মুফতী আবুল হাসান শামসাবাদী
নওগাঁর রাণীনগরের ১০১ দোররা মারার ঘটনাকে কেন্দ্র করে দৈনিক প্রথম আলো পত্রিকায় গত ২৪ ফেব্রুয়ারী সম্পাদকীয় কলামে ইসলামবিবর্জিত ও সমাজবিরোধী বক্তব্য প্রদান করে সেক্যুলার জাহিলিয়্যাতের গোমরাহী ছড়ানো হয়েছে। ‘বদলে যাওÑবদলে দাও’ মুখরোচক শ্লোগানের অন্তরালে তারা ইসলামী মূল্যবোধ, আদর্শ চরিত্র ও সুস্থ সামাজিক রীতিনীতির বিরুদ্ধেই অবস্থান নিয়েছেন বলে সেই বক্তব্যের দ্বারা প্রতিভাত হচ্ছে।
উক্ত সম্পাদকীয় কলামে স্থানীয় মাতবরদের ফয়সালাকে ফতোয়াবাজি বলে উল্লেখ করে সেই ঘটনার প্রেক্ষিতপ্রসঙ্গ টেনে বলা হয়েছেÑ“এ ঘটনা এই বাস্তবতা সামনে আনে যে, বিবাহিত নারীর সঙ্গে পরপুরুষের মেলামেশা সহজভাবে দেখা হয় না। এর মূলে রয়েছে কুসংস্কার, সামাজিক অনগ্রসরতা, অশিক্ষা এবং সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরায়ত বিদ্বেষ। নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মানের চোখে না দেখতে পারার যে সীমাবদ্ধতা, সেখান থেকেই এ ধরনের অনাচারের উদ্ভব ঘটতে পারছে। অসামাজিকতার সংজ্ঞা অভিযুক্ত ব্যক্তিরা নিজেরাই তাঁদের উর্বর মস্তিষ্ক দিয়ে নির্ধারণ করেন। ভদ্র মহিলার স্বামী যেখানে তাঁর বন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় আপত্তি তোলেননি, সেখানে তথাকথিত মাতবরেরা গায়ে পড়ে ঝামেলা পাকিয়েছেন, আইন হাতে তুলে নিয়েছেন।” (দ্রষ্টব্য : দৈনিক প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারীÑ২০১২ সম্পাদকীয় কলাম)
এ বক্তব্যে প্রথম আলো বিবাহিত নারীর সঙ্গে পরপুরুষের অবাধ মেলামেশাকে প্রশ্রয় না দেয়ার সামাজিক ও ইসলামী রীতিনীতির বিরুদ্ধে মারাত্মক কটুক্তি করেছে। অথচ বেগানা নারী-পুরুষের নির্জন মেলামেশা যে যিনা-ব্যভিচারেরই উৎসÑতা বলার অপেক্ষা রাখে না। বর্ণিত ঘটনায়ই এর প্রমাণ রয়েছে।
নওগাঁর রাণীনগর উপজেলার মিরাট উত্তরপাড়া গ্রামের উক্ত ঘটনার বিবরণে গ্রামবাসীর বরাতে বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক করতোয়া, বার্তা লাইভ ২৪ ডট কম প্রভৃতি পত্রিকায় উল্লেখ করা হয়েছে যে, “গত ১৬ ফেব্রুয়ারী বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে আটটার দিকে একই গ্রামের মেছের আলীর ছেলে আবদুল মতীন (২৫) প্রতিবেশী ভ্যানচালক খোরশেদ আলমের অনুপস্থিতিতে তাদের শয়নকক্ষে ঢুকে খোরশেদের স্ত্রী-আকলিমা বিবির (২৭) সাথে গল্পগুজবে মত্ত হয়, আর এই সুযোগে তাকে নির্জনে একা পেয়ে ধর্ষণ করার প্রয়াস চালায়।” তাহলে কি প্রথম আলো এভাবে ধর্ষণের পথ সুগম করতেই বেগানা নারী-পুরুষের নির্জন মেলামেশার পক্ষে সাফাই গাইছে?
বিবাহিত নারীর সঙ্গে পরপুরুষের মেলামেশাকে সহজভাবে মেনে না নেয়ার মানসিকতাকে প্রথম আলো কুসংস্কার, সামাজিক অনগ্রসরতা, অশিক্ষা এবং সর্বোপরি নারীর প্রতি পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরায়ত বিদ্বেষ বলে খেদোক্তি করেছে। এটা স্বয়ং ইসলামের ওপর আঘাতের শামিল। কেননা, ইসলামই তা কঠোরভাবে নিষিদ্ধ করেছে। হযরত আবদুল্লাহ ইবনে মাসউদ (রা.) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেনÑ“তোমরা স্বামীর অনুপস্থিতিতে কোন মহিলার নিকট গমন করবে না। কেননা, শয়তান তোমাদের প্রত্যেকের ভিতর রক্তের ন্যায় বিচরণ করে।” (দ্রষ্টব্য : তিরমিযী শরীফ, ২য় খন্ড, ২৬৪ পৃষ্ঠা)
বস্তুত বেগানা নারী-পুরুষের বেপর্দাভাবে নির্জনে একত্রিত হওয়া চারিত্রিক অবক্ষয় ও নৈতিক বিপর্যয় ঘটানোর জন্য ইবলীস-শয়তানের একটি মোক্ষম ফাঁদÑযা কুপ্রবৃত্তিকে উস্কে দিয়ে তাদের মাঝে অপকর্ম সংঘটিত করে তাদের জীবনকে তছনছ করে দিতে পারে এবং এর জেরে তাদের পরিবার ও সমাজকে ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিতে পারে। যার উদাহরণ আজ বেশুমার। এ কথা বুঝাতে হযরত ইবনে উমর (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে রাসূলুল্লাহ (সা.) ইরশাদ করেনÑ“যখনই কোন বেগানা পুরুষ কোন বেগানা নারীর সাথে নির্জনে একত্রিত হয়, তখন তাদের তৃতীয়জনরূপে শয়তান উপস্থিত হয়।” (দ্রষ্টব্য : তিরমিযী শরীফ, ২য় খন্ড, ২৭৭ পৃষ্ঠা)
এমনকি কোন জরুরী প্রয়োজনেও বেগানা নারীর সামনে না গিয়ে পর্দার আড়াল থেকে প্রয়োজন সমাধা করার জন্য ইসলাম নির্দেশ দিয়েছে। এ সম্পর্কে পবিত্র কুরআনে মহান আল্লাহ ইরশাদ করেনÑ“আর যখন তোমরা তাদের (বর্ণিত নারীদের) কাছ থেকে কোন জিনিস চাইবে, তা পর্দার আড়াল থেকে চাও। এটা তোমাদের অন্তর ও তাদের অন্তরের জন্য অধিক পবিত্রতার বিষয়।” (সূরাহ আহযাব, আয়াত : ৫৩)
বলা বাহুল্য, নারীর প্রতি নির্যাতন, টিজিং ও অপকর্মের সস্তা সুযোগ বন্ধ করতেই ইসলাম বেগানা নারী ও পুরুষের নির্জনে গল্প করা বা আড্ডা দেয়া সম্পূর্ণরূপে নিষিদ্ধ করেছে। ইসলামের এ সুমহান বিধানকেই কিনা প্রথম আলো কুসংস্কার, সামাজিক অনগ্রসরতা ও অশিক্ষা বলে অভিহিত করছে! (নাউযুবিল্লাহ)
আমাদের জন্য আশার কথা যে, ইসলামের শাশ্বত মূল্যবোধে লালিত এ মুসলিম দেশের সামাজিক রীতি অশ্লীলতা ও লুচ্চামিকে প্রশ্রয় দেয় না। তাইতো বেগানা নারী-পুরুষের অবৈধ মেলামেশাকে সমাজ খারাপ নজরে দেখে এবং এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ ও প্রতিরোধে সোচ্চার হয়। আর এ কারণেই অনাচারীরা সমাজে খুল্লুমখোলা অপকর্ম করার দুঃসাহস দেখাতে পারে না। অথচ আমাদের মুসলিম সমাজের এ সুন্দর মানসিকতাপূর্ণ রীতিনীতিকেই প্রথম আলো কুসংস্কার ও সামাজিক অনগ্রসরতা বলে উল্লেখ করেছে!
বেগানা নারী-পুরুষের অবাধ মেলামেশা কোন সুস্থ বিবেকই সমর্থন করতে পারে না। তা প্রকারান্তরে যৌনহিং¯্রতারই জন্ম দেয়Ñযা থার্টিফার্স্ট নিশিতে টিএসসি প্রাঙ্গণে বাঁধনের উপর হামলে পড়ার প্ররোচনা যোগায়। এ বিবেকের তাড়নাকে প্রথম আলো কি করে অশিক্ষা ও পুরুষতান্ত্রিক সমাজের চিরায়ত বিদ্বেষ বলে চিত্রায়িত করল, তা বোধগম্য নয়।
সেই সাথে প্রথম আলো সেখানকার গ্রাম্য মাদবরদের ফয়সালাকে ‘ফতোয়াবাজি’ আখ্যা দিয়ে চরম ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। এটা ইসলামের পরিভাষার অবমাননা বৈকি। অভিজ্ঞ মুফতীগণের শরয়ী হুকুম বর্ণনার ক্ষেত্র ছাড়া অন্য কোথাও ‘ফতোয়া’ শব্দ ব্যবহার করা যায় না। অথচ বর্ণিত ঘটনায় কোন মুফতীর ফতোয়া ছিল না, ছিল শুধু গ্রাম্য মাদবরদের ফয়সালা। ইসলামের ফতোয়া কখনো যিনা-ব্যভিচারের শাস্তিস্বরূপ এলাকার মাদবরদেরকে ১০১ দোররা মারার অধিকার দেয় না। যিনা, চুরি-ডাকাতী, মদ্যপান প্রভৃতি অপরাধের শাস্তিমূলক ইসলামের হদ-কিসাসের দ-বিধি শুধুই ইসলামী রাষ্ট্রের সাথে সম্পৃক্তÑযা কেবলমাত্র রাষ্ট্র কর্তৃকই কার্যকর হতে পারে, কোন ব্যক্তিবিশেষ বা পঞ্চায়েত কর্তৃক নয়। এ সম্পকে হযরত ইবনে মুহাইরিয (রা.) হতে বর্ণিত হাদীসে বলা হয়েছেÑ“হুদুদ (বিভিন্ন অপরাধের জন্য নির্ধারিত শরয়ী শাস্তিদ- প্রয়োগ), গনীমাত (যুদ্ধলব্ধ সম্পদ বন্টন), যাকাত উসূল ও তাক্বসীম এবং জুমু‘আ কায়িম শাসক বা রাষ্ট্রপ্রধানের ওপর ন্যস্ত।” আল্লামা তাহাবী (রহ.) বলেন, “এ বিষয়ে কোন সাহাবী এর বিপরীত কিছু বলেছেন বলে আমাদের জানা নেই।” (দ্রষ্টব্য : মুসান্নাফ ইবনে আবি শাইবাহ্, ৩য় খন্ড, ১৪৫ পৃষ্ঠা) এ সংক্রান্ত হাদীসসমূহ উদ্ধৃত করে ‘ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার’ কিতাবে বলা হয়েছেÑ“এ সকল হাদীস দ্বারা প্রমাণিত হয়Ñকোন প্রকারের আইনানুগ বিচার ও শরীয়ত নির্ধারিত শাস্তি প্রদানের অধিকার একমাত্র রাষ্ট্রের।” (দ্রষ্টব্য : ফিকহুস সুনানি ওয়াল আছার, ২য় খন্ড, ১২৭ পৃষ্ঠা)
সুতরাং নওগাঁর রাণীনগরের ঘটনায় ১০১ দোররা মারার ফয়সালা কার্যকর করে আইন হাতে তুলে নিয়ে মাদবররা অবশ্যই অপরাধী হয়েছেন, কিন্তু তাতে তো শরীয়তের ফতোয়ার কোন দোষ নেই। এমতাবস্থায় তাদের এ বেআইনী কর্মটিকে ‘মাদবরিবাজি’ বা ‘ফয়সালাবাজি’ না বলে কেন ‘ফতোয়াবাজি’ আখ্যা দেয়া হল?
অপরদিকে ফতোয়া ইসলামের একটি পবিত্র পরিভাষা। এর সাথে ‘বাজি’ শব্দ যুক্ত করা মারাত্মক অপরাধ। ‘বাজি’ শব্দটি ধোঁকা, ফেরেব প্রভৃতি মন্দ বিশেষণের সাথে যুক্ত হতে পারে, ফতোয়ার মত ইসলামের পবিত্র বিধানের সাথে নয়। সুতরাং এখানে ‘ফতোয়াবাজি’ শব্দের ব্যবহার করে প্রথম আলো ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।
প্রথম আলো আরো উল্লেখ করেছেÑ“নারীকে মানুষ হিসেবে সম্মানের চোখে না দেখতে পারার যে সীমাবদ্ধতা, সেখান থেকেই এ ধরনের অনাচারের উদ্ভব ঘটতে পারছে।.... ভদ্র মহিলার স্বামী যেখানে তার বন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় আপত্তি তোলেননি, সেখানে তথাকথিত মাতবরেরা গায়ে পড়ে ঝামেলা পাকিয়েছেন...।”
বাহ্, পরকীয়াকে বৈধতাদানের কী চমৎকার সাজেশন! নিজের স্ত্রীকে আরেক পুরুষের বাহুডোরে আগলে দেয়ায় পুরুষের কী কৃতিত্ব এবং নারীর কী সম্মান লুকায়িত থাকতে পারে, তা পশ্চিমা বিধর্মী সমাজই বলতে পারবে, বাংলাদেশের মত ধর্মপ্রাণ মুসলিম সমাজ নয়। আমাদের ইসলামধর্ম এ ধরনের পুরুষকে ‘দাইয়্যূস’ বলে। দাইয়্যূস অর্থÑ আত্মসম্ভ্রমহীন কাপুরুষÑযে তার অধীনস্থ নারীদেরকে পরপুরুষের সাথে নস্টি-ফস্টি করতে লাগামহীনভাবে ছেড়ে দেয়। এ জাতীয় দাইয়্যূস পুরুষদের সম্পর্কে হাদীস শরীফে বলা হয়েছেÑ“তারা বেহেশতের নাগাল পাবে না।”
মজার ব্যাপার হল, “ভদ্র মহিলার স্বামী যেখানে তার বন্ধুর সঙ্গে আলোচনায় আপত্তি তোলেননি....” বলে প্রথম আলো যে বন্ধুর পক্ষে ওকালতী করেছেন, বাংলাদেশ প্রতিদিন, দৈনিক করতোয়া, বার্তা লাইভ ২৪ ডট কম প্রভৃতি পত্রিকার খবরে প্রকাশÑসেই ভ্যানচালক বন্ধু আবদুল মতীন নির্জনতার সুযোগে সেই ভদ্র মহিলার সম্ভ্রম লুটে নেয়ার প্রয়াস চালান। আর তখন সেই ভদ্র মহিলা চিৎকার দেন। সেই চিৎকার শুনে এলাকাবাসীগণ ছুটে এসে সেই বন্ধুকে পাকড়াও করেন এবং তাকে সারারাত গাছের সাথে বেঁধে রাখেন। এমতাবস্থায়ও কি করে প্রথম আলো সেই লম্পট-ব্যভিচারীদের পক্ষ নিয়ে তাদের নির্জন অভিসারের সুযোগদানের পক্ষে ওকালতী করলো? জানি না, প্রথম আলোতে এমন ক’জন উদারপ্রাণ (?) আছেনÑযারা তাদের স্ত্রীদের সাথে এভাবে আবদুল মতীনদের অভিসারের সুযোগ করে দিবেন! যদি তারা তা না করতে পারেন, তাহলে এ বস্তপঁচা থিউরী এদেশের ধর্মপ্রাণ মুসলিমজাতির ঘাড়ে চাপাতে চাচ্ছেন কোন্ যুক্তিতে?
মূলত প্রথম আলো উক্ত বক্তব্যের দ্বারা ইসলাম, সমাজ ও বিবেকের বিরুদ্ধে ঘৃণ্য অবস্থান নিয়েছে। নওগাঁর রাণীনগরের বর্ণিত ঘটনার যে মূল্যায়ন প্রথম আলো করেছে, তা আইয়্যামে জাহিলিয়্যাতের কদাকার কালচারÑযা নারীকে নিছক ভোগ্যপণ্যরূপেই পরিগণিত করে এবং এর ছত্রছায়ায় যৌনদস্যুতা ও যিনা-ব্যভিচার দ্বারা সমাজে কলুষতাই ছড়াতে পারে। এ অপপ্রয়াস ইভটিজিং বা নারীত্বের অবমাননা তথা যৌন হয়রানি ও যৌন নির্যাতনকেই স্বাগত জানায়। যেহেতু তা নারী-পুরুষের বেপর্দা ও লাগামহীন চলাফেরারই ফলশ্রুতি।
(লেখক : ইসলামী বিশেষজ্ঞ, সম্পাদকÑমাসিক আদর্শ নারী।

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




