ছেলেটা ভীষণ ব্যস্ত ছিল। মেয়েটা অলস সময় কাটাত। ক্যাফেটেরিয়ায় বসে ছেলে যখন একের পর এক ফাইল ঘাটতে থাকে মেয়েটা তখন মিষ্টি কিছু কথা একটু মায়া ভরা হাসির আশায় বসে থাকতো। তারা একজন আরেক জনকে অনেক ভালবাসে। দুজনেই দুজনকে খুব কাছ থেকে অনুভব করে, আর দশটা নববিবাহিত জুটির মতই।
এক বছর আগেও যে ছেলেটা ঘুম থেকেই উঠত বেলা বারটার পর। সে এখন প্রতিদিন সকালে আটটায় অফিস পৌঁছায়। সহজ সরল মনের এই মেয়েটাই তো এখন তার ভবিষ্যৎ। কাজ না করলে কি আর চলে? এই যান্ত্রিক সমাজে সুখ নামের বস্তুটা অনেকাংশেই টাকার কাছে বিক্রি হয়। পরিশ্রম না করলে টাকা আসবে কোত্থেকে? আর সুখ ই বা কিনা হবে কি দিয়ে? এত সাধারণ মনের একটা মেয়ে, অথচ এই মেয়ের মুখের একটু হাসিই একটা ছেলের জীবনের লক্ষ্য বদলে দিল! সামনের মাসেই একটা প্রজেক্ট দাড় করাতে হবে। বেশ বর প্রজেক্ট, কামাইও ভাল। এটা যদি সাবমিট হয় তাহলে এই মাসের শেষেই মিষ্টি হাসির মেয়েটার জন্য একটা গাড়ি কিনবে ছেলেটা। গরমের দিন, নিজের বউকে আগুন জ্বালা রোদে রিকসায় চড়ে হাঁসফাঁস করতে দেখতে কি আর ভাল লাগে?
শুধু মেয়েটাই বোঝে না। কাড়ি কাড়ি টাকা তার দরকার নেই। সেতো ছেলেটার কাছ থেকে একটু সময় চায়। একসাথে থাকার সময়। মেয়েটা ভাল করেই জানে সুখের জন্য টাকা লাগেনা, শুধু মন লাগে। কি হয় মাঝে মাঝে অফিস ফাঁকি দিয়ে যদি বাইরে কোথাও ঘুরতে যাওয়া যায়। এমন কি ক্ষতি হবে যদি দুজন দুদিন সবার আড়ালে সাগর পাড়ে নিরুদ্দেশ সময় কাটায়?
ছেলে জানে এই মায়াবি হাসি নিজের করে নিতে তার কতইনা কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছিল। একটা ভাল জব ছাড়া মেয়ের বাবা মার মন ভোলানো দায়। সাথে আবার ভাল বংশের ছেলে হওয়া তো আবশ্যক। ছেলেকে কর্মঠ হতে হবে। তাদের মেয়েকে সুখে রাখার জন্য ছেলের থাকতে হবে ভারি একটা ব্যাংক অ্যাকাউন্ট। কিন্তু মেয়ে তো এসব চায় না তার লাগবে শুধু ভাল মনের একটা মানুষের ভালোবাসা। যে তার যত্ন নিবে, প্রতিদিন কিছু কবিতা শুনাবে, সন্ধায় টিএসসিতে বসে একসাথে বাদাম খাবে। এবং অবশ্যই তার বাবা মাকে খুশি করেই তাকে এসব করতে হবে। আর যাই হোক মেয়ে তো তার বাবা মায়ের অবাধ্য হতে পারে না।
ভাগ্য যদি ভাল হয় তাহলেই মেয়েকে বিয়ে করা সম্ভব। আর ভাগ্যকে ভাল করতে হলে মেয়ের বাবা মা আর মেয়ে সবাইকে খুশি করতে হবে। ছেলেটা পেরেছিল। পরিশ্রম কম করেনি। ছেলেটা জানে ভালবাসা শুধু মনের ক্ষুধা মিটায়, পেট ভালবাসা চিনেনা, তাকে দিতে হয় অন্য কিছু।
দিন এভাবেই চলে যেতে পারত। আমার গল্পটাও এভাবেই শেষ হতে পারত। তাদের দুজনকে সুন্দর একটা সংসারে রেখে আমি এখানেই ইতি টানতে পারতাম। কিন্তু আসলেই কি তাই? এই কলকারখানার সমাজে কি এই সুখের সমাপ্তি হয়?
হ্যাঁ, এরকম একটা সময় ছেলেটার ধরা পরল ক্যান্সার। ডাক্তার বলেছে ক্যান্সারটা একদম শেষ পর্যায়ের, যার অর্থ দাঁড়ায় সারা শরীরেই ছড়িয়ে পরেছে। তবে হ্যাঁ, ভালো টাকা পয়সা খরচ করলে সে হয়তোবা আরও বছর পাঁচেক বাঁচবে।
বিধি বাম হলে যা হয়, সে নাহয় আরও বছর পাঁচেক বেঁচে থাকলো, সমস্যা নেই। মাত্র তিন বছরের সংসারের এই মিষ্টি মেয়েটা আরও পাঁচ বছর তার সাথেই থাকলো তাও সমস্যা নেই। কিন্তু তার পর? মেয়েটার ভবিষ্যৎ কি? ছেলে জানে না। মেয়েও জানেনা। মেয়ের বাবা মাকে তো জানতে হবে। মেয়ে তো তাদের। ঐ যে বললাম, যান্ত্রিক সমাজ। সমাজটা সব সময় এমনি হয়। মেয়ের বাবা মা সিদ্ধান্ত নিল তাদের মেয়েকে তারা অন্য কোথাও বিয়ে দিবে। পাঁচ বছর বসিয়ে রেখে বুড়ি বানিয়ে বিয়ে দেয়া নয়, যত তাড়াতাড়ি সম্ভব বিয়ে দিবে। এবং মেয়েকে চাপ দেয়া হল ছেলেকে ডিভোর্স দেয়ার জন্য। একদিন দুইদিন আর কত দিন? বাবা মায়ের বাধ্য ভদ্র একটা মেয়ের পক্ষে কতদিনই বা এড়িয়ে চলা সম্ভব? ছেলে যখন হাসপাতালের বেডে শুয়ে ক্যালেন্ডারের পাতা দেখছে, মেয়েটি তো তখন তার পাশেই ছিল। সারা রাত মেয়েটার চোখে শুধু মুক্তা দানা ঝরেছে। নাহ, ছেলেটা মেনে নিতে পারেনি। যাকে খুশি রাখার জন্য সে নিজের জীবনের লক্ষ্যই পালটে ফেলল সেই মিষ্টি মেয়েটা সারা রাত ধরে কেঁদেছে, এটা মেনে নেয়া কঠিন। রাত পার হয়ে যখন নতুন সূর্য চারপাশ আলকিত করল, মেয়েটার দ্বিতীয় অবিবাহিত জীবন শুরু হল। এখনও মেয়েটা কাঁদছে, তবে এখন কোন দ্বিধার কান্না না, কাঁদছে ছেলেটার জন্য। যাওয়ার আগে একটা কথাই বলে গেল "আল্লাহ যেন তোমাকে এভাবে রেখে কষ্ট না দেয়, তোমার কষ্ট আমি সহ্য করতে পারব না।"
পাঁচ বছর পর যখন ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হল, তখন বোঝা গেল ডাক্তার আর যমদূতের মনের মিল সবসময় হয় না। ছেলে অনেক বার মেয়ের সাথে যোগাযোগ করেছে। কিন্তু মিষ্টি মেয়েত এখন আর সেই মিষ্টি নেই। সে এখন দায়িত্বশীল মা। ছেলেটাও বুঝতে পারল সে আর ছেলে নেই। সে এখন সমাজের এক গন্তব্যহীন তথাকথিত ভদ্র লোক।
হুম, এখন মনে হয় এটা আমাদের সমাজের আর দশটা করুন ভালবাসার গল্পের মত হয়েছে।
এবার একটু আমাদের কলকব্জায় ভরা যান্ত্রিক সমাজের ভালবাসার দিকে তাকাই। প্রেম হওয়ার পর প্রথম কয়েক দিন ছেলে মেয়ে বিশাল আবেগ বুকে নিয়ে একজন আরেক জনকে আগলে রাখে। কিছুদিন পর তাদের এই আবেগ ফিকে হয়ে যায়। অনেকের আবার নতুন আবেগ জন্ম নেয়। অনেকে তো আবার আবেগ নামের শব্দটাই চিনে না।
আমরা তো নিজেদেরকেই ভালবাসতে পারি না, অন্য কাউকে কিভাবে ভালবাসবো? সত্যিকার অর্থে দোষটা আমাদের না, দোষটা নিয়তিরও না। দোষটা এই প্রকৃতির, যাকে আমরাই এত নির্মম করে তৈরি করেছি। যে আমাদেরকেই প্রতিনিয়ত পরিচালিত করে।
ছেলেটা মেয়েটার মুখের হাসি ফোটাতে চেয়েছিল টাকা দিয়ে, এটা ছেলের দোষ নয়। তাকে আমাদের সমাজ এ শিখিয়েছে টাকা দিয়ে হাসি কিনা যায়। মেয়েটা মৃত্যুপথযাত্রী ছেলেটাকে ছেড়ে চলে গেল, এতেও আমি মেয়ের দোষ দেই না। আমাদের উদার সমাজই তাকে শিখিয়েছে বেঁচে থাকার তাগিদে, ভালো থাকার তাগিদে ছেলেটাকে ছেড়ে দিতে।
এর মাঝেও কিছু কিছু মানুষ থাকে যারা এই সমাজে থেকেও সমাজের এই নীতিগুলোকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে নিজের স্বকীয়তাকে সগৌরবে টিকিয়ে রেখেছে। আমরা তাদের খুব কমই দেখতে পাই। তাদের এই স্বকীয়তা মানুষকে দেখানোর জন্য না, নিজের সভাবসুলভ এই স্বকীয়তা নিয়ে তারা আমাদেরই মত ভিড়ের মাঝে ঘুরে বেড়ান। আমার বিশ্বাস তাদের জন্যই আমাদের এই যান্ত্রিক জরাজীর্ণ সমাজে বিশ্বাস, ভালোবাসা, আবেগ, আদর, স্নেহ, মায়া, মমতা নামের শব্দগুলো টিকে আছে।
সর্বশেষ এডিট : ০৩ রা জুন, ২০১৪ রাত ১০:৪৭