somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ত্রিশ বছর আগের একদিন

২১ শে আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ১২:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ছফিনা বেগম বিরবির করে কিছু বলছেন, ঠিক বোঝা যাচ্ছে না।উনি বেশ কিছুক্ষণ ধরে ভেলা নিয়ে এদিক ওদিক ঘুরছেন, শৌচকাজ করার জায়গা পাচ্ছেন না।চারদিকে বানের পানি থৈথৈ করছে,সব জায়গা পানিতে তলিয়ে গেছে।শৌচ কাজের যায়গা নেই।যে দুএকটা গাছ মাথা তুলে আছে সেগুলাও সাপ,বেজি,বিছা আর পোকামাকড়ের দখলে।কালও আধা ডুবে যাওয়া পাটক্ষেতে যাওয়া যেত, আজ পাট খেত ডুবে গেছে। তিনি কি করবেন বুঝতে পারছেন না।পোলাপানের দল পানিতে ঝাপিয়ে পরছে, তিনি তাদের ধমকাচ্ছেন,"যাহ পুলাপান, দূরে যা।" পুলাপান তার কথা শুনছে না।
উনি শেষমেশ পুলাপানের সামনেই কাপড় দিয়ে লজ্জা ঢেকে শৌচকাজ সারলেন। দু'একটা পুলাপান বললো,"দেখ দেখ, ছফিনাবু লেংটা!ছফিনাবু লেংটা।"

বাড়ি ফিরেই ছফিনা বেগমের মন খারাপ হল, তার পুত্র দাওয়ায় মন খারাপ করে বসে আছে।তাকে মুড়ি দেয়া হয়েছিল, খায়নি।নিশ্চয়ই মন খারাপ।সকালেও ঊঠানে পানি ছিল না, এখন পানি প্রায় দাওয়ায় ঊঠে গেছে। সাফি পানিতে পা ডুবিয়ে বসে কানে রেডিও ধরে আছে। রেডিওতে ঘোষণা করা হচ্ছে, "স্মরণ কালের শ্রেষ্ঠ বন্যা।রাষ্ট্রপতি জনাম হোসেইন মোহাম্মদ এরশাদ ভারত গিয়ে প্রধানমন্ত্রী রাজীব গান্ধীর সাথে বৈঠক করেছেন। তিনি আশ্বস্ত করেছেন , বাধ খুলে দিবে না।"
কিন্তু রাজীব গান্ধী কথা রাখেননি।ব্রহ্মপুত্র নদ দিয়ে পানি ধেয়ে আসছে।এভাবে চলতে থাকলে তাদের বাড়িও আজ ডুবে যাবে। তাদের বাড়িটা ব্রহ্মপুত্রের একদম কাছে, বাড়ির সাথেই শিকদার পাড়া ঘাট।

সাফি রাজীব গান্ধীকে একটা কুৎসিত গালি দিল।বলল," মুক্তিযুদ্ধে কি বা* একটু সাহায্য করছে, তার জন্য ওদের পায়ে ধরে থাকতে হবে!থুহ।গান্ধীর বংশই খারাপ।" ছফিনা বেগম মনঃক্ষুণ্ন হলেন,বললেন,"বাপধন, গালি দিস না।বেডার মা ইন্দিরা গান্ধী ভালা আছিল।কেমুন হাসি হাসি মুখ!দেখলেই মনে আরাম লাগতো। শেখসাব আর হেয় খুব মিল আছিল। আর এইডা তো এরশাদের দোষ, বেডায় শয়তান! মাইয়া মানুষ দেহে না, এক কাডা জমিন দেহে।মাইনশের গরু মাইরা চামড়া লইয়া যায়।অভিশাপ লাগছে, আল্লার গজব পরছে।"

ছফিনা বেগম ঘরে ঢুকে গেলেন।ঘরে খাবার নেই, দু'একজন রিলিফের মাল পায়।সেটাও পিয়ারপুর, অষ্টধর বাজার যেতে হয়।প্রায় ২ ঘন্টা সাতার কেটে যেতে হয়, ছফিনা বেগম বুড়ি আর সাফি সাতার জানে না। তবে সাফি ঢাকা থেকে আসার সময় অনেক শুকনা খাবার নিয়ে এসেছে, ঐগুলা ছফিনা বেগম খান না।তার ছেলের বৌ শাপলা পোয়াতি। সারাদিন খাইখাই করে।আম্মা, এইডা খাইতে মন চায়।আম্মা ঐটা বানায়া দেন।আম্মা, খাসির মাথা খাইতে মন চায়।মাইয়াডা শাপলা ফুলের মতই ফকফকা!মায়াকন্ঠী, কি মায়া নিয়া আম্মা ডাকে!

মাইয়াডার লাইগা ছফিনা বেগমের মন পোড়ে। এই বন্যায় আইসা আটকে গেছে।পোলার মনও এই জন্যেই খারাপ, শাপলা বাপের বাড়ি।বানের পানি বাড়ছে, আসতে পারছে না।বৌ সোহাগি পোলা সাফি, ওর বাপও এমনি ছিলো। ক্ষেতে কামলা দিতে গিয়াও বারবার বাড়ি ফিরে ছফিনা বেগমকে দেখে যাইতো। এলাকায় নাম ফুটে গেল বৌ পাগলা সফিক!সাফি যখন পেটে ছফিনা যা খেতে চাইতেন, এনে দিতেন।বকফুলের বড়া, ছফেদা, আতাফল, শুকনো পাট শাক, পাকা গাব আরও কত কি! তখন পাটের সময় ছিল না।লোকটা পাট শাক কোথা থেকে আনছে কেডা জানে? তার হাসের মাংস খাইতে ইচ্ছে করেছিল, বলে নাই।তখন টাকা পয়সার খুব অভাব ছিল।এজন্যই হয়তো সাফির খুব লোল পরতো।

তবে ছফিনা বেগম শাপলার কোন ইচ্ছে অপূর্ণ রাখেন না।শাপলা যা খেতে তিনি চায় ব্যবস্থা করেন।ওর পেটে যেন একটা রাক্ষস, এতেই বোঝা যায় পোলা হবে, পোলা!

ছফিনা বেগম আমসত্ত্ব রোদে দিয়ে সাফিকে বলছেন,"ও বাপধন!শাপলারে আনতে যাবিনি?আমি তর মামারে খবর দেই, নাউ নিয়া আহুক।যাবিনি?"
"না, আম্মা, যাবো না।শাপলা পানি ভয় পায়।আর বন্যার পানি জোরেশোরে বাড়ছে।এখানে এনে কি হবে, আজ রাতেই মনে হয় আমাদের বাড়ি ডুবে যাবে।ওদের বাড়ি উজানে, বেশ উঁচু। ওখানেই থাকুক।"

ছফিনা বেগম ছেলের কাধে হাত রাখলেন,"বাপধন আমি শরমিন্দা, আমি জোর কইরা তগেরে গেরামে আনছি।বানের পানি এইবার কমবো না।তুই এক কাম কর, শাপলারে নিয়া ঢাকা যা গিয়া।বাড়িত আনন লাগতো না।তর হৌড় বাড়িত্তেই যাগা।"
"কি বল, আম্মা।এই অবস্থায় তোমারে রেখে যাবো না।আর পিয়ারপুর স্টেশন ডুবে গেছে, জামালপুর থেকে ট্রেন আসছে না।তাহলে তোমাকে নিয়ে ঢাকা চলে যেতাম।"
"আমি কোনহানে যামু না, বাবা।আমার নারকেল-সুপারি মাইনশে চুরি করবো।মুরগি,গরু,কইতরের কি অইবো? আমি যাইতাম না,তরা যাগা।"

সাফি একটু হাসলো,বললো,"আম্মা, সারা দেশ তলিয়ে যাবার যোগাড়। ভারত থেকে পানির ঢ্ল আসছে।আর তুমি আছো তোমার গরু,ছাগল,কবুতর নিয়ে।"
"তয় বাপধন, শাপলারে খাওনগুলা দিয়া আয়।মাইয়াডা আমসত্ত্ব খাইতে চাইছে।হের পেটে তর পোলাতো রাক্ষস, কত কিছু খাইতে চায়।যাবিনি?"

সাফি উত্তর দিল না।
সে গোসল করতে গেল।সে নদী ভয় পায়।সাতার শেখার অনেক চেষ্টা করেছে, পারেনি।সবাই হাত নাড়ালে ভেসে থাকে অথচ সাফি ডুবে যায়।সাফি ফিরে এলে ছফিনা বেগম খাবার দিলেন।
"বাপধন খাইয়া ল, তর বৌ উজান গেরামে আছে। চিন্তার কিছু নাই। বানে ঐ এলাকা ডুবে না।তুই কাইল রাইতেও কিছু খাস নাই।"

বিকালে পানি অনেক বেড়ে গেল।দাওয়া পেরিয়ে খাটের পায়ের কাছে চলে এল।সাফির বাবার কাবরের কাছেও পানি আসি আসি করছে।হয়তো একটু পরেই ডুবে যাবে।প্রতিদিন এই সময়ে ছফিনা বেগম স্বামীর কবরের পাশে দাঁড়িয়ে থাকেন।সূরা ফতিহা, ইখলাস, নাস, ফালাক, কাফিরুন, কুরাইশ, তাকাছুর,আয়াতুল কুরসি আর দরূদ শরীফ পড়েন।একাজের অন্যথা কখনো হয়নি।তবে আজ তিনি একমনে কবরের চারপাশে মাটি দিয়ে উঁচু করছেন।সাফিও হাত লাগালো।
"বাপধন, কাজাইকাটা ঘাটে নাকি বড় মাছ ধরা পরছে।নতুন পানির মাছ অতি স্বাদ।একটা আন গিয়া,শাপলারে দিয়া আহিস।মাইয়াডা পরাণ ভইরা খাইবো।বাপের বাড়ি কেমুন আছে, আল্লাহ জানে!"
"মাগরিবের আগে আগে যাবোনে।"

"আমারে নিয়া, যাইস।তুই ভালা মাছ চিনবি না।"
"আচ্ছা, তুমারে নিয়েই যাবো।"

ছফিনা বেগম আজ দ্রুতই মাগরিবের নামাজ পড়লেন।ছেলে রেডি হয়ে বাইরে হাটু পানিতে দাঁড়িয়ে আছে।তার বড় মামাকে খবর দেয়া হয়েছে। তিনি কাল সকালে নৌকা নিয়ে আসবেন। মা-ছেলে পলাশকান্দী পেড়িয়ে গড়েরগাও হয়ে কবুতর মাড়ি শাপলার বাপের বাড়ি যাবে।ঐপথে পানির স্রোত একটু কম।সদ্য যৌবনা ব্রহ্মপুত্র রুদ্রমূর্তি ধারণ করেছে।

কাজাইকাটা ঘাটে ছফিনা বেগম একটা রূপালী কাতলা আর একটা বোয়াল দরদাম করছেন।পাশেই লোকজনের একটা জটলা।কিছু একটা নিয়ে হইচই করছে।সাফি ঐদিকে এগিয়ে গেল।কাঠের বক্স, একটা কাঠের বক্স ভেসে এসেছে।সবাই দখলে নেয়ার চেষ্টা করছে, মনে হচ্ছে ভিতরে সাত রাজার ধন!যে পাবে সেই ধনী হয়ে যাবে।গত বন্যায় রমজান পেয়েছিল।সে দোচালা আধাপাকা বাড়ি করেছে।এজন্য প্রায় মারামারি লাগার যোগাড়!

বাক্স খোলা হল, সবাই "লাশ লাশ" বলে ক্যাচম্যাচ করছে।সাফি মনে মনে বললো, নে শালারা নে এবার।কে আগে নিতে পারিস!কর মারামারি! একটু কৌতূহল নিয়ে সে বক্সের ভিতরে উঁকি দিল।

হায় আল্লাহ! শাপলার ফরশা মুখ নীল হয়ে আছে।কপালের কাটা দাগ স্পষ্ট, শাপলা বাথরুমে পরে গিয়ে কপাল কেটেছিল।সাফি এদিকওদিক তাকালো।সূর্য ডুবে গেছে, চারপাশ সূর্যের রক্তিম ম্লান আলোয় এখনো কিছুটা আলোকিত। সে কিছু দেখতে পেল না!

একটু আগেও ছেলেটা একটা কাঠের বাক্স নিয়ে নদীতে নেমে যাচ্ছিল।পেছনে চেচাচ্ছিল সাদা চুলের শাড়িপরা একজন মহিলা, তার দু'হাতে দুইটা মাছ,"ও বাপধন কই যাস?কই যাস তুই!তোমরা অরে ফিরাও, আমার পোলায় হাতার পারে না।তোমরা কেউ দেহ না, ফিরাও অরে!কি হইছে অর।ও পানিত নামে ক্যা?"
বুড়িও ছেলেটার পিছনে পিছনে ব্রহ্মপুত্রে নেমে গেল।ব্রহ্মপুত্রের তখন অনেক ক্ষুদা, পারলে সারা দুনিয়া গিলে খায়।

নদীর জলে রক্তিম আলোর আভা ছিল, আস্তে আস্তে কালো হয়ে গেল। মা-ছেলেকে আর দেখা যাচ্ছে না।ব্রহ্মপুত্র আগের মতই শান্তভাবে বয়ে যাচ্ছে, যেন কিছুই হয়নি!
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে আগস্ট, ২০১৯ দুপুর ১২:০৭
২টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে মুক্তিযোদ্ধাদের মুমিনী চেহারা ও পোশাক দেখে শান্তি পেলাম

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৭ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ৯:৫৮



স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানে স্টেজে উঠেছেন বত্রিশ মুক্তিযোদ্ধা তাঁদের চব্বিশ জনের দাঁড়ি, টুপি ও পাজামা-পাঞ্জাবী ছিলো। এমন দৃশ্য দেখে আত্মায় খুব শান্তি পেলাম। মনে হলো আমাদের মুক্তিযোদ্ধা আমাদের মুমিনদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

দু'টো মানচিত্র এঁকে, দু'টো দেশের মাঝে বিঁধে আছে অনুভূতিগুলোর ব্যবচ্ছেদ

লিখেছেন মোহাম্মদ গোফরান, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ১২:৩৪


মিস ইউনিভার্স একটি আন্তর্জাতিক সুন্দরী প্রতিযোগিতার নাম। এই প্রতিযোগিতায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশের সুন্দরীরা অংশগ্রহণ করলেও কখনোই সৌদি কোন নারী অংশ গ্রহন করেন নি। তবে এবার রেকর্ড ভঙ্গ করলেন সৌদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দুই টাকার জ্ঞানী বনাম তিনশো মিলিয়নের জ্ঞানী!

লিখেছেন সাহাদাত উদরাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ রাত ২:৫৯

বিশ্বের নামীদামী অমুসলিমদের মুসলিম হয়ে যাওয়াটা আমার কাছে তেমন কোন বিষয় মনে হত না বা বলা চলে এদের নিয়ে আমার কোন আগ্রহ ছিল না। কিন্তু আজ অষ্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত ডিজাইনার মিঃ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমি হাসান মাহবুবের তাতিন নই।

লিখেছেন ৎৎৎঘূৎৎ, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ দুপুর ১:৩৩



ছোটবেলা পদার্থবিজ্ঞান বইয়ের ভেতরে করে রাত জেগে তিন গোয়েন্দা পড়তাম। মামনি ভাবতেন ছেলেটা আড়াইটা পর্যন্ত পড়ছে ইদানীং। এতো দিনে পড়ায় মনযোগ এসেছে তাহলে। যেদিন আমি তার থেকে টাকা নিয়ে একটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তিযোদ্ধাদের বিবিধ গ্রুপে বিভক্ত করার বেকুবী প্রয়াস ( মুমিন, কমিন, জমিন )

লিখেছেন সোনাগাজী, ২৮ শে মার্চ, ২০২৪ বিকাল ৫:৩০



যাঁরা মুক্তিযদ্ধ করেননি, মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে লেখা তাঁদের পক্ষে মোটামুটি অসম্ভব কাজ। ১৯৭১ সালের মার্চে, কৃষকের যেই ছেলেটি কলেজ, ইউনিভার্সিতে পড়ছিলো, কিংবা চাষ নিয়ে ব্যস্ত ছিলো, সেই ছেলেটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×