somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- বারো)

১৭ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দশ

অনেক খোঁজাখুঁজি করে শেষ পর্যন্ত আধাবেলা কাজের জন্য একজন গৃহকর্মী পাওয়া গেল। সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত তার কাজ- সকালের নাস্তা বানানো, দুপুরের রান্না করা, ঘরদোর পরিষ্কার রাখা এবং জামাকাপড় কাঁচা। বেশিরভাগ ঠিকা গৃহকর্মী ঘর মুছতে আর জামাকাপড় কাঁচতে চায়, রান্না করতে চায় না। সঙ্গত কারণেই সে বেতন যা চাইল আমি তাতেই রাজি হয়ে গেলাম। বয়স বাইশ-তেইশ বছর, নাম আছিয়া, আমাকে কাকা বলে ডাকত। সকালবেলা তিনটে রুটি বেশি বানাতে বলতাম আর সবজি একটু বেশি রান্না করতে বলতাম, রাতে সেই সবজি আর রুটি খেতাম। কী রান্না হবে, কী বাজার করতে হবে, এসব নিয়ে কথা বলা ছাড়াও মাঝে মাঝে ওর সংসারের খোঁজ-খবর নিতাম। আছিয়া ওর পাঁচ বছরের ছেলে রাকিবকে নিয়ে কাজে আসত। ওরা মা-ছেলে আমার বদ্ধ জীবনের ছোট্ট একটা জানালা হয়ে উঠেছিল। আমি মাঝে মধ্যে রাকিবের জন্য খেলনা আর আইসক্রিম-চকলেট নিয়ে আসতাম। এইটুকুতেই ওদের মা-ছেলের মুখে কী এক মায়াময় হাসি ফুটে উঠত। রাকিবকে পড়াতাম, ড্রয়িংরুমে আমি আর রাকিব ক্রিকেটও খেলতাম, তা দেখে আছিয়া বলত, ‘আমার পোলার লগে মিশ্যা কাকাও য্যান পোলাপান অইয়া গেছেন!’

দুপুরের মধ্যে কাজ শেষ করে ওরা মা-ছেলে চলে যেতেই শ্মশানের নীরবতা নামত ফ্ল্যাটে। দুপুরে খেয়ে একটু ভাতঘুম দেবার পর হয় সিনেমা দেখতাম, নয়ত বই পড়তাম। সন্ধ্যেবেলা হাঁটতে বেরিয়ে অনেকটা সময় বাইরে কাটিয়ে আসতাম। হাঁটার পর চায়ের দোকানে বসে চায়ে চুমুক দিতে দিতে নানা ধরনের মানুষের আসা-যাওয়া দেখতাম, চা পান করতে আসা অন্য মানুষদের কথা শুনতাম, কখনো কখনো কারো সাথে গল্পও জুড়ে দিতাম। বাসায় ফিরতাম নয়টার দিকে। কোনো কোনো সন্ধ্যায় শিল্পকলায় নাটক দেখতে কিংবা ছায়ানট সংস্কৃতি ভবনে সংগীতের অনুষ্ঠানে যেতাম।

বেশ কয়েক মাস কাজ করার পর একদিন লক্ষ করলাম আছিয়ার চোখ-মুখ বেশ ফোলা, দেখেই বোঝা যাচ্ছিল যে ও কেঁদেছে, বিধ্বস্ত আর উদাসীন লাগছিল ওকে। মন খারাপ নিয়ে কাজ করল, প্রয়োজনের অতিরিক্ত কথাও বলল না। আমিও কিছু জিজ্ঞেস করে ওকে বিব্রত করলাম না। ভাবলাম- হয়ত ওর বরের সঙ্গে ঝগড়া হয়েছে, বর হয়ত মারধরও করেছে ওকে। পরের দু-দিন চোখ-মুখের ফোলা ভাব না থাকলেও ওর মন খারাপ, কথা কম বলার প্রবণতা, উদাসীনভাব রয়েই গেল। মন দিয়ে কাজও করতে পারছিল না। তরকারিতে লবণ কম-বেশি হচ্ছিল, ভাজি কাঁচাই থাকছিল। একদিন আমি ওকে ডেকে আমার উল্টোদিকের সোফায় বসতে বললাম। জিজ্ঞেস করলাম, ‘আছিয়া, ক’দিন ধরেই খেয়াল করছি তোর মন খারাপ। যদি তোর কোনো সমস্যা হয়ে থাকে, আর বিষয়টা যদি আমাকে খুলে বলার মতো হয়, তাহলে আমাকে বলতে পারিস।’

আছিয়া মাথা নিচু করে একটুক্ষণ চুপ করে রইলো, তারপর কেঁদে ফেলল। বললাম, ‘কাঁদিস না, কী হয়েছে খুলে বল। কাঁদলে তো সমস্যার সমাধান হবে না।’
রাকিব ড্রয়িংরুমে বসে ব্যাটারি চালিত গাড়ি নিয়ে খেলছিল, ওর সামনে এই ধরনের আলোচনা করা ঠিক হবে না বলে ওকে গাড়ি নিয়ে বারান্দায় গিয়ে খেলতে বললাম।

রাকিব বারান্দায় গেলে আঁচলে চোখের জল মুছে আছিয়া বলল, ‘রাকিবের আব্বারে পুলিশ ধইরা নিয়া গেছে।’
বললাম, ‘কেন কী করেছে রাকিবের আব্বা?’
‘রাস্তায় ট্যাকা তুলতে গিয়া এক ব্যাডারে মাইরধর করছিল, হেই ব্যাডায় রাকিবের আব্বাসহ সবাইরে পুলিশে ধরাইয়া দিছে।’
‘রাস্তায় টাকা তুলতে গিয়েছিল কেন?’
‘রাকিবের আব্বায় বিল্ডিংয়ের রঙের কাম করে না, হ্যায় যে কাম করে তা মাইনষেরে কইতে শরম লাগে, তাই আপনারেও মিছা কতা কইছিলাম।’

আমি রাকিবের বাবার পেশা জানার জন্য জিজ্ঞাসু চোখে আছিয়ার দিকে তাকিয়ে রইলাম। আছিয়া আমার দিক থেকে চোখ নামিয়ে নিয়ে বলল, ‘হ্যায়, আরও অনেকের লগে হিজড়া সাইজা রাস্তায় ট্যাকা তোলে।’
‘তোর বর কত দিন ধরে এসব করে?’
‘বিয়ার আগে থেইকাই করে। আমরা জানতাম না। বিয়ার সময় কইছিল যে ঢাকায় রঙের কাম করে। আমি জানবার পারছি বিয়ার পর হ্যার লগে ঢাকায় আইয়া। শরমে এই কতা বাড়ির কাউরে কইতেও পারি নাই। বাম-মায়ের মান-সুম্মানের কতা চিন্তা কইরা নিজেরে কোরবানি দিয়া হ্যার লগে রইয়া গেছি।’

আছিয়ার জন্য খারাপ লাগল। এমন শান্তশিষ্ট মিষ্টি একটা মেয়ে, অথচ এমনভাবে প্রতারণার শিকার হয়েছে।

আছিয়া আবার বলল, ‘কত কইছি যে এই কাম চাইড়া অন্য কাম করো। হ্যায় কতা শোনে না। আমারে বুঝায় যে এই কামে মেলা ট্যাকা পাওন যায়, অন্য কাম করলে হ্যায় এত ট্যাকা কামাইতে পারবো না।’
বললাম, ‘কোন থানার পুলিশ ধরেছে ওদেরকে?’
‘আদাবর থানা।’
‘তুই থানায় গেছিলি?’
‘হ গেছিলাম। পুলিশ ছাড়বো না, কোর্টে নাকি চালান দিবো।’
‘তাইলে তো আইনজীবী ধরতে হবে।’
‘হ্যাগো গুরুমা আছে, হ্যায় নাকি সব ব্যবস্থা করবো।’

‘তাহলে চিন্তা করিস না, ওর জামিন হয়ে যাবে। জামিনে বেরিয়ে এলে ওকে একদিন আমার কাছে নিয়ে আসিস, আমি ওকে বোঝাবো যাতে এই কাজ ছেড়ে অন্য কোনো সম্মানজনক কাজ করে। আর তোর বর না আসতে চাইলে আমাকেই তোর বাসায় নিয়ে যাস। যা এখন কাজ কর গিয়ে, মন খারাপ করে থাকিস না।’

আছিয়া নিজের কাজে ফিরে যাচ্ছিল। বললাম, ‘শোন, রাকিব যেন ওর আব্বার এইসব কথা জানতে না পারে। ওর সামনে তোরা এসব বিষয় নিয়ে আলোচনা করবি না।’
‘আইচ্চা।’ ঘাড় নাড়ল আছিয়া, তারপর রান্নঘরে চলে গেল।

এখন এটা একটা সামাজিক সংকটের জায়গা এবং দিন দিন এই সংকট আরও বাড়ছে। সড়কপথে, নৌপথে, রেলপথে, হাট-বাজারে, সব জায়গায় বৃহন্নলারা সঙ্ঘবদ্ধ হয়ে সাধারণ মানুষের কাছ থেকে টাকা তোলে, ওদের ভাষায় ছল্লা করে। টাকা দিতে না চাইলে মানুষের ওপর জোরজুলুম করে আদায়ের চেষ্টা করে। সাধারণ মানুষের সঙ্গে বৃহন্নলাদের কথা কাটাকাটি, হাতাহাতি, মারামারির ঘটনা ঘটে। যারা প্রকৃত বৃহন্নলা, তাদের সংকট হচ্ছে- তারা পরিবারে থাকতে পারে না। সমাজের মানুষ যেমনি উঠতে-বসতে তাদেরকে কটুক্তি করে, তেমনি পরিবারের মানুষের কাছেও তারা বৈষম্য-লাঞ্ছনার শিকার হয়। কোনো পরিবারে একজন বৃহন্নলা থাকলে সমাজের মানুষের কাছে সেই পরিবারের মানসম্মান থাকে না, এই অজুহাতে অনেক পরিবার বৃহন্নলাদের বাড়ি থেকে বের করে দেয়। কিন্তু একজন বৃহন্নলা পরিবার থেকে বের হয়ে থাকবে কোথায়? কী কাজ করবে? খাবে কী? ফলে তারা বৃহন্নলাদের সংগঠনে যোগ দেয় এবং বৃহন্নলা নেত্রীরা তাদেরকে রাস্তাঘাটে ছল্লা করতে নামিয়ে দেয়। অনেককে যৌনকর্মীর পেশাতেও নামায়। এলাকাভিত্তিক বৃহন্নলাদের একজন নেত্রী থাকে, সেই নেত্রীর ছত্রছায়ায় থাকে সাধারণ বৃহন্নলারা। সাধারণ বৃহন্নলারা রোজ ছল্লা করে বা যৌনসেবা দিয়ে যে পরিমাণ টাকা রোজগার করে, তার থেকে একটা ভাগ দিতে হয় নেত্রীকে। বিনিময়ে নেত্রী তাদের নিরাপত্তা দেয়, দেখভাল করে। ছল্লা বেশ লাভজনক হওয়ায় রাকিবের আব্বার মতো অনেক পুরুষ বৃহন্নলা সেজে অন্য বৃহন্নলাদের সঙ্গে মিশে ছল্লা করে বেড়ায়। বৃহন্নলা নেত্রীরাও এইসব পুরুষদের দলে ভেড়ায় বেশি রোজগারের লোভে। তদন্ত করলে হয়ত দেখা যাবে যে সারা দেশে যে সংখ্যক বৃহন্নলা ছল্লা করে বেড়ায়, তার বিরাট অংশই প্রকৃতপক্ষে বৃহন্নলা নয়, পুরুষ। পুরুষের বৃহন্নলা সেজে ছল্লা করা একটা অপরাধ। যারা প্রকৃত বৃহন্নলা, তাদের সংখ্যাটিও এদেশে কম নয়।

আমি যখন কুয়াকাটা ঘুরতে যাই, তখন সেখানে দুজন বৃহন্নলার সঙ্গে আমার আলাপ হয়। আমি বিকেলের দিকে হোটেল থেকে বেরিয়ে সমুদ্র সৈকতে যেতাম। জিরো পয়েন্ট থেকে সৈকত ধরে পূর্বদিকে হাঁটতে হাঁটতে অনেকটা পথ চলে যেতাম। তারপর ফিরে এসে বিশ্রামের জন্য সৈকতের যে-দিকটায় একটু ভিড় কম সেখানে একটা আরাম কেদারা ভাড়া করে বাতাসে শরীর এলিয়ে দিয়ে সমুদ্র দেখতাম। ক্ষুধা পেলে সৈকতের পাশের ফিস ফ্রাইয়ের দোকান গুলো থেকে নাস্তা আর রাতের খাবার খেয়ে আবার এসে বসতাম আরাম কেদারায়। রাত দুটো পর্যন্ত সৈকতের খোলা হাওয়া গায়ে মেখে তারপর হোটেলে ফিরতাম।

রাত তখন একটা বাজে, সাগরে ভাটা চলছে, সৈকতে ভিড় কমে গেছে। পিঠে চাঁদের আলো বয়ে ঢেউগুলো অবিরাম আছড়ে পড়ছে সৈকতে। হঠাৎ সৈকতের পশ্চিম দিক থেকে দুজন মানুষ আমার কেদারার সামনে দিয়ে পূর্বদিকে অল্প দূরে গিয়ে দাঁড়িয়ে পড়ল, নিচুস্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলল, তারপর আবার ফিরে এসে আমার কেদারার কাছে দাঁড়ালো। আমার সামনে দিয়ে যাবার সময় আমি তাদেরকে নারী ভেবেছিলাম, কিন্তু আমার কাছে এসে দাঁড়ানোর পর বুঝলাম তারা বৃহন্নলা। দুজনেই আমার দিকে লাস্যময়ী ভঙ্গীতে তাকালো। আমিও তাকালাম তাদের দিকে। দুজনের মুখেই গাঢ় মেকআপ, কপালে টিপ, হাতে কাঁচের চুড়ি। খোলা চুল উড়ছিল বাতাসে। একজন আমার আরাম কেদারার একেবারে কাছে এসে বলল, ‘বডি ম্যাসাজ করাবেন?’
আমি তাকালাম তার মুখের দিকে, বয়স হয়ত চব্বিশ-পঁচিশ হবে। বললাম, ‘কী নাম তোমার?’
‘লাইলী।’
অন্যজনের দিকে তাকালাম, তার বয়সও একই হবে। বললাম, ‘তোমার নাম?’
সে-ও আরেকটু কাছে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘ববিতা।’
লাইলী আবার বলল, ‘ভালো করে ম্যাসাজ করে দেব। বাসে জার্নি করে আসছেন, ম্যাসাজ করলে শরীরের ব্যথা সেরে যাবে।’
বললাম, ‘আমার শরীরে তো ব্যথা নেই।’
‘ব্যথা না থাক, আরাম পাইবা।’ ববিতা চোখ টিপে একেবারে তুমি করে বলল।
লাইলী বলল, ‘এইখানে ম্যাসাজ নিতে লজ্জা লাগলে হোটেলে নিয়ে চলেন।’
বললাম, ‘আমার ম্যাসাজ লাগবে না।’

ববিতা আমার পায়ের কাছে বসে হাঁটুর একটু উপরে হাতের চাপ দিতে দিতে বলল, ‘চলো না ডালিং, ম্যাসাজ নেওয়া ছাড়াও যা খুশি করতে পারবা। খরচ বেশি না, এক হাজার টাকা দিলেই হবে।’
বললাম, ‘এসব না করে তোমরা তো অন্য কোনো কাজ করে খেতে পারো।’
লাইলী বলল, ‘কে আমাদের কাজ দেবে? কেউ দেবে না। যে বাপ-মায়ে জন্ম দিছে, তারাই খ্যাদায় দিলো!’
‘আমি তোমাদের কাজ দিলে করবে?’
তারা দুজন একে অন্যের দিকে তাকালো। ববিতা বলল, ‘কী কাজ দিবা?’
‘আমার বাসার কাজ। বাজার করা, রান্না করা, কাপড় ধোয়া, বাসা পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখা, এইসব আর কী।’
ববিতা বলল, ‘তোমার বাসার লোকে হিজড়ারে কাজে নেবে?’
‘আমার বাসায় আমি একাই থাকি।’
‘ক্যান, পোলাপান নাই?’
‘ছেলে-মেয়েরা বিদেশে থাকে, স্ত্রী মারা গেছেন।’

ববিতা শব্দ করে হেঁসে উঠে বলল, ‘বুড়ায় তো দেখি রসের নাগর, চালাকও আছে, বাসায় নিয়ে মাঙনা লাগানোর ধান্দা করতেছে। ওইসব কাজকর্মের কথা বাদ দাও ডালিং। হোটেলে নিয়ে চলো, বিন্দাস যা খুশি কোরো।’

ববিতা আমার হাত ধরে উঠে দাঁড়াল, শরীরে অদ্ভুত যৌন আবেদন ফুটিয়ে তুলে, বামহাতে শাড়ির আঁচল উড়িয়ে গেয়ে উঠল, ‘এই রাত তোমার আমার
ঐ চাঁদ তোমার আমার
শুধু দুজনের.....’

ববিতার হাত থেকে আমার হাত ছাড়িয়ে নিলাম। মানিব্যাগ বের করে দুটো একশো টাকার নোট বের করে দুজনের হাতে দিয়ে বললাম, ‘চা খেয়ো। তোমরা এখন যাও মা। আমি একা একা সমুদ্র দেখবো।’

লাইলী বলল, ‘চল ববি, কাকারে আর ঝামেলা না করি।’
ওরা চলে যেতে যেতে পিছনের দিকে ফিরে তাকালো, তারপর সামনে তাকিয়ে ববিতা ব্যঙ্গাত্মক স্বরে বলল, ‘তোমরা এখন যাও মা, আমি একা একা সমুদ্র দেখবো। হি হি হি।’
দুজনেই শব্দ করে হেসে উঠল।

দেশের এই বিপুল সংখ্যক বৃহন্নলা জনগোষ্ঠীকে সমাজের বোঝা করে না রেখে সরকারের উচিত এদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করা। সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে তাদের যোগ্যতা অনুযায়ী কাজের ব্যবস্থা করতে হবে। চট্টগ্রাম সিটি কর্পোরেশন একটা ভালো কাজ করেছে, তারা বেশ কিছু বৃহন্নলাকে খণ্ডকালীন পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে। যদিও পরবর্তীতে কয়েকজন চাকরি ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। পরিচ্ছন্নতাকর্মী হিসেবে তারা মাসে যে বেতন পায়, ছল্লা করে তার চেয়ে তিন-চারগুণ বেশি রোজগার করে। এজন্যই এসব কাজে তারা থাকতে চায় না। কিন্তু তাদের নানাভাবে বোঝাতে হবে, যাতে তারা আর ছল্লার জীবনে ফিরে না যায়। তবে বৃহন্নলাদের কেউ কেউ স্বাধীনভাবে বাঁচার চেষ্টা করছে। কেউ নিজে বিউটি পার্লার গড়ে তুলেছে, কেউবা সেখানে চাকরি করছে। কেউ কেউ বিভিন্ন শো-রুমে বিক্রয়কর্মী হিসেবে কাজ করছে। কেউ অনলাইনে বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ব্যবসা করছে। বৃহন্নলাদের সমাজের মূল স্রোতে ফেরাতে এবং তাদেরকে জনশক্তিতে পরিণত করতে প্রয়োজনে সরকারি-বেসরকারি উদ্যোগে ‍শুধুমাত্র তাদের জন্য নানা ধরনের কারখানা তৈরি করতে হবে। তাদেরকে প্রশিক্ষণের মাধ্যমে দক্ষ করে সেইসব কারাখানায় নিয়োগ দিতে হবে। ছল্লা করা কোনো সম্মানজনক কাজ নয়, এটাও ভিক্ষাবৃত্তি। বৃহন্নলাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করে প্রয়োজনে আইন করে ছল্লা বন্ধ করতে হবে।

কিছুদিন পরই রাকিবের আব্বার জামিন হলো আর আছিয়া কাজে এসে জানাল, ‘কাকা, সামনের মাস থেইকা আমি আর কাজ করবার পারুম না, আমরা ঢাকা ছাইড়া যামুগা। আপনি একটা কাজের মানুষ দেইখা লন।’

আছিয়ার ওপর বাসার দায়িত্ব ছেড়ে দিয়ে বেশ নিশ্চিন্তে ছিলাম। ও চলে যাবে শুনে মন খারাপ হলো। বললাম, ‘ঢাকা ছেড়ে চলে যাবি কেন?’
‘রাকিবের আব্বার সুবুদ্ধি অইছে, হ্যায় আর হিজড়া সাইজা চাঁদাবাজি করবো না। গ্রামে যাইয়া মুদি দোকান দিবো।’

ওরা চলে যাবে শুনে মন খারাপ হলো, আবার ভালোও লাগলো এজন্য যে রাকিবের আব্বা একটা ভুল পথ ছেড়ে সম্মানজনক কাজের মাধ্যমে রোজগারের সিদ্ধান্ত নিয়েছে। চলে যাবার দিন বেতন ছাড়াও আছিয়াকে পাঁচ হাজার টাকা দিলাম রাকিবের আব্বার ব্যবসার কাজে লাগানোর জন্য। রাকিবের জন্যও ভীষণ মন খারাপ হলো।

আবার একা একা রান্নাবান্না, ঘরদোর পরিষ্কার করতে লাগলাম। কিন্তু এভাবে একা আর কতদিন? মানুষের সঙ্গ ছাড়া কী বাঁচা যায়! শরীর খারাপ হলেও দেখার কেউ নেই। একা একা হাসপাতালে যেতে কী যে অসহায় লাগে! কোনো একদিন মরে শরীরটা ঘরে পঁচে গেলেও কেউ জানতে পারবে না।

একটা বিষয় নিয়ে নিজের সঙ্গে নিজেই যুঝতে লাগলাম, বলা যায় নিজের সাথে নিজের যুদ্ধ। অবশেষে যুদ্ধ শেষ হলো। মনটাকে স্থির করে একদিন সকালে বাঁধনকে ফোন করে ওর সঙ্গে দেখা করার কথা জানালাম। ও আমাকে যেতে বলল।

বাঁধনের সঙ্গে আমার পরিচয় হয় তপতী মারা যাবার কিছুদিন পর। একদিন সন্ধ্যায় ধানমন্ডি লেকের পাড়ে একপাক হাঁটার পর বিশ্রাম নেবার জন্য বেঞ্চে বসলাম, কিছুক্ষণ পর তেতাল্লিশ-চুয়াল্লিশ বছরের এক ছেলে হেঁটে ক্লান্ত হয়ে বেঞ্চের কাছে এসে আমার উদ্দেশে বলল, ‘আঙ্কেল একটু বসি?’
আমি একপাশেই বসে ছিলাম, অবশিষ্ট বেঞ্চ ফাঁকাই পড়ে ছিল, তবু ভদ্রতাবশতই অনুমতি চাইলো সে। বললাম, ‘নিশ্চয়, বসুন বসুন।’

ছেলেটি আমার মুখ চেনা, আগেও কয়েকবার দেখেছি সন্ধ্যাবেলায় হাঁটতে। আমি-ই আগ বাড়িয়ে আলাপ শুরু করলাম। আজকাল আমার এই এক অভ্যাস হয়েছে, পার্কে কিংবা চায়ের দোকানে অপরিচিত কারো সঙ্গে আগ বাড়িয়ে আমি-ই আলাপ শুরু করে দিই। একা থাকার কারণে কথা বলার জন্য ভেতরটা আঁকুপাকু করে বলেই হয়ত এই অভ্যস হয়েছে। অথচ আগে আমি অপরিচিত মানুষের সঙ্গে সহজে মিশতে পারতাম না।

ছেলেটির নাম বাঁধন। আমাকে তুমি সম্বোধন করে কথা বলার অনুরোধ করল। বাবা-মা কেউ নেই, বিয়েও করেনি। আগে একটা এনজিও তে চাকরি করত, পরে নিজেই এনজিও খুলেছে। সেই এনজিও একটা বৃদ্ধাশ্রম চালায় গাজীপুরে। পৈত্রিক কিছু জমিজমা পেয়েছিল, সে-সব বিক্রি করে বৃদ্ধাশ্রম গড়তে ব্যয় করেছে। প্রবীণদের সেবা করেই বাকি জীবন কাটানোর ব্রত নিয়েছে সে। শুনে আমি অবাক হয়ে ওর মুখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম, আজকালকার দিনেও এমন ছেলে হয়! আমার বুক চিরে একটা দীর্ঘশ্বাস বেড়িয়ে এলো!

অনেকক্ষণ আলাপ হলো আমাদের মধ্যে। বাঁধন ওর মোহাম্মদপুরের অফিসে চায়ের নিমন্ত্রণ জানাল আমাকে। আমি ওর অফিসের ঠিকানা, ফোন নম্বর নিয়ে নিলাম। একদিন যাব বলে ওকে কথাও দিলাম। কিন্তু আর যাওয়া হয়নি, তবে সন্ধ্যাবেলা লেকের পাড়ে হাঁটতে গিয়ে দেখা হয়েছে অনেকবার।

পরদিনই গেলাম আমি ওর সঙ্গে দেখা করতে। আমাকে দেখে খুব খুশি হলো, অফিস সহকারিকে নাস্তা আর চা দিতে বলল। কুশল বিনিময়ের পর চায়ে চুমুক দিতে দিতে বললাম, ‘বাবা, আমি তোমার অতিথি হতে চাই। তোমার বৃদ্ধাশ্রমে এই নিঃসঙ্গ বৃদ্ধের জন্য কি একটু জায়গা হবে?’
বাঁধন খানিকটা বিস্ময় প্রকাশ করে বলল, ‘বলেন কী আঙ্কেল! আপনি…!’

ওর অবাক হওয়া দেখে আমি মৃদু হেসে বললাম, ‘আমি তেমন কোনো সম্ভ্রান্ত বা ধনী নই। নিতান্তই গ্রামেরই ছেলে, আর তোমাকে তো বলেছি-ই যে আমি কলেজে শিক্ষকতা করতাম। সেই সুবাদেই এই শহরে থাকা এবং ছোট্ট একটু মাথা গোঁজার ঠাঁই করা। স্ত্রী পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছেন। ছেলে-মেয়েরা সব বিদেশে থাকে। একা একা বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়েছে আমার জন্য। তোমার বৃদ্ধাশ্রমে গেলে কথা বলার মানুষ তো অন্তত পাব। তোমার ওপর আমি চাপ দিচ্ছি না, যদি তোমার পক্ষে সম্ভব হয় তবেই আমাকে নাও।’
বাঁধন বলল, ‘আমাকে লজ্জা দেবেন না আংকেল। আপনি কবে যেতে চান বলুন, আমি আপনাকে নিয়ে যাবো।’
বললাম, ‘আমি যে-কোনো দিন যাবার জন্য প্রস্তুত। আর একটা কথা, আমার একটা পোষা বিড়াল আছে, বিড়ালটিকে সঙ্গে নিলে অসুবিধা হবে?’
‘না, না কোনো অসুবিধা হবে না। আপনি নিয়ে নিবেন বিড়ালটিকে।’

বাঁধন এক টুকরো কাগজ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলল, ‘এখানে আপনার বাসার ঠিকানাটা লিখে দিন। আমি আগামী শুক্রবার বৃদ্ধাশ্রমে যাবার আগে আপনাকে বাসা থেকে তুলে নেব।’

আমার ঠিকানা কাগজে লিখে দিয়ে ওর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে বাসায় ফিরে এলাম। কেবলই মনে হতে লাগল যে বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে আমার ভালো লাগবে তো? সবার সঙ্গে মানিয়ে নিতে পারব তো? নিজের ভেতর থেকেই উত্তর এলো- যদি ভালো না লাগে, কিংবা মানিয়ে নিতে না পারি তাহলে ফিরে আসব বাসায়। কিন্তু চেষ্টা তো করা যাক, জীবনে একটা নতুন অভিজ্ঞতা অন্তত হোক।

পরের শুক্রবার সকালেই বাঁধন এলো বাসায়। সব জিনিসপত্র আগেই গুছিয়ে রেখেছিলাম দুটো ব্যাগে। বাঁধনকে বললাম, ‘আমার বারান্দার টবের গাছগুলো নিয়ে যেতে চাই, ওদেরকে আমি কথা দিয়েছি যে একদিন ওদেরকে মাটিতে রোপন করব।’

বাঁধন বলল, ‘অবশ্যই, কোথায় আমাকে দেখিয়ে দিন।’

দুজনে গাছগুলো আর ব্যাগ দুটো লিফটে নামিয়ে নিয়ে বাঁধনের গাড়িতে তুললাম। তারপর জুঁইকে নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। গ্যারেজ থেকে গাড়ি রাস্তায় নামলে জানালা দিয়ে শেষবারের মতো তাকালাম বারান্দায়। তারে কোনো কাপড় ঝুলে নেই, গাছগুলো নেই, দেখে মনে হলো যেন কতকাল ধরে শূন্য পড়ে আছে পোড়ো বাড়ির মতো। বুকের ভেতরটায় মোচড় দিয়ে উঠল। শুক্রবার সকালের ফাঁকা রাস্তায় গাড়ি এগিয়ে চলল বাঁধনের বৃদ্ধাশ্রমের উদ্দেশে।



(চলবে......)
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:২৯
৩টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আদর্শের রাজনীতি না কোটি টাকার হাতছানি...

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:২৫



১. আমি অনেক আগে ব্লগে লিখেছিলাম, বাংলাদেশে ছোট দলগুলো নিষিদ্ধ করা উচিত। উন্নত দেশের মত ২/৩ টিতে থাকাই উত্তম। কারণ, ছোট দলের নেতাদের টকশো-তে গলাবাজি করা ছাড়া আর কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে উড়ে গেল মাদ্রাসার দেয়াল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৯



ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছেন।

বিস্ফোরণে মাদ্রাসার একতলা ভবনের পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষের দেয়াল উড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তেল আর জল কখনো এক হয় না......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩৫



জুলাই ছিলো সাধারণ মানুষের আন্দোলন, কোন লিডার আমারে ডাইকা ২৪'এর আন্দোলনে নেয় নাই। কোন নেতার ডাকে আমি রাস্তায় যাই নাই। অথচ আন্দোলনের পর শুনি আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড নাকি মাহফুজ। জুলাই বিপ্লবের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্ল্যাং রেভলিউশন: ১৮+ সতর্কবার্তা ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:৩০


সোশ্যাল মিডিয়ায় আজকে একটা ভাইরাল ভিডিও চোখে পড়লো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সদস্য সালাউদ্দিন আম্মার গণজাগরণ মঞ্চ ৩.০ তে উপস্থিত হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন: দেখতে পাইলে বাকশাল, শা*উয়া মা*উয়া ছিড়া ফেল/... ...বাকিটুকু পড়ুন

কবিতাঃ হে বলবান

লিখেছেন ইসিয়াক, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৪০

কে আছিস বলবান!
হ্ আগুয়ান।
দে সাড়া দে ত্বরা।
ধরতে হবে হাল,বাইতে হবে তরী, অবস্থা বেসামাল।

জ্বলছে দেখ প্রাণের স্বদেশ
বিপর্যস্ত আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
মানবিকতা, মূল্যবোধ, কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির বাতিঘর।
সর্বত্র আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×