খিলক্ষেত ওভর ব্রিজে উঠতে ইউটার্ণ এর পাটাতনে দরবেশী স্টাইলে বসা; রক্তবর্ণ চোখে, যেন আগুন ঝড়ছে; চুল-দাড়ি না ছাঁটার দরুণ বেয়াড়াভাবে বড়ই হচ্ছে দিন দিন; সারাশরীরে তেল চেটচেটে কাঁদা; হাত বাড়িয়ে রাখা এক আধ্যাত্মিক সন্যাসী’র চাহুনী!
বয়সে তরুণ আনুমানিক ৩৫ এর বেশি হবে না। কারণ আমি যখন সরকারী প্রাইমারী স্কুলে পড়তাম। তখন সে একটা চা স্টলে’র বয় ছিল। তার সারাদিনের কাজ- চা’র অর্ডার আসলে চা নিয়ে দোকানে পৌঁছনো; মালিকের সংসারের বাজার-সদায় নিয়ে বাড়িতে যাওয়া এবং মালিকের দুপুরের খাবার বাড়ি থেকে নিয়ে আসা। সারাদিনের রুটিণ শেষে দোকান বন্ধ করে দোকানেই ঘুমানো; খুব ভোরে উঠে দোকান খোলা ও ঝাড়ু দেওয়া। সপ্তাহের সাতদিনই ডিউটি, একেই কাজ, একেই টাইম টেবিল।
আজকের এই তরুণটিই সেদিন বেড়ে উঠচ্ছিল এভাবে কিন্তু বড় হয়ে উঠেনি তার কাজের পরিধি। তখনও সেই একই কাজ- চা’র অডার্র নেয়া কাস্টমারকে চা দেয়া। এখন তার দোকানে-দোকানে চা’র কাপ নিয়ে যেতে হয়না।
সংসারে বাবা-মা আছেন, তাঁরাও অন্যের কাজ করেন। খোঁজ-খবর বেশি রাখেনা। তরুণটি আজ যুবক হয়ছে; বৃদ্ধি পেয়েছে শারীরিক চাহিদা। কিন্তু চা’স্টলের মেসিয়ারের এইদিকটাতে কেউই নজর দেয়নি। তবুও চলছে, হোটেলের চাকুরি, বাজার নিয়ে মালিকের বাসায় যাওয়া।
সে হোটেলের কাস্টমারকে ভাল খাবার খাওয়া কিন্তু নিজের খাবার আসে মালিকের বাড়ি থেকে। সে অনেক বড় হয়েছে গেছে। এখন সে নিজের ইচ্ছামত চাকুরি বদলায় এক দোকান থেকে অন্যদোকানে। সুজা কথায় এক হোটেল থেকে অন্য হোটেলে। চাকুরি করে, চাকুরি ছাড়ে, চাকুরি ছাড়াও থাকে কোন কোন দিন! ছুটির দিনে নিজের বাড়িতে যায় না, কেউ থাকে না বলে! তখন বাজারেই ঘুরে বেড়ায় এমোড় থেকে অন্য মোড়ে; এই রাস্তা ছেড়ে অন্য রাস্তায়। কেউ চাইলে তার বাড়িতে বাজার-সদায় পাঠাতে পারে দু’পাঁচ টাকা দিয়েই। আসলে চাকুরি ছাড়া-ধারা করতে করতেই এলাকার অধিকাংশ মালিকের বাড়ি, বাড়ি’র লোকজন তার পরিচিত হয়ে গেছে।
এক বাবুর্চি তাকে একদিন রান্না-সহকারী হিসেবে বিয়ে বাড়িতে নিয়ে গেল। সেদিন বিয়ে বাড়িতে দু’বার ভাল খাবার খেয়েছে; ফিরে আসার সময় ১০০ টাকাও পেয়েছে। এখন সে মাঝে মাঝে বিয়ে বাড়িতে বাবুর্চির সাথে যায়। টাকা যাই পাক; ভাল খাবার খাওয়া যায়। কিন্তু এলাকার সব বিয়ে বাড়িতে তো আর এক বাবুর্চি যায় না। খোঁজতে থাকল কিভাবে প্রায়ই বিয়ে বাড়িতে খাওয়া যায়। তাই বাবুর্চির সাথে আর সে যায় না, বিয়ের খোঁজ পেলেই নিজেই চলে যায় বিয়ে বাড়িতে, কিন্তু কি কাজ করবে বিয়ে বাড়িতে? বের করল বাসন মাজার কাজ। বিয়ে বাড়ির খবর পেলেই দাওয়াত ছাড়া থালা-বাসন মাজার কাজে সকালেই গিয়ে হাজির হয়। এক সারি খাওয়া শেষ হতেই আবার বাসন মাজা; এভাবে দুপুর বা বিকাল পর্যন্ত এর মধ্যে এক-দু’বার খেয়ে বাড়ির কাউকে না বলেই বিদায়। দূরের কোন বিয়ে বাড়িতেও সে পায়ে হেটে হাজির হয়ে যায়।
তবে কোন দিন কোন চুরির অপবাদ ঝুটেনি কপালে ঝুটেছে মাঝারে মসজিদে থাকার। ধর্মাচরণ না করার কারণে গলা ধাক্কা খেয়ে বের হয়ে যাওয়ার। এভাবে তাচ্ছিল্লতা পেয়ে নিজের আত্মসম্মান কোন দিন ছিল বলে আর মনে করতে পারেনা। একদিন সে এক মেথরের সাথে লেট্রিণ পরিষ্কার করতে যায়। বালতি ভরে নিয়ে দূরে কোথাও ফেলে আসাই কাজ। কিন্তু এ কাজটা করতে হয় রাতে। তাই সে মেথরের সাথে একদিন দু’দিন করতে করতে নিজেই এখন লেট্রিণ পরিষ্কার করতে যায়। এই কথা এক-কান দু’-কান করে এলাকার সব মানুষও জেনে ফেলেছে। তাই আর বিয়ে বাড়িতে যেতে পারে না সে। দাওয়াতিরাও অভিযোগ করে এই ছেলে বাসন মাজলে তারা খাবেনা। হোটেলেও আর চাকুরি করতে পারে না একই অভিযোগে দায়ে। এলাকায় আর থাকতে পরছে না।
এখন পথ একটাই, ঢাকা, কেউ চিনেনা তাকে, অজানা শহর, লক্ষ-লক্ষ মানুষ। এখানে ভিক্ষা করলেই কি? আর লেট্রিণ পরিষ্কার করলেই কি? শুনেছি, আমাদের দেশের অনেক মানুষই নাকি বিদেশে এমন কাজ করে। তাই একদিন সবার অলক্ষ্যেই পরাজিত জীবন থেকে পালাতে চলে আসে রাজধানী ঢাকায়। বানেভাসা, নদীভাঙ্গন, সর্বহারা মানুষের মত ভাগ্যরে খুজে ঢাকা শহরে।
খিলক্ষেত-নিকুঞ্জ ওভারব্রিজে উঠার সিরির মাঝের ইউটার্ণের পাটাতনে সকাল থেকেই বসে থাকে। এক পরাজিত আবেগ নিয়ে, কিছুই বলে না; শুধু হাত বাড়িয়ে রাখে। কেউ বুঝেনা সে কি ভিক্ষা চায়? না, তাকে দিলে কি কামিয়াব হওয়া যাবে, এমন কিছু? কেউ হয়ত অসহায় মানুষ ভেবে, খাবারের জন্য দু’পয়সা দেয়।
প্রায় চার মাস আগে, যেদিন নিকুঞ্জ বাসা নিলাম; ওভার ব্রিজ পার হচ্ছি বিকালে বাসায় আসব। আর নামার সময় ব্রিজের ইউটার্ণে এভাবেই হাত বাড়িয়ে বসে থাকতে দেখেছি তাকে। ৩৫’র কোটার এক যুবক, পরাজিত জীবনে’র আবেগ নিয়ে বসে আছে হাত বাড়িয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে ফেব্রুয়ারি, ২০১১ দুপুর ২:৪১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




