মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারে গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের দেয়া রায়কে কেন্দ্র করে দেশে যে সহিংসতা শুরু হয়েছে তার আড়ালে বাড়ছে রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ ঘায়েলের তৎপরতা। কোন কোন ক্ষেত্রে হত্যা খুনের ঘটনা ঘটছে বিরোধী দল ছাড়িয়ে নিজ দলের ভিতরেও। অন্তর্দ্বন্দ্ব চরিতার্থ করার সুযোগ নিচ্ছে অনেকেই। আর এর জের ধরে বাড়ছে হত্যা-খুনের ঘটনা। বাড়ছে প্রতিপক্ষের ওপর প্রতিশোধ নেয়ার প্রবণতা। সেই সঙ্গে চলছে গুপ্তহত্যা আর সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর নির্যাতনের ঘটনাও। আর এসবের জন্য বিরোধী পক্ষকে দোষারোপ করে চেষ্টা চলছে রাজনৈতিক সুবিধার ফসল ঘরে তোলার। সামনের নির্বাচনেও এ সুযোগকে কাজে লাগিয়ে বাড়ছে প্রতিপক্ষ ঘায়েলের তৎপরতা। বিভিন্ন দলের নেতা-কর্মীদের নামে আসছে হত্যার হুমকি দিয়ে বেনামী চিঠি। এ নিয়ে রাজনৈতিক মহলে বাড়ছে উৎকণ্ঠা।
বিশেষ করে মানবতাবিরোধী অপরাধীদের সর্বোচ্চ সাজার দাবিতে শাহবাগ আন্দোলন শুরুর পর সারা দেশে বেড়ে যায় এ ধরনের অপরাধ প্রবণতা। ভাংচুর করা হয় জামায়াত-শিবির নিয়ন্ত্রণাধীন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। আন্দোলনে এক পর্যায়ে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি নিষিদ্ধের দাবি উঠলে বাড়ে সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতি নষ্ট করার মতো নানা ঘটনা। এরপরই শাহবাগ আন্দোলনের উদ্যোক্তা ব্লগারদের নাস্তিক আখ্যা দিয়ে সারা দেশে পাল্টা আন্দোলন শুরু করে ইসলামী ও সমমনা দলগুলো। এদের সঙ্গেও মিশে যায় জামায়াত-শিবির। শুরু হয় পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষের পাশাপাশি গণজাগরণ মঞ্চ ভাংচুরের ঘটনাও। তালিকা থেকে বাদ যায়নি মন্দির, শহীদ মিনারও।
এর পর জামায়াতের নায়েবে আমির মাওলানা দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে ফাঁসির আদেশের পর পরিস্থিতি আরো নিয়ন্ত্রণহীন হয়ে ওঠে। জামায়াত-শিবিরসহ ইসলামী দলগুলোর সঙ্গে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ে বগুড়া, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, চট্টগ্রাম, সিলেট, চাপাইনবাবগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায়। এই পরিস্থিতির সুযোগ নিয়ে সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনসহ ব্যক্তিগত প্রতিপক্ষরাও হামলার শিকার হন। হামলা হয় প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতাদের বাড়ীঘর ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেও। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী গ্রেফতার করে এসব ঘটনার সাথে জড়িত সন্দেহভাজনদের। এদের মধ্যে রয়েছে জামায়াত-শিবির, বিএনপি এমন কি বাদ যায়নি ক্ষমতাসীন দল আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীরাও। শেরপুরে শহীদ মিনার ভাংচুর করার সময় হাতে নাতে জনতার হাতে ধরা পড়ে এক জেলা ছাত্রলীগ নেতা।
শুধু ভাংচুর নয়, শুরু হয় খুন, গুপ্তহত্যা, অপহরণ আর সেই সঙ্গে চলে এক অপরের ওপর রাজনৈতিক দোষারোপ বা পলিটিক্যাল ব্লেইম গেইম।বিশেষ করে আলোচনায় উঠে আসে বেশ কয়েকটি চাঞ্চল্যকর ঘটনা।
১৫ ফেব্রুয়ারি খুন হন, শাহবাগের প্রজন্ম চত্বরের আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী ব্লগার এবং স্থপতি আহমেদ রাজিব হায়দার ওরফে থাবা বাবা।
২ মার্চ শনিবার একই ভাবে খুন হন ছাত্রলীগের সাবেক কেন্দ্রীয় সদস্য ও সিলেট মহানগর ছাত্রলীগের সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক জগৎজ্যোতি তালুকদার। আহত হন আরেক ছাত্রলীগ নেতা জুয়েল আহমদ।
৭ মার্চ বৃহস্পতিবার থেকে নিখোঁজ রয়েছেন যশোরের বেনাপোল পৌরসভার প্যানেল মেয়র (কাউন্সিলর)ও শার্শা উপজেলা ছাত্রলীগের সাবেক সভাপতি তারিকুল আলম তুহিন। উল্লেখ্য গত ৩ মার্চ বেনাপোলে আওয়ামী লীগের দুই গ্রুপের সংঘর্ষ হয়। মেয়র আশরাফুল আলম লিটন ও প্যানেল মেয়র তারিকুল আলম তুহিন গ্রুপের মধ্যে ধাওয়া পাল্টা ধাওয়ার ঘটনা ঘটে। এদিন রাতে র্যাব তুহিনের বাড়িতে হানা দেয়। এর কয়েকদিন পর থেকেই তাকে পাওয়া যাচ্ছে না বলে পরিবার ও দলের পক্ষ থেকে অভিযোগ করা হয়।
বৃহস্পতিবার রাতে শাহবাগ আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত সানিউর ছুরিকাহতহন।রাত সাড়ে ৮টার দিকে অজ্ঞাত দুর্বৃত্তরা তার মাথা ও পায়ে ছুরিকাঘাত করে পালিয়ে যায়। তবে কারা কি কারনে তার ওপর হামলা করেছে তা আন্দাজ করা না গেলেও প্রজন্ম চত্ত্বর থেকে দাবি করা হচ্ছে জামায়াত-শিবিরের কর্মীরাই সানিউরের ওপর হামলা চালিয়েছে।
সর্বশেষ দু’দিন নিখোঁজ থাকার পর ৮ মার্চ শুক্রবার বেলা পৌনে ১১টার দিকে শহরের চারারগোপ এলাকায় শীতলক্ষ্যা নদী সংলগ্ন একটি খালে পাওয়া যায় তানভীর ত্বকী’র লাশ। সে নারায়ণগঞ্জ নাগরিক কমিটির সহসভাপতি ও গণজাগরণ মঞ্চের উদ্যোক্তা রফিউর রাব্বি’র ছেলে।
এসব ঘটনায় শুরু হয় একপক্ষ অপর পক্ষের ওপর দোষারোপ। এই প্রেক্ষাপটে দেশের বিভিন্ন স্থানে বেড়ে যায় প্রতিহিংসামূলক হামলা ও সহিংসতার ঘটনা। আর বর্তমান পরিস্থিতির সুযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক বিরোধ, ব্যক্তিগত আক্রোশ মিটিয়ে দায় চাপানো হচ্ছে জামায়াত শিবিরের ঘাড়ে। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীও অনেক ক্ষেত্রে রাজনৈতিক চাপ সামাল দিতে গিয়ে দায়ীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারছে না বলে অভিযোগ উঠেছে। পাশাপাশি অভিযোগ রয়েছে, সঠিক তদন্ত না করে প্রকৃত ঘটনা ধামা চাপা দেয়া হচ্ছে।
বিশেষ করে মানবাধিকার সংস্থা অধিকার বিশ্লেষণে উঠে এসেছে আরো চাঞ্চল্যকর তথ্য।
অধিকারের রিপোর্ট অনুযায়ী, গেল ৫ ফেব্রুয়ারি থেকে ২৫ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রায় প্রতিদিনই পুলিশের গুলি, সরকার দলীয় নেতা-কর্মীদের হামলা ও রাজনৈতিক সহিংসতা থেকে প্রাণ রক্ষার্থে পালাতে গিয়ে মানুষ নিহত হয়েছেন।
এর আগে গত জানুয়ারি মাসে রাজনৈতিক সহিংসতা ও পুলিশের গুলিতে নিহত ১৭ জন মানুষ। যাদের মধ্যে গত ২৯ জানুয়ারি চট্টগ্রামে চার জন; ৩১ জানুয়ারি বগুড়ায় চার জন ও ফেনীতে এক জন নিহত হন। প্রতিবেদনে বলা হয়, ফেব্রুয়ারি মাসে ৩৭ জন বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছেন বলে অভিযোগ রয়েছে। এই বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের মধ্যে ২৮টি ঘটেছে শাহবাগের আন্দোলন সময়কালে পারস্পরিক ঘটনাকে কেন্দ্র করে।
বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের শিকার ৩৭ জনের মধ্যে ১৭ জন জামায়াত-শিবির কর্মী, তিনজন অন্যান্য ইসলামী দলের সদস্য, একজন বিএনপি কর্মী, একজন গার্মেন্টস কর্মী, একজন হকার, একজন দারোয়ান, একজন কলেজ ছাত্র, একজন মাদ্রাসা শিক্ষক, একজন কৃষক, একজন রুদ্র ব্যবসায়ী, একজন যুবক, একজন সবজি ব্যবসায়ী ও সাতজন কথিত অপরাধী বলে জানা গেছে।
অধিকার অভিযোগ করে,নির্যাতনের ক্ষেত্রে সরকারেরর ‘জিরো টলারেন্স’ এর ঘোষণা থাকা সত্ত্বেও সরকার আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নির্যাতন এবং এই ক্ষেত্রে তাদের দায়মুক্তি বন্ধে কোনো কার্যকর ব্যবস্থা তো নেয়ই-নি, বরং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোকে উপেক্ষা করে তাদেরকে আরো উৎসাহিত করেছে।
অধিকার জানায়, ফেব্রুয়ারি মাসে মোট ৭৩ জন নারী ও মেয়ে শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছেন বলে জানা গেছে। এদের মধ্যে ৩২ জন নারী, ৪০ জন মেয়ে শিশু। ৩২ জন নারীর মধ্যে পাঁচজনকে ধর্ষণের পর হত্যা করা হয়েছে এবং ১২ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন। ৪০ জন মেয়ে শিশুর মধ্যে ২৮ জন গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন।
সূত্র: হার্ডনিউজ২৪.কম

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




