ছফুরনের টুকরো সুখ
মিজানুর রহমান
পাখিরা নিড়ে ফিরছে। পোড়ামাটির গন্ধে ভরা বাতাসে আজানের সু-মিষ্ট সুর ভেসে আসছে। ছফুরন শাড়ির আঁচল টেনে মাথায় দিলো। ফজলু মিয়া বেশ দূর থেকে রিক্সার বেল বাঁজাতে বাঁজাতে বাড়িতে ঢুকলো। ফজলু মিয়াকে অসময়ে আসতে দেখে আঁৎকে উঠে ছফুরন। রান্না ফেলে দু্্রত ছুটে এসে বললো, ওগো মনির বাপ আইজ এতো তাড়াতাড়ি ফিরলা যে! জ্বর বাইড়া গেছে নাকি! নিশ্চুপ থাকে ফজলু মিয়া। ছফুরন ছল ছল চোখে অভিমানের সুরে বলে, সেই সহালে রিক্সা নিয়া বাহির হইছো, কত কইলাম আইজ একটু দেরি কইরা বাহির হও কেডা শুনে আমার কথা? ফজলু মিয়া রিক্সার সিটে বসা। ছফুরন হাত বাড়ায়। রিক্সা থেকে নামিয়ে ফজলু মিয়ার সারা গায়ে হাত বুলাতে বুলাতে ছফুরন বলে, ওগো এ কি অবস্থা তোমার! গা গতর এতো গরম ক্যান! শরীল খুব খারাপ লাগতাছে বুঝি? ফজলু মিয়া কিছু বলতে চাইলো কিন্তু সে সুযোগ না দিয়েই ছফুরন তাকে ঘরে নিয়ে বিছানায় শুইয়ে দিলো। তারপর এক কলস পানি আর বদনা নিয়ে ঘরে ঢুকলো। ফজলু মিয়াকে খাটের ওপর বসা দেখে ছফুরন ধমকের সুরে বলে, কি ব্যাপার উইঠা বসলা যে? একটুও কথা শুন না ক্যান? তারপর গলা নরম করে বলে, মাথায় পানি দিলে দেখবা আরাম লাগবো, শুইয়া পড়। ফজলু মিয়া ছফুরনের হাত থেকে পানির বদনাটা নিয়ে নিচে রাখে। তারপর পাশে বসিয়ে বলে, দেখ ছফুরন, আমার কিছুই হয় নাই। কলসটা রাইখ্যা দেও। বিশ্বাস কর ইচ্ছা কইরাই আইজ তাড়াতাড়ি বাড়িত ফিরছি।
- তাইলে গা গরম ক্যান?
- গা প্রতিদিনই গরম থাহে।
- কই আগেতো কহনো দেহি নাই।
- আগে যহন বাড়িতে ফিরতাম তহন তুমি এই ভাবে কহনো দেহ নাই, তাই বুঝবার পার নাই। তাছাড়া আগেতো রিক্সা থেকে নাইমা গোছল সাইরা ঘরে ঢুকতাম তাই দেহে তাপ থাকতো না।
শংকা কাটলো ছফুরনের। কিন্তু তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার কারণতো জানা চাই। তাই মিষ্টি হেসে ছফুরন বলে, আইজ বুঝি ভালা ভাড়া পাইছো? প্রেমিক-প্রেমিকরা উঠছিলো বুঝি? ফজলু মিয়া হাসে, ওগো না আজ কালকার প্রেমিক-প্রেমিকারা এক টাহাও বেশি দেয়না। হেগো যে পরিমাণে মোবাইলে কথা কওন লাগে তাতে হেগোরে আরও দিলে ভালা হয়।
- তাইলে আইজ কি এমন হইল যে ভাড়া না মাইরা এতো তাড়াতাড়ি বাড়িত ফিরছো?
- রিক্সা চালাইবার সময় আজ দেখছিলাম বড় বাজারের কয়েক যায়গায় ও এম এস চাল, বুঝলা না সরকারী চাল, বিক্রি হইতাছে। চল্লিশ টাহার চাল চব্বিশ টাহায় দিতাছে। আজ যা কামাই করছি তা দিয়া কালকার চাল হইয়া যাইবো। কথা শেষে ফজলু মিয়া কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকে ছফুরনের দিকে। পরে ম্লান হেসে বলে, কত দিন তোমারে সঙ্গ দিবার পারিনা! সেই সহালে বাহির হই আর ফিরি রাইতে। দুই তিনটা মানুষের প্যাটের ভাত জোগাইতেই এতো সময় লাইগা যায়। তারপর দীর্ঘাশ্বাস ছেড়ে বলে, এই দশ বছরে কত মাইনুষরে চড়াইছি এই রিক্সায়। কত প্রেম ভালোবাসা আদর সোহাগ নিজের চোখে দেখছি। যাত্রীগো এ ধরনের আদর সোহাগ দেইখ্যা খুব হিংসা হইতো। ফজলু মিয়া দু‘হাতের মধ্যে ছফুরনের একটা হাত নিয়ে বলে, বিশ্বাস করো ছফুরন মাঝে মধ্যে মনে হইতো ভাড়া না খাইট্টা তোমার কাছে ছুইট্টা আসি। কিন্তু প্যাটের কথা ভাইব্বা আসতি পারি নাই। আর অহন তো একেবারে অসম্ভব। চালের কেজি চল্লিশ টাহা, কাঁচা বাজারে আগুন, তেল আর মাছের দাম আকাশ ছোঁয়া। কবে যে জিনিসের দাম কমবো। একটা দীর্ঘাশ্বাস ছেড়ে ফজলু মিয়া ছফুরনের মুখোমুখি বসে। তারপর দু‘হাত দিয়ে মুখখানি ধরে আবেগ ভরা কন্ঠে বলে, ছফুরন বিয়ার প্রথম দিন গুলানের কথা মনে আছে তোমার? ছফুরন মাথা নাড়ে। মনে পড়ে সে দিনগুলোর কথা। রিক্সায় করে কত যায়গায় ঘুরতো ওরা। প্রতিদিন এক সাথে ঘুরতে যেত বলে শ্বশুর শাশুড়ির কত না বকা খেয়েছে। স্মৃতিপটে ভেসে ওঠে দুষ্টমিভরা দিনগুলো। লজ্জায় লাল হয়ে উঠে ছফুরন। ভাবতে অবাক লাগে এদিক সেদিক কত ঘুরাঘুরি তারপরও পেটের ভাত যোগাতে এতো সময় লাগতো না। অথচ এখন ঘুম ভাঙ্গার পর থেকে শুরু হয় ওর রিক্সার প্যাডেল ঘুরানো আর থামে মাঝরাতে। তার পরও-----। কোথায় যে যাচ্ছে দেশটা, ভাবতে কষ্ট হয় ছফুরনের।
রাত ঘনিয়ে আসছে। আকাশের চাঁদ উজ্জ্বল হয়ে উঠছে। রূপালী চাঁদের আলোয় ঝলমল করছে মাহি চৌধুরীর ফুলের বাগান। ফজলু মিয়া বউয়ের কোলে মাথা রেখে চৌধুরীর বাগানের দিকে তাকিয়ে আছে। ¯^vgxi চুলের মধ্যে আঙ্গুল চালিয়ে আলতোভাবে চুল টানার এক ফাঁকে ছফুরন ফিসফিসিয়ে বলে, দেহ এই বয়সেও চৌধুরী সাহেব বউয়ের লগে দোলনায় চইড়া দোল খাইতাছে। ছফুরন ফজলু মিয়াকে বুকের সাথে চেপে ধরে। ফজলু মিয়া ছফুরনের সারা শরীরে আলতো হাত চালায়। শিশুর মতো আদর উপভোগ করলো ছফুরন। অনাবিল সুখে দুজনের মুখ থেকে একটি শব্দও বের হলো না। ঘরের মধ্যে শুধু নিশ্বাঃসের শব্দ। হঠাৎ জানালা দিয়ে এক ঝটকা বাতাস ঢুকলো। ছফুরনের চুলগুলো উড়ে এসে ঢেকে দিলো ফজলুর মুখ। বাতাসে শাড়ির আঁচল পড়ে গেল। ছফুরন শাড়ি গোজগাছ করতে চাইলো। ফজলু মিয়া বাঁধা দিল। চাঁদের আলোকছটা পড়ছে ছফুরনের শরীরে। ফজলু মিয়া ছফুরনের লুকায়িত সৌন্দর্য হৃদয় দিয়ে উপভোগ করছে আর মনে মনে বলছে হে বাতাস তুমি বার বার এসো ছোঁয়া লাগাও ছফুরনের গায়ে। ফজলু মিয়ার চোখে আজ চৈত্রের উত্তাপ নেই আছে শুধু ভালোবাসা। কাজল টানা চোখ। উর্বর বুক। মেদহীন শরীর। মুক্তো ঝরা হাসি। এমন একটা গোলাপ তার ঘরে অথচ ঘ্রান নেওয়ার ফুসরত হয়না তার। ছফুরন হালকা ধাক্কা দিয়ে আহলাদি কন্ঠে আব্দার করলো, তুমি প্রতিদিন তাড়াতাড়ি বাড়িত ফিরবা। আমি না হয় ও এম এস চাল আনতে যামু।
ফজলু মিয়া ঘরের বারান্দায় বসা। রাগে গজ গজ করছে। সেই দুপুর থেকে না খাওয়া। মনে মনে অনেক কিছু ভাবছে। ছফুরন কি চাল আনতে গিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে? করিম সাহেবের ছেলে প্রায় ওর দিকে কু-নজর দিতো। ছফুরন কি তার সাথে গল্প জমালো? এলোমেলে ভাবনায় ফজলু মিয়ার বুক দুরু দুরু কাঁপছে।
বিকাল পাঁচটা। চালের প্যাকেট হাতে ছফুরন মাথা নিচু করে আসছে। ফজলু মিয়া উঠে দাঁড়ায়, সেই সহালে গেছো আর আসতাছো অহন। কি করতাছিলা এতক্ষন। মাইনুষেও কি গতর দেহাইয়া বেড়াইতাছিলা? রাগে গজ গজ করে কথাগুলো বলছিলো ফজলু মিয়া। ছফুরন উত্তর দেয় না। রিক্সার প্যাডেল ঘুরানো অনেক কষ্টের কাজ তার ওপর ক্ষিধার জ্বালা। পেটে কিছু পড়লে ঠিকই ভালো কথা বলবে। তাই দেরি না করে রান্না শুরু করলো ছফুরন।
খাবার খেতে দিয়ে ছফুরন পাখা দিয়ে বাতাস করে আর বলে, j¤^v লাইন, অনেকে ভোর রাইতে যায়গা ধইরা রাখে, এই জন্য এতো দেরি হইছে। ফজলু মিয়া তাকায় ছফুরনের দিকে। চোখে মুখে ক্ষোভ নাই। খাওয়া শেষে হাত মুছতে মুছতে ফজলু মিয়া বলে, আমাগো ও এম এস চাল দরকার নাই ছফুরন। গরীবের এতো ভালোবাসা থাকতি নাই। ছফুরন কাছে গিয়ে বসে। হাত থেকে গামছা নিয়ে বলে, ওগো কাল একটু তাড়াতাড়ি যাইয়া দেহি সময় মতো পাওয়া যায় কিনা? তুমি আর না কইরো না। ফজলু মিয়া চাঁপা কন্ঠে বলে, আচ্ছা ঠিক আছে, দেহ কি হয়।
অনেক রাত। পৃথিবী প্রায় নিঝুম। ফজলু মিয়া ঘুমিয়ে আছে। ছফুরন বেশ কিছুক্ষন চেয়ে থাকে ফজলু মিয়ার দিকে। ওর ভালো লাগছিলো টুকরো সুখের মুহুর্ত গুলো মনে করে। পা টিপে টিপে জানালার কাছে আসে ছফুরন, তাকায় চৌধুরীর বাগানের দিকে। সব প্রকৃতি সেজেছে নতুন সাজে। পাশের পুকুরে মাছেরা খেলা করছে। চাঁদের আলোয় ঝিলমিল করছে মাছগুলো। সব কিছুই সুন্দর লাগছে আজ। কিছুক্ষন উপভোগ করলো প্রাকৃতিক সৌন্দর্য। তারপর দেওয়ালে টাঙানো চালের প্যাকেটটা হাতে নিয়ে জানালা বন্ধ করলো ছফুরন। এরপর খুব আস্তে আস্তে দরজা খুলে বের হয় বড় বাজারের পথে।
ফজরের আজানে ঘুম ভাঙ্গে ফজলু মিয়ার। ছফুরন পাশে নেই। ভাবে সকালের j¤^v লাইন এড়াতে হয়তো বাথ রুম সারতে গেছে । পাঁচটি রুমের ভাড়াটিয়াদের জন্য একটা মাত্র ল্যাট্রিন। মালিক বেটা বড় হাড় কিপ্টা। কিছুতেই আরেকটা ল্যাট্রিন বানাতে রাজি হয় না। ঘর থেকে বের হলো ফজলু মিয়া। ল্যাট্রিনে কেউ নেই। ঘরের আনাচে কানাচে কোথাও নেই ছফুরন। বেশ দুঃচিন্তায় পড়ে গেল ফজলু মিয়া।
হঠাৎ মনে পড়লো কাল রাতের কথা। ছফুরন বলছিলো একটু তাড়াতাড়ি গেলে সময় মতো ঠিকই চাল নিয়ে ফিরতে পারবে। তাহলে কি ছফুরন বড় বাজারে গেছে? অজানা আশঙ্খায় গা ছমছম করছে ফজলু মিয়ার। দড়ির পরে রাখা শার্টটা এক টানে নামিয়ে গায়ে দিলো ফজলু মিয়া। তারপর হাঁটে বড় বাজারের পথে।
কুয়াশা মাখা মায়াময় ভোর। প্রকৃতি সেজেছে আপন রঙে। পুব আকাশে লালিমা বেড়ে চলছে। বিষণ্ন ফজলু মিয়া হাঁটছে, উপেক্ষিত হচ্ছে প্রকৃতির সাজ । খানিক দুর এগিয়ে রাসা্তর বাম পাশে নজর গেল তার । হাত পা ছড়িয়ে পড়ে আছে এক জন মহিলা । এগিয়ে গেল ফজলু মিয়া । রক্ত মাখা শাড়ি। মুখটা কাপড়ে ঢাকা। কাপড় সরাতেই চমকে উঠে। একি! ছফুরন যে। গলায় ফাঁসের দাগ। দু‘হাত দিয়ে মাথাটা উঁচু করে কোলের ওপর নিল। নিজেকে আর সামলাতে পারলোনা। চিৎকার করে উঠলো, ছফুরনরে কেডা তোর এ সর্বনাশ করলো। আল্লাগো আমার ছফুরনরে কেডা মাইরা ফালাইলো, কি দোষ আছিলো ছফুরনের। মুখে হাত বুলিয়ে ফুপিয়ে উঠে বলে, একটু সুখের লাগি ক্যান বাহির হইছস। অহন আমি কি করমু। ফজলু মিয়ার আর্ত-চিৎকারে বাতাস ভারি হয়ে উঠলো। মসজিদ থেকে মুসল্লিরা ছুটে আসলো। ফজলু মিয়া দু‘হাত আকাশের দিকে তুললো। বুক চাপড়াতে চাপড়াতে বলতে লাগলো, আল্লাগো তুমি আমার ছফুরনরে আমার কাছে ফিরাইয়া দেও।
ফজলু মিয়ার বুকফাটা আর্তনাদে যেন জমিন কেঁপে উঠলো। মাটির ঢিবিগুলো যেন তুলার মতো উড়তে লাগলো। বড় বাজারের উঁচু দালানগুলো যেন মুহুর্তে মিশে গেল মাটিতে।
এস এম মিজানুর রহমান
হাসান লাইব্রেরী
কালীগঞ্জ মেইন বাস স্ট্যান্ড
কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মোবাঃ ০১৯১২ ৩৭৭৭৩২

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




