আমি কফির ট্রে হাতে নিয়ে আইরিনের রুমের সামনে দাঁড়িয়ে দরজায় নক করলে মারিয়া এসে দরজা খুলে দেয়। আইরিন পরিচয় করিয়ে দেয়ার আগেই মারিয়া এসে নিজেই পরিচিত হয়। মেয়েটার চুল আর চোখ অদ্ভুত সুন্দর। ব্রাউন আর গোল্ডেন রঙের মিশেল ওর চুলে। চোখ গুলো নীল আর স্বচ্ছ খুব। ওদের ঘরে এসে দেখি মা মেয়ে মিলে ততক্ষণে ওদের খাট দুটো সেট করে ফেলেছে। আইরিন এসে আমাকে চেয়ার এগিয়ে দেয়। বলে -
অনেক ধন্যবাদ কফির জন্য। কাজ করে একদম হাঁপিয়ে গেছি। কফির কাপটা নিয়ে বেশ শব্দ করে আইরিন দীর্ঘ চুমুকে কফিটা মুখে নিয় চোখ বন্ধ করে তৃপ্তির শব্দ করে।
- আহ মাম্মা!
- কী হয়েছে! নুহা তো ঘরের লোকই। শব্দ করে খেলে সমস্যা কী!
আমি হেসে ফেললে আইরিন বলে -
মেয়েটা সবসময় আমার পিছে লেগে থাকে বুঝলি!
আইরিনকে বেশ ঘরোয়া আর আপন মনে হচ্ছিলো আমার। কিছুক্ষণ আগের আমার করা কাজের জন্য নির্ভার লাগছিল বলেই কী আইরিনের মাঝে ঘরোয়া ভাব খুঁজে পাচ্ছি কিনা তা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে চাচ্ছিলাম না। আইরিনই কাজের ফাঁকে ফাঁকে জানালো মারিয়ার বাবা জার্মান থাকে। কাজের সূত্রে ইতালি এসে পরিচিত হবার কারণে এক সময় তারা বিয়েও করে। তবে বছর দশেক হলো তারা স্বেচ্ছায় বিবাহ বিচ্ছেদের পর যার যার জীবন গুছিয়ে নিয়েছে। আইরিন রাশিয়ান হলেও রাশিয়ায় আর ফিরে যায়নি। মারিয়ার বাবা ওর খরচ নিয়মিত দিয়ে যাচ্ছে এটা জানাতে অবশ্য আইরিন ভোলে না। আমি মারিয়ার দিকে তাকাই। ওর বয়স কত হতে পারে ভাবি। তেরো অথবা চৌদ্দ হবে বড়জোড়। ওর মায়ের মত এত চঞ্চল বা বেশি কথা বলে না। একটু চুপচাপই। ওদিকে আইরিন বলেই চলেছে -
দেখ না নুহা, মারিয়াকে কত করে বললাম আমার সাথে এক বিছানায় ঘুমাতে, রাজী হলো না। নতুন বাসায় উঠলে আলাদা বিছানায় থাকবে, যেমন বলেছে আমাকে দিয়ে তাইই করালো।
- মাম্মা, তুমি নাক ডাকো। ঘুমের ডিস্টার্ব হয় আমার
- মারিয়া মিথ্যা বলবি না
নুহা, শোনো আমি মিথ্যা বলছি না। এখনই প্রমাণ দিচ্ছি দাঁড়াও। বলে মারিয়া ওর মোবাইল নিয়ে কেমন একটা বিদঘুটে অডিও ক্লিপ শোনালো। আইরিন আর আমি হা হা করে হাসতে শুরু করলেও মারিয়া নির্বিকার মুখে বসে রইলো। ওদের কাজে আমি সাহায্য করতে চাইলেও আইরিন মানা করলো। বলল গল্প করতে করতে ওর কাজ করতে ভালো লাগে। এতে নাকি কাজ আগায়। মারিয়া একদমই কথা বলতে চায় না তাই আমাকে পেয়ে নাকি হাঁপ ছেড়ে বেঁচেছে।
- মাম্মা,তোমার কী মনে হয় নুহাও তোমার মত বকবক করে সারাক্ষণ? এই ঘরে ঢোকার পর কয়টা কথা বলেছে নুহা বলতে পারবে? সারাক্ষণ তুমি সবাইকে ডিস্টার্ব করো কিন্তু।
মারিয়া ওর বিছানায় পা ঝুলিয়ে বসে কমিকস পড়ছিল একটা। বই এর দিক থেকে মুখ না উঠিয়েই ও বলছিল কথা গুলো। ও ফানি কথাও কী গম্ভীর মুখে বলতে পারে, আমার ভালোই লাগলো ব্যাপারটা। আইরিন আমার দিকে তাকালে আমিও মাথা নেড়ে সায় জানাই। তারপর আবার দুজনে হেসে উঠি শব্দ করে। হাসার পর বুঝতে পারি কত দীর্ঘ দিন পর মনে হয় আমি এভাবে শব্দ করে হাসলাম। ভেতরটা আস্তে আস্তে নির্ভার হতে থাকে যেন এমন লাগছে। ঘড়ির কাঁটায় রাত প্রায় একটা বাজতে চললো। আইরিন জিজ্ঞেস করে রেজা ঘুমিয়ে গেছে কিনা। আমিও জানাই আমারো এবার ওঠা উচিত। আগামীকাল সকালে চাইলে মারিয়া আর আইরিন আমার সাথে ব্রেকফাস্ট করতে পারে। ওদের যেহেতু এখনো গোছগাছ হয়নি।
বাইরে গুড়িগুড়ি বৃষ্টি শুরু হয়েছে বোধ হয়। আইরিন ওদের রুমের জানালা লাগাতে লাগতে বিরক্তি প্রকাশ করছিল। সকালে এই বৃষ্টি থাকলে নির্ঘাত ওর বাস পেতে দেরী হবে।
- সকালেরটা সকালে বুঝবে। এখন রাতের গবেষণা করো তো
ওদের মা মেয়ের খুনসুটি ফেলে আমি বিদায় নেই। ওয়াশ রুমে ঢুকে হাতে মুখ ধুয়ে আয়নায় নিজেকে একবার দেখি। আমার ভেতরকার অবস্থা চেহারায় কী কিছু বোঝা যাচ্ছে। আমি আয়না দিয়ে আমার চোখের দিকে তাকিয়ে থাকি কিছুক্ষণ। আবার চোখেমুখে পানির ঝাপটা দেই।
- আগামীকাল কী করবে নুহা?
- জানি না
- কেন জানো না? জানা লাগবে তো। তুমি যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছ
- বাংলাদেশে চলে যাবো
- বললেই তো আগামীকাল চলে যেতে পারছ না। আর রেজা তোমার মায়ের কান ভাঙিয়েছে। দেশে গিয়েও কী সুবিধা করতে পারবে?
- তাহলে কী করবো?
- আমি কি জানি তুমি কী করবে?
- বলো না নুহা তাহলে কী করবো আমি?
- নিনো না ইতালির বাইরে কিছুদিনের জন্য যাবে, ওর সাথে ঘুরতে যাও
- মাথা ঠিক আছে তোমার? নিনো আমার কে? আমি নিনোর কী যে ও আমাকে নিয়ে যাবে ওর সাথে
- বাহ তুমি থেকে থেকে ওর কথা ভাবতে পারো আর আমি বললেই আমার মাথা খারাপ? কাল সকালে উঠে পত্রিকা কিনে চাকুরির খবর আছে কিনা খোঁজ নাও। সোনিয়াকে ফোন করো। বাংলাদেশে তোমার মা-বাবা- ভাই এদের সাথে হাই হ্যালো করো। ব্লকবাস্টারে গিয়ে জর্জোর সাথে দেখা করো। আর দাঁত ব্রাশ করে ফ্রেশ হয়ে বারান্দায় গিয়ে দেখে আসো নিনো আসছে কিনা। এসে থাকলে একটু টাংকি মেরে রেজার সাথে ঘুমাতে যাও
- অসম্ভব। ওর সাথে শোবো না
- চাইলেও পারবা না। গিয়ে দেখো ও আজ দরজা লাগিয়ে দিয়েছে। তোমাকে আজ লিভিং রুমে ঘুমাতে হবে সেই ইজি চেয়ারে। হা হা হা
বাইরে বৃষ্টি আরো বাড়লে রাতে ঠান্ডা পড়বে। এই চিন্তা করেই আমার কেমন শীত শীত করে উঠলো। ওয়াশ রুম থেকে বের হয়েই আমি বারান্দায় গিয়ে দাঁড়াই। আইরিন কী কাজে যেন কিচেনে গিয়েছিল। ইশারা দিলো কখন ঘুমাবো। বাইরে ঠান্ডা তাড়াতাড়ি যেন শুয়ে পড়ি।
নিনোর বারান্দায়ও আঁধার। ওর বসার জায়গাটা ফাঁকা। আমার কী একটু মন খারাপ হয়? বাসার সামনের ফাঁকা জায়গা দিয়ে দূরের যে পাহাড়ি এলাকাটা দেখা যায়, আমি সেদিকে তাকিয়ে থাকি। কতক্ষণ অপেক্ষা করবো বুঝি না। এমন না কেউ আমাকে কথা দিয়েছে আমার জন্য অপেক্ষা করবে। তবুও কেন যেন একটু একটু আমার খারাপ লাগে। ভেতরটায় ব্যথা করে। বারান্দার অন্ধকার জায়গাটা আরো নিকষ অন্ধকার লাগতে থাকে। রাস্তায় কিছুক্ষণ পর পর গাড়ি যাচ্ছে আসছে। রাত হবার কারণেই শব্দ ছাপিয়ে আসছে। নীরবতাকে আরো স্পষ্ট করে দিচ্ছে যেন। খুট করে শব্দ হতেই নিনোর বারান্দায় চোখ যায়। কী আশ্চর্য বুকের ধুকপুকানি কেমন বেড়ে যাচ্ছে। এমন না আমি নিনোর চোখ দেখতে পাচ্ছি, ওকে দেখতে পাচ্ছি। তবুও কেন অদ্ভুত একটা ভালোলাগায় মোহাবিষ্ট হচ্ছি। লিফটের সামনে যেদিন ওর সাথে প্রথম দেখা হয়, ওর চোখজোড়া মনে পড়ে যাচ্ছে। সেই সাথে আবার ওর সাথে সেদিনের মত বেরিয়ে পড়তে সেই সাথে আবার ওর সাথে সেদিনের মত বেরিয়ে পড়তে ইচ্ছে করছে। কেন যেন মনে হচ্ছে আমি বললে ও সত্যিই আমাকে নিয়ে বের হবে কোনো প্রশ্ন করা ছাড়াই। আমার সামনের দিনগুলো কেমন হতে পারে, আমি কোথায় থাকবো শেষ পর্যন্ত আমার মনে এসব নিয়ে কোনো দুশ্চিন্তাই যেন হয় না। বরং মনে হতে থাকে অনন্তকাল আমি এখানে দাঁড়িয়ে থাকতে পারবো। আমি কেন এসব ভাবছি জানি না। এসব ভাবা ঠিক হচ্ছে কিনা তাও জানি না।
- খুব ঠিক হচ্ছে, নুহা। তুমি ভাবো। তোমার ব্রেইনে নিনো একটা অক্সিজেনের মত কাজ করছে। কিছুটা রিলাক্স তোমার প্রাপ্য। ন্যায় অন্যায় আপাতত ভুলে যাও। ভাবনার জগতের সুখ নাও
- সত্যি নুহা?
- একদম সত্যি। নিনোর দিকে তাকাও
রাত আসলেই একটা ঘোরময় সময়। আমার মাতাল হতে ইচ্ছে করে। বাইরের ঠান্ডা বাতাসে আমি কেঁপে কেঁপে উঠি। তবুও হাত বাড়িয়ে বৃষ্টিকে ছুঁই। নিনোও হাত বাড়ায় বৃষ্টিকে ছুঁয়ে দিতে।
- উহু বৃষ্টিকে নয়। নিনো তোমাকে ছুঁয়ে দিচ্ছে বোকা মেয়ে। ওর হাত ধরো। নুহা বলে যায় আমাকে। আমার ভাবতে ভীষণ ভালো লাগে। আমি বারান্দা থেকে মুখ উঁচিয়ে আকাশের দিকে তাকাই। যদি কিছু বৃষ্টি আমার চোখ আর চুলকেও ছুঁয়ে যায়। আমার ভীষণ ঠান্ডা লাগতে থাকে। বৃষ্টির ছাঁটে আমার পা ভিজে যাচ্ছে। নিনো কেন এখনো বারান্দায় বসে আছে। ওকে ভীষণ দেখতে ইচ্ছে করছে। সিগারেটের জ্বলে ওঠা ছাড়া আর কোনো আলোর রেখা স্পষ্ট হয়ে ওঠে না। একবার ইচ্ছে করে বারান্দার আলোটা জ্বেলে দেই। নির্লজ্জ হতে ইচ্ছে করে খুব।
খুব নিচু স্বরে নিনো আমাকে শুভ রাত্রি জানালেও ওকে আমার খুব কাছেই মনে হয়। আমিও ওকে শুভ রাত্রি বলি। ইচ্ছে করে ওকে ফোন দিয়ে সারারাত গল্প করি। আমার মোবাইলটা কী আইরিনদের ঘরে ফেলে এলাম! আমার কোথা থেকে এত সাহস এলো জানি না। নিনোকে বিদায় দিয়ে লিভিং রুমে এসে দরজা আটকে দেই। রুমের হিটার ছেড়ে পিসি অন করি। নিনোকে ফোন করবো ভাবছি কিন্তু ভালো লাগার একটা আবেশে আমার হাত কেমন কাঁপছে। কাঁপা কাঁপা হাতে শেষ পর্যন্ত ওকে ফোনটা আমি করেই ফেলি।
কি বলবো নিনোকে, আমি খুঁজেই পাই না হ্যালো বলা ছাড়া।
- নুহা তুমি বৃষ্টিতে ভিজছিলে কেন?
- ভিজছিলাম না তো!
- দেখলাম যে
- এই অন্ধকারেও দেখতে পেলে
- হুম আমি অন্ধকারেও দেখি। ঘুমিয়ে পড়ো
- আমি তোমাকে আমার একটা পছন্দের জায়গায় নিয়ে যেতে চাই নিনো, যাবে?
- কেন চাও নুহা?
- আমার ভালো লাগবে
- কবে?
- আগামীকাল?
- আমি অপেক্ষা করবো। জানিও।
দীর্ঘক্ষণ আমি বা নিনো কথা বলি না। কথা না বলেও ছুঁয়ে থাকা যায় কী তীব্রভাবেই না টের পাওয়া যায়! আমি কি নিনোকে ভালোবেসে ফেলছি ধীরে ধীরে?
- না বাসছ না। আপাতত তুমি একটা আশ্রয় খুঁজছ। মানসিক আশ্রয়। এটা দোষের না, নুহা। তবে ঘন ঘন বেশি কাছে যেও না নিনোর।
আমি ভেতরের নুহার কথায় আশ্বস্ত হই। একটা ভালোলাগার আবেশে আমার পুরো শরীর কেমন শান্ত হয়ে গেছে নিমিষেই।
শ্রুতি গোস্বামীর গান শুনতে শুনতে আমার চোখ বুজে আসে ধীরে ধীরে -
"বদল তোমার হয়, বদল আমারও
বদলাও কে কতোটা বদলাতে পারো
শুধু বদলায় না আমার এ ঠিকানা
আরশিনগরে আমি বরাবরই থাকি
ও আমার সোনাঝুরি বনের একাকী"
চলবে...