একটা ঘরের কথা চিন্তা করা যাক -যা আধুনিক প্রযুক্তির বিভিন্ন যন্ত্রপাতি দিয়ে সাজান আছে। দিনের আলো কমে আসলে ঘরের লাইটগুলি জ্বলে ওঠে, ঘর গরম হলে এসি চালু হয়ে যায়। টিভি, ফ্রিজ তো আছেই। এ'রকম একটা ঘরে যদি এমন কিছু মানুষকে থাকতে দেয়া হয় যাদের এ'সব বিষয়ে কোন জ্ঞান নেই এবং এই ঘরের বাইরে থেকে কোন জ্ঞান লাভের সুযোগও নেই - তাহলে এসব যন্ত্রপাতির প্রতি তাদের আচরন কেমন হবে চিন্তা করুন।
প্রথম একদল লোক পাওয়া যাবে যারা এই সবযন্ত্রপাতি এবং এদের কার্যপ্রনালী দেখে চিন্তা করবে যে এ'সব নিজে নিজে তৈরী হয়নি এবং এ'গুলো কোন শক্তি ছাড়া এমনি এমনি চলছেও না। এ'গুলোকে কেউ তৈরী করে কিছু নির্দিস্ট নিয়মের অধিন করে দিয়েছে বলেই এ'গুলো এভাবে কাজ করছে। যদিও ঐ ঘরের মধ্যে থেকে টিভি স্টেশন বা বিদ্যুৎ উৎপাদন কেন্দ্র সম্পর্কে সঠিক ধারনা পাওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হবে না তবুও তারা বুঝবে যে কোন একটা শক্তি/ইন্ডাস্ট্রি নিশ্চয়ই আছে যেখানে এ'গুলো তৈরী হয়েছে।
দ্বিতীয় যে দলটি পাওয়া যাবে তারা এ'গুলোকেই মহা শক্তিশালী ভেবে বসবে। তারা মনে করবে লাইট একটা বিশাল ব্যাপার যে রাত হলেই নিজে নিজে জ্বলে ওঠে। এ.সি, ফ্রিজ, টিভি সবকিছুই তাদের কাছে মহা বিস্ময়কর এবং বিশাল ক্ষমতাধর মনে হবে। তাদের কেউ কেউ এগুলোর পুজা করাও শুরু করতে পারে।
তৃতীয় দলটা হবে নাস্তিকদের। এরা এসব জিনিস দেখে প্রথমে বিস্মিত হলেও এ'গুলোর কার্যপ্রনালী জানার চেস্টা করবে। এই চেস্টার এক পর্যায়ে তারা সেই সেন্সরটি খুজে পাবে যা অন্ধকার হলে লাইট জ্বালাতে সাহায্য করে, টিভির রিমোট, ফ্রিজ এবং এ.সির সুইচগুলোও তারা খুজে পাবে এবং নিজেদেরই এ'সবের চালক/নিয়ন্ত্রক বলে ঘোষনা করবে। তারা বলবে- আমি সুইচ টিপি বলেই তো লাইট জ্বলে, আমি রিমোট টিপি বলেই তো টিভিতে বিভিন্ন অনুস্ঠান দেখা যায়- এখানে পাওয়ার প্ল্যান্ট আর টিভি স্টেশনের কাজ কি? ঠিক আমার দেড় বছরের মেয়েটারমত। সে যেদিন প্রথম বেড সুইচ টিপে লাইট জ্বালান শিখেছিল সেদিন তার কি আনন্দ। বাসার সবাই তো বটেই পাশের বাসার লোকদেরও ডেকে দেখাচ্ছিল কি বিরাট কাজ সে করতে পারছে। ঐ অবস্থায় তাকে এটা বুঝান কি সম্ভব ছিল যে তোমার এই কাজকে বাস্তবায়িত করার পিছনে এক বিশাল পাওয়ার প্ল্যান্ট এবং পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন সিস্টেম কার্যকর আছে? নাস্তিকরা যখন বলে-"আমি বীজ বপন করি বলে ফসল জন্মায় এখানে ঈশ্বরের কি কাজ?"-তখন আমার মেয়ের সেই দিগ্বিজয়ী হাসির কথা মনে হয়। আর করুনা হয় সেই নাস্তিকদের প্রতি যারা জ্ঞান সমুদ্রের সামান্য কয়েকটা ফোটা আহরন করেই নিজেদের মহা জ্ঞানী ভাবছেন।
সুতরাং নাস্তিকতা আসলে সল্পবিদ্যার ফসল যেখানে মানুষ নিজেকে মহা শক্তিমান মনে করে। সে যা জানে তার বাইরেও কিছু থাকতে পারে এটা মানতে পারে না। উদাহরনের তৃতীয় শ্রেনীর লোকরা যেমন লইট, ফ্যান, টিভি, ফ্রিজের সুইচ আবাষ্কার করেই নিজেদের মহা শক্তিশালী ভাবে, পাওয়ার প্ল্যান্ট বা টিভি স্টেশনকে অস্বীকার করে-নাস্তিকরা ঠিক তেমনি বিজ্ঞানের স্বাধারন কিছু আবিষ্কার দেখেই নিজেদের সর্বশক্তিমান ঘোষনা করে আর এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ডের কোন স্রস্টা-নিয়ন্ত্রক নেই বলে ঘোষনা করে।
বিজ্ঞান আসলে কি আবিষ্কার করে? সকল মহান বিজ্ঞানীদের প্রতি পুর্ন শ্রদ্ধারেখেই বলছি- বিজ্ঞান শুধুমাত্র প্রকৃতির নিয়ম-বৈশিস্টই আবিষ্কার করে - তার বেশি কিছু নয়। বিজ্ঞান যখন আবিষ্কার করেছে পৃথীবি সুর্যের চারদিকে ঘোরে, তার বহু আগে থেকেই পৃথীবী সুর্যের চারদিকেই ঘুরছিল। বর্তমান যুগের বিস্ময় ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি যে সিলিকন এবং জার্মেনিয়ামের সেমি কন্ডাক্টিভ প্রপার্টিজের উপর ভিত্তি করে গড়ে উঠেছে সেই প্রপার্টিজ বহু বিলিয়ন বছর আগে থেকেই তাদের মধ্যে ছিল-মানুষ জানত না- বিজ্ঞান মানুষকে জানিয়েছে। এ'ভাবে চিন্তা করলে দেখা যাবে বিজ্ঞানের সকল আবিষ্কারই প্রকৃতির বিভিন্ন নিয়ম-বৈশিস্টের উপর নির্ভরশীল। এই আবিষ্কার গুলোকে তুলনা করা যেতে পারে উদাহরনের লোকদের বিভিন্ন সুইচ আবিষ্কারের সাথে যা আগে থেকেই সেট করা ছিল। ঘরের মধ্যে বসে সুইচ-রিমোট আবিষ্কার করে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বা টিভি স্টেশনকে অস্বীকার করা যেমন মুর্খতা ঠিক তেমনি স্রস্টার সৃস্টির মধ্যে থেকে বিভিন্ন নিয়ম বৈশিস্ট আবিস্কার করে স্রস্টাকে অস্বীকার করাও নিতান্তই স্বল্পবিদ্যার ভয়ঙ্কর পরিনতি ছাড়া কিছুই নয়।
বিজ্ঞান কিন্তু কখনই বলে না যে স্রস্টা নেই। কারণ বিজ্ঞান প্রমান ছাড়া কিছু বলতে পারে না। 'আছে' যেমন বলে না 'নেই'ও তেমনি বলতে পারে না। কিন্তু নাস্তিকরা তাদের নাস্তিক বিশ্বাসকে প্রতিস্ঠিত করার জন্য সবসময় বিজ্ঞানকে ব্যাবহার করতে চায়। এ'জন্য বিজ্ঞানের ব্যাপাটা পরিস্কার হওয়া জরুরী।
বৈজ্ঞানিক সত্য বলতে সেটাই বুঝায় যেটা প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরিক্ষার মাধ্যমে প্রমানিত হয়েছে এবং তার উপর আর কোন গবেষনার প্রয়োজন নেই। যেমন 'পৃথিবী সুর্যের চারদিকে ঘোরে'-এটা বৈজ্ঞানিক সত্য। কারণ এটা প্রমানিত হয়ে গেছে এবং এখন আর এ'বিষয়ে কার গবেষনা করার প্রয়োজন নেই।
কিন্তু আজকে যদি বিজ্ঞানের কাছে প্রশ্ন করা হয়-পৃথিবী ছাড়া অন্য কোন গ্রহে প্রানের অস্তিত্ব আছে কি? তার উত্তরে বিজ্ঞান কি বলবে? এখনও এ'ধরনের কোন গ্রহ আবিষ্কার হয়নি-কিন্তু তার অর্থ কি এধরনের কোন গ্রহ নেই এটাই বৈজ্ঞানিক সত্য? মোটেই না-কারণ তাহলে এ'বিষয়ে আর কোন গবেষনার প্রয়োজন থাকত না। যদি প্রশ্নটা এমন হয়-সৌরজগতে মানুষের বসবাসের উপযোগী কোন গ্রহ আছে কি? তাহলে বিজ্ঞান বলবে নেই-কারন আজকের বিজ্ঞান সৌরজগতের সবগুলি গ্রহের ব্যাপারেই যথেস্ট তথ্য জানে এবং জানে বলেই নিশ্চিত ভাবে বলতে পারছে এগুলোতে প্রানের অস্তিত্ব নেই। সুতরাং কিছু নেই বলা, আছে বলার চেয়েও কঠিন-কারণ নেই বলতে হলে থাকার সবগুলো সম্ভাবনা পরীক্ষা করতে হবে এবং শুধুমাত্র তার পরই বলা যাবে নেই।
যদি বিষয়টা এমন হত যে বিজ্ঞান আজ পর্যন্ত যা জানে তাই সব-এর বাইরের সবকিছু নেই এবং এটাই বৈজ্ঞানিক সত্য- তাহলে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রা বহু আগেই থেমে যেত। কারণ বিজ্ঞান সেই বিষয় নিয়েই গবেষনা করে যা আজও বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে প্রতিস্ঠিত হয়নি। কাজেই বিজ্ঞান আবিষ্কার করতে পারেনি বলেই - বেহেস্ত, দোযোখ, জ্বিন, ফেরেস্তা কিছুই নেই এমনকি আল্লাহও নেই এ'কথা বলা নিতান্তই অবৈজ্ঞানিক। বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে নেই বলতে হলে এই সৃস্টিজগতের সকল রহস্য-সকল জ্ঞান মানুষের আয়ত্বে আসতে হবে এবং সেই জ্ঞানের ভিত্তিতেই কেবলমাত্র সিদ্ধান্ত নেয়া যাবে শ্রস্ঠা আছে কি নেই।
কিন্তু সমস্যা হল-আমাদের জ্ঞান যে হারে বাড়ে অজ্ঞতার পরিধী তারচেয়ে বহুগুন বেশি হারে বাড়ে। মানুষের জ্ঞান যখন পৃথীবির মধ্যে সীমিত ছিল তখন বলাযেত পৃথিবীটা ঘুরে দেখলে এবং এর কোথাও কোন আলামত না পেলেই বলা যাবে ওসব কিছু নেই। কিন্তু আজকে আমাদের জ্ঞান যখন সৌরজগত পর্যন্ত পৌছেছে তখন দেখা যাচ্ছে এই বিশ্বব্রক্ষ্মান্ড বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ ব্যাপি বিস্তৃত। সুতরাং এখন যদি বলতে হয় কিছু নেই তাহলে আমাদের এই বিলিয়ন বিলিয়ন আলোকবর্ষ ব্যাপি ছড়ান মহাকাশের পুরোটা জানতে হবে। তাহলে আমরা আমাদের জ্ঞান কয়েক আলক মিনিট বাড়াতে গিয়ে অজ্ঞতার পরিধি বিলিয়ন বিলিয়ন আলোক বর্ষ বাড়িয়ে ফেলেছি।
যখন বিজ্ঞান বলত-এই সৃস্টিজগতই সব-এর কোন শুরু বা শেষ নেই-অনন্তকাল ধরে এ'ই জগত স্থীতিশীল অবস্থায় আছে এবং অনন্ত কাল তাই থাকবে- তখন এই জগতের বিষয়ে জানাই যথেস্ট ছিল। কিন্তু এখন বিগ ব্যাং থিওরী প্রমানিত হবার পর যখন বিজ্ঞান বলছে এই জগতের শুরু ছিল তখনই আমাদের অজানার গন্ডি আরো বেড়ে যাচ্ছে-প্রশ্ন আসছে তাহলে শুরুর আগে কি ছিল? যার শুরু থাকে স্বাভাবিক ভাবে তার শেষও থাকবে, তাহলে সেই শেষের পর কি থাকবে? যার শুরু থাকে তার সুচনাকরী থাকে, কে সেই সুচনা কারী? বলা হচ্ছে এই জগৎ সম্প্রসারিত হচ্ছে-তাহলে এর বাইরেও কিছু আছে-নাহলে সম্প্রসারিত হচ্ছে কোথায়- সেই বাইরের জগৎটাও তাহলে আমাদের জানতে হবে।
আবার মাত্রাগত দিক বিবেচনা করুন। একসময় আমরা তৃমাত্রিক স্থান নিয়েই সন্তুস্ট ছিলাম। বিজ্ঞান যখন বল্ল, না এটা তৃমাত্রিক নয় বরং চতুর্মাত্রিক এবং চতুর্থ মাত্রা হচ্ছে সময়-তখনই প্রশ্ন তৈরী হল-চতুর্থ মাত্রা যদি থাকে তাহলে মঞ্চম-ষস্ঠ মাত্রা কি নেই? অথবা আমাদের চতুর্মাত্রিক জগতের সমান্তরালে অন্য মাত্রার কোন জগত কি থাকতে পারে না? তাহলে এখন আমাদের এটাও নিশ্চিত ভাবে জানতে হবে যে অন্য মাত্রা আছে কি না, থাকলে সেই মাত্রার জগতের অবস্থা কি?
তাহলে দেখা যাচ্ছে বিজ্ঞানের অগ্রযাত্রার ফলে আমাদের জ্ঞান বা জানার পরিধী যে গতিতে বাড়ছে অজানার পরিধী বাড়ছে তার চেয়ে অনেকগুন বেশী গতিতে। এ'ভাবে চলতে থাকলে বিজ্ঞান কোন দিনই বিশ্ব জগতের সবকিছু জানতে পারবে না এবং কোন দিনও বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে বলতে পারবে না যে "আমরা যা আবিষ্কার করিনি তাই নেই"।
সুতরাং নাস্তিকরা যে বিজ্ঞানকে অবলম্বন করে তাদের নাস্তিকতাকে জাস্টিফাই করার চেস্টা করে সেই বিজ্ঞান আজকে তো নয়ই অদুর ভবিষ্যতেও কোন দিন তাদের দাবিমত বৈজ্ঞানিক সত্য হিসেবে ঈশ্বরের অনস্তিত্ব ঘোষনা করতে পারবে না।
কাজেই ঈশ্বরের অনস্তিত্বও একটা বিশ্বাস মাত্র। আমরা যেমন আল্লাহর অস্তিত্বে বিশ্বাস করি, নাস্তিকরাও তেমনি তাঁর অনস্তিত্বে বিশ্বাস করে- কিন্তু ভাব দেখায় এমন যেন তারা খুব বড় পন্ডিত আর আমরা সব অন্ধ। বাস্তবাতা হচ্ছে নাস্তিকতাই বড় অন্ধকার যেখানে মানুষ যা জানে তার বাইরের সবকিছু অস্বীকার করে। আশা করি নাস্তিকরা তাদের ভুল বুঝতে পারবে এবং মহান স্রস্টা, সর্বশক্তিমান আল্লাহর প্রতি বিশ্বাস স্থাপন করে আলোর পথে ফিরে আসবেন আর তাঁর সৃস্টির বিশালতা অনুধাবন করে শ্রদ্ধা এবং কৃত্জ্ঞতায় মাথা অবনত করবে।