রাত বাড়লে তরু চুপ করে ব্যালকনিতে এসে দাঁড়ায়। নিচে রাস্তায় টুং টুং শব্দে রিকশা চলে, গাড়িগুলো উজ্জ্বল হেডলাইটের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে দেয় পথচারীদের। দু'একজন দ্রুত পায়ে হেঁটে চলে যায়- তরু তাকিয়ে তাকিয়ে দেখে। নিজেকে তার হঠাৎ হঠাৎ পথের মত মনে হয়। পথ- যার উপর দিয়ে লাখো মানুষ পার হয়ে যায় প্রতিদিন। অথচ কেউ তাতে দাঁড়াতে চায় না। পথের বুকে সবার স্থান, কারো বুকে পথের স্থান নেই.........
...........................................................
জানালায় দাঁড়িয়ে তরু চাঁদ দেখে। শহরের মানুষ শুক্লপক্ষ কৃষ্ণপক্ষের হিসাব রাখে না, তরু রাখে। সে কৃষ্ণপক্ষের রাতগুলো ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে রাস্তা দেখে। শুক্লপক্ষে রাস্তা দেখে না সে, চাঁদ দেখে। তার চাঁদটা মুক্ত না। তার চাঁদটা দাগকাটা, তার আকাশটাও অবারিত না, তার আকাশ এক টুকরো, এক জানালা। গ্রীলের দাগকাটা আকাশ আর চাঁদ দেখেই সে অভ্যস্ত।
তরু বেশ কয়েক মাস আগে তার নানাবাড়িতে গিয়েছিল, প্রথম ঢাকার বাইরে। ছাদে উঠে সে আকাশ দেখেছিল। তাতে বিশাল চাঁদ। হঠাৎ তরু যেন একটা স্ফুলিঙ্গ চট করে জ্বলে নিভে যেতে দেখেছিল। আরো অনেকক্ষণ ছাদে থেকে সে অপেক্ষা করল বিষয়টা আবার ঘটে কিনা দেখার জন্য। কিন্তু আর ঘটল না। তার উত্তেজিত বিবরণ শুনে সবাই হেসেই খুন- সে নাকি জোনাকী পোকা দেখেছে। তরু বহুবার জোনাকীর কথা বইয়ে পড়েছে, কখনো দেখেনি। জোনাকী কি পোকা! যে ছোট্ট প্রাণীটা তার শরীরে আলো নিয়ে ঘোরে তাকে পোকা বলা মানুষকে কতটুকু সাজে?
যেটাই হোক, তরু মুগ্ধ হয়েছিল। বাড়ি ফিরে ডায়রিতে সে তার জোনাকী দেখার পুরো বিষয়টি লিখে রাখল। তার দুর্ভাগ্য না সৌভাগ্য কে জানে, সে আর কখনো জোনাকী দেখেনি।
তরু ঢাকার আকাশে যে দু' একটা তারা জানালার ফাঁক গলে দেখতে পায় তাদের সাথে তার দেখা জোনাকীটার আলোকে মিলিয়ে দেখে। জোনাকীটাই বোধহয় বেশি সুন্দর ছিল। রাতে ঘুমাতে যাবার আগে আকাশ দেখার সময়টা তরু কি মাঝে মাঝেই একঝাঁক তারার পরিবর্তে একটা উড়ন্ত জোনাকীর জ্বলে ওঠা দেখার আশা করে না?
করে।
কিন্তু ঢাকার আকাশে জোনাকী দেখা যায় না।
..........................................................
আজ রাতে কোন একটা কারণে তরুর খুব মন খারাপ। তরু খুব চাইছিল সে একটা জোনাকী দেখবে আজ রাতে। আলতো হাতে জানালার পর্দা সরিয়ে সে রাস্তার দিকে তাকিয়ে থাকে। টুং টুং শব্দে রিকশা চলে। রাস্তার নিয়ন আলোয় অন্ধকার আরো জমাট বেঁধে থাকে। গাড়িগুলো শাঁ শাঁ শব্দে ছুটে যায়। হঠাৎ দু' একটা গাড়ির মন্দগতি দেখে তার মনে হয় গাড়িটা সত্যিই হয়ত তাদের বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে যাবে। সেখান থেকে অতিপ্রিয় কোন একজন মানুষ বেরিয়ে আসবে। তাকে জানালায় দেখে হেসে হাত নাড়বে.........
কেন জানি কথাটা ভেবেই তরুর মনটা আরো বিষন্ন হয়ে ওঠে। চোখে পানি চলে আসে তার। ঝাপসা চোখে সে গাড়িটার ধীরে চলে যাওয়া দেখে........ কেউ বেরিয়ে এসে বলে না,'দেখেছ তরু, কি চমৎকার রাত আজ! চল, দূরে কোথাও ঘুরতে যাই।'
এই দূরে কোথাওটা যে ঠিক কোথায় তরু জানে না........ কেবল মনে হয় অ-নে-ক দূরে। এতটাই দূরে যতটা দূরে গেলে এই ব্যস্ত শহরটাও মায়ার শহর হয়ে ওঠে। এই শহরের হেডলাইটের আলোগুলো যেখান থেকে জোনাকীর মত ছোট্ট দেখায়, ততদূরে.......
তরু যাবে, তত দূরেই যাবে। একদিন এই শহর থেকে অনেক দূরে......... বহু দূরে। যেখানে কারো হাত ধরে গাড়ি থেকে নেমে বিশাল উপুড় করা আকাশে তারার মেলা দেখা যায়। না, তরু সেদিন আকাশে তারা দেখবে না, সে দেখবে জোনাকী, শত শত জোনাকী সেখানে বার বার জ্বলে উঠবে.......
ফিরে এসে তরু জোনাকীর ছবি আঁকবে, অনেকবার চেষ্টায়ও যেটা সে করতে পারেনি। জোনাকীর মত তার ছবিতে স্ফুলিঙ্গ জ্বলে উঠবে.......
তরু ভিজা চোখে দু'হাতে বালিশ জড়িয়ে ধরে শুয়ে পড়ে।
রাতে সে স্বপ্ন দেখল।
অদ্ভুত একটা স্বপ্ন ........... সে একটা জায়গায় ঘুরতে গিয়েছে। নির্জন আধা গ্রাম- আধা শহর ধরনের জায়গাটা। গাড়ি করে আসেনি, রিকশা করে এসেছে। তার পাশে কে একজন অচেনা মানুষ। তরুকে সে বলছে,'তরু জোনাকী দেখবে না? এসো আমার সাথে....'
তরু তার পিছন পিছন হাঁটছে... তাল রাখতে কষ্ট হচ্ছে তার... তবু হাঁটছে......একটা অদ্ভুত জায়গায় এসে ছেলেটা থেমে যায়। তরু ছেলেটার মুখটা দেখার চেষ্টা করে, কিন্তু ছেলেটা যেন নিজেকে লুকাচ্ছে.....
তরু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখে ঝোপে ঝোপে জোনাকী জ্বলছে, উড়ে বেড়াচ্ছে জোনাকীরা। শত শত জোনাকী। টিপ টিপ করে জ্বলছে, হাত বাড়ালেই তাদের আলোটা ছুঁয়ে দেয়া যায়। তরু কি একটা কথা বলার জন্য ফিরে দেখে ছেলেটা নেই!
গেল কোথায়! তরু একঝাঁক জোনাকীর মাঝে দাঁড়িয়ে আছে। জোনাকীর আলোয় যতদূর দেখা যায় তরু দেখতে চেষ্টা করে, ছেলেটাকে দেখা যায় না..................
সাথের মানুষটা নেই বলে তরুর বেশ একটু খারাপই লাগে, থাকলে তাকে জোনাকী ধরে দেয়া যেত। তরু একটা জোনাকী হাতে ধরে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে...........
জোনাকীটা তরুর হাতে জ্বলছে, নিভছে।
এটা সেই মানুষটার জন্য একটা ছোট্ট উপহার, যে তাকে জোনাকীর দেশে নিয়ে এসেছে.........
এটা তার জন্য.........
কেবলই তার জন্য...........
সর্বশেষ এডিট : ০১ লা সেপ্টেম্বর, ২০১২ দুপুর ১২:০৩

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






