‘কেড়ে নিয়েছে ওই হায়েনার দল, ধর্ষিত মায়ের চোখের জল……’ – আহ! কি অদ্ভুত, কি সুপার্ব স্টার্টিং! আশি’র দশকের অন্যতম জনপ্রিয় গান ‘রাজাকারের তালিকা চাই’; গেয়েছেন তৎকালীন জনপ্রিয় ব্যান্ড ‘নোভা’-র দলনেতা আহমেদ ফজল। বাংলা ব্যান্ডের ইতিহাসে এটিই সর্বপ্রথম একটি গান যেখানে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবী প্রকাশ্যে আহবান করা হয়েছে।
নোভা ব্যান্ড সম্পর্কে আরেকটু না বললেই নয়। অন্যান্য জনপ্রিয় ব্যান্ডের গানগুলোর প্রধান উপজীব্য যেখানে ছিল প্রেম-প্রনয়-ছ্যাকা, সেখানে নোভা ব্যান্ড শ্রোতাদেরকে উপহার দিয়েছিল কিছুটা ভিন্ন ধারার গান। ওদের অ্যালবামগুলোতেও প্রেমের গান ছিল; তবে যুদ্ধাপরাধ, ড্রাগস, বন্যা, গ্রামীন দুঃখী জীবন প্রভৃতি সামাজিক প্রতিবন্ধকতা ও সমস্যা মূলক বিষয়ের প্রাধান্যের ফলে সমসাময়িক ব্যান্ডগুলো থেকে তারা ছিল কিছুটা স্বতন্ত্র ও বৈচিত্র্যপূর্ন!
আজও নোভা আ্মার অনেক পছন্দের একটি ব্যান্ড। ‘রাজাকারের তালিকা চাই’ গানটা দিয়েই নোভার সাথে আমার পরিচয়। সেই স্কুলবেলাতেই আমি প্রেমে পড়ে যাই এই গানের। অবশ্য এই গানটির একটা বিশাল সমালোচনা হচ্ছে যে, গানটির সুর পুরোটাই পিংক ফ্লয়েডের বিখ্যাত ‘অ্যানাদার ব্রিক ইন দ্য ওয়াল’ গানটি থেকে হুবুহু চোখা মারা! তবে আমি সেই বিরল সৌভাগ্যবানদের একজন (বা বলদও বলা যেতে পারে
সেই বয়সে হৃদয়কে নাড়িয়ে দেওয়ার মত অনেক উপকরন আছে এই গানটিতে। বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের স্বাধীনতার উদাত্ত আহবান অথবা মেজর জিয়ার স্বাধীনতার ঘোষনা – এই গানের মাধ্যমেই নিশ্চিতভাবে চিরস্থায়ী হয়ে গিয়েছিল মনের ভিতরে। এছাড়া গানটির কিছু লিরিকসের কথা উল্লেখ করতেই হবেঃ
‘আর নয় আর কতকাল তারা পাবে প্রশ্রয়, পরাজিত সব দালালের আজ দাও পরিচয়……’ – কি অপূর্ব ভাষ্য, কি তেজী কন্ঠ! ‘ওই রাজাকার ছেড়ে যা এই দেশটা আমার, আরেকটি মুক্তিযুদ্ধ করবে তোদের চির অবসান……’ – অদ্ভুত! সিম্পলি অদ্ভুত!! ‘আমরা এ প্রজন্ম রাজাকারের তালিকা চাই, আমরা এ প্রজন্ম রাজাকারের ফাঁসি চাই!’ – হায়, আজও আমাদের এ কথাগুলোই বলতে হচ্ছে!
আমি বেশ কয়েকদিন ধরে এই গানটি নিয়ে ‘টেকনিক্যালি’ ছোটখাটো একটি জরীপ চালিয়েছি তিনটি ভিন্ন ভিন্ন বয়স-গ্রুপের শিক্ষিত মানুষদের মাঝে। ত্রিশ থেকে পয়ত্রিশ বছর বয়সীরা প্রথম গ্রুপে, পঁচিশ থেকে ত্রিশদের নিয়ে দ্বিতীয় এবং বিশ থেকে পঁচিশ বছরের যুবকদের সমন্বয়ে তৃতীয় গ্রুপ। প্রথম গ্রুপের প্রায় ৯৫%ই গানটি শুনেছে, তবে তার মধ্যে ৫০% এর মত সুর নকলের দায়ে অভিযুক্ত করে গানটিকে প্রায়-প্রত্যাখ্যাত করেছে! দ্বিতীয় গ্রুপেও কাছাকাছি রকমের ফলাফল পাওয়া গেছে, অবশ্য এই গ্রুপে গানটির প্রশংসা করার হার তুলনামুলকভাবে অনেক বেশী। আশ্চর্য্যের ব্যাপার ঘটেছে তৃতীয় গ্রুপের রেজাল্টে; মাত্র ২৫% গানটি শুনেছে, ৩০% নোভা ব্যান্ডের নামই শুনে নাই! যদিও আমার কাছে কিছুটা প্রত্যাশিতই ছিল এ ধরনের রেজাল্ট (অযথা নিশ্চয়ই এই জরীপের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করি নাই), তারপরও নিঃসন্দেহে বেশ হতাশাজনক রেজাল্ট!
অবশ্য তৃতীয় গ্রুপকে দোষ দেওয়ার কিছু নাই। আমার অভিযোগের তীর থাকবে সেই নব্বই দশকের প্রজন্ম বরাবর! তারা কিছুতেই দায় এড়াতে পারে না, কেননা তারাই এই গানটাকে পরবর্তী প্রজন্মের কাছে প্রত্যাশিত মাত্রায় পৌঁছে দিতে পারে নাই। যে ব্যাপক হারে ‘মেলায় যাই রে’, ‘মাধবী’, ‘জেল থেকে বলছি’ বা ‘ফিরিয়ে দাও’ গানগুলোর প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে বিস্তার ঘটেছে বা মুখে মুখে ছড়িয়েছে, সেই হারে এই গানটির বিস্তার ঘটে নাই। শুধু এই গানটি কেন, আমি তো মনে করি নোভা তথা ফজল তৎকালীন প্রজন্মের কাছে ব্যাপকভাবে সমাদৃত হয়নি কখনোই, সর্বদাই আন্ডাররেটেড হিসেবে মূল্যায়িত হয়েছে। নোভার কিছু গান তো আসলেই ক্ল্যাসিকঃ ‘তুমি নাই বাসরী’ (বা স্কুল পলাতক মেয়ে), ‘পদ্মার পাড়ে’, ‘নীনা হাসনাঈন’, ‘স্বপ্ন রানী’, ‘রাখাল ছেলে’ গানগুলো মানের দিক দিয়ে অসাধারন! এছাড়া একটা মিক্সড অ্যালবামে ফজলের গাওয়া দুইটি প্রেমের গান ‘প্রতীমার ছবি’ এবং ‘একরাশ নিঃসঙ্গতা হারালো’ আমার খুবই পছন্দের। এই গানগুলো জনপ্রিয়তা পেয়েছে সত্যি, কিন্তু তারপরও অন্যান্য ব্যান্ডের সুপারহিট গানগুলোর জনপ্রিয়তা লেভেলের কাছাকাছি ভিড়তে পারেনি কখনোই!
আমি নিজেও যে খুব একটা ব্যতিক্রম ছিলাম তা অবশ্য নয়! তারপরও নোভার প্রতি আমার আলাদা একটা ক্রেজ ছিল সবসময়ই। একটা বিষয়ে স্মৃতিচারন না করলেই নয় – তখন নোভার চতুর্থ অ্যালবাম বের হয়েছে, নাম ‘ভাইসো’। এই অ্যালবামটি সম্ভবত ততোটা জনপ্রিয়তা পায় নি, যদিও আমার কাছে অসম্ভব ভালো লেগেছিল। আমি আমার পুরা ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিয়েছি কেবলমাত্র, হ্যাঁ কেবলমাত্র এই ‘ভাইসো’ অ্যালবামের গান শুনে! ফিজিক্স, কেমিস্ট্রি, ম্যাথের জটিল জটিল প্রবলেমগুলা সলভ করতাম গানগুলো ওয়াকম্যানে শুনতে শুনতে! যে গানটি অদ্ভুত ভাল লাগতো, সেটা হচ্ছে ‘ঘুমপাড়ানী মা ’! বারবার শুনতাম এই গানটা, কি যে একটা মোহ ছিল এই গানের – আহ! (দুর্ভাগ্য, গানটা অনলাইনে এখনো পর্যন্ত খুঁজে পাচ্ছি না)! আমার পরিচিত মহলে গানটি সেরুপ প্রভাব ফেলতে পারেনি, এই এত বছরেও কাউকে কখনোই এই গানের কথা রিকল করতে শুনি নাই! পরবর্তীতে জেমসের ‘মা’ গানটি যখন ব্যাপক হিট হলো, তখন মনে মনে শুধু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলেছিলাম, ফজলের ‘মা’ গানটা কি দোষ করেছিল?
সে যাক, আবার ‘রাজাকারের তালিকা চাই’ প্রসঙ্গে ফিরে আসি। সেই সময়ের প্রেক্ষাপটে গানটি গাওয়া কিন্তু এত সহজ ব্যাপার ছিল না; অনেক সাহসী হলে তবেই এরকম একটা গান গাওয়া সম্ভব। ফজল সেই সাহস দেখিয়েছিল, যদিও এতে রাজাকারদের চুল বিন্দুমাত্র বাঁকা হয় নি সেসময়! রাজাকারদের পূর্নাংগ তালিকা আমরা আজো পাইনি, কখনো যে পাবো সে সম্ভাবনাও শূন্য। বাস্তবতা হচ্ছে, রাজনৈতিক পরিক্রমায় অনেক রাজাকারই আজকে পরিনত হয়েছে মুক্তিযোদ্ধায়! সেই বাইশ-তেইশ বছর আগে একজন আহমেদ ফজল যে দাবী জানিয়েছিল তার সাথে শাসকগোষ্ঠী এবং শিক্ষিত জনগন যদি একাত্মতা ঘোষনা করতো, হয়তো আমরা একটা পুর্নাঙ্গ তালিকা পেলেও পেতে পারতাম! এ ধরনের একটা গানের শক্তি অপরিসীম, কিন্তু সে সময় সেই শক্তির সঠিক প্রয়োগে আমরা নিঃসন্দেহে ব্যর্থ হয়েছি।
যাই হোক, শুনতে পাচ্ছি নোভা নাকি আবার ফিরে আসছে, এবং অচিরেই একটি অ্যালবামও বের করতে যাচ্ছে; গতানুগতিক ধারা নয়, বরং পুরনো সেই ফ্লেভার বজায় থাকবে এই অ্যালবামেও! আরো উল্লেখ্য, ‘রাজাকারের তালিকা চাই’ গানটির দ্বিতীয় সংস্করনও থাকবে এখানে! অধীর আগ্রহে অপেক্ষায় আছি অ্যালবামটির জন্যে।
পরিশেষে 'রাজাকারের তালিকা চাই' গানটা ইউটিউব থেকেঃ
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে অক্টোবর, ২০১১ রাত ১১:৫১

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




