মৃত ব্যক্তির মুখে একটা মেয়ে থুতু ছিটিয়ে দিচ্ছে!অত্যন্ত কুৎসিত দৃশ্য হবার কথা।কিন্তু মেয়েটা এমন ভঙ্গিতে কাজটা করলো, সবাই অবাক হয়ে তাকিয়ে রইলো। যেন এটা স্বাভাবিক, যে কেউ মৃত ব্যক্তির মুখে থুতু ছিটিয়ে দিতে পারে।
ইদের আগের দিন আফসার আলী মারা গেলেন। দুর্ঘটনায় মৃত্যু, তিনি গরুর বাজারে গরুর নিচে পরে মারা গেলেন।ইমাম সাব আফসোস করছেন, আহারে লোকটা শেষবার কালেমা পড়ারও সময় পায়নি! তিনি আফসার আলীর কানে কালেমা পড়ছেন।বলছেন,"আল্লাহ ক্ষমাশীল, নিশ্চয়ই তিনি ক্ষমা করবেন!"
আফসার আলী পাইপের মিস্ত্রী ছিলেন, তার স্ত্রী গার্মেন্টস কর্মী। তার দুই ছেলে, এক মেয়ে।বড় মেয়ে তিনবার HSC ফেল করেছে, ছেলে তিতুমীর কলেজে পড়ে আর ছোটছেলে কলেজিয়েট স্কুলে নবম শ্রেণির ছাত্র।তার স্ত্রী চিৎকার করে কাঁদছে,"আমার কি অইবো গো।আমি কেমনে পুলাপান নিয়া বাচমুগো।তুমি আমারে ফালাইয়া কেমনে যাইতে পারলাগো!ওরে আল্লাহ, আমার পুলাপানের কি অইবোগো!"
তার মেয়েটিও বাকি যুবতী মেয়েদের মত কাঁদছে।যাতে তাকে অসুন্দর না দেখায়,চোখের কাজল না মুছে যায়, একটু পরপর চুল ঠিক করছে!বড় ছেলে বাবু আশেপাশে নেই, হয়তো মিনিট্রাক ঠিক করছে। লাশ জামালপুর নিয়ে যেতে হবে।ছোটছেলে মা-বোনকে স্বান্তনা দেয়ার চেষ্টা করছে, তার শরীরও মাঝেমধ্যে কেঁপেকেঁপে উঠছে।
আমি, বিনা, এমিলি, রত্না গার্মেন্টস থেকে ফিরছিলাম। দেখলাম, রুবেলের দোকানের সামনের মাঠে খাটিয়াতে একটা লাশ কাফনে ঢাকা। খুব বেশি লোক নেই।আগ্রহ নিয়ে দেখতে গেলাম!
লাশ আফসার আলী'র শুনেই তার খারাপ গুনগুলি মনে হল।নিশ্চয়ই আমার পাপ হয়েছে। আল্লাহ বলেছেন,"তোমরা মৃত ব্যক্তির ভালোগুন, কাজ আলোচনা কর।" আমি চেষ্টা করেও পারলাম না।শুধু খারাপ দিকই মনে হল!লোকটা নিয়ম করে সকাল আটটা এবং বিকেল পাঁচটায় প্রাইমারি স্কুলের রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতো। আর ঠিক তখনই গার্মেন্টস ছুটি দিত।আমি কিভাবে জানি?আমিও ঐপথেই গার্মেন্টসে যাই। আমি শুরুতে অতটা আমলে নেইনি।ভেবেছি, দাঁড়িয়ে থাকতেই পারে।
একদিন আমি অফিসে যাওয়ার পথে, প্রাইমারি স্কুল মাঠ পার হচ্ছি।তখন আফসার আলী আর এক মধ্যবয়সী মহিলা ঝগড়া লেগে গেল।মহিলার দাবি, আফসার আলী প্রতিদিন তার মেয়ের দিকে কুনজরে তাকিয়ে থাকে।তিনি বললেন যে আফসার আলীর নজরেও নাকি বিষ!হ্যা, কিছু মানুষের নজরে বিষ থাকে।যেমনঃআমাদের সেকশন অফিসার কাশেম।চোখ দিয়ে খেয়ে ফেলতে চায়।
আসলেইতো, লোকটা ড্যাবড্যাব করে তাকিয়ে থাকে।এতে অতটা দোষের কি আছে?কিছু লোকের দৃষ্টিই এমন।তবে মেয়েরা বলাবলি করে,"এই বেটা তাকালে গা ঘিনঘিন করে।" একজন বুড়ীমতন মহিলা বললো,"আফসার আলী চোখ দিয়া ধর্ষণ করতে পারে।" শুনে অন্য মেয়েরা সায় দিল। আমি ধরেই নিলাম, আফসার আলী খারাপ লোক।
সেদিনের বয়স্কা মহিলার মেয়েটাকে হিংসে হল, মেয়েটা মাকে বলতে পেরেছে। আমিতো তাও পারিনি। একদিন রাত ৯ টায় অফিস শেষে বাসায় ফিরছি।প্রাইমারি স্কুলে আসলেই কেমন গা ছমছম করে।আমি দুরুদুরু বুকে অন্ধকার পার হচ্ছিলাম। কোথা থেকে এসে আফসার আলী আমার হাত ধরে টেনে স্কুলের পিছনে নিয়ে গেল, আমি কোনমতে ছাড়িয়ে দৌড়ে পালিয়েছি।আমার বুকের দিকে জামা ছিড়ে ফেলেছে। এখনো নিজেকে অশুচি মনে হয়!
লাশের পাশে দাঁড়িয়ে এগুলাই ভাবছিলাম। ঠিক তখনই এই অবাক করা কাণ্ড ঘটলো। ধবধবে সাদা জামাপরা একটা মেয়ে এসে লাশের গায়ে থুতু ছিটিয়ে দিল।যেভাবে এসেছিল ঠিক তেমনি শান্তভাবে চলে যাচ্ছে, যেন কিছুই হয়নি। আরে এতো জান্নাত! আমরা যে ছাপড়ায় থাকি, রাস্তার বিপরীত পাশের ছয়তলা বিল্ডিংয়ে থাকে।সেবার HSC'তে গোল্ডেন এ+ পেল।
আমি জান্নতের পিছুপিছু হাটছি।তাকে চিনি, কখনো কথা হয়নি।মেয়েটার উচ্চতা কম, মেয়েদের এভারেজ উচ্চতার চেয়েও কম।মুখখানা শিশুদের মত, সে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়লেও দেখে মনে হয় হাইস্কুলে পড়ে।চোখে গোলগোল ফ্রেমের চশমা পরে।মুসার দোকান পার হতেই রাস্তাটা অন্ধকার।মনে হল, আমি অশরীরী কারও পিছনে হাটছি।
জান্নাত পিছনে ফিরে বললো,"পিছনে আসছেন কেন?আমি খারাপ, তাই তার মুখে থুতু দিয়েছি।"
আমি বললাম,"শুনুন,আপনার থেকে কিছু সাহস আমায় দেবেন?আমারও খুব ইচ্ছে হচ্ছিল, লাশের মুখে থুতু দেই।সাহস হয়নি।"
জান্নাত কিছু বললো না।রাগী চোখে তাকিয়ে রইলো। আমি ফিরে আসছিলাম। যে মেয়ে মৃত মানুষের মুখে থুতু দিতে পারে, তাকে ভয় পাওয়াই উচিত।পেছন থেকে জান্নাত'ই ডাকলো।
"আপা শুনুন, কিছুটা শুনে যান।আমার মা আমার কথা বিশ্বাস করেনি।আপনি অবশ্য করবেন।কি করবেন তো?কাউকে বলতে পারিনা।মনে হচ্ছে আপনার আমার গল্পটা একই।"
বলেই হাসতে লাগলো। কোন স্বাভাবিক মানুষের হাসি না, কেমন জানি!
"তখন আমি মাত্র সেভেনে উঠেছি।সেদিন বাসায় কেউ নেই।কলে পানি আসছে না।আমি আফসার কাকাকে বলতেই তিনি আমাদের ঘরে এলেন।মুচড়ে মুচড়ে কল দেখলেন, কল ঠিকই আছে, পানি নেই। চলেই যাচ্ছিলেন, হয়তো বুঝলেন বাসায় কেউ নেই। আমার বুকের উপর চেপে বসলেন। আমার দুনিয়া অন্ধকার হয়ে গেল।যখন সজাগ হলাম, দেখি আমার নিচের দিকে রক্তে ভেজা।বাসায় ফিরলে মাকে বললাম, তিনি মুখ চেপে ধরলেন। বললেন, কিছুই হয়নি।"
আমার কিছু বলা উচিত, কিছুই বলতে পারছিলাম না।আমার জিহবা অবশ হয়ে গেছে।মেয়েটা তাদের বাসার গেটে দাঁড়িয়ে কথা বলেই যাচ্ছে, যেন আমি তার কত পরিচিত। আগে তার সাথে কখনো কথাই হয়নি।
"মা আমাকে প্রতিদিন বোঝান, মেয়েদের শরীর ব্যবহারের জন্যই। একবার দুবার ব্যবহার করলে এটা অপবিত্র হয়ে যায় না। আপনার কি মনে হয়?"
আমাকে প্রশ্নের উত্তর দেয়ার সুযোগ না দিয়েই জান্নাত হুট করে ভেতরে ঢুকেই গেট বন্ধ করে দিল। এমনেও আমি কিছু বলতে পারতাম না।দুনিয়ায় সব মেয়েই পুরুষদের কাছে এক, কি আমার মত পোশাক শ্রমিক, কি বিদেশিনী, কি উচ্চ শিক্ষিত বড় চাকরিজীবী!
জান্নাতকে আমার গল্পটা বললে বুক থেকে একটা বোঝা নেমে যেত।ইস যদি বলতে পারতাম,"জান্নাত আমারও তোমার মত নিজের প্রতি ঘেন্না লাগে।তবে তুমি সাহসী, প্রতিশোধ নিতে পেরেছ।আমিতো তাও পারিনি।" ভাবলাম অন্যদিন দেখা হলে বলবো।
সকালে উঠেই খবর পেলাম, জান্নাত গলায় দড়ি দিয়েছে। আমি তাও পারবো না।আমাকে আফসার আলী, কাশেমদের হাত থেকে নিজেকে বাচিয়ে চলতে হবে।আমি মারা গেলে মারা যাবে অসুস্থ মা, নষ্ট হবে ছোট ভাইবোনের পড়ালেখা করার স্বপ্ন।
আমিতো মরতেও পারবো না, প্রতিশোধ নেয়াতো দূরের কথা!
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই আগস্ট, ২০১৯ বিকাল ৫:০৩