somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গোধূলিবাড়ি (উপন্যাস: পর্ব- তেরো)

১৮ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এগারো

বৃদ্ধাশ্রমের নাম- গোধূলিবাড়ি। নামটি বেশ মনে ধরলো আমার। গোধূলিবাড়ি’র পরিসর বেশ বিস্তৃত। দক্ষিণ ও পূর্বমুখী এল আকৃতির বিশাল ঘর, মেঝে ও দেয়াল পাকা, আকাশী রঙের টিনের ছাউনি। সদস্যদের থাকবার জন্য আঠারোটি কক্ষ, একটি অফিস রুম এবং একটি হলরুম রয়েছে। দক্ষিণমুখী কক্ষগুলো নারীদের আর পূর্বমুখী কক্ষগুলো পুরুষদের জন্য। পুরুষদের নয়টি কক্ষের মধ্যে সাতটিতে আগে থেকেই আছেন চৌদ্দজন, আর নারীদের নয়টি কক্ষের মধ্যে ছয়টিতে আছেন বারোজন। বাকি কক্ষগুলো খালি। হলরুমে একটি টেলিভিশন আর দুটি বুকশেলফ আছে। ইচ্ছে হলে কেউ টেলিভিশন দ্যাখে, কেউ সংবাদপত্র পড়ে, কেউ এখানে বসেই বই পড়ে কিংবা বই নিয়ে নিজের ঘরে গিয়ে পড়ে। ঘরের পিছনেই আলাদা রান্নাঘর, রান্নাঘরের একপাশে রান্না হয়, আরেকপাশে পাশ ডাইনিং রুম। থাকার ঘরের মাঝখান দিয়ে সরু একটি গলি আছে পিছনের রান্নাঘরে যাবার জন্য। রান্নাঘরের দু-পাশ দিয়ে এবং পিছনের অনেকটা জায়গাজুড়ে শাক-সবজির বাগান। পালংশাক, লাল শাক, মটরশুটি, ফুলকপি, বাঁধাকপি, ঢেঁড়শ, টমেটোসহ নানা প্রকার শাক-শবজির চাষ করেন বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দারাই।

থাকার ঘরের সামনের দিকে একেবারে ঘর-লাগোয়া সারিবদ্ধভাবে লাগানো কয়েকটি কৃষ্ণচূড়া, দুটি পলাশ, একটি কদম ও কিছু ফলের গাছ। তারপরেই মাঝারি আকৃতির একটি খেলার মাঠ। খেলার মাঠের দক্ষিণে ছোট্ট একটি পুকুর। পুকুরের চারিদিকের পাড়ে নানারকম ফলজ ও বনজ গাছ লাগানো, গাছগুলো সবে বেড়ে উঠছে। পুকুরে মাছ চাষ করা হয়, বৃদ্ধাশ্রমের বাসিন্দাদের মাছের যা চাহিদা, তার কিছুটা এই পুকুর থেকে পাওয়া যায়।

আমি খালি পড়ে থাকা পুরুষদের জন্য বরাদ্দ আট নম্বর কক্ষটিতে উঠলাম। কক্ষগুলো বেশ বড়। প্রত্যেক কক্ষে দুটি করে খাট পাতা, দুজন করে সদস্য থাকেন। সদ্যদের দেখাশোনা এবং রান্না করার জন্য আছে চারজন কর্মী, দুইজন নারী ও দুজন পুরুষ। ব্যবস্থা খুবই ভালো। আমার খুব পছন্দ হলো।

আসবার সময় আমার ভেতরটা হাহাকার করছিল। বুঝতেই পারছেন কেন এই হাহাকার। আশঙ্কা ছিল, বৃদ্ধাশ্রমে আমি মানিয়ে নিতে পারবো তো? কিন্তু বাঁধন যখন সবার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলো, সবার আন্তরিক ব্যবহার দেখে আমার আশঙ্কা কিছুটা দূর হলো।

দেখা গেল বয়সের দিক থেকে গোধূলিবাড়ি’তে আমার চেয়ে বড় আছেন মাত্র দুজন। একজন ভদ্রমহিলা, সবাই তাকে বেনুদি বলে ডাকেন। পঁচাত্তর বছর বয়সী বেনুদি বিধবা। ফর্সা গায়ের রঙ, লম্বা। মাথার কাঁচা-পাকা লম্বা চুল বেশিরভাগ সময় ঢিলে খোঁপা বেঁধে রাখেন। তার চেহারা এবং চালচলনে সুস্পষ্ট আভিজাত্যের ছাপ পাওয়া যায়। বনেদি ঘরের মেয়ে ছিলেন তিনি, তবে ভালোবেসে বিয়ে করেছিলেন নিন্ম মধ্যবিত্ত পরিবারের ছেলেকে। স্বামী-স্ত্রী দুজনই মাধ্যমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক ছিলেন। অমায়িক ব্যবহার বেনুদির, একেবারেই নিরহংকারী, অথচ কী ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। আমাদের দেশে অনেকে মনে করেন রাগী এবং দাম্ভিক আচরণই ব্যক্তিত্বের লক্ষণ। কিন্তু ব্যাপারটা আসলে তা নয়, রাগ বা দম্ভের সঙ্গে ব্যক্তিত্বের কোনো সম্পর্ক নেই। এই ধারনা যে ভুল তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ- বেনুদি। বয়স হলেও বেনুদির গানের গলা এখনো দারুণ! রোজ সকালে হারমনিয়াম বাজিয়ে রেওয়াজ করেন। এখানকার সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের নেতৃত্ব দেন তিনি। প্রতি শুক্রবার সন্ধ্যায় হলরুমে গানের আসর বসে।

আরেকজন আমার চেয়ে বড়। তিনি হলেন হারুন ভাই, বয়স চুয়াত্তর কি পঁচাত্তর হবে। হারুন ভাইকে সবাই ক্যাপ্টেন বলে ডাকেন। আমি ভেবেছিলাম সত্যি সত্যিই বুঝি তিনি জাহাজ কিংবা বিমানের ক্যাপ্টেন ছিলেন। চেহারা-স্বাস্থ্য তেমনই পোক্ত, লম্বা আর মেদহীন। পরে জানলাম তিনি ট্রেন চালাতেন। এখানে বৃদ্ধদের শরীরচর্চা এবং খেলাধুলায় নেতৃত্ব দেন তিনি, এজন্যই সবাই তাকে ক্যাপ্টেন বলে ডাকেন। হারুন ভাই একদিন দুঃখ করে বললেন, ‘সারাটা জীবন এই দুই হাতে ট্রেন চালিয়েছি। কোটি কোটি মানুষকে পৌঁছে দিয়েছি তাদের গন্তব্যে। কিন্তু কবে যে নিজের জীবনের ট্রেনটা বে-লাইনে চলে গেছে খেয়াল করি নাই। যখন খেয়াল করলাম, তখন জায়গা হলো এই গোধূলিবাড়ি’তে।’

গোধূলিবাড়ি’র সকালবেলার নীরবতা ভাঙে বেনুদির গানের সুরে। খেয়াল কিংবা ঠুমরি দিয়ে শুরু করেন, তারপর পঞ্চকবির গানে গানে রোদ্দুর ওঠে। আমরা বেশিরভাগ পুরুষ আর কয়েকজন নারী তখন ক্যাপ্টেনের নেতৃত্বে শরীরচর্চা করি। শরীরচর্চা শেষ হলে স্নান করে নাস্তা সেরে খবরের কাগজ পড়ার পর কেউ টিভি দ্যাখে, কেউ বই পড়ে, কেউ গল্পগুজব করে সময় কাটায়।

আমি যেদিন গোধূলিবাড়ি’তে উঠলাম তার কিছুদিন পরই এক বিকেলে ক্যাপ্টেন আমার ঘরে এসে হাজির। আমি তখন বিছানায় শুয়ে মিহির সেনগুপ্ত’র অসাধারণ একটি উপন্যাস ‘সিদ্ধিগঞ্জের মোকাম’ পড়ছিলাম। বই থেকে মুখ তুলে দেখি ক্যাপ্টেনের হাতে ফুটবল, পরনে কালো হাফপ্যান্ট, গায়ে সাদা টি-শার্ট।

ক্যাপ্টেন বললেন, ‘দাদা, রেডি হয়ে নিন।’
আমি অবাক হয়ে ক্যাপ্টেনের হাতের ফুটবলের দিকে তাকিয়ে রইলাম। ক্যাপ্টেন সেটা লক্ষ্য করেই বললেন, ‘ফুটবল খেলতে হবে। উঠুন।’
আমাকে একটু দ্বিধাগ্রস্ত দেখে ক্যাপ্টেন আবার বললেন, ‘কী, ভয় করছে?’
আমি হেসে বললাম, ‘না, ভয় ঠিক নয়। তবে ভাবছি, বুড়ো হাড়ে সইবে কিনা!’
‘আরে আপনি তো এখনও যথেষ্ট ফিট আছেন। চলুন, সামনে আমাদের ম্যাচ আছে। জিততে হবে তো।’
‘ম্যাচ! কাদের সঙ্গে?’

‘দুই কিলোমিটার দূরে একটা স্কুলের মাঠে সকালবেলা আমাদের মতো বয়স্করা শরীরচর্চা করেন, দলটির নাম প্রভাতী শরীরচর্চা কেন্দ্র, তাদের সঙ্গে। আমাদের মাঠে খেলতে আসবে। চলুন, চলুন, আপনার শরীর খুব ফিট, আপনাকে আমাদের দরকার।’

অনেক বছর ধরে ফুটবলের প্রতি ভালোবাসা কেবল টিভিতে খেলা দেখার মধ্যেই সীমাবদ্ধ। ছাত্রাবস্থায় যথেষ্ট ফুটবল খেলেছি, খ্যাতিও ছিল বেশ। কিন্তু সে অনেককাল আগের কথা। কর্মযজ্ঞে ঢুকে স্বেচ্ছা অবসর নিতে হয়েছে ফুটবল থেকে। তাই ক্যাপ্টেন একটু উস্কানি দিতেই আমার শরীর থেকে হারিয়ে যাওয়া যৌবন যেন হঠাৎ মনের মধ্যে জেগে উঠে আমাকে বিছানা থেকে টেনে তুলে ধাক্কাতে ধাক্কাতে নিয়ে গেল মাঠে!

গোধূলিবাড়ি’র সামনের ছোট্ট মাঠেই হবে খেলা। আমি মাঠে পৌঁছে দেখি প্রায় সবাই চলে এসেছে, বল নিয়ে গা গরম করছে। গোধূলিবাড়ি’র পনেরজনের মধ্যে আমরা দশজন খেলবো, বাকি পাঁচজনের ফিটনেস খেলার পর্যায়ে নেই। আমরা দশজন ছাড়াও স্থানীয় কয়েকজন ভদ্রলোক খেলবেন আমাদের সঙ্গে, আমাদেরই কাছাকাছি বয়সী, সকালবেলা আমাদের সঙ্গেই শরীরচর্চা করেন। দু-দলে ভাগ হয়ে আমরা প্র্যাকটিস শুরু করলাম। প্র্যাকটিসের শুরুতে আমার বেশ হাসি পাচ্ছিল। খেলোয়াড়দের গড় বয়স পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি তো হবেই। আমি একটু লজ্জাও পাচ্ছিলাম। গোধূলিবাড়ি’র বারান্দা আর পুকুরঘাটে বসে এখানকার ভদ্রমহিলারাও যে বুড়োদের কাণ্ডকারখানা দেখছেন!

এত বছর বাদে এই বুড়ো বয়সে এসে আবার ফুটবলে পা ছোঁয়ালাম। শুরুতে কিছুটা আড়ষ্ট থাকলেও অল্পক্ষণের মধ্যেই ভয়-লজ্জা কাটিয়ে আমি যেন ফিরে গেলাম সেই হারানো দিনে! সকালের শরীরচর্চার কারণে শরীর মোটামুটি ফ্ল্যাক্সিবল থাকলেও প্রথম কয়েকদিন দমে কিছুটা সমস্যা হচ্ছিল, কিন্তু কয়েকদিন প্র্যাকটিসের পর আর তেমন কষ্ট হচ্ছিল না। যদিও আমাদের মাঠ স্বাভাবিক মাঠের আয়তনের চেয়ে অনেক ছোট।

প্রতিদিন সকালে চলত শরীরচর্চা আর বিকেলে ফুটবল প্র্যাকটিস। ক্যাপ্টেনের পরিকল্পনায় আমরা প্র্যাকটিস করতাম। প্র্যাকটিসের পর চলত মিটিং, নিজেদের দূর্বল দিকগুলো নিয়ে আলোচনা হতো, কিভাবে দূর্বলতাগুলো দূর করা যায় সে সম্পর্কে একেকজন মতামত দিতাম আমরা। প্রত্যেকেরই সে কী উত্তেজনা, যেন আমরা সবাই ষাট-সত্তরোর্ধ্ব বৃদ্ধ নই, একদল যুবক!

অবশেষে এলো ম্যাচের দিন। আগের দিনই বাঁধন চলে এলো গোধূলিবাড়ি’তে। অফিসরুমে একটা সিঙ্গেল খাট আছে রাতে ওর ঘুমানোর জন্য। খেলার দিন সকাল থেকেই গোধূলিবাড়িতে সাজ সাজ রব। স্থানীয় যুবকেরা খেলার আয়োজনের যাবতীয় দায়িত্ব কাঁধে তুলে নিয়েছিল। বেলা উঠতে না উঠতেই মাইক বাজতে শুরু করল। মাঠে চুনের দাগ দেওয়া হলো, রঙিন কাগজের পতাকায় সাজানো হলো মাঠ। একটু পর পর মাইকে ঘোষণা করা হলো খেলার কথা।

দুপুর গড়াতেই দেখি খেলা দেখার জন্য আশ-পাশের ছেলে-ছোকরা থেকে শুরু করে বৃদ্ধরা পর্যন্ত আসতে শুরু করেছে। আমার ভেতরে তখন চরম উত্তেজনা। দেখলাম, আমার মতো সব খেলোয়াড়দের একই অবস্থা। ক্যাপ্টেন যেন টগবগে তরুণ বনে গেছেন! ক্যাপ্টেন আমাদের দলেরও ক্যাপ্টেন। দুপুরের পর পরই প্রভাতী শরীরচর্চা কেন্দ্রের খেলোয়াড়রা চলে এলেন কেউ সাইকেল চালিয়ে, কেউবা ভ্যানে চড়ে। আর তাদের সঙ্গে এলো নানা বয়সের সমর্থকগোষ্ঠী।

বিকাল চারটায় রেফারির বাঁশি বাজলো, শুরু হলো খেলা। আমাদের বয়সের কারণে আগে থেকেই নব্বই মিনিটের বদলে সময় নির্ধারণ করা হয়েছিল পঞ্চাশ মিনিট। বল একবার প্রভাতী শরীরচর্চা কেন্দ্রের ডি-বক্সের কাছে যায় তো আরেকবার আমাদের ডি-বক্সের কাছে আসে। মাইকে চলতে লাগলো ধারাভাষ্য। দু-দলের সমর্থক ছেলে-ছোকরাদের সে কী উৎসাহ!
‘মারুন কাকা!’
‘দাদু জোরসে!’
‘মামা ডানে পাস দ্যান।’
‘গোল...ওহ্ হো হলো না! ওকে দাদু আবার হবে, চালিয়ে যান, চালিয়ে যান।’

মাঠের বাইরে থেকে দু-দলের খেলোয়াড়দের উদ্দেশে অবিরাম ভেসে আসতে লাগলো এসব উৎসাহব্যঞ্জক কথা। আমাদের মাঠ হওয়ায় সরমর্থকের সংখ্যা আমাদেরই বেশি। আমি আর ক্যাপ্টেন হারুন ভাই আমাদের দলের স্ট্রাইকার। মাঝমাঠ থেকে বল আমাদের পায়ে এলে আমরা বল নিয়ে প্রভাতী শরীরচর্চা কেন্দ্রের ডি-বক্সের দিকে এগিয়ে গেলেই মাঠের চারপাশ থেকে সমর্থকরা জোরালো চিৎকার করতে লাগলো। ক’দিন আগে বৃষ্টি হওয়ায় মাঠের কয়েকটা জায়গায় জল জমেছিল। দু-দলের খেলোয়াড়রাই জল-কাদায় মেখে একেবারে ভূত হয়ে গেলাম!

গোলশূন্য অবস্থায় হাফ টাইমের বাঁশি বাঁজলো। বিরতিতে লেবুর শরবত খেয়ে একটু তরতাজা হয়ে নিলাম দু-দলের খেলোয়াড়রাই। বিরতির পর আবার শুরু হলো খেলা। বেশ কয়েকবার ডি-বক্সের কাছে গিয়েও প্রতিপক্ষের ডিফেন্সের বাধায় ব্যর্থ হলাম আমরা। এরপর মাঝমাঠ থেকে আচমকা লম্বা শর্টে আমার পায়ে বল দিলেন আমাদের মিডফিল্ডার বীরেন রোজারিও। আমি দুজনকে কাটিয়ে বল বাড়িয়ে দিলাম সামনে থাকা ক্যাপ্টেনের দিকে, ক্যাপ্টেন ডিফেন্ডারকে পরাস্ত করে একটু সামনে এগিয়েই বাঁ পায়ে নিলো শর্ট। গোল! মাঠের বাইরে সমর্থকদের তুমুল শোরগোল উঠলো! আমরা যেন হিতাহিত জ্ঞানশূন্য হয়ে গেলাম! খেলোয়াড়রা একে অন্যকে জড়িয়ে ধরে আনন্দ করতে লাগলাম। মাঠের বাইরে থেকে আমাদেরই বয়সী কেউ কেউ এসে আমাদের জড়িয়ে ধরলেন। গোল উদযাপন শেষে আবার শুরু হলো খেলা। খেলার যখন আর দুই মিনিট বাকি, তখন আমাদেরকে হতাশায় ডুবিয়ে প্রতিপক্ষ একটা প্যানাল্টি পেয়ে গেল বল আমাদের সেন্টার ব্যাক সিরাজুল ইসলামের হাতে লাগায়। প্যানাল্টি শর্ট নিলেন প্রতিপক্ষের স্ট্রাইকার, আমরা প্রস্তুত ছিলাম যদি আমাদের গোলরক্ষক বিনয় গোস্বামী কোনোভাবে প্যানাল্টি ঠেকিয়ে দিতে পারেন, আমরা যে করেই হোক বল ডি-বক্সের বাইরে পাঠিয়ে দেব। কিন্তু আমাদেরকে আরও হতাশায় ডুবিয়ে বিনয় গোস্বামীকে ফাঁকি দিয়ে বল জাল খুঁজে নিলো। আবার খেলা শুরু হতে না হতেই রেফারির শেষ বাঁশি বাজলো। ফলাফল ড্র।

আমাদের বয়সের কথা ভেবে অতিরিক্ত সময় বাড়ানো হয়নি। একবারে টাইব্রেকার। টাইব্রেকার তো নয়, যেন বুড়োদের হার্টের চরম পরীক্ষা! ঠিক হলো আমাদের প্রথম শর্টটি নেবেন ক্যাপ্টেন আর শেষ শর্টটি আমি। মাঝখানে বীরেন রোজারিও, ইসমাইল হোসেন আর মান্নান সাহেব। প্রতিপক্ষের প্রথম শর্টটি গোল হলো, আমাদের ক্যাপ্টেনও গোল দিলেন। একটা একটা করে শর্ট শেষ হয় আর আমাদের উত্তেজনা যেন আরো বাড়তে থাকে। এর মধ্যে বিনয় গোস্বামী ওদের একটা শর্ট ঠেকিয়ে দিলেন আর আমরা এক গোলে এগিয়ে গেলাম। তবে আমাদের মান্নান সাহেবের শর্টটি গোলবারের উপর দিয়ে গেল। চারটে করে শর্ট শেষে ফলাফল ১-১। ওদের পঞ্চম শর্টটিও বিনয় গোস্বামী ঠেকিয়ে দিলেন। আমাদের দলের হয়ে সর্বশেষ শর্ট নিতে এগোলাম আমি। আমি গোল করতে পারলেই আমরা জিতে যাব। আর না পারলে ড্র হবে। আবার একটা করে শর্ট নিতে হবে। কিন্তু আমার তখন পা কাঁপছে! কলেজ জীবনের কথা মনে পড়ে গেল আমার। কলেজেও আমি একবার এই রকম পরীক্ষার মুখোমুখি হয়েছিলাম। টাইব্রেকারে সর্বশেষ শর্টটি আমি নিয়েছিলাম এবং গোল করে দলকে জিতিয়েছিলাম। আমি ক্ষণিকের জন্য সেই স্মৃতিতে ডুব দিলাম। আমার শরীর-মনে যেন জোর ফিরে এলো। পায়ের কম্পন বন্ধ হলো। যেন সত্তর বছরের বৃদ্ধ নয়, শর্ট নিতে যাচ্ছি অনেক বছর আগের সেই আঠারো বছরের যুবক! আমি শর্ট নেবার জন্য প্রস্তুত, রেফারির বাঁশি বাজার অপেক্ষায়। রেফারির বাঁশি বাজলো, শর্ট নিয়ে আমি হতবিহ্বল হয়ে দাঁড়িয়েই রইলাম। গোল! ক্যাপ্টেন হারুন ভাই এসে আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। সাথে অন্য সহখেলোয়াড়রাও। আমাদের সমর্থকেরা উল্লাস করতে লাগলো।

আনন্দে আমার চোখ ভিজে উঠল। সে যে কী অনুভূতি বলে বোঝাতে পারব না! স্মৃতিকাতর হয়ে পড়লাম আমি। হাজারো স্মৃতি আমার ভেতরে ভিড় করতে লাগলো। সেই স্কুল-কলেজের দিনগুলো আবার যেন ফিরে পেলাম আমি, যা এতদিন অনেক স্মৃতির নিচে চাপা পড়ে ছিল!

এ তো শুনলেন একটা ফুটবল ম্যাচের কথা। আমাদের গোধূলিবাড়ি’তে বারোমাস-ই খেলাধুলা-সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান লেগেই থাকে। বাঁধনই এসবের আয়োজন করে। কেন করে তা আমরা বুঝতে পারি। যাতে পরিবার ছেড়ে আসা এই মানুষগুলো পরিবারের কথা ভুলে, কষ্ট ভুলে, হাসি-আনন্দে থাকতে পারে তার জন্যই এই আয়োজন।



(চলবে........)
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই আগস্ট, ২০২৩ দুপুর ১:১৬
৪টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আদর্শের রাজনীতি না কোটি টাকার হাতছানি...

লিখেছেন বিচার মানি তালগাছ আমার, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ বিকাল ৪:২৫



১. আমি অনেক আগে ব্লগে লিখেছিলাম, বাংলাদেশে ছোট দলগুলো নিষিদ্ধ করা উচিত। উন্নত দেশের মত ২/৩ টিতে থাকাই উত্তম। কারণ, ছোট দলের নেতাদের টকশো-তে গলাবাজি করা ছাড়া আর কোন... ...বাকিটুকু পড়ুন

শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণে উড়ে গেল মাদ্রাসার দেয়াল, বোমা তৈরির সরঞ্জাম উদ্ধার

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সন্ধ্যা ৭:১৯



ঢাকার দক্ষিণ কেরানীগঞ্জের হাসনাবাদ এলাকায় একটি মাদ্রাসায় ভয়াবহ বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেছে। এতে নারী, শিশুসহ চারজন আহত হয়েছেন।

বিস্ফোরণে মাদ্রাসার একতলা ভবনের পশ্চিম পাশের দুটি কক্ষের দেয়াল উড়ে গেছে। ঘটনাস্থলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

তেল আর জল কখনো এক হয় না......

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:৩৫



জুলাই ছিলো সাধারণ মানুষের আন্দোলন, কোন লিডার আমারে ডাইকা ২৪'এর আন্দোলনে নেয় নাই। কোন নেতার ডাকে আমি রাস্তায় যাই নাই। অথচ আন্দোলনের পর শুনি আন্দোলনের মাস্টারমাইন্ড নাকি মাহফুজ। জুলাই বিপ্লবের... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্ল্যাং রেভলিউশন: ১৮+ সতর্কবার্তা ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ২৭ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১০:৩০


সোশ্যাল মিডিয়ায় আজকে একটা ভাইরাল ভিডিও চোখে পড়লো। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের সদস্য সালাউদ্দিন আম্মার গণজাগরণ মঞ্চ ৩.০ তে উপস্থিত হয়ে স্লোগান দিচ্ছেন: দেখতে পাইলে বাকশাল, শা*উয়া মা*উয়া ছিড়া ফেল/... ...বাকিটুকু পড়ুন

কবিতাঃ হে বলবান

লিখেছেন ইসিয়াক, ২৮ শে ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১১:৪০

কে আছিস বলবান!
হ্ আগুয়ান।
দে সাড়া দে ত্বরা।
ধরতে হবে হাল,বাইতে হবে তরী, অবস্থা বেসামাল।

জ্বলছে দেখ প্রাণের স্বদেশ
বিপর্যস্ত আমার প্রিয় বাংলাদেশ।
মানবিকতা, মূল্যবোধ, কৃষ্টি, সভ্যতা, সংস্কৃতির বাতিঘর।
সর্বত্র আজ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×