মূল রচনা: ঢাকার মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনা শোরগোল ফেলেছিল সংবাদমাধ্যমে। আক্রান্ত সেই তরুণীকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন ফেরিওয়ালা হান্নান মিয়া। শুনুন বিস্তারিত...
---
চারপাশের নিয়মিত পাশবিকতার গল্পে খুব দুর্বিষহ লাগছিলো! মনে হচ্ছিলো একজনও কি নেই যে, ফেসবুকে লেখালেখি বাদ দিয়ে, ভিডিও করে কথা বলা বাদ দিয়ে বাস্তবে কিছু করে দেখাতে পারে? কত শিক্ষিত লোকই তো এই বিষয়ে স্ট্যাটাস দিল, ভিডিও বানালো, ব্লগ লিখলো রাতারাতি বিখ্যাত হয়ে গেল। সম্ভবত এই লোকটা ফেসবুক ব্যবহার করতে পারেন না বলেই তার সময় আছে, আসল কাজে নামবার!! স্যালুট ফেরিওয়ালা বাহাদুর "হান্নান মিয়া" আপনাকে! আপনারা আছেন বলেই হয়তো মনুষ্যত্ব আছে! আজকের প্রথম আলোর ছুটির দিনের আর্টিকেলটা পড়েই দেখুন না!
মূল রচনা: ঢাকার মানিকগঞ্জে চলন্ত বাসে ধর্ষণের ঘটনা শোরগোল ফেলেছিল সংবাদমাধ্যমে। আক্রান্ত সেই তরুণীকে বাঁচাতে এগিয়ে এসেছিলেন ফেরিওয়ালা হান্নান মিয়া। শুনুন বিস্তারিত...
বাহাদুর হান্নান!
মো. সাইফুল্লাহ | তারিখ: ০২-০২-২০১৩
‘মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডে নামছেন? রিকশাওয়ালাকে বলেন, “পশ্চিম সেওতা, মাখখু বাবুর্চির বাড়ি যাব।” বললেই নিয়ে আসবে।’ মুঠোফোনে এভাবেই নির্দেশনা দিলেন হান্নান। সামনে দাঁড়ানো রিকশাচালক ততক্ষণে ফোনের এ-পাড়ের কথা শুনেই আন্দাজ করে ফেলেছেন, কোথায় যেতে হবে। প্যাডেল ঘোরাতে ঘোরাতে বললেন, ‘কার সাথে কথা কইলেন? হান্নান? মানে হকার হান্নান তো? হান্নান ভাইয়ের বাড়ি যাইবেন, কইলেই হয়।’
বাসস্ট্যান্ড এলাকার সবাই-ই কমবেশি হান্নানকে চেনেন। আগে পরিচয় না থাকলেও, গত কয়েক দিনে চেনা হয়ে গেছে। মানিকগঞ্জ বাসস্ট্যান্ডের হকারদের একজন হান্নান। অন্য হকারদের সঙ্গে গলা মিলিয়ে তিনিও হাঁক ছাড়েন, ‘লাগবে... চানাচুর, বাদাম, চকলেট।’ ‘হকার’ পরিচয় ছাড়াও হান্নান কীভাবে আলাদা একটা পরিচিতি পেলেন, সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। আগে ঘুরে আসা হোক ‘মাখখু বাবুর্চির বাড়ি’।
মাখখু বাবুর্চি হান্নানের নানা। বাবুর্চি হিসেবে এলাকায় তাঁর বেশ সুনাম। বাবুর্চি বাড়ির উঠানে বসেই কথা হলো হান্নানের সঙ্গে। ‘আপনার নাম কি শুধু “হান্নান” লিখব?’—প্রশ্ন শুনে মাখখু বাবুর্চির নাতিকে কিছুটা বিভ্রান্ত দেখাল। একটু ভেবে বললেন, ‘তাইলে হান্নান মিয়া লেখেন।’ হান্নান মিয়া জানালেন, দুই বছর ধরে তিনি এ এলাকায় চানাচুর-বাদাম-চকলেট বিক্রি করেন। ‘এর আগে কী করেছেন?’—জানতে চাই। হান্নান যখন উত্তর দেওয়া শুরু করলেন, মনে হলো প্রশ্নটা ভুল হয়েছে। প্রশ্ন হওয়া উচিত, ‘কী করেননি?’ ‘রিকশা চালাইছি, আইসক্রিম বেচছি, ডাব বেচছি, পুরান কাপড়চোপড় বিক্রি করছি, ঢাকায় বাসাবাড়ি রং করছি, এসি লাগাইছি...’ হান্নানের তালিকা লম্বা হতেই থাকে। পরিচয়পর্ব শেষে হান্নানের কাছে জানতে চাই, ‘সেদিনের ঘটনা।’
শুভযাত্রায় অশুভযাত্রা
সেদিনও প্রতিদিনের মতোই চানাচুর, বাদামের ঝোলা নিয়ে বের হয়েছিলেন হান্নান। তখন দুপুর। চানাচুর-বাদামের অনেকখানিই তখনো অবিক্রীত রয়ে গেছে। মানিকগঞ্জ পল্লী বিদ্যুৎ এলাকায় একটি গতিরোধকের সামনে দাঁড়িয়ে বাসের জন্য অপেক্ষা করছিলেন হান্নান। বাসের গতি মন্থর হলেই টুক করে উঠে পড়বেন। যদি কিছু বিক্রি হয়, এই আশায়। সে সময় মানিকগঞ্জ থেকে আরিচার দিকে যাচ্ছিল শুভযাত্রা পরিবহনের একটি বাস। দূর থেকে একনজর দেখেই হান্নান বুঝলেন, বাসের ভেতর যাত্রী নেই। শুভযাত্রা থেকে মনোযোগ সরিয়ে তাই তাঁর নজর তখন পেছনে, পরবর্তী বাসের আশায়। এরপর ‘হঠাৎ শুনি, বাসের ভিতর থেইকা একটা মেয়ের চিৎকার। দেখি, ভিতরে বাসের হেলপার একটা মেয়ের সাথে ধস্তাধস্তি করতেছে। দেইখাই আমি দৌড়ায় বাসটাতে উঠতে গেলাম, কিন্তু আমারে দেইখা ড্রাইভার দিল টান। উঠতে পারলাম না। বাসে বাসে হকারি করি, তাই সব ড্রাইভার-হেলপাররেই চিনি। ওগোরেও দেইখাই চিনছিলাম। আমারেও মনে হয় ওরা চিনছিল’ বলছিলেন হান্নান।
চটজলদি পরের বাস ধরলেন হান্নান। বিক্রিবাট্টার চিন্তা তখন মাথায় উঠেছে। তাঁর দৃষ্টি শুধু সামনে, আঁতিপাঁতি করে খুঁজছেন শুভযাত্রার বাস। তরা সেতুর কাছে গিয়ে দেখলেন, বাসটা উল্টো দিকে যাচ্ছে। সেখানেই নেমে গেলেন হান্নান। উঠলেন উল্টো দিকগামী আরেকটা বাসে। একটু দেরি হয়ে যাওয়ায় ততক্ষণে শুভযাত্রার বাসটা হারিয়ে ফেলেছেন। এবার রাস্তায় কড়া নজর রাখলেন তিনি। একটা পেট্রলপাম্পের পাশে খালি জায়গায় শুভযাত্রার বাসটা একনজর দেখলেন বলে মনে হলো। কিন্তু হান্নানের বাসটা দ্রুত চলে যাওয়ায় সেখানে নামা হলো না। কিছু দূর গিয়ে তাই আবারও নেমে উল্টো দিকের বাস ধরতে হলো তাঁকে।
‘মানোরা ব্রিজের কাছে গিয়া দেখলাম, মেয়েটা রাস্তার পাশে বইসা কানতাছে। রিকশাওয়ালারা তারে ঘিরা দাঁড়ায় আছে। আমি বললাম, “বোইন তুমি কাইন্দো না। তোমার কিছু বলতে হবে না। আমি ওদেরকে চিনি। আমি দেখতাছি”। বোইনরে যাত্রীছাউনিতে নিয়া বসাইলাম। পাশের একটা দোকানদারকে বললাম, “ওরে একটু দেইখেন।” ডিমের দোকান থেইকা একটা লাঠি নিয়া রওনা হইলাম মালিক সমিতির অফিসে।’ হান্নান তখন রাগে ফুঁসছেন। অনেকক্ষণ ধরে বাসটার পেছনে ছুটেছেন, ধরতে পারেননি। এবার একটা হেনস্তা করে ছাড়বেন।
বিচার চাই
মালিক সমিতির অফিসে উপস্থিত ছিলেন মানিকগঞ্জ জেলা সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি বাবুল সরকার। সব শুনে দ্রুত ব্যবস্থা নিলেন তিনি। বাবুলের নেতৃত্বে গার্মেন্টসকর্মী মেয়েটিকে মালিক সমিতির অফিসে আশ্রয় দেওয়া হলো, থানায় খবর দেওয়া হলো। পাশাপাশি, অপরাধীরা যেন পালিয়ে যেতে না পারে, তাই কৌশলে তাদের আটক করার ব্যবস্থাও করলেন বাবুল। সবার তৎপরতায়, বন্দী হলো বাসচালক দীপু আর হেলপার আবুল কাশেম।
মানিকগঞ্জ জেলা বাস-মিনিবাস মালিক সমিতির সভাপতি কাজী এনায়েত হোসেন ওরফে টিপু বলছিলেন, ‘সেদিন আমরা সবাই সোচ্চার ছিলাম। সমিতির লোকজন থেকে শুরু করে সাধারণ মানুষ, সবার একটাই কথা, “বিচার চাই।” কিছুদিন আগে দিল্লিতেও এমন একটা ঘটনা ঘটেছে। সেই ঘটনা সবাইকে আরও সচেতন করেছে। অন্য কোথাও গেলে হয়তো চড়-থাপড় দিয়ে মীমাংসা হয়ে যেত। কিন্তু যেহেতু আমাদের কানে আগে এসেছে, মীমাংসার প্রশ্নই আসে না। ওরা যে জঘন্য অপরাধ করেছে, কঠিন সাজা হওয়া উচিত।’
বর্তমানে কারাগারে আছে সেই বাসচালক আর হেলপার। গোটা মানিকগঞ্জেই এখন অপরাধীদের সঠিক বিচারের দাবি উঠছে। এলাকাবাসী, বিভিন্ন সংগঠন দফায় দফায় মানববন্ধন, মিছিল ও সমাবেশ করছে। এমনকি মানববন্ধনে অংশ নিয়েছেন শুভযাত্রা পরিবহনের অন্য বাসচালক-হেলপাররাও। সকাল ছয়টা থেকে বেলা ১১টা পর্যন্ত নিজেদের বাস চলাচল বন্ধ রেখে অন্যদের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন তাঁরা। হোক সে সহকর্মী, অন্যায়ের সাজা তাদের পেতেই হবে!
জানা গেছে, ঘটনার শিকার গার্মেন্টসকর্মী তরুণী সুস্থ আছেন। গত শনিবার থেকে কাজে যোগ দিয়েছেন তিনি।
ভয়
ভালো কাজের জন্য সবার কাছ থেকে প্রশংসা পেয়েছেন হান্নান। কিন্তু উল্টো অভিজ্ঞতাও হচ্ছে। হান্নান বললেন, ‘খুব ভয়ে আছি ভাই। সেদিন মাঝরাতে ফোন কইরা হুমকি দিছে। আরও লোকজনের কাছে শুনতেছি, আমারে নাকি মাইরা ফালাইব। কিছু কিছু বাস ড্রাইভার-হেলপারও এখন আমারে দেখতে পারে না। বাসে বাসে হকারি করি ভাই। মাইনষের ডরে না জানি ব্যবসা বন্ধ হইয়া যায়।’
হান্নানের মা বললেন, ‘আমার পোলাটা সত্য কথা বলতে ভয় পায় নাই, আমরা সবাই খুশি হইছি। কিন্তু সত্যি কথা কইয়া না জানি মরতে হয়। রাইত-বিরাইতে যেন নিশ্চিন্তে চলাফেরা করতে পারে, এই ব্যাপারটা আপনারা একটু দেইখেন ভাই।’
সাত ভাইয়ের মধ্যে সবার বড় হান্নান। জহিরুল, জাহাঙ্গীর, জাবেদ, আমজাদ, আজাদ আর সবার ছোট সিন্দবাদ! দুর্ধর্ষ নাবিকের নামে নাম বলেই, ছোটজনের সঙ্গে দেখা করার ইচ্ছা ছিল। বাড়িতে ছিলেন না বলে দেখা হলো না। মজা করেই হান্নানকে জিজ্ঞেস করলাম, ‘আপনাদের সাত ভাইয়ের তাহলে কোনো চম্পা নেই?’ হেসে মাথা নাড়েন তিনি। বোন না থাকলেও, বোনদের কীভাবে সম্মান দেখাতে হয়, ভালো করে জানেন হান্নান। বললেন, ‘আমি যেইটা করছি, এইটা অন্য যে কেউ থাকলে করত। এইটা সবারই কর্তব্য। আমার যদি একটা বোইন থাকত, আজকে তারে যদি কেউ আপনার সামনে অত্যাচার করে, আপনে যাইবেন না?’
Click This Link