আমাকে কেউ কোনদিন চিঠি লেখে না। মেইলও করে না। এস.এম.এস.ও না। কিছুই না। আমার সর্বপ্রকার ইনবক্সই খালি। খালি থাকারই কথা। আমাকে কে লিখবে। লিখতে হলে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ কাউকে লিখতে হয়। আমি তেমন কেউ না। আমার এস.এম.এস.গুলো আসে কাস্টমার সার্ভিস থেকে। চিঠি এসেছিল একটা। স্কুলের পুনর্মিলনীর চিঠি। মেইল আসে সব জাংক মেইল। অনাথ একটা মানুষ আমি। আমাকে কে চিঠি লিখবে। তুমি তো এটা জানতেই। সব কিছুই জানতে আমার সম্পর্কে। কিভাবে খালার বাড়িতে মানুষ হয়েছি, কিভাবে বার বার পরীক্ষা দিয়ে সরকারী বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হয়েছি, কেমন করে ক্লাসের সব ছেলে মেয়ে আমাকে করুণা করে.... সবই তো জানতে। জানতে না? তারপরও এমন একটা চিঠি (একটাই সত্যিকারের চিঠি আমি পেয়েছি, সেটা তোমার কাছ থেকে) লিখলে কি করে, অ?
আমি অসহায় হতে পারি, অনাথ হতে পারি, তবু আমি মানুষ বলেই নিজেকে মনে করে এসেছি এতদিন। চিঠিটা পেয়ে আমার মনে হয়েছে আমি বোধহয় মানুষও না। পথের কুকুর শ্রেণীর কেউ হয়ে থাকব। তুমি কি চমৎকার করে লিখেছ- "আপনার তেল চকচকে কালো চামড়া দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে প্রেমে পড়ে যাব, এটা ভাবলেন কি করে?" এত কঠিন একটা কথা চিঠিতে লেখা যায়! আমার ধারণা ছিল না।
তোমার চিঠির সবচেয়ে মজার কথাটা কি জানো, তুমি এক জায়গায় লিখেছ-"আপনার হলুদ দাঁতের হাসি দেখে আমার পিত্তি জ্বলে যায়।" আবার লিখেছ "ফ্যাল ফ্যাল করে যখন তাকিয়ে থাকেন আপনার কালো ঠোঁটের ফাঁক দিয়ে সাদা মুলার মত দাঁতগুলো বের হয়ে থাকে, এটা কি আপনি জানেন?" এক জায়গায় বলেছ 'মুলার মত সাদা' আরেক জায়গায় 'হলুদ'। আসলে আমার দাঁতের রং কি? গোলাপি? না সবুজ?
হা হা হা.... এই জিনিসটা পড়ে আমার সত্যি হাসি পেয়েছে। রাগে অন্ধ হয়ে একটা চিঠি লিখেছ। তোমাকে আমি ক্ষমা করলাম যাও। জোর করে করলাম। করার একটা চেষ্টা বলতে পারো, অ। তোমাকে ক্ষমা করা আমার পক্ষে সম্ভব বলে আমার মনে হয় না। যাক সে কথা। তুমি তো আর আমার ক্ষমা ভিক্ষা করনি। আমি ক্ষমা করলেই বা, আর না করলেই বা।
সবচেয়ে খারাপ লেগেছে এই ভেবে যে তুমি ভেবে বসে আছ তোমার প্রেমে পড়ে আমি হাবুডুবু খাচ্ছি। তোমার এই ধারণাটা হয়েছে দেখে আমি অবাক হয়েছি। সত্যি অবাক হয়েছি। প্রেমে পড়া আমার জন্য বিলাসিতা, এটা আমার চেয়ে ভালো আর কে জানে? তবুও তোমার প্রেমে পড়েই গিয়েছি। মন চাইছে তোমার পায়ে ধরে সাধি, আমাকে বিয়ে করবে, অ?
অ, তুমি আমার ছাত্রী ছিলে। তোমার কাছে এটা যতটা অপমানজনক ব্যাপার হতে পারে, আমার কাছে তারচেয়েও বেশি। তোমার মত একটা মেয়েকে আমি পড়িয়েছি! ভাবতে আমার অবাক লাগে। সত্যি অবাক লাগে। শিক্ষক বোধ করি সে-ই যে ছাত্রকে পড়ার প্রতি আগ্রহী করে তুলতে পারে। আমি সেটা পেরেছিলাম। তুমি তিনটা সাবজেক্টে ফেল নিয়ে আমার কাছে পড়া শুরু করেছিলে, শেষ করেছ সিক্সটি পারসেন্ট অ্যাভারেজ নিয়ে। এর পিছনে আমার অবদানটা আশা করি তুমি স্বীকার কর। তোমাকে বাংলা পড়ানোর আগে তোমাকে শতটা গল্পের বই পড়ানোর চেষ্টা, তোমাকে অংকের মজার ট্রিকস শেখানো.... কি আমি করিনি বলতো? আমার ছাত্রদের মধ্যে তুমি সবচেয়ে ঠান্ডা মাথার ছিলে তোমাকে আগেও বলেছি। এখনও আমি তা-ই মনে করি। ঠান্ডা মাথার একটা মেয়ে হয়ে এইরকম একটা চিঠি তুমি আমাকে দিতে পারলে কি করে আমার মাথায় আসে না, অ। আমি যতদূর জানতাম তুমি আমাকে শিক্ষক হিসেবে শ্রদ্ধাই করতে। সেই অতীত শ্রদ্ধাকে স্মরণে রেখেই বলছি, আমি কালো হই, তালঢ্যাঙা হই, আমার দাঁত মুলার মত হোক বা হলুদ হোক; তোমার জন্য আমার শুভকামনা রইল। কেবল সাদা দাঁতের মানুষের প্রর্থনাই কবুল হয় এমন শুনিনি, তাই প্রার্থনা করার ধৃষ্টতা দেখালাম।
ভালো কথা, তোমার ভাই (যে একসময় আমার বন্ধু ছিল এবং যার কল্যাণেই আমি তোমার টিউশানিটা পেয়েছিলাম, যে এখন আমাকে পথে দেখলে চট করে কোন একটা গলিতে ঢুকে লুকিয়ে পড়ে) তাকে বলো তাকেও আমি ক্ষমা করেছি। ভাবছ এত মহানুভব মানুষের মত ক্ষমা বিলিয়ে বেড়াচ্ছি কেন? নিশ্চয়ই কোন কারণ আছে। আছে তো বটেই তবে তোমাকে বলার মত নয় সেটা।
তুমি আমার প্রতি সময়ে অসময়ে যে শ্রদ্ধা এবং করুণা (যেটাকে আমার কাছে ভালবাসা বলে মনে হয়েছিল) দেখিয়েছ তার জন্য অনেক ধন্যবাদ। নইলে জীবনের একটা বড় রূপ আমার কাছে অদেখা থেকে যেত। মায়া কি, মমতার স্বাদ কেমন আমার জানাই হত না। এক কাপ চা-ও যে কতটা ভালবেসে পরিবেশন করা যেতে পারে আমার বোঝা হত না।
ধন্য তুমি, অ। যখন আমি আমার সত্যিই ভাবতে শুরু করেছিলাম তুমি হয়ত আমাকে ভালবাস, সেই সময়ই তুমি ধাক্কাটা দিলে। কারণটা আমি বুঝলাম না। কেন করলে এমন? জানতে ইচ্ছে হচ্ছে।
তুমি সুখী হও, অ। ভালো থাকো। রাহাতের মুখে শুনেছি তোমার নাকি বিশাল এক রাজপুত্রের সাথে বিয়ের কথা হচ্ছে। সুখী হও তুমি। তোমার জন্য দোয়া রইল। দোয়া রইল যেন তোমার ছেলে আমার মত কালো বা তালঢ্যাঙা কিংবা মুলার মত দাঁত নিয়ে না জন্মায়। অবশ্য যদি জন্মায়ও তুমি হয়ত তাকে ডেন্টিস্টের কাছে নিয়ে যাবে। নিয়ে যেও। তাকে যেন কোন মেয়ে আবার এমন কোন চিঠি না লিখতে পারে।
বিশাল চিঠি লিখে ফেললাম অ। শেষ কয়েকটা কথা বলি। ১০০ ভাগ সত্যিই বলি।
এক. তোমার প্রেমে আমি কখনোই পড়িনি। তোমার বিশ্বাস না হলেও আমি বিশ্বাস করাতে আসব না। আমার এত ঠ্যাকা পড়েনি। বরং তোমার একটু চোখকান খোলা থাকলে তুমি নিজেই টের পেতে ক্যাম্পাসে তোমাকে নিয়ে কত গুজব ভেসে বেড়াত। বেশিরভাগ গুজবই এমন- কি করে এই ঝাক্কাস মেয়েটা এমন কাকতাড়ুয়া (আমি) টাইপ ছেলের প্রেমে পড়ে! রুবেল (সবাই যাকে গুন্ডা রুবেল ডাকে, তোমার না চেনার কথা না) আমার কাছে একদিন এসে অসম্ভব কান্নাকাটি করল। সে নাকি তোমাকে পাচ্ছে না আমার কারণেই। তুমি নাকি আমাকে পছন্দ কর। বলতে পারছ না। আমি সরে গেলে তার একটা চান্স হলেও হতে পারে। এখন পুরো বিষয়টাই আমার কাছে গোলমেলে ঠেকছে। জট পেকে গেছে। এই জট খোলা আমার সাধ্যের বাইরে। জট থাকুক। তুমিও থাকো। এবং ভালো থাক।
দুই. তুমি যখন নাইনে উঠলে অরূপ আমাকে বলল, 'তোর আর পড়াতে আসতে হবে না। ও আর তোর কাছে পড়বে না। ও কমার্স নেবে'। আমার খটকা লেগেছিল। তুমি সায়েন্স না নিয়ে কেন কমার্স নিলে। এখন বুঝি আমার কাছে যাতে না পড়তে হয় এজন্যই তুমি কমার্স নিয়েছিলে। এত ঝামেলা করার দরকার ছিল না। আমাকে বললেই হত। আমি তোমাকে পড়াতে আসতাম না আর। যাহোক, আমি কিছুদিন যোগাযোগ রাখার চেষ্টা করেছি, তোমাকে কখনোই ফোনে পাওয়া যেত না (তুমি রিসিভ করতে না) আর অরূপ প্রাইভেটে ভর্তি হবার পর কেন যেন আর আমার সাথে যোগাযোগ রাখেনি। এটা ওর হীনমন্যতা কিনা আমি জানি না। যাহোক, হঠাৎ করে কি এমন হয়ে গেল আমি বুঝিনি। আমাকে তুমি শিক্ষক হিসেবে পছন্দ করতে বলেই আমি জানতাম। কি জানি...
মানুষের জানায় কত ভুলই তো থাকে।
শেষ কথাটা বলি অ, তোমাকে আমি ক্ষমা করিনি। কখনো করব না। কখনোই না। অতটা মহৎ আমি না। অবশ্য তুমি আমার ক্ষমা চাও-ওনি। চাও বা না চাও ক্ষমা তুমি পাবে না, অ।
যেমনই থাক ভাল থাকার চেষ্টা কর অ। সবসময়।
-------রফিক।
..................................................................
স্যারের এই চিঠিটা আমি যখন হাতে পাই তখন স্যার অলরেডি ঢাকা ছেড়ে রওনা হয়ে গেছেন। চিঠি পড়ে থ হয়ে গেলাম আমি। এসব কি লিখেছে স্যার! আমি স্যারকে একটা ছোট্ট চিরকুট লিখেছিলাম। বহু যত্নে বহু কাটাকুটির পর। অনেক ভয়ে ভয়ে........
কিন্তু খারাপ কিছু তো লিখিনি আমি। কেবল লিখেছিলাম,
"স্যার এতগুলো বছর পর আমি আর সব জায়গায় চান্স পেয়েও এখানে এসে কেন ভর্তি হয়েছি, তা কি আপনি বুঝতে পেরেছেন? আপনি তো অনেক চালাক। নিশ্চয়ই বুঝেছেন। স্যার, আপনার জন্য পাঁচটা বছর অপেক্ষা করেছি, আরো করতে পারব। আর ক'বছর অপেক্ষা করতে হবে স্যার?
-অ"
পুরো বিষয়টার মেকানিজম বুঝতে আমার অনেকটা সময় কেটে গিয়েছিল। কাঁদতে কাঁদতে স্যারের মেসে গিয়ে শুনলাম স্যার নাকি বাসা ছেড়ে দিয়ে চলে গেছে। ওখানেই বসেছিলাম। রুবেল এসে আমাকে নিয়ে গিয়েছিল ক্যাম্পাসে। পুরোটা পৃথিবীর সব রং হঠাৎ গুলিয়ে গিয়েছিল... আমি স্যারকে চিঠি পাঠিয়েছিলাম তিন্নি আপুর হাত দিয়ে। তিন্নি আপু স্যারের ডিপার্মেন্টেই পড়ত।
বছরখানেক পর ভাইয়া বিয়ে করেছিল তিন্নি আপুকে।
ক্যাম্পাসে যেতাম না আমি। বাবা আর মা আর ভাইয়াকে অকথ্য গালিগালাজ করে মাস ছয়েক পর বাসা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিলাম। রুবেলকে সেদিনই বিয়ে করি। বিয়েতে বাবা আর মা এসেছিলেন। আমাকে দোয়াও করলেন। কিন্তু স্যার আসেননি। স্যারের আর কোন খবরই পাইনি। ভাইয়ার সাথে আর কোনদিনই কথা বলিনি আমি দেশের বাইরে চলে যাবার আগে আমাদের বাড়িতে এসেছিল ভাইয়া আর তিন্নি আপু, সরি ভাবি। আমাকে জড়িয়ে ধরে ভাইয়া কাঁদল অনেক। আমি কিছুই বলিনি। ভাইয়াই আমাকে কমার্সে ভর্তি করিয়ে এসেছিল, আমি জানতাম না। স্কুলে গিয়ে জানলাম, আমি নাকি কমার্সে। বাবা মা কখনোই রফিক ভাইকে পছন্দ করতেন না। ভাইয়ার এত প্রাণের বন্ধু ছিল, অথচ ভাইয়া আমার নাম দিয়ে কি যেন যাচ্ছেতাই একটা লিখে স্যারকে পাঠিয়েছিল। যাবার আগে আমাকে বলে গেছে। বলার দরকার ছিল না। আমি আগেই বুঝেছিলাম।
সবচেয়ে আশ্চর্য বিষয় হল আমার বড় ছেলেটা হয়েছে ভীষণ কালো। কি করে এমন হল আমি ভেবে পাই না, ওর বাবা আর আমি দু'জনই ফর্সা। ছেলেটা গম্ভীর হয়েছে খুব, ওর দিকে তাকিয়ে কেন যেন স্যারের কথা বারবার মনে পড়ে যায়, তেমনই চকচকে চোখ ওর, আমার ধারণা বড় হলে ওর ব্যক্তিত্বও স্যারের মতই চমৎকার হবে। কেন মনে হয় কে জানে.....
কতগুলো বছর পেরিয়ে গেছে..........
আজ স্যারের জন্মদিন। কত বছর স্যারকে দেখি না.... অথচ কোন বছরই এই একটা দিন আমি ভুলি না। গুন্ডা রুবেলও আর গুন্ডা নেই। সে বোধহয় পৃথিবীর সেরা বাবা এবং সেরা স্বামী।
আমি সুখে আছি স্যার। ভালো আছি। আপনার দোয়া কাজে লেগেছে।
আপনি কেমন আছেন?
আপনি ভালো আছেন তো স্যার?
সর্বশেষ এডিট : ১৯ শে জুলাই, ২০১২ সন্ধ্যা ৭:১৯

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।






