রাতের আকাশে অসংখ্য তারার ভিড় আজ। দু-একটা এলোমেলো মেঘ অন্যদিন ভুল করে চলে আসে।আজ ওরাও ভুল করতে ভুলে গেছে হয়তো!
ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেছে। আশপাশ থেকে ভেসে আসা ছিটেফোটা আলোও এবার নিরুদ্দেশ! এখন রাতের আকাশ আরও জমকালো। চারপাশের মসৃন কালোয় শুধু তারাদের আনাগোনা । এ ছাদ থেকে বাইরের কোলাহল অনেক দূরের।পাশের বাড়ির বাঁশঝাড় আমাদের ছাদে হেলান দিয়ে ঝিমুচ্ছে ! রাত্রি চুপিচুপি কখন জানি ওদের দিয়ে গেছে কালচে সবুজ পোশাক ! অন্ধকারের সুযোগ নিয়ে কটা ফেরারী জোঁনাকি হাজির...বাঁশপাতার ফাঁক দিয়ে ওরা উঁকি দিয়ে বুঝে নিতে চাইছে এসময়ে শহরে আসাটা ঠিক হল কিনা..!
ছাদের এপাশের কদম গাছটা একসময় আমার সমান ছিল...এখন দিব্যি দোতালা ছাদকেও হারিয়ে দিয়েছে...! তখন এ কদম গাছটার কাছে স্কুল থেকে ফিরেই ছুটে আসতাম ! স্কুলের গল্প গুলো শোনাতে...! দুপুরগুলিতে বাড়িতে রমা খালা ছাড়া আর কেউ থাকতো না..ও ব্যস্ত থাকতো কত কি কাজে..ভর দুপুরেও বাড়িটা ভিষণ খাঁ খাঁ করতো তখন...আমি আর মা মরে যাওয়া কদম গাছটা গল্প করে দুজন দুজনের নিঃসঙ্গতা দূর করে দিতাম...! শূন্যতায় ভরা দুপুরগুলি বেশ কেটে যেত কল্পপুরের সব রাজকুমারী আর দত্যি-দানোর সাথে...!
কেমন আছো...?
উত্তর যথারীতি নেই...!
একসময় নিজে বানিয়ে নিতাম জবাব...! এবার দেখে নিলাম..! ও ভিষণ ভাল আছে..।গত বর্ষার সাজ এখনো গায়ে।পাপড়ি ঝরা কমলার মত হয়ে উঠা কদম জানান দিচ্ছে ও কতটা সুখে আছে।ওর নতুন সঙ্গীকেও দেখতে পেলাম যেন...!অন্ধকারে আবছা অবয়ব।ওর কথা বাসায় পা দিয়েই শুনেছি।গাছের আম সে তার মনে করে বাড়িতে নিয়ে যায়...! কদমের ডালে বেশ ভাবুক ভঙ্গিতে দাড়িয়ে বিশাল লেজটা রাজকীয় হালে একটু একটু নাড়াচ্ছে আর খুব মনযোগ দিয়ে কি একটা জরিপ করছে..।রাতে কোন কদমটা দিয়ে খাবারের পর্ব সারা হবে সেটাই হয়তো...।
কাঠবিড়ালীকে কি ঈর্ষা করা যায়...? না..থাক! থাক ওরা বন্ধুতে মিলেমিশে...আমিওতো বদলে গেছি..!
আজ বিকেলে আকাশে অনেকগুলি সাদা ঘুড়ি দেখেছিলাম..হয়তো ওরই একটা ছাদের এ কোনটায় পড়ে আছে... না জানি কোন লক্ষী বাবুটার ঘুড়ি...কেটে গেছে তাতে কি...উড়েছে তো ওর ঘুড়ি...আমার ঘুড়ি আজ পর্যন্ত উড়েনি..!
জানতাম না একা ঘুড়ি উড়ানোই যায়না! প্রথমটায় ঘুড়ি উড়িয়ে দিতে কাউকে যে লাগে এ ছোট মাথায় আসেইনি ।বারবার চেষ্টা করছি ঘুড়িটা উড়াতে।ও উপরেই উঠছেনা..! আমি চেষ্টা করেই যাচ্ছি..আমার চেষ্টায় বিরক্ত হয়েই যেন ঘুড়ি গেল ছিড়ে ! ঝাপসা চোখে দেখেছিলাম অন্যদের ঘুড়িগুলো উড়েই চলছে...আমার হাতে লাটাই আর ছেড়া ঘুড়ি....। অনেকক্ষণ সেদিন ছাদে থাকি।আকাশের ঘুড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে বহুক্ষন ধরে ভেবেছিলাম...একদিন আমার ঘুড়িও উড়বে....অনেক উচুতে উঠে ঐ মেঘদের গুঁতো দিয়ে আসবে....!
কি ভিষণ বোকা বোকা কষ্ট ছেলেবেলার..! বোকা বোকা নিঃসঙ্গতাগুলি কত বিভ্রান্তিতে আশ্রয় খুঁজেছে বারবার....! নিঃসঙ্গতা সবসময়ই কেন বিভ্রান্ত হয়...? সবসময় কেন ভুল কোথাও নিয়ে যায়?
বাঁশের পাতাগুলি তিরতির করে কাঁপছে.....কাঠবিড়ালীটা কদম গাছ থেকে অন্য গাছে ছুটে গেল, জোনাকীগুলো বাঁশপাতা ছেড়ে আম গাছটিতে ভিড় জমালো, অনেকক্ষন থেকে ছাদের অন্ধকার কোণে কিছু খুঁজে বেড়ানো ইঁদুরটাও অন্য কোথাও চলে গেল।রাত বাড়ছে, আকাশে তারাদের ভিড় বাড়ছে..আর নিঃসঙ্গতা তার ভুলের জাল বুনে চলেছে।
------------------------------