দ্বীপ উপজেলা হাতিয়ার বিচ্ছিন চরাঞ্চলের সাধারণ মানুষের জীবন কাটে বহু কষ্টের মাঝে। উপজেলার চরাঞ্চলের প্রায় ৯৫ ভাগ মানুষ রয়েছে দরিদ্র সীমার নিছে। বন্যা, ঝড়-জলোচ্ছ্বাস, নদী ভাঙ্গন, অতিবৃষ্টি, আশ্বিন-কার্তিক মাসের ‘মঙ্গা’ আর পৌষ-মাঘের কনকনে শীতের কষ্টকে সঙ্গী করে জীবন কাটাতে হয় তাদের। নেই কোন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, আশ্রয়কেন্দ্র ও স্বাস্থ্যসেবা। তিন বেলা পেটফুরে খেতে পাওয়া পরিবার চরে খুঁজে পাওয়া যাবে না। কেউ হয়তো একবেলা খায়, কেউ দুইবেলা। সব মিলিয়ে চরবাসীর দুঃখ-কষ্ট যেন নিত্যসঙ্গী।
‘তিনবার দৈরা ভাঙ্গি বেগ্গিন লই যাইবার হর নলেরচরে আইছি। তুফান আইলে ঘরে বই আল্লারে বোলান ছা- আঙ্গো আর কিছুই করার নাই। দেশের বাড়িততো দুই এক্কান দেলান কোটা দেখতাম। ইয়ানে আই হেইটাও দেখিনা। গত বইন্নার সময় আঙ্গোরে কেউ দেখতে আয়েন। শিতকালেও খবর নেয়না কেউ।’ দীর্ঘ শ্বাস নিয়ে কথাগুলো বললেন বিচ্ছিন্ন নলেরচরে বসবাসকারী আবুল হাশেম। সম্প্রতি উপজেলার চরাঞ্চলে ঘুরতে গেলে দেখা যায় সাধারণ ভূমিহীনদের এমন চিত্র।
১১টি ইউনিয়ন ও ছোট-বড় মোট প্রায় ২৯টি চর নিয়েই দ্বীপ উপজেলা হাতিয়া গঠিত। এসব চরে প্রায় ২ লক্ষাধিক মানুষ বসবাস করে। এর প্রায় সকল পরিবারের পুরুষ সদস্যরা কাজের সন্ধানে ছুটে যায় ঢাকা, চট্টগ্রাম, সিলেট, কুমিল্লা, কক্সবাজার, মহেষখালী কিংবা কোন বড় বড় শহরে। কেউবা আবার নদীতে মাছ শিকার করে জিবিকা নির্বাহ করেন। আবার অনেকেই মাছ ধরতে গিয়ে জলদস্যুদের হাতে সর্বস্ব হারিয়ে মানবেতর জীবন যাপন করতে হয়। ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাসসহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবেলায় কোন প্রস্তুতি নেই এসব লোকের। এ চিত্র দেখা গেছে বয়ারচর, নলেরচর, ক্যারিংচর, নঙ্গলিয়ারচর, চরবাশার, চরআজমল, ডালচর, কালাদুর, দমারচর, নিঝুমদ্বীপ, বন্দরটিলা, জাগলারচর, কালামচরসহ সকল চরাঞ্চলের সাধারণ ভূমিহীন মানুষের।
সম্প্রতি দেশের উপকূলে বয়ে যাওয়া মৌসুমী লঘুচাপের প্রভাবে প্রবল বর্ষণ ও অমাবস্যার তীব্র জোয়ারে এসব এলাকার বিস্তীর্ণ ভূমি ৮-১০ফুট পানিতে তলিয়ে যায়। এ সময় মূহুর্তের মধ্যে পানি বন্ধি হয়ে পড়ে এলাকার ৫০ হাজার পরিবার। ভেসে যায় চরাঞ্চলের প্রায় ২০হাজার গবাদি পশু। ভেঙ্গে যায় ৮-১০ হাজর কাঁচা ঘরবাড়ি। পানি বন্ধি পরিবারের সদস্যরা খাদ্যের অভাবে মানবেতর জীবন যাপন করছে। জোয়ারের তোড়ে চর ও দ্বীপ গুলোর প্রায় ৪০হাজার একর রাজা শাইল ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। পানিতে ভেসে যায় হাজার হাজার মৎস্য খামারের মাছ। জোয়ারের পানিতে ভেঙ্গে যায় প্রায় ২০ কিঃ মিঃ কাঁচা ও পাকা রাস্তা। ক্ষতিগ্রস্থ হয় প্রায় ১৫ কিঃমিঃ বেড়ীবাঁধের। তবুও থেমে থাকেনি তাদের জীবন।
এসব চরের পুরুষেরা কাজের সন্ধানে শহরে গেলে তাদের পরিবারগুলো বাড়িতে হয়ে পড়ে অভিভাবকহীন, ভোগে নিরাপত্তাহীনতায়। এ সময় অনেক পরিবারের নারী ও কন্য সদস্যদের উপর চলে যৌন নির্যাতনের ঘটনা। পরিবারে পুরুষ সদস্যরা বাড়িতে না থাকায় তাদের এসব হয়রানি নিরবে মেনে নিতে হয়। কেউ এসবের প্রতিবাদ করলেও সুবিচার পায়না। উপরন্তু এসব ঘটনা জানাজানি হলে ওই নারীকেই কলঙ্কিনী নারী হিসেবে থাকতে হয় সমাজে। তাই চরাঞ্চলের দারিদ্র্য পীড়িত নারীরা মুখ বুজেই সহ্য করেন এসব নির্যাতন।
কাজের সন্ধানে বাড়ির পুরুষ সদস্যরা শহরে এলে বাড়িতে থাকা নারী-শিশু সদস্যদের খাওয়া চলে সারাদিন একবেলা। নয়তো সুদের উপর টাকা ধার করে চলতে হয়। কাজ থেকে ফিরে সেই ্ঋণের টাকা পরিশোধ করে যা টাকা হাতে থাকে তাই দিয়ে চলে বাকি ক’দিন। তারপর আবার সেই ঋণ করে চলা। এভাবেই চলে তাদের জীবন চক্র। অভাব এদের পিছু ছাড়ে না।
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ সন্ধ্যা ৬:৫০