somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ব্যানফ সৌন্দর্যে বিমুগ্ধ চিত্ত

২৬ শে মে, ২০১৩ দুপুর ২:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ক্যালগেরি ছেড়ে ট্রান্স কানাডা হাইওয়ে ধরে ছুটে চলেছে আমাদের গাড়ি। গাড়ির ভেতোর পাঁচজনের একটি পরিবার। মাখন, সায়লা, আঁচল, আবেশ আর আমি। গাড়ি চালাচ্ছে মাখন। গন্তব্য ব্যানফ ন্যাশনাল পার্ক। যেখানে ছড়িয়ে আছে উদার প্রকৃতির অফুরাণ সৌন্দর্য। সৃষ্টির অপার অকৃত্রিম সৌন্দর্যের হাতছানি যেখানে তাবৎ দুনিয়া থেকে টেনে নিয়ে আসে ভ্রমণপিপাসু মানুষদের। ব্যানফের রূপ-সৌন্দর্যের কথা অনেক শুনেছি। কানাডা প্রবাসী জীবনের গত পাঁচ বছরে অনেকেই বলেছেন, সুযোগ হলে একবার ব্যানফ থেকে ঘুরে এসো। কিন্তু এর আগে এমন সুযোগ হয়নি। কানাডায় আমার বসবাসের প্রথম শহর লন্ডন অন্টারিও, এরপর কিছু সময় টরেন্টো, তারপর মন্ট্রিয়ল, এবং বর্তমানে ক্যালগেরি। আগের তিনটি শহর লন্ডন, টরেন্টো বা মন্ট্রিয়ল থেকে ব্যানফের দূরত্ব হাজার হাজার কিলোমিটার, যা পাড়ি দিয়ে ব্যানফ দেখার খায়েশ মেটানো আমার পক্ষে ছিলো অসম্ভব। তবে সময়ের পথ পরিক্রমায় আজ সে সুযোগ এসেছে। অনেকদিনের একটা ইচ্ছে পূরণ হবে আজ, সে কারণে মনের ভেতোর একটা উত্তেজনাও কাজ করছে। কানাডার সবচাইতে পুরনো এই ন্যাশনাল পার্কটির দূরত্ব ক্যালগেরি থেকে পশ্চিমে একশ' বিশ কিলোমিটার। ড্রাইভ করে গেলে যেতে হবে ট্রান্স কানাডা হাইওয়ে ধরে।
রোদের মোড়কে জ্বলজ্বলে দিন। যদিও আবহাওয়া চ্যানেল থেকে বলা হয়েছিলো, এদিন বৃষ্টি থাকবে। কিন্তু হয়েছে ঠিক উল্টোটা। গত সন্ধ্যায় আবহাওয়া চ্যানেলে বৃষ্টির পূর্বাভাসের কথা শোনার পর মাখন প্রোগ্রামটা বাতিল করতে বলেছিলো; কিন্তু সায়লা রাজি হয়নি। একেই তো ওর ছুটি; অপরদিকে দিনটি ভিক্টোরিয়া ডে উপলক্ষে বিশেষ ছুটির দিন। ছেলে-মেয়েরও বন্ধ। 'এমন একটা দিনে ঘরে বসে থাকার কোনো মানেই হয় না', সায়লা মাখনের প্রোগ্রাম বাতিল করার প্রস্তাবের প্রেক্ষিতে বলেছে, 'ক্যালগেরিতে বৃষ্টি হলেই যে ব্যানফেও হবে তা ভাবছো কেনো! কাল আমরা ব্যানফে যাবোই।'
মজার ব্যাপার হচ্ছে, রাত শেষে আবহাওয়া চ্যানেলকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে সকাল হলো সূর্যি মামার হাসি দিয়ে।
ভোরবেলা উঠেই সায়লা রান্না-বান্না সেরে নিলো, কেননা আমরা ব্যানফে গিয়ে চমৎকার একটা স্পটে হোমমেড লাঞ্চ সারবো। সিদ্ধান্তটা কাল রাতেই জানিয়ে দিয়েছে সায়লা।
রওয়ানা দেবার কথা ছিলো ঠিক দশটায়, কিন্তু সবকিছু গোছগাছ করে বেরুতে বেরুতে বেজে গেলো সোয়া দশটা। সায়লার সব কাজই ছিমছাম। পরিপাটি। ও সকালে উঠেই রান্না-বান্নার সাথে আর যা যা নিতে হবে সব গুছিয়ে ফেলেছে। সায়লা বললো, 'এমনিতেই ব্যানফ জায়গাটা ঠান্ডা, তার ওপর এর আগে যতোবার গিয়েছি তা সামারের মধ্যভাগে। আজকের অবস্থা কি সে সম্পর্কে আগাম করে কিছুই বলতে পারছি না।' বৃষ্টির আশঙ্কা আর ঠান্ডা লাগতে পারে এমন ধারণা করে আমরা যে যার মতো গরম কাপড়ও সাথে নিলাম। তবে ভারী নয়।
ট্রান্স কানাডা হাইওয়ে ধরে গাড়ি যতোই এগুচ্ছে ততোই বদলে যাচ্ছে রাস্তার দু'পাশের প্রাকৃতিক দৃশ্যপট। বহুদূর থেকে দেখা রকি মাউন্টেন যতোই এগিয়ে আসছে ততোই বাড়ছে রূপের শোভা, আর একই সাথে বাড়ছে আমার হৃদয়ের গভীরে উত্তেজনা। মাখন, সায়লা, আঁচল ও আবেশ এর আগে অনেকবার এসেছে, ফলে ওরা আমার মতো উত্তেজিত নয়। অপরদিকে, আমার সামনে যেনো ধীরে ধীরে অবমুক্ত হচ্ছে নববধূর অবগুন্ঠন। খুলে যাচ্ছে অদেখা এক ভুবনের রুদ্ধদ্বার। একশ' দশ কিলো গতির হাইওয়ে। মাখন চালাচ্ছে আরো দশ কিলো যোগ করে। রাস্তায় টীম হর্টনস কফিশপ থেকে মাখন নিজের জন্য কফি, সায়লার জন্য স্ট্রিপ এবং আমার জন্য গ্রীণ টি, আর আঁচল আবেশের জন্য নিলো হট চকোলেট। রেকর্ডারে হালকা সঙ্গীতের মূর্চ্ছণার সাথে গরম গ্রীণ-টিতে চুমুক দিতে দিতে আমি উপভোগ করছিলাম এগিয়ে আসা অদেখা অপরূপ প্রকৃতিকে। এক সময় শুরু হলো বিশ্বখ্যাত রকি পর্বতমালার পাদদেশ ধরে চলা। কী আর বলবো সে অনুভব-অনুভূতির কথা! পাইন বৃক্ষের সবুজ রূপে আকাশের মেঘ-ছোঁয়া বিশাল বিশাল পাহাড়ের শরীর আমার হৃদয়ে ছড়িয়ে দিতে লাগলো একের পর এক ভালোলাগার পরশ। নীল আকাশে খন্ড খন্ড সাদা মেঘ, ছুঁয়ে যাচ্ছে কোনো কোনো পাহাড়ের বরফের টোপর পরা চূড়া! এতোদিন ছবিতে দেখে‌ছি রকির এই রূপ, আজ তা চোখের সামনে চলমান! আমি অভিভূত!
কোনো জায়গায় বেড়াতে বেরুলে গাড়ির মধ্যে মু‌খে কুলুপ এঁটে বসে থাকা আমার স্বভাব নয়, সে কথার ক্ষেত্রেই হোক আর খাওয়ার ক্ষেত্রেই হোক। থেকে থেকে এটা ওটা বিষয়ে কথা হচ্ছিলো মা‌খন ও সায়লার সাথে। একই সাথে চলছিলো মুখরোচক আহারদি। সায়লা পথের জন্য বারবিকিউ ভূট্টা, বিস্কিট, খোসা ছড়ানো কমলা, চিপস, চকোলেট সবই নিয়ে এসেছে। পথ চলতে চলতে সে সবেরও সদ্ব্যবহার হচ্ছিলো। ভূট্টার বারবিকিউটা এক কথায় চমৎকার! প্রায় অর্ধেকটাই শে‌ষ করলাম আমি।
অনেকদিন থেকেই শরীরটা ভালো যাচ্ছে না, ফলে আমাকে নিয়ে বাইরে বেরুলে মাখন এবং সায়লা সার্বক্ষণিক সচেতন থাকে আমার ব্যাপারে। অসুধ, পানিসহ আমার প্রয়োজনীয় সবকিছু সায়লা আগে থেকেই গুছিয়ে নেয়। আজও এর কোনো ব্যতিক্রম হয়নি। তবে আজ সকাল থেকেই বেশ ভালো বোধ করছি। রকি'র সান্নিধ্যে আরো যেনো সতেজ হয়ে উঠলাম। একেই বুঝি বলে প্রাকৃতিক দাওয়াই!
হৃদয় জুড়িয়ে দিতে দিতে পথ দ্রুতই ফুরিয়ে এলো। ব্যানফে ঢোকার মুখে টোল প্লাজায় আমরা থামলাম। উনিশ ডলার চল্লিশ সেন্ট দিয়ে ফ্যামিলি প্রবেশপত্র সংগ্রহ মাখন। গাড়ির জন্য ওরা একটা স্টিকার দিলো, সাথে একটা মাউন্টেন গাইড।
আবার ছোটার পালা। আবার চোখ ধাঁধানো পাহাড়ি রূপ! বেশ কিছুটা পথ পাড়ি দিয়ে পাহাড়ের পাদদেশে প্রবাহমান স্বচ্ছ নীল জলের লেকঘেঁষা একটা চমৎকার লোকেশনে গাড়ি থামিয়ে আমরা ছবি তুললাম। প্রকৃতির বিশাল ক্যানভাসে সৃষ্টিকর্তার সে এক অসাধারণ দৃষ্টিনন্দন সুবিশাল চিত্রকর্ম! আমাদের ক্ষুদ্র ক্যামেরায় তা পরিপূর্ণ ধারণ অসম্ভব। তারপরও মনের শখ মিটিয়ে নৈসর্গিক দৃশ্যের কিছু ছবি তুললাম। অসুস্থতাহেতু শরীর-স্বাস্থ্য অনেকটাই ভেঙ্গে গেছে। বেশ অনুভব করলাম, নিজের ভগ্ন চেহারা আর স্বাস্থ্য এমন রূপ ঝরানো ঝকঝকে প্রকৃতির সাথে অন্ততঃ ছবিতে বড়ই বেমানান দেখাবে। তারপরও নয়নাভিরাম দৃশ্যকে পেছনে রেখে আমার গোটা কয়েক ছবি তুললো সায়লা ও মাখন। গ্রুপ ছবিও তুললাম। প্রায় মিনিট বিশেক বিরতির পর আবার শুরু হলো আমাদের পথচলা। এক সময় ব্যানফ ডাউন টাউনকে বাঁয়ে রেখে আমরা ছুটলাম লেক লুইসের পথ ধরে।
গাড়িতে উঠে সায়লা দিনের সফরসূচির একটা ধারণা দিয়েছে। সে বলেছে, 'আমরা প্রথমেই লেক লুইসে যাবো।' সে সফরসূচি মাথায় রেখেই মাখন গাড়ি চালাচ্ছে। সায়লা জানিয়ে দিয়েছে, 'আমরা লেক লুইসেরই কোনো এক স্পটে লাঞ্চ সারবো। এরপর ফিরবো বো ফলসে। তারপর গন্ডোলা। হাতে সময় থাকলে সবশেষে ব্যানফ ডাউন টাউন।'
লেক লুইসের পার্কিং লটে গিয়েই বেশ বুঝতে পারলাম পর্যটকদের কাছে এর কদর কতোটা। পার্কিং লট উপচে পরা গাড়ি। সৌভাগ্যক্রমে আমাদের খুব একটা বেশি সময় ঘোরাঘুরি করতে হলো না। মিনিট তিনেকের মধ্যেই একটা পার্কিং পেয়ে গেলাম।
পার্কিং লটে দেখা হলো একটা ইন্ডিয়ান পরিবারের সাথে। জামিনি। সায়লার কলিগ। সে সূত্রে আগে থেকেই আমি তার পরিচিত। সব সময়ই সে আমার অসুস্থতার খবরাখবর নেয়। বলতে গেলে আমার ভালো একজন শুভাকাঙ্খীও। বাড়তি ছুটির এ দিনটিতে জামিনিও পরিবার নিয়ে এসেছে লেক লুইসের সৌন্দর্য উপভোগ করতে। আমাদের পরিবারটার সাথে জামিনির পরিবারের মিলন হলো পার্কিং লটেই। কুশলাদি বিনিময়ের পর আমরা পা বাড়ালাম ভিক্টোরিয়ার পাদদেশে লেকের সৌন্দর্য দর্শণে।
আমি যতোই এগুচ্ছি আমার চোখর সামনে ততোই উন্মোচিত হচ্ছে অপার বিস্ময়! লেক লুইসের নাম আমার জানা ছিলো, তবে জানা ছিলো না, বাস্তবিক অর্থে তা কতোটা আকর্ষণীয় হতে পারে; হতে পারে কতোটা হৃদয়গ্রাহী। এখানে এসে হৃদয় দিয়ে অনুভব করলাম প্রকৃতি কতোটা উদার, ব্যাপক এবং বিশাল। প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের প্রাচুর্যে ঠাঁসা লেক লুইস প্রথম দর্শণেই আমার নয়ন ও মন হরণ করে নিলো। ব্যানফ ডাউন টাউন থেকে লেক লুইসের দূরত্ব ৭৪ কিলোমিটার, আর এর অবস্থান প্রায় এগারো হাজার ফিট উঁচু মাউন্ট ভিক্টোরিয়ার পাদদেশে। একে বলা হয়ে থাকে মাউন্ট ভিক্টোরিয়ার সন্তান। অবশ্য নামকরণটাও এসেছে সে দৃষ্টিকোণ থেকেই। জানা যায়, প্রিন্সেস ক্যারোলিন আলবার্টাকে স্মরণ করেই এর নাম রাখা হয়েছে লেক লুইস। বলাবাহুল্য প্রিন্সেস ক্যারোলিন ছিলেন রাণী ভিক্টোরিয়ার চতুর্থ কন্যা। মাউন্ট ভিক্টোরিয়ার কন্যা লেক লুইসকে এক কথায় বলা যায় ভূ-স্বর্গ। শুনেছি এখানকার পানির রঙটাও নাকি অদ্ভূত। 'এমারেল্ড' সবুজ! কিন্তু দুঃখজনক যে, সে পানি দেখার সৌভাগ্য আমার হলো না। কেননা এখনো বরফ গলেনি লেকের। পানি জমাটবদ্ধ। তবে লেকের জমাটবদ্ধ বরফের ওপাড়ে শুভ্র মুকুট পরা ভিক্টোরিয়ার ঠিঁকড়ে পড়া রূপ আমাকে রীতিমতো মাতাল করে তুললো। রোদের স্পর্শ সে রূপের চমক বাড়িয়েছে যেনো আরো সহস্রগুণ। আশে পাশের পাহাড়ে আছে হাইকিং-এর ট্রেইল, আর ক্যাম্পিং করার ব্যবস্থা। সবই সুন্দর, সবটাই যেনো ছবি।
থেকে থেকেই আমার নখ ক্যামেরার সাটারে চলে যাচ্ছে, একই সাথে ছোট্ট শব্দ হচ্ছে 'ক্লিক'। মন ভরে না ছবি তুলেও। এখানেও সায়লা আমার কিছু ছবি তুললো লেক আর ভিক্টোরিয়ার সৌন্দর্যকে পেছনে রেখে। বিশ্বাস করুন বা না করুন, লেক লুইসের মধ্যে কেমন যেনো একটা সুরেলা আকর্ষণ আছে; আছে হ্যামিলনের বংশীবাদকের বাঁশির সুরের মতো একটা মোহনীয় সুর। যা পর্যটকের কানে মধুবর্ষণ করে। হৃদয়তন্ত্রীতে ছড়িয়ে দেয় পরম ভালোলাগার পরশ। পাহাড়ের সৌন্দর্য আর সে সুরের মূর্চ্ছণায় ইচ্ছে করে দীর্ঘ সময়ের জন্য নিজেকে নিবিড় করে সঁপে দিতে। ফুল ফুটুক আর না ফুটুক আজ বসন্তের মতো, প্রিয়া কাছে থাক বা না থাক সময় ধরা দেবেই ছন্দোময় বর্ণিল মোড়কে। বর্ণময় স্রোতে ভাসিয়ে নিয়ে যাবে চরম ভালোলাগার আবেগ আর আবেশে।
লেক লুইস থেকে বেরুনোর মুখেই ঘটলো একটা বিপত্তি! পথে অসমান জায়গায় বেকায়দায় পা পড়ে ছিঁড়ে গেলো সায়লার স্যান্ডেল। বেড়াতে এসে এমন বিপত্তি শুধু বিব্রতকরই নয়, দূরবস্থাও বাড়িয়ে দেয়। ছোট ছোট পাথরের নুড়ি বিছানো পথ। খালি পায়ে হাঁটাটাও বড্ড বিপজ্জনক। সায়লা ছেঁড়া স্যান্ডেল পায়ে দিয়েই খোঁড়া মানুষের মতো কায়দা করে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে হাঁটতে লাগলো। এরপর পাশের একটা স্পোর্টস গুডসের দোকানে গিয়ে স্যান্ডেল কিনলো। দুরবস্থার কবল থেকে মুক্তি মিললো সায়লার। এখানে মাখন আমার জন্য একটা টি-সার্ট কিনলো। বেশ পছন্দ হলো সেটা আমার। বুকের ওপর একটা হরিণের ছবি, নিচে লেখা 'লেক লুইস, কানাডা।'
লেক লুইসের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য উপভোগের মধ্য দিয়েই ঘড়ির কাটা স্পর্শ করলো ১টার ঘর। পেটের ভেতোর নড়াচড়া করতে শুরু করেছে খিদের পোকা। আমরা ভিক্টোরিয়ার পাদদেম ছেড়ে ফেয়ারভিউ নামের একটা পিকনিক স্পটে প্রবেশ করলাম। বনের ভেতোর খানাপিনার জন্য চমৎকার ব্যবস্থা। সুন্দর, পরিচ্ছন্ন। বেশ পছন্দ হলো জায়গাটা আমাদের। সবুজ প্রকৃতির সুনিবিড় সান্নিধ্যে গাছের ছায়ায় একটা বেঞ্চ বেছে নিলাম আমরা লাঞ্চের জন্য। পাঁচজন মানুষের জন্য সায়লার চমৎকার আয়োজন। মুরগির রোষ্ট, পোলাও, ডিমের কারি, সালাদ; সাথে সফট ড্রিংস। সায়লা পাকা রাঁধূনিও বটে। ওর হাতের রান্নার স্বাদও এক কথায় চমৎকার। আমার খাবার-দাবারের ব্যাপারে ও সব সময়ই সচেতন। অসুস্থ হবার পর আমি একদমই ঝাল খেতে পারি না। নামমাত্র ঝাল দিয়ে ও এমন সুস্বাদু রোষ্ট বানিয়েছে যা রসনা তৃপ্তিকে পরিপূর্ণ করলো। আমরা সকলেই পরিতৃপ্তির সাথে লাঞ্চ সারলাম।
লাঞ্চের পর আবার পথে নামলাম। মন চাইছিলো না সুন্দরী লেক লুইসকে ছেড়ে আসতে। ইচ্ছে হচ্ছিলো আরো কিছুটা সময় থাকি এই সুন্দরীর দেহমাঝে, কিনতু হাতে সময় কম। পরবর্তী গন্তব্য বো-ফলস।
ব্যানফের হৃদপিন্ডের পাশেই বো ফলস-এর অবস্থান। যারা নায়গ্রা ফলস দেখেছেন তাদের কাছে বো-ফলস তিলতূল্য। তবে এটাকে নায়াগ্রার একটা অতি ক্ষুদ্র সংস্করণ হিসেবে দেখলে মন্দ লাগবে না। এখানে কিন্তু একটা কথা স্বীকার করতেই হবে যে, বো-ফলস যতোই ছোট হোক না কেনো; চারিদিকে পাহাড়ঘেরা এর সৌন্দর্য কিন্তু অপার ও সুবিস্তৃত। ফলসের পাদদেশে পানিতে রয়েছে বোটে ভ্রমণের সু-ব্যবস্থা। এখানেও দর্শণার্থীর ভিড়! ফলসের পাশে কাঠের সিঁড়ে বেয়ে আমরা ওপরে উঠলাম। ছবি তুললাম। এখানে মিনিট তিরিশেক সময় কাটিয়ে আবার পথে নামলাম। এবার গন্তব্য গন্ডোলা।
যাদের সুউচ্চ পাহাড়ের চূঁড়ায় উঠে পুরো ব্যানফকে দেখার সাধ; তাদের অবশ্যই গন্ডোলাতে চাপতে হবে। চৌত্রিশ ডলার মূল্যের একটি টিকেট কেটে গন্ডোলায় চাপলে তা আপনাকে আট মিনিটে বয়ে নিয়ে যাবে সালফার মাউন্টেনের সুউচ্চ চূঁড়ায়। যেখান থেকে আপনি প্রত্যক্ষ করতে পারবেন ব্যানফ শহর আর আশে পাশের নয়নাভিরাম দৃশ্যাবলী। পুরো পাহাড় জুড়েই পাইন বন। মায়াভরা সবুজের ওপর দিয়ে ছুটে চলে গন্ডোলা। গন্ডোলাতে চাপলে আপনি ওপর থেকে দেখতে পাবেন বিশ্বখ্যাত 'ব্যানফ স্প্রিং হোটেল'। দেখবেন সবুজে ঘেরা পাহাড়, আর শহরের বুক চিরে বয়ে চলা সুন্দরী বো নদী। গন্ডোলাতে চেপে সালফার মাউন্টেন ঘুরে এসেছে এমন এক ফিলিপিনো পর্যটক লুইসের সাথে আলাপকা‍লে তিনি তার অভিঙ্গতার বর্ণনা দিলেন এভাবে, 'আমার স্বর্গ দেখার সাধ ছিলো; গন্ডোলাতে চেপে আমি তা ওপর থেকে দেখে এলাম। সালফার মাউন্টেনের চূঁড়া থেকে ব্যানফ স্প্রিং হোটেলটাও দেখলাম। বিশাল হোটেল। আমার কাছে মনে হয়েছে শহরের অর্ধেকটা জুড়েই তা বিস্তৃত।'
গন্ডোলা ভবনে একটা শপিং কমপ্লেক্স আছে। সায়লা সেখানে টুকটাক কেনাকাটা করলো। আমাকে কিনে দিলো একটা ফ্রেন্ডশিপ ব্রেসলেট, এবং তা পরিয়ে দিলো আমার হাতে। ব্যানফের ছবি সম্বলিত একটা চাবির রিংও সে আমাকে কিনে দিলো। গন্ডোলাতে ঘন্টা দেড়েক কাটিয়ে আমরা চললাম ব্যানফ ডাউন টাউনের লক্ষ্যে।
ব্যানফ। পুরো শহরটাই যেনো একটা সৃষ্টিকর্তার সুনিপুণ তুলিতে আঁকা বিশার ঝকঝকে একটি নিখুঁত ছবি। যা কানাডার সর্বাধিক পর্যটকপ্রিয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম। সামার এখনো আসেনি এর মাঝেই সেখানে নেমেছে পর্যটকের ঢল। বিশাল বিশাল সব পার্কিং লট। তারপরও জায়গা পাওয়া মুস্কিল। পিক সিজনের অবস্থা তো আরো ভয়াবহ। ব্যানফ শহরটা পুরোটাই পাহাড়-পর্বতে ঘেরা। রাস্তার দু'পাশে শত শত রিসোর্ট। এ কারণে অনেকে একে 'রিসোর্ট টাউন'ও বলে থাকেন। মজার ব্যাপার হচ্ছে, এখানকার প্রায় সবকিছুই একই ধাঁচের আর কাঠের তৈরী। রঙের ব্যবহারও অনেকটা একইরকম। হৃদয় ছুঁয়ে যায়।
ব্যানফ ডাউন টাউন। অসাধারণ হৃদয়গ্রাহী! যেনো একটা বহুরঙা ছবি। বিশ্বের নামি-দামি সব ব্রান্ডের শো-রুমে ঠাঁসা! নানা পণ্যে সুশোভিত দোকানগুলোও চিত্তকে নাড়া দেয় সমানভাবে। হেন জিনিস নেই যা এখানে পাওয়া যায় না। সে সবের আকর্ষণও তীব্র। যে জিনিসটার ওপর চোখ পড়বে সেটাই কিনতে ইচ্ছে করবে। মোট কথা পর্যটকদের মনোরঞ্জন আর কোনাকাটা করার জন্য চেষ্টার ত্রুটি নেই কোথাও। আমরা অনেকগুলো শো-রুম, দোকানে ঘোরাঘুরি করলাম। এখানেও সায়লা টুকটাক কেনাকাটা করলো।
ঘড়ির কাটা ছ'টা স্পর্শ করলো। এবার ফেরার পালা। একবুক তৃপ্তি আর ঝুলিভরা অভিঙ্গতা নিয়ে আমরা গাড়িতে চাপলাম। গাড়ি ছুটলো ক্যালগেরির উদ্দেশে। পরন্ত বেলার নিরুত্তাপ রোদ রকি পর্বতমালার বরফের টোপর পরা মাথায় তখন বিষন্নতা ছড়াতে শুরু করেছে। সেদিকে চোখ রেখে আমার মনটাও ব্যানফকে ছেড়ে আসার বেদনায় বিষন্ন হলো। আসার পথে কানাডার রকিজের বিশ্বখ্যাত 'থ্রি-সিসটার'কে গভীরভাবে দেখলাম; এবং হৃদয় দিয়ে উপভোগ করলাম তিন বোনের অপার সৌন্দর্যকে। যাবার কালে এতোটা নিবিড়ভাবে উপভোগ বা উপলব্ধি করিনি। এই 'থ্রি-সিসটার'-এর কথা অনেক শুনেছি। বইয়ে পড়েছি। আজ তাদের দেখে নয়ন ও মন জুড়ালাম।
ফেরার পথে রাস্তায় বেশ ট্রাফিক পেলাম। টানা তিনদিনের ছুটি শেষে সবাই কর্মস্থলে ফিরছে। রাস্তা অনেক স্লো। আর এই স্লো রাস্তা ঠেলে বাসায় ফিরতে ফিরতে বেজে গেলো সন্ধ্যা সাড়ে সাতটা। বাসায় ফিরেও ব্যানফের জন্য মনটা বিষন্নই রইলো। মনে মনে সিদ্ধান্ত নিলাম, শরীর-স্বাস্থ্য ভালো থাকলে এই সামারে আর একবার ব্যানফে যাবো।

মাহাবুবুল হাসান নীরু
-২৪ মে, ২০১৩,
মার্টিনরিজ ক্রীসেন্ট, ক্যালগেরি, কানাডা।
[email protected]
১০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×