উপমহাদেশের প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ অমর্ত্য সেন কোন এক সভায় একবার বলেছিলেন, “জবাবদিহিতা ছাড়া উন্নয়ন সম্ভব নয়”। আক্ষরিক অর্থে জবাবদিহিতা শব্দটা ব্যবহার করলেও এর আরেকটি প্রতিশব্দ হতে পারে – স্বচ্ছতা। পৃথিবীর কোন উন্নত দেশের নাম মাথায় আসলেই আমরা ভাবি- তাদের অনেক উঁচু দালান আছে, বড় বড় রাস্তা আছে, অনেক সম্পদ মজুদ আছে। হ্যাঁ, আমাদের মত দেশের জন্যে এসব অনেক দুঃসাধ্য। একবারের জন্যেও ভাবিনা এসব সম্পদের চেয়েও এই দেশ গুলোর এমন কিছু সম্পদ আছে, যা চাইলে আমরা রাতারাতিই অর্জন করতে পারি। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে- স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, ন্যায়বিচার, সংবাদ পত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি।
অত্যন্ত দুঃখ ও পরিতাপের বিষয় – আমাদের দেশে এই শব্দগুলোর বড়ই অভাব। প্রতিটা ক্ষেত্রে, প্রতিটা প্রতিষ্ঠানে, হোক তা ছোট, হোক বড়। এদেশ এক সময় ছিল দারিদ্রের দুষ্ট চক্রে আক্রান্ত। আর এখন তা গিয়ে দাঁড়িয়েছে অসততার দুষ্ট চক্রে। এটা এমনই জঘন্য যে, কেউ মাঝে একটু ভাল অথবা সৎ থাকার চেষ্টা করবে, দেখা গেল পরের দিন তার লাশ পাওয়া যাবে শহরের কোন ডোবায় অথবা রাস্তায় ফেরার পথে হাত কেটে ফেলে দিবে কথিত দুরবিত্তরা। পত্রিকায় হেডলাইন হবে, মাননীয়রা দুঃখ প্রকাশ করবেন, কেউ কেউ আবার চোখে টিপ্পনীও কাটবেন।
আমরা মোটামুটি সহজ লভ্য বলে সব সময়ই ভারতকে অনুকরন করি। যেমন ধরুন, আপনি একটা সিনেমা বানাবেন, সব কিছুর জন্যে বাজেট রাখলেও সিনেমার গল্পের জন্যে বাজেট লাগেনা। অতি সহজেই হিন্দিকে বাঙলায় অনুবাদ করে চালিয়ে দেয়া যায়। ব্যাতিক্রম ও আছে। আবার রাজনৈতিক সংস্কৃতিও একই। হরতাল বিষয়টা ভারতের বন্ধ থেকেই আসছে। দুখের বিষয় হচ্ছে, ভালো বিষয় গুলো খুব কৌশলে এড়িয়ে যান আমাদের মাননীয়রা। এই যেমন, কোন ব্যর্থতার পর তার দায়ভার কাঁধে নিয়ে পদত্যাগ করা। আবার ভারতের বিচার বিভাগ কিন্তু পৃথিবীর উন্নত দেশগুলোর মতই স্বাধীন। আমরা কিন্তু আমাদের বিচার বিভাগে এর সামান্যতম প্রয়োগও করতে পারিনা। যদিও আমরা দাবি করি ক্ষেত্র বিশেষে আমাদের বিচার কাজ নাকি আন্তর্জাতিক মানের! এদেশে বিচারের রেশমাত্র নেই বলেই একই অপরাধ বারবার হচ্ছে। প্রকৃত অপরাধীর শাস্তি হয়না বলেই, দুই দিন পর পর শাহাজালালে সোনার বার পাওয়া যায় কেজিতে কেজিতে। কে জানে, যা ধরা পড়ে তার কয়গুন অবৈধভাবে পাচার হয়! বিচার নাই বলেই হয়ত- যারা আইন শৃঙ্খলা রক্ষা করার দায়িত্ব নেন, তারাই রাজপথে চাঁদাবাজি করেন, রাস্তায় গাড়ি থামিয়ে তারাই অযথা যানজট তৈরি করেন, মানুষকে জিম্মি করে টাকা আদায় করেন। এ যেন সরষের ভেতরেই আসল ভুত! সান্ত্বনা এইটুকুই – দেশের আইনশৃঙ্খলা অন্য সবসময়ের থেকে ভালো আছে।
যাইহোক, এসব চাঁদাবাজি, চোরাই কারবারির কারনে হয়ত সাময়িক অর্থনৈতিক ক্ষতির সন্মুখিন হচ্ছি, যা পুষিয়ে নেয়া সম্ভব। কিন্তু এমন কিছু অপরাধ আছে যা পুরো দেশ তথা জাতিকে মেরুদণ্ডহীন করে দিচ্ছে। তার মধ্যে অন্যতম হচ্ছে প্রশ্নপত্র ফাঁস। এর ফলে একদিকে জাতি হচ্ছে মেধা শূন্য, অন্য দিকে দেশ চালানর দায়ভার যাচ্ছে গাধার পিঠে। যে ছাত্র কোন মতে মুরব্বিদের দোয়ার জোরে কিংবা হাউজ টিউটরের কল্যানে কোন মতে নাইন পর্যন্ত আসছে সে এসএসসি তে পাচ্ছে গোল্ডেন ফাইভ! যার প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক হওয়ার যোগ্যতা নাই, তাকে বানানো হচ্ছে বিসিএস ক্যাডার, প্রশাশনের বড় কর্তা! তাও না হয় মানলাম। প্রশাসন চালাবে। জীবন মরেনের তো কিছুনা। আস্তে আস্তে শিখে নিবে। কিন্তু যে ছেলে কোন ভাবে টেনে-টুনে কিংবা ডিজিটাল প্রশ্ন পেয়ে এইচএসসি পাশ করল, তাকেই আবার প্রশ্ন ফাঁস করে দিয়ে ঠেলে দেয়া হচ্ছে মেডিকেল কলেজ গুলোতে। এ যেন গাধাকে দিয়েই ঘোড়ার গাড়ি চালানো! সেই ছেলেই দুই দিন পরে আবার ডাক্তার হয়ে আপনার-আমার ওপেন হার্ট-সার্জারি করছে। এজন্যেই হয়ত প্রযুক্তির এত উন্নতির পরও আমাদের স্বাস্থ্য সেবা এতটা ত্রুটি যুক্ত। আর এতসব জঘন্য অপরাধের সাথে জড়িত যাদের হাতেনাতে আটক করা হয়, শাস্তি হিসেবে করা হচ্ছে সাময়িক বরখাস্ত! একটা জীবন নষ্টের শাস্তি যদি হয় ফাঁসী কিংবা যাবজ্জীবন কারাবাস, এতোগুলা জীবন নষ্টের জন্যে দায়ীদের কী শাস্তি হওয়া দরকার?
মজার ব্যপার হচ্ছে আমাদের মাননীয়রা এত বোকা না। উনারা ভালো করেই জানেন, হাল্কা সর্দি-জর হলেও উনারা যাবেন সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে। সুতরাং ঢাকা মেডিকেলে কোন ছাত্র ভর্তি হল না হল এটা নিয়ে ভাবার এত সময় বা প্রয়োজন উনাদের নেই। বেসরকারি মেডিকেল কলেজ গুলা ইতিমধ্যেই আন্দোলন শুরু করেছে, মেডিকেল ভর্তি পরীক্ষার পাশ নম্বর কমিয়ে ২০ নম্বর করার জন্যে। তাদের আন্দোলনের যুক্তিও আছে। এই পাশ মার্কই কেন “প্রাইভেট মেডিকেল ব্যবসা শিল্পের” অন্তরায় হয়ে দাঁড়াবে?
শেষ করা যাক মালয়েশিয়ার প্রেসিডেন্ট মাহাথির মোহাম্মদের একটা ঘটনা দিয়ে। একবার তিনি শারীরিক ভাবে অত্যন্ত অসুস্থ পড়ছিলেন। উনার শরীরে জরুরি ভাবে অস্ত্রপচার করা লাগবে। মেডিকেল বোর্ড গঠন করা হল, উন্নত চিকিৎসার জন্যে তাঁকে বিলেতের কোন এক স্বনামধন্য হাসপাতালে নেয়া হবে। বিষয়টি উনার নজরে আসার সাথে সাথেই ডাক্তারদের ডেকে পাঠালেন এবং শাসিয়ে বললেন- “যে কোনভাবেই যেন উনার চিকিৎসা নিজ দেশেই করা হয়। এতে তাঁর যা হবার তাই হবে। কিন্তু বিদেশে উনার চিকিৎসা করা যাবেনা”। তখন ওই মেডিকেল টিম উনার সফল অস্ত্রপচার করলেন। আজ সেই মালয়েশিয়া চিকিৎসা সেবায় পৃথিবীতে সম্ভবত তিন নম্বর। আমাদের দেশপ্রেমী মাননীয়গণ কথায় কথায় বলেন, বাংলাদেশ একদিন মালয়েশিয়াকে ছাড়িয়ে যাবে, তারাই সামান্য সর্দি-কাশির চিকিৎসাও সিঙ্গাপুরে গিয়েই করেন!
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে সেপ্টেম্বর, ২০১৫ রাত ১:১২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




