অনিতা
মিজানুর রহমান
কাল পূর্ণিমা। অথচ জোছনার আলোক-ছটা নেই। ঘন কালো মেঘে পুরো আকাশ ঢেকেছে। সুমিত ছাদে কিছুক্ষন পায়চারী করে ঘরে ফিরলো। হাত মুখ ধুয়ে প্রতিদিনের ন্যায় বসলো কম্পিউটারের সামনে। ইন্টারনেটে অফিসের বেশ কিছু কাজ বাড়িতে বসেই করতে হয় ওকে। দীর্ঘক্ষন ধরে কাজ করার পর ক্লান্ত সুমিত হঠাৎ ইন্টারনেট থেকে অবচেতন মনে একটি মোবাইল b¤^‡i কল দিলো। ওপার থেকে ভেসে আসলো একটি নারীকন্ঠ ।
হ্যালো। নমস্কার। কে বলছেন প্লিজ?
সুমিত উত্তর দিলো না। চুপ করে থাকলো অনেক্ষণ। ওপারের মিষ্টি কন্ঠটি হঠাৎ কর্কশ হয়ে উঠলো,
এতো রাতে ফোন দিয়ে কথা বলছেন না-এটা কোন ধরনের বেয়াদবী? কথাই যদি না বলবেন তবে ফোন দিলেন কেন? এপার থেকে কোন উত্তর না পাওয়ায় প্রচন্ড ক্ষিপ্রতার সাথে বলে চললো-
হ্যালো! বোবা নাকি? কথা বলতে পারেন না? বেয়াদব কোথাকার। এভাবে আর কখনও আমাকে বিরক্ত করবেন না। সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেল। সুমিত চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে দুলছিলো। কিছুক্ষণ পর সোজা হয়ে বসলো। ম্যাসেস পাঠালো সুমিত। ‘সত্যি বলেছেন। আমি আসলে বোবা। কথা বলতে পারি না। আমি জানি আপনি প্রশ্ন করবেন বোবারা আবার কানে শোনে নাকি? আসলে আমি জন্ম থেকে বোবা নই। একটা অ্যাকসিডেন্ট আমার বাক শক্তি কেড়ে নিয়েছে। আমি সুমিত। বাড়ি কুষ্টিয়া। রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়ো কেমিস্ট্রির ছাত্র ছিলাম। এখন একটা ঔষধ কোম্পানীতে কেমিষ্ট হিসেবে চাকরী করি। সে যাক। আমি কি আপনার বন্ধু হতে পারি? সুমিত উত্তরের অপেক্ষায় বসে ছিলো কিছুক্ষণ। নেট থেকে মেসেজ পাঠিয়েছে কথাটা মনে পড়ায় আবার কল দিলো সুমিত।
এবার ব্যথিত কন্ঠে উচ্চারিত হলো, সরি আমাকে ক্ষমা করবেন। আমি না জেনে আপনাকে কষ্ট দিয়েছি। ক্ষমা করবেন প্লিজ। আমি অনিতা। অনার্স ফাইনাল ইয়ারের ছাত্রী। অবশ্যই আপনি আমার বন্ধু হতে পারেন।
তরাতে কাজের ফাঁকে ফাঁকে ম্যাসেস ও ফোন আর অনিতার সাড়া---। এভাবেই সুমিত এক সময় অনিতার কাছাকাছি এসে যায়। সুমিত ¯^v` পায় নতুন এক জীবনের। সে জীবন সম্পূর্ণ ভিন্ন। ভিন্ন অনুভবের, ভিন্ন উত্তেজনার। কী করবে সুমিত? রাতের গভীরতায় অনেক এলোমেলো ভাবনায় কাতর হয়ে পড়ে সুমিত। নিজের বুদ্ধি আর বিবেকের সঙ্গে নিয়ত যুদ্ধও চলতে থাকে তার। কখনো জয়ী হয় কখনও পরাজিত হয়। পরাজয়ে কখনো সে নিশ্চুপ থাকে কখনো থাকতে পারেনা। নিজেকে বুঝে উঠতে তার কষ্ট হয়। অজ্ঞাতে ক্রমে সে এগিয়ে যায় অনিতার দিকে।
রাত দশটা ফোন করলো সুমিত, একবার রিং হতেই অনিতা রিসিভ করলো। অনুরাগের সুরে বলে,
ঔষধের মান নির্ণয়ের গুরু দায়িত্ব, তোমার ওপর, অফিসে ব্যস্ত থাক তাও মানছি তাই বলে কি দিনে একবারও ফোন করা যায় না? সুমিত, লেখে বোবার হাতে ফোন, কল রিসিভ করে শুধু শোনা। সহ কর্মীরা কেমন দৃষ্টিতে নিবে একটু ভেবে দেখ। ‘সরি! কি করবো বলো? সারা দিনে অনেক কথা জমা হয়ে যায় যার অর্ধেটাই ভুলে যাই রাত আসতে আসতে।’ বললো অনিতা। সুমিত জানায় এখন থেকে অফিস থেকে ফেরার পরেই ফোন করবে।
ব্যস্ততার কারনে দিনের বেলায় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকে। তাই অনিতা প্রহর গুনতো রাতের। রাত জেগে কথা বলা। দেরী করে ঘুম থেকে ওঠা, ছোট বোন রোহিতার সাথে ফিসফিসিয়ে কথা বলা কোন কিছুই এড়াইনি অনিতার মায়ের চোখে। সেই ছোট বেলায় বাবাকে হারিয়েছে ওরা। কিন্তু মা প্রমিলা ওদেরকে বাবার অভাব বুঝতে দেয়নি কোন দিন। মেয়ের হঠাৎ পরিবর্তনে বেশ ভাবিয়ে তুলছে তাকে। অনিতা এখন আর সেই ছোট্ট বালিকা নয়। তাই দেরি না করে মা অনিতার সাথে কথা বললো। মেয়ের সাথে কথা বলে মা প্রমিলার দুঃচিন্তা কিছুটা কমলো বটে কিন্তু সুমিতের সাথে কথা বলা প্রয়োজন। সেজন্য মা অনিতাকে বললো সুমিতকে বাসায় নিমন্ত্রন করতে।
অনিতা সুমিতকে ওদের বাড়ীতে আসার নিমন্ত্রন করলো। মা ওর সাথে কথা বলতে চাইছে। কাজেই যত ব্যস্ততাই থাক না কেন যাতে আসতে ভুল না হয়, সে কথা আজ কয়েক বার সুমিতকে স্মরণ করে দিয়েছে অনিতা।
অনিতার আমন্ত্রনে সুমিত ওদের বাড়ীতে যাওয়ার জন্য মনস্থির করলো। এভাবে আর কত দিন। অদেখার যন্ত্রনা ওকে বিদগ্ধ করে। অন্তত একবার দেখা হওয়া দরকার। সুমিত তার আবেগের তীব্রতাকে নিয়ন্ত্রনে এনে যাওয়ার মনস্থির করলো।
বিকাল চারটা। সুমিত অনিতাদের বাসায় পৌঁছাল। কলিং বেল চাপতেই একটি ফুটফুটে মেয়ে দরজা খুলেই লাজুক কন্ঠে বললো আপনি কি সুমিতদা? সুমিত মাথা নাড়ল। মিষ্টি হেসে মেয়েটি বললো, আমি রোহিতা। অনিতার ছোট বোন। দিদি সেই দুপুর থেকে সেজেগুজে বসে আছে আপনার অপেক্ষায়। আসুন দিদির রুমে যাই। সুমিতকে বসতে বলে রোহিতা দ্রুত পায়ে হেঁটে খাটে বসা অনিতার কাছে গিয়ে কানে কানে ফিস ফিসিয়ে বললো, দিদি সুমিতদা! তোমরা কথা বল আমি আসছি। তারপর তড়িৎ বেগে রুম ত্যাগ করলো।
সুমিতের আগমনে অনিতার বুকের ভেতরে বইছে আনন্দের জোয়ার। সেই জোয়ারে ভাসছে কল্পনার তরী। যেটি নোঙ্গর ফেলতে চাইছে সুমিতের হৃদয়ে। অভাবানীয় সুখে ডুবে যেতে যেতে অনিতা টের পায় তার বুকের ভিতরে ¯^h‡Zœ সাজানো ফুলের শয্যায় প্রবেশ করছে সুমিত। এতোটা দিন পর দেখা আজ , অনিতা কি বলবে তাকে না বলা গোপন সব কথা? যে কথাগুলো বলার জন্যই এতো দিনের অপেক্ষা তার। কী করবে কী বলবে কিছুই ভেবে পায়না ।
ঘরের ভেতর তখনও নিস্তব্ধতা, শুধু নিঃশ্বাসের শব্দ। সুমিতকে প্রাণ ভরে দেখতে ধীরে ধীরে মুখ তুললো অনিতা। অপূর্ব সুন্দর! এ যেন মনের ক্যানভাসে আঁকা সুমিতের চেয়ে অনেক সুন্দর সুমিত। লাজুক সুমিত মাথা নিচু করে বসে আসে সোফায়। হালকা গলা ঝেড়ে অনিতা বলে, তোমার আসার দেরি দেখে মা তো বলেই ফেললো তোমার সত্যবাদী সুমিতরা শুধু ফোনেই আসে বাস্তবে আসার সাহস পায় না। জানো মাকে কিছুতেই বোঝাতে পারছিলাম না যে, অন্যরা আর আমার সুমিত এক না। তোমার প্রসংশা মায়ের কাছে একটু বেশিই করে ফেলেছিলাম তাই মা তোমার সাথে দেখা করতে উদগ্রীব হয়ে আছে।
সুমিত মুখ তুলে তাকায় অনিতার দিকে। লাল পেড়ে নীল শাড়ী পরা অনিতা-কপালে রুপালী জরিমাখা নীল টিপ। অপূর্ব সুন্দর। আরো বেশি সুন্দর সুমিতের চোখে। সুমিত অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে রইলো অনিতার দিকে। খুব জোরে ওর বলতে ইচ্ছে তুমি সুন্দর অনেক সুন্দর-পৃথিবীর সব সুন্দরের রানী তুমি। প্রায় মুখফসকে বেরিয়ে আসছিলো কথাগুলো। তড়িৎ সামলে নিল নিজেকে । কারন শুধু অনিতার কাছে ও বাকরুদ্ধ সুমিত। তারপরও কথা বলতেই হবে জানাতে হবে আসল সত্য। সুমিত উঠে দাঁড়ায়। কাঁপা কাঁপা ¯^‡i সুমিত বলে, তোমার অসম্ভব আকাঙ্ক্ষার কাছে নিজের একটা প্রসঙ্গ ঠাঁই পায়নি কোন দিন যা বলবার জন্য আজ এসেছি। সুমিত কথা বলছে! অনিতা অবাক বিষ্ময়ে তাকিয়ে আছে সুমিতের দিকে। সুমিত অনিতার দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে বলে চলে, আমি আসলে বোবা নই। আমি বিবাহিত। আমি তোমার সাথে প্রতারনা করেছি। সরি! আমাকে ক্ষমা করো বন্ধু। সুমিতের চোখ বেয়ে ফোঁটা ফোঁটা জল গড়িয়ে পড়ছে। ছল ছল চোখে ভেসে উঠছে সন্তানের মুখ। মনে পড়ছে স্ত্রীর সাথে কাটানো প্রথম যৌবনের কিছু উচ্ছল সময়, কিছু স্মৃতি। সুমিত কাতর হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে বেরিয়ে পড়ে বাড়ির উদ্দেশ্যে।
নাস্তার প্লেট হাতে মা ও রোহিতা রুমে আসলো। সুমিত নেই। অনিতার চোখে জল। মায়ের হাত থেকে প্লেট পড়ে গেল। রোহিতা ছুটে গেল অনিতার কাছে। অনিতা বালিশের পাশে রাখা একটা চিঠি বাড়িয়ে দিলো রোহিতার দিকে।
এস এম মিজানুর রহমান
হাসান লাইব্রেরী
কালীগঞ্জ মেইন বাস স্ট্যান্ড
কালীগঞ্জ, ঝিনাইদহ।
মোবাঃ ০১৯১২ ৩৭৭৭৩২
...

অনুগ্রহ করে অপেক্ষা করুন। ছবি আটো ইন্সার্ট হবে।




