জানালা
জানালা মানেই বদ্ধ ঘরে ঢুকে পরা একচিলতে স্নিগ্ধ বাতাস, জানালা মানে বৃষ্টির মাঝে আনমনে হাত বাড়িয়ে বৃষ্টির ছোঁয়া নেয়া, জানালা মানে রাত শেষে ভোরে এক চিলতে স্নিগ্ধ রোদ। জানালা মানে ঢিলের সাথে উড়ে আসা প্রেমের প্রথম চিরকুট।
সবই ঠিক আছে কিন্তু আমাদের মত নিম্ন মধ্যবিত্ত ঘরের ছেলেরা ঢাকায় এসে খুব ঘুরে ফিরে যে বাসা টি খুঁজে পায় সেটিতে জানালা নামক বস্তুটি থাকা বা না থাকাতে তেমন কিছু আসে যায় না। অনেক সময় সাধের জানালা খোলা পর্যন্ত যায় না। জানালা দিয়ে খোলা বাতাস, ভোরের স্নিগ্ধ আলো, বৃষ্টি ছোঁয়া বা চাঁদনি রাতে চাঁদ কে সাথী করে নস্টালজিক হওয়া এসব যেন বই এর পাতায় অলিক কোন গল্পের মত শোনায়। এ ইট-কাঠের শহরে আছি অনেক দিন ধরেই। এমন কিছু জানালা নিয়েই লিখতে বসেছি আজ।
১.
কাঁঠাল বাগানে ফ্রি স্কুল স্ট্রিট এর একটি বাড়ি। পাঁচতলা ভবনের তিন তলায় মেস এ একটি রুম এ তিন জন থাকতাম। উত্তর মুখি জানালা। জানালার অপর পাশে অন্য একটি বিল্ডিং এর রান্না ঘর। চুলোটি ঠিক আমাদের জানালা বরাবর তাদের জানালার সামনেই। মাঝে মাঝেই সকালে ঘুম ভাঙ্গত ডিম ভাজির মৌ মৌ করা গন্ধে বা একটু বেলা করে ঘুমোলে দুপুরে রান্না করা মাছ বা মাংসের মাতাল করা সুবাসে। তাদের সুবাসে নাক ডুবিয়ে আমরা মেসের খালার রান্না করা বিস্বাদ খাবার গুলো গলধকরন করতাম। কে যেন বলে গিয়েছেন ঘ্রাণে না কি অর্ধেক আহার হয়ে যায়। কথাটি অর্ধেক না হয়ে দু এক কাঠি উপরের দিকে হলেও আমার আপত্তি ছিল না। অনেক দিন আবার তেল-মশলার তেলানিতে হাঁচি পরতে পরতে ঘর থেকে দৌড় দিতে হত।
ঐজানালা আমাদের জানালার দূরত্ব ছিল এক হাতের মত। জানালা দিয়ে হাত গলিয় একটু কসরত করলেই ঐজানালার নাগাল পাওয়া যেত। ওপাশে যে মহিলা রান্না করতেন সে মধ্য তিরিশ এর কোটায় হবেন। মাঝে মাঝে আমাদের কান্ড কারখানা দেখে মুখ টিপে হাসতেন। ব্যাচেলর বন্ধুদের সাথে বেসামাল কথা বার্তাও দু একটা শুনে থাকবেন। মাঝে মাঝে দেয়াশলাই চেয়ে নিতেন। কখনও অভিযোগ করেন নি অনেক রাত করে আমরা বাতি জেলে রাখি বলে। শুধু একদিন বলেছিলেন,
- এত রাত পর্যন্ত জাগেন ক্যান ভাই?
আমাদের উত্তর একচিলতে হাসি। এছাড়া আর কিইবা উত্তর হতে পারে আমাদের। একদিন আমার প্রচন্ড জ্বর। মাঝ রাতে দু বন্ধু মিলে আমার মাথায় পানি দিয়ে দিচ্ছে গা মুছে দিচ্ছে। আমি অসার হয়ে আছি। জ্বরের ঘোরে সব ওলট পালট লাগছে। এর মাঝেই শুনতে পেলাম, আমার বন্ধু কে উনি জিজ্ঞেস করছেন,
- কি হইছে ওনার?
- জ্বর আসছে প্রচন্ড। আমার বন্ধুটি উত্তর দিল।
উনি বেশ উদ্বিগ্ন হয়ে বললেন,
- ইস খুব কষ্ট হচ্ছে না? একটু বেশি করে পানি দিয়ে দেন।
জ্বর ভালো হওয়ার কদিন পর আমাকে রেডি হতে দেখে উনি জিজ্ঞেস করলেন,
- এখন কেমন আছেন? জ্বর আছে এখনও?
আমি খুবই অপ্রস্তুত ভাবে শুধু হেসে বললাম,
- এখন ভাল।
এ প্রানহীন শহরের প্রানহীন মানুষরা কেউ কারো খোঁজ রাখে না, উত্তরের সেই জানালা দিয়ে যেন এক মানুষ তার অস্তিত্ব জানান দিয়ে গেল, এ শহরেও প্রান আছে, মমতা আছে, মানুষ আছে।
২.
কাঁঠাল বাগানেই আরও একটি বাসা। চার তলায় নতুন আখড়া গাড়লাম পাঁচ জন। আমার ঘরের সাথে ছোট্ট একটা বেলকোনি। তার পাশে কাঁচ দেয়া বেশ বড় একটি জানালা। কয়েকদিন থেকে বুঝলাম জানালাটি বাসার ড্রয়িং রুমের। সেটি আমার বেলকুনি থেকে একটু উঁচুতে। জানালা খুলে রাখলেও ভারি পর্দা থাকে সেখানে। পর্দায় দৃষ্টি আটকানো যায় কিন্তু কথা ত আটকে না।
আসার পর থেকেই আধো বোল বলা এক শিশুর কান্না শুনতাম। দুপুরে কেউ একজন সেই বাচ্চা কে কিছু একটা খাওয়ানোর আপ্রান চেষ্টা করত। কখনো খুব নরম সুরে রাজ্যের অর্থহীন কথা সে নানান সুরে বলত। কখন একটু ধমক দিত। ধমকে বাচ্চা টি কেঁদে দিত। সাথে সাথেই তার কন্ঠ পরিবর্তন হয়ে আর্দ্র হয়ে আসত। ময়না, যাদু, পাখি সহ নানান নামে সে তার পা ধরত, মাফ চাইত আরও কত রাগ ভাঙ্গানী কথা। একটু পরে সেই কান্না একোটু একটু করে বন্ধ হয়ে আসত। কি আশ্চর্য যে বাচ্চা কথা বলা শেখেনি সে ধমক বোঝে, আদর বোঝে। আর একজন মানুষ অর্থহীন কথা বলে তার সাথে যোগাযোগ রক্ষা করছে। এ যেন এক ঐশ্বরিক যোগাযোগ।
বদ্ধ জানালার পাশেও ঘটে যায় কত ঘটনা। সুখ দুঃখ বা অভিমানের অশ্রু সেই জানালার গ্রিলেই আটকে থাকে এই প্রানহীন নগরে।
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১৫ রাত ৩:৪৫