কৈশোরবেলায় যে সকল সেলিব্রেটিদের মৃত্যুতে খুব কষ্ট পেয়েছিলাম তাদের মধ্যে অন্যতম ছিল প্রিন্সেস ডায়ানা ও সালমান শাহ। কিন্তু তারও আগে যার মৃত্যুকে কোনভাবেই কখনোই মেনে নিতে পারি নাই, সে হচ্ছে দিব্যা ভারতী। মাত্র ১৯ বছর বয়সের এই বলিউড নায়িকার অকাল প্রয়ানে কয়েক রাত ঠিকমতো ঘুমাতে পারি নাই, খাওয়া-দাওয়াও ছেড়ে দিয়েছিলাম। সেই বয়সে এই মৃত্যু ছিলো আমার জীবনে একটি নিদারুন আঘাত।
আজ ৫ই এপ্রিল দিব্যার ১৯তম মৃত্যুবার্ষিকী। দিব্যা ভারতী বড় অসময়ে এসেছিলো এ পৃথিবীতে; সম্ভবত এত আগেভাগে ওকে পৃথিবীতে পাঠানো ছিলো পরম করুনাময়ের ভুল সিদ্ধান্ত। তাই সেই ভুল শোধরানোর কারনেই সম্ভবত তিনি পুনরায় দিব্যাকে ফেরত ডেকে নিয়ে যান! এছাড়া এত জলদি তাকে ডেকে নেওয়ার আর কোন কারন দেখি না। সে কত অসম্ভব প্রতিভা নিয়ে জন্মেছিল সেটা তার ২/৩ বছরের ক্যারিয়ারই বলে দেয়। এত কম সময়ের মধ্যে এতটা জনপ্রিয়তা পাওয়ার নিদর্শন খুব বেশী একটা নেই।
যাই হোক, দিব্যা ভারতী্র ক্যারিয়ার সম্বন্ধে আরো ডিটেইলস আছে উইকিতে; আমি আর সেগুলো বলতে চাচ্ছি না। আমি এখানে তার মৃত্যুর ‘কন্ট্রোভার্সি’ সম্পর্কে একটু আলাপ করতে চাই। এটা সত্যি দুঃখজনক যে, এখন পর্যন্ত তার মৃত্যুর কারনটা একটা অমীমাংসিত রহস্য হিসেবেই রয়ে গেছে। এখনো পরিষ্কার নয় যে এটা কি হত্যা, আত্মহত্যা নাকি দূর্ঘটনা ছিল?
দূর্ঘটনা, আত্মহত্যা না হত্যা?
দূর্ঘটনা?......পুলিশের তদন্ত ও সাক্ষীদের সাক্ষ্য যেভাবে এসেছে (বা হয়তো যেভাবে সাজানো হয়েছে), সেটা নির্দেশ করে এটি একটি দূর্ঘটনা ছিলো। তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী, সে রাতে দিব্যার মৃত্যুর সময় তিনজন মানুষ উপস্থিত ছিলঃ দিব্যা ভারতীর ড্রেস ডিজাইনার নীতা লুলা, নীতির স্বামী ডঃ শ্যাম লুলা এবং বাসার কাজের মেয়ে। দিব্যার স্বামী প্রযোজক সাজিদ নাদিদওয়ালা সেসময় বাসায় উপস্থিত ছিল না। পরেরদিন ভোরে দিব্যাকে আউটডোর শুটিংয়ে যেতে হবে বিধায় রাতের বেলাতেই সে তার ড্রেস ডিজাইনার নীতা লুলাকে বাসায় ডেকে পাঠায়। এই তিনজনের উপস্থিতিতে এই মর্মান্তিক ঘটনাটি ঘটে রাত ১১.৪৫ মিনিটের সময় (৫ই এপ্রিল, ১৯৯৩)।
সাক্ষী নীতা লুলার ভাষ্য অনুযায়ী, দিব্যা ভারতী ড্রিঙ্ক করতঃ অবস্থায় খোলা জানালার উপর একেবারে কিনারায় বসে কাজের মেয়েটির সাথে কথা বলছিলো। এসময় সে হঠাৎ ব্যালেন্স হারিয়ে ফেলে এবং যার পরিনতিতে পাঁচ তলা থেকে নীচে পড়ে নিহত হয়। .......ঘটনা এরকম হতেই পারে, এটা অবিশ্বাস্য কিছু নয়। তবে তদন্ত কমিটি ও সাক্ষীদেরকে টাকা দিয়ে কেনা হয়েছিল বলেও অভিযোগ আছে! এছাড়া আরেকটি সুত্র মতে, দিব্যার উচ্চতা ভীতি ছিলো। তথ্যটা যদি সত্যি হয়ে থাকে, তাহলে জানালার ধারে তার ওভাবে বসাটা কোনভাবেই মেলে না।
আত্মহত্যা?......এটা খুব কম বিশ্বাসযোগ্য! জনপ্রিয়তার এত চরমে অবস্থানকালীন সময়ে যখন টপে পৌঁছানোটা সময়ের ব্যাপার মাত্র, সেসময় সে আত্মহত্যার পথ বেছে নিবে, এটা কেউই বিশ্বাস করতে চায় না। তাছাড়া আরেকটা ব্যাপার দিব্যার আত্মহত্যার মানসিক অবস্থাকে সমর্থন করে না। ধরা যাক, তদন্ত রিপোর্ট অনুযায়ী নীতা লুলাকে রাতের বেলায় ডেকে আনার তথ্যটা সত্যি; তাহলে খুব সহজ একটা প্রশ্ন/যুক্তিঃ দিব্যা যদি আত্মহত্যা করার মত মানসিক অবস্থায় থাকতো, সে অবস্থায় কি পরেরদিনের শুটিং এর জন্যে নিজের ড্রেস ডিজাইনারকে ডেকে আনতো?
হত্যা?......দিব্যা ভারতীর অধিকাংশ ভক্তের স্থির বিশ্বাস যে এটি ছিলো স্পষ্টতই একটি হত্যাকান্ড এবং এই হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতা রয়েছে স্বয়ং স্বামি সাজিদ নাদিদওয়ালার। নীতা লুলা ও ডঃ শ্যাম লুলার মাধ্যমে সাজিদই এই হত্যাকান্ডটি ঘটিয়ে থাকতেও পারে। সাজিদ নাদিদওয়ালা লোক হিসেবে কখনোই ভাল ছিল না; আর সে রাতে তার বাসায় না থাকাটাকেও সবাই সন্দেহের চোখেই দেখে। দিব্যার মৃত্যু হওয়ার পরপরই সম্ভাব্য হত্যাকারী হিসেবে তার দিকেই ছিলো মিডিয়া ও ভক্তদের আঙ্গুল।
এছাড়া এ হত্যাকান্ডে সাজিদের সাথে সাথে আন্ডারওয়ার্ল্ড জগতের আবু সালেম বা দাউদ ইব্রাহীমের হাত থাকাও বিচিত্র নয়। গুজব আছে, আন্ডারওয়ার্ল্ডের সাথে ছিল সাজিদের বেশ সখ্যতা। আলোচিত মুম্বাই বিস্ফোরন ঘটনায় সাজিদের সংশ্লিষ্টতা থাকলেও থাকতে পারে! দিব্যা কি এ ব্যাপারে কিছু জানতো? তার মুখ বন্ধ করে দেওয়াটা কি অতীব জরুরী হয়ে পড়েছিল?... লক্ষ্যনীয় ব্যাপার হচ্ছে, মুম্বাই বিস্ফোরন ঘটেছিল ১৩ই মার্চ, ১৯৯৩। আর দিব্যার মৃত্যুর ঘটনাটি ঘটে পরের মাসেই ৫ই এপ্রিল, ১৯৯৩। তাই দিব্যার মৃত্যু রহস্যে মুম্বাই বিস্ফোরন, আন্ডারওয়ার্ল্ড সংশ্লিষ্টতা ইত্যাদি বিষয় একেবারে ফেলনা নয়!
এই প্রেক্ষাপটে আরেকটু অন্য অ্যাঙ্গেলে চিন্তা করা যায়। সেই রাতে ওই বাসায় আসলেই কারা ছিল সেটা কিন্তু পুরোপুরি জানা যায় নি। তদন্ত রিপোর্টটি সাজানো – এ সন্দেহ অনেকের। অনেকেই বিশ্বাস করে, নীতা লুলাদের পরিবর্তে স্বয়ং সাজিদ বা আন্ডারওয়ার্ল্ডের কেউ কেউ সে রাতে উপস্থিত ছিল বাসায়। কথা কাটাকাটির এক পর্যায়ে সে বা তারা ধাক্কা দিয়ে দিব্যাকে জানালা দিয়ে নীচে ফেলে দেয়।
আরেকটি ইন্টারেস্টিং পয়েন্ট হচ্ছে, মুম্বাই পুলিশ এই কেস বন্ধ করে দেয় ১৯৯৮ সালে। যে পুলিশ চীফের আমলে কেস বন্ধ করে দেওয়া হয়, সেই পুলিশ চীফ পরবর্তীতে বিভিন্ন কেসে দূর্নীতির অভিযোগে চাকরি হারায়। সুতরাং টাকার বিনিময়ে যে সাজানো তদন্ত রিপোর্ট বানানো হয়েছে, অতঃপর কেস বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে সেই সন্দেহটা কিন্তু অমূলক নয়। ...... যাই হোক পুরা ব্যাপারটাতে এত কনফিউশন, এত স্পেকুলেশন আছে যে, কোন কংক্রীট ডিসিশনে আসা সম্ভব নয়। তাই আজো আমরা কেউ পুরোপুরি নিশ্চিত জানি না দিব্যা ভারতীর মৃত্যু কি হত্যা, নাকি আত্মহত্যা, নাকি নিছক একটি দূর্ঘটনা?
হিন্দু-মুসলিম তর্কঃ
দিব্যা ভারতী ১৯৯২ সালের মে মাসে সাজিদকে গোপনে বিয়ে করে এবং সেটা অনেকদিন পর্যন্ত গোপন রাখা হয়। সাজিদ মুসলমান হওয়াতে এই বিয়েতে দিব্যার পরিবারের একেবারেই মত ছিল না। কিন্তু পরিবারের বিপক্ষে যেয়ে দিব্যা সাজিদকে বিয়ে করে। সাজিদের ভাষ্যানুযায়ী, বিয়ে করার পরে সে ধর্মান্তরিত হয়ে ইসলাম ধর্মও গ্রহন করে; এবং মুসলিম নাম হিসেবে ‘সানা নাদিদওয়ালা’ নামটি গ্রহন করে। কিন্তু সেটাও গোপন রাখা হয় মূলতঃ তার ক্যারিয়ারের ভবিষ্যত এবং তার পিতা-মাতার অমতের কথা চিন্তা করে।
দিব্যার কট্টর মুসলিম ভক্তরা তাই প্রায়শই উষ্মা প্রকাশ করে যে, একজন মুসলিম হওয়া সত্ত্বেও কেন তাকে কবর না দিয়ে দাহ করা হলো? সাজিদ নাদিদওয়ালা নিজেও নাকি দিব্যাকে কবর দেওয়ার পক্ষে ছিলো। কিন্তু পরিস্থিতি তার অনুকূলে ছিলো না; সম্ভাব্য হত্যাকারী হিসেবে সবাই তখন তাকেই সন্দেহ করছে! এছাড়া দিব্যার পিতা-মাতা এই বিয়েকে মেনে নেয় নাই বা তার ধর্মান্তরিত হওয়ার ঘটনাকে আমলে নেয় নাই। তাই তারা তাদের স্বীয় ধর্মের অনুসারেই দিব্যার দাহকার্য সম্পন্ন করে। শেষকৃ্ত্যানুষ্ঠানে নবপরিনীতা বধুর সাজে দিব্যার সেই শেষ পথচলা দেখে চোখের পানি ধরে রাখা মুশকিল!
আমার একটি ফ্যান্টাসীঃ
স্বভাবতই আমি পুনর্জন্মে বিশ্বাস করি না! কিন্তু যদি দিব্যাকে হত্যা করা হয়ে থাকে, তাহলে আমি চাই দিব্যার যেন আবার পুনর্জন্ম হয় (যেমনটা আমরা মুভিতে দেখি ‘কর্জ’, ‘করন-অর্জুন’ বা হালের ‘ওম শান্তি ওম’) যাতে নিজ হাতে খুনীকে শাস্তি দিতে পারে! মৃত্যুর পরপরই যদি তার পুনর্জন্ম হয়ে থাকে, তাহলে এ বছরেই পুনর্জন্ম নেওয়া দিব্যা ভারতীর বয়স হবে ১৯ বছর। আশা করতে দোষ কি?
পরিশেষেঃ
দিব্যা ভারতীর মৃত্যুরহস্যের কারনে নয়, বরং দিব্যাকে আজো লাখো ভক্ত বুকের ভেতরে লালন করে তার অভিনয়ের কারনেই; তার আদরমাখা বুলি, তার নিষ্পাপ চাহনী, ফুলের মতো সুন্দর একটি মেয়ে তার কর্মগুনেই সবার হৃদয়ে স্থায়ী আসন দখল করে নিয়েছে। আমি দিব্যা অভিনীত ১৪টি হিন্দী মুভিই দেখেছি, এবং অধিকাংশই আমার পছন্দের। তারপরও সবার জন্যে আমার রেকমেন্ড হচ্ছেঃ ‘দিওয়ানা’, ‘দিল কা ক্যায়া কসুর’ আর ‘রঙ’। তার সৌন্দর্য্য ও অভিনয় প্রতিভার অপূর্ব নিদর্শন হয়ে আছে এই মুভিগুলো। এই গর্জিয়াস, হাস্যোজ্জ্বল, সদা চঞ্চল, প্রানোচ্ছ্বল, নিষ্পাপ চেহারার দিব্যা ভারতীকে এই জীবনে কখনোই ভোলা সম্ভব নয়!
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই এপ্রিল, ২০১২ রাত ৮:৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




