত কি হয় কতজনের নামে! জীবিত মানুষের জন্যে ভাস্কর্য হয়ে যায় স্বাধীনতাযুদ্ধে যেসব বীর শহীদ হয়েছেন তাদের পাশে শুধু ইসাবেলার দুবছরের বাচ্চাকে নিয়ে এসিও না একটা চলন্ত ফ্যানের নীচে নিরুপদ্রব ঘুমের ছোট্ট স্বপ্ন কখনো পূরন হয় না।
ভাবনায় ছেদ পড়ে। মিনার বাথরুম থেকে বের হয়।
-একটা ভালো আরেকটা শকিং খবর আছে।
ইসাবেলা মিনারের দিকে মনোযোগ দেয়।
-কি?
-আমার হংকং এ ট্রেনিংটা হয়েছে। নেক্সট উইকে যেতে হবে। তোমাদের সাথে ঈদে থাকতে পারব না।
ইসাবেলা মনের তীব্র আনন্দ গোপন করে মন খারাপের সুনিপুণ অভিনয় করে। ওর মন খারাপের বহর দেখে মিনার বলে ফেলে, 'আমার মনে হয় তুমি এবার তোমাদের বাসায় ঈদ করলে ভালো করবে। আম্মাও তো মামার বাড়ী চলে যাচ্ছে। তুমি লিমিনকে নিয়ে একা, একা...তারচেয়ে তুমি লিমিন, লিমিনের নানাবাড়ীই যাও।"
ইসাবেলা নাইওরে যাচ্ছে না কিন্তু ওর সেরকমই লাগছে। লিমিন ওর মামার কোলে, ইসাবেলা গাড়িতে ওঠে। কতবছর পর ঈদের ভোরে মায়ের চুমুতে ওর ঘুম ভাঙ্গবে, ভাই একটানে বিছানা থেকে দাঁড় করিয়ে দেবে। নিজের অতীতকে আবার কাছে পাবার জন্যে ইসাবেলা মনে মনে বলে, ঈদটা একটু তাড়াতাড়ি হোক, ঊনত্রিশ রোজা ই যথেষ্ট।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে ডিসেম্বর, ১৯৬৯ সন্ধ্যা ৭:০০

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।



