somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

গল্পঃ পরাবাস্তব প্রতিবিম্ব

১৫ ই আগস্ট, ২০১৩ দুপুর ১:৪৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


শিহাবের ট্রেন ভাগ্য খুবই খারাপ। তার সিট সবসময় এমন জায়গায় পড়ে, যেখানটায় লোক চলাচল একটু বেশি। ট্রেন কোন স্টপেজে থামলেই গিজগিজ করে লোক ওঠে এবং পাশ কাটিয়ে যাবার সময় কনুইয়ের গুতা খেতে হয় তাকে। আর জানালার পাশে তো কখনোই সিট পড়ে না ওর। যদিও বা ভুলে কখনো পড়ে-ই, তাহলে দেখা যায় জানালার শাটার নষ্ট। অনেক ঠেলাঠেলি করেও উপরে ওঠানো যাচ্ছে না।
কিন্তু এবার ঈদের ছুটিতে বাড়ি যেতে গিয়ে অদ্ভূতভাবে খুব ভাল একটা সিট পেয়ে গেল শিহাব। সিটটা ট্রেনের মাঝামাঝি জায়গায়, জানালার পাশে। না, জানালার শাটারেও কোন সমস্যা নেই। সবকিছু ঠিক ঠাক। শিহাব মনে মনে বেশ খুশী হয়ে উঠল! ব্যাগটা উপরে তুলে রেখে বেশ আরাম করে জানালায় কনুই তুলে দিয়ে বসে পড়ল। যদিও ট্রেন ছাড়েনি এখনও, কিন্তু বেশ বাতাস বইছে। আকাশে মেঘও নেই আবার রোদও নেই। কে জানে বৃষ্টি হবে কি না।
ট্রেন ছাডতে এখনও পনের মিনিট বাকি, তাই শিহাব ব্যাগ থেকে একটা উপন্যাস বের করল। আর্নেস্ট হোমিংওয়ের "আ ফেয়ারওয়েল টু আর্মস"। শিহাবের অত্যন্ত প্রিয় বই। বইয়ে মুখ ডুবিয়ে দিল শিহাব।

দশ মিনিট যেতে না যেতেই একটা মেয়েলী সুরেলা রিনিরিনি কন্ঠ বলে উঠল,"এক্সকিউজ মি, শুনছেন?" কন্ঠটা শুনে কান জুড়িয়ে গেল শিহাবের। অতিমাত্রায় সুরেলা কন্ঠ। বাংলায় এই ধরণের কন্ঠের একটা সুন্দর নাম আছে, কিন্নরী কন্ঠ।
শিহাব বই থেকে মুখ তুলে কন্ঠের অধিকারিণীর দিকে তাকাল।
পরীর মতন সুন্দর একটা মেয়ে হাতে ভারী একটা স্যুটকেস নিয়ে দাড়িয়ে আছে। শিহাব ফিরে তাকাতেই বলল,"আপনার সিট নম্বর কি B-32 ?"

"জ্বী।"

"আপনার পাশের সিটটাই আমার। কিছু মনে না করলে আপনি কি এ পাশের সিটে বসবেন? আমার আসলে জানালার পাশে না বসলে অসুস্থ লাগে...।"

"জ্বী,অবশ্যই।"

সুন্দরী মেয়েটার মুখের দিকে তাকিয়ে সিটটা ছেড়ে দিতে একটুও দ্বিধা করল না শিহাব। তবে মেয়েটা তখনই সিটে না বসে স্যুটকেসটা ঠেলেঠুলে উপরে তুলে দিতে লাগল। ভারী স্যুটকেস, সহজে ঢুকতে চাচ্ছিল না ভিতরে। শিহাব সাহায্য করতে এগিয়ে এল।
"আপনি বসুন, আমি তুলে দিচ্ছি।"
"থ্যাংকস!" কাষ্ঠ হাসি হেসে সিটে বসে পড়ল মেয়েটা।
ট্রেন ছাডতে তের মিনিট লেইট করল। যদিও তাতে যাত্রীদের কোন অভিযোগ দেখা গেল না।
শিহাব বই পড়ছে, আর পাশে বসা মেয়েটা কানে হেডফোন লাগিয়ে গান শুনছে। ওদিকে ট্রেনের গতির সাথে তাল মিলিয়ে মেঘ জমতে শুরু করেছে আকাশে। এক ঘন্টা যেতে না যেতেই মেঘের বুক চিড়ে বড় বড় বৃষ্টির ফোঁটা পড়তে শুরু করল। রিমঝিম বর্ষা শুরু হতেই পাশের মেয়েটা "এ মা" বলে দ্রুত উঠে দাড়াল। চটপট জানালার শাটার নামিয়ে দিতে চাইল। কিন্তু বিধিবাম! অর্ধেক নেমেই আটকে গেল জানালাটা। অনেক ঠেলাঠেলি করেও আর পুরোপুরি বন্ধ করা গেল না। অগত্যা ঐ অবস্থায়ই বসে রইল মেয়েটা। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছিল তার জামা কাপড়। বাধ্য হয়ে একটু সরে বসতে হল শিহাবের দিকে। মেয়েটা এবং শিহাব, দু'জনেই বিব্রতবোধ করছিল এভাবে গাদাগাদি হয়ে বসায়। বিব্রতবোধটা আরো বাড়িয়ে দিতেই বোধহয় পকেটে ভাইব্রেট মুডে রাখা মোবাইল ফোনটা বেজে উঠল শিহাবের। কিন্তু মেয়েটা এমনভাবে সেঁটে আছে গায়ের সাথে, যে মেয়েটাকে ডিস্টার্ব না করে কোনভাবেই মোবাইলটা বের করা সম্ভব নয়। আবার দু'জনের মাঝখানে অতিরিক্ত ভাইব্রেশনটাও বেশ অস্বস্তিকর।
একসময় মেয়েটাই এগ্রেসিভ হয়ে বলল, "মনে হয় আপনার ফোন বাঁজছে।"
শিহাব মলিন হেসে বলল, "ওহ, আই সি!"
ফোন হাতে নিয়ে দেখল, রিমা ফোন করেছে। সব্বনাশ! আগেও ৯ টা মিসড কল। সবগুলো রিমার। আজকে শিহাবের কপালে বোধহয় জব্বর ঝাড়ি আছে।
"হ্যালো রিমা? সরি, সরি, সরি....!

রিমা ওপাশ থেকে বেশ রাগত স্বরেই বলল, "হোয়াট সরি? একঘন্টা ধরে ফোন দিয়ে যাচ্ছি, ধরোনি কেন? কই তুমি? ট্রেনে উঠেছ? কোন অসুবিধা হয়নি তো? ট্রেন কোন স্টেশনে এখন?...."
"ওরেবাপ্পস! এত্ত প্রশ্ন? হ্যা, ট্রেনে উঠেছি সেইফলি। ফোন ধরিনি কারণ আমার পাশে একটা সুন্দরী মেয়ে বসে আছে। ওর সাথে গল্প করছিলাম তাই তোমার ফোন ধরতে ইচ্ছে হয়নি।"
"কি? কোন সুন্দরী মেয়ে? তোমার সেই ক্লাসমেট না তো? নাকি....."

"রিল্যাক্স রিমা! ফাজলামো করছি।"

টুকটাক খুনসুটি, মান-অভিমান আর কেয়ারিং কথাবার্তা শেষে রিমা ফোন রাখল।ফোন রাখার আগে আগে একরাশ উপদেশ দিল অবশ্য, "এই খবরদার, বৃষ্টিতে ভিজবে না কিন্তু। বৃষ্টিতে ভিজলেই তো তোমার জ্বর বেঁধে যায়।.... পৌঁছেই ফোন করবে।...আর একদমই সিগারেট ফুঁকবে না .....!" ব্লা ব্লা ব্লা!!!
ফোন রাখতেই পাশে বসা মেয়েটা মিষ্টি করে হাসল।

"আপনার গার্লফ্রেন্ড বুঝি?"

অসহায় মুখ করে কাঁধ ঝাকাল শিহাব, "হ্যা!"

শিহাবের ভঙ্গী দেখে হেসে ফেলল মেয়েটা। বাহ, হাসলে গালে টোল পড়ে মেয়েটার! আর টোল পড়লেই চেহারার সৌন্দর্য্য লাফ দিয়ে কয়েক ডিগ্রী বেড়ে যায় আপনা-আপনি।
"বাই দা ওয়ে, আমি শিহাব, আপনি?"

"আমি সেতু।"
ঠিক সেই মূহুর্তে ট্রেন একটা সেতুর উপর দিয়ে গেল। কান ঝালাপালা করা শব্দে শিহাব বুঝতে পারল না মেয়েটার নাম।
"সরি, কি বললেন? নীতু?"

"সেতু! দা ব্রিজ!!"

হেসে উঠল দু'জন।
"তো সেতু, ঈদের ছুটিতে বাড়ি যাচ্ছেন বুঝি?"

"ঠিক বাড়িতে না, এক কাজিনের বিয়েতে যাচ্ছি।"

"ওহ, আই সি! আমি অবশ্য বাড়িতেই যাচ্ছি।"

"প্রায়ই যাওয়া হয়?"

"আরে না। গ্রাজুয়েশন করে মাত্র চাকরীতে ঢুকলাম। এখনই ঘন ঘন বাড়িতে গেলে চাকরী থাকবে?"

"হুম! কিসে গ্রাজুয়েশন করলেন?"

"কম্পিউটার সায়েন্সে, ঢাকা ইউনিভার্সিটি থেকে।"

মেয়েটা নড়েচড়ে বসল।
"রিয়েলি? এ বছরই গ্রাজুয়েশন করলেন?"

"না, গতবছর, কেন?"

"আরে, তাহলে তো আপনি আমার সিনিয়র ভাই! আমিওতো ঢাবিতে পড়ছি কম্পিটার সায়েন্সে!"

"তাই নাকি? বাহ! কোন সেমিস্টারে পড়ছ? তুমি করেই বলি, কিছু মনে করো না।"

"অবশ্যই তুমি করে বলবেন ভাইয়া! আপনার চেয়ে বেশ জুনিয়র আমি। থার্ড সেমিস্টার চলছে মাত্র।"

"ও আচ্ছা! তার মানে আমি ক্যাম্পাস ছেড়ে দেওয়ার পরপরই তুমি ঢুকেছ।"

কথায় কথায় বেশ কেটে যেতে লাগল সময়টা। শিহাবেরও ভাল লাগল এতদিন পর নিজের বিশ্ববিদ্যালয়ের কাউকে পেয়ে। কথায় কথায় কিছুটা নস্টালজিয়াও পেয়ে বসল। চাকরী জীবনের ব্যস্ততায় ইউনিভার্সিটির উচ্ছল দিনগুলোর কথা রোমন্থন করার সময় কই?

একসময় রিমার কথাও উঠল।

"রিমা আপু খুব বকে বুঝি আপনাকে?"

"বকে মানে? ঝাড়ির উপর রাখে সারাক্ষণ। পান থেকে চুন খসবার জো নেই!"

দু'জনের কথার মাঝে হঠাৎ প্রচন্ড ব্রেক কষে দাড়িয়ে গেল ট্রেনটা। ট্রেন প্রথমে একটু ঝাঁকি খেল, তারপর স্বাভাবিকের চেয়ে বেশ দ্রুত গতি কমে আসতে লাগল। থেমে গেল একসময়।

"কি হল ভাইয়া?"
"বুঝতে পারছি না সেতু, এটা তো কোন স্টেশনও নয়।"

আসলেই একটা নির্জন জায়গা। একপাশে দিগন্ত বিস্তৃত শস্য ক্ষেত,আরেক পাশে একটা বিশাল দীঘি,কিছু ঝোপঝাড় । একটা বড়সড় তালগাছের নিচে দাড়িয়ে আছে একটা ভাঙাচোরা টঙের মত চায়ের দোকান।
যাত্রীরা হৈ-হুল্লোর শুরুকরে দিয়েছে। কি কারণে ট্রেন থামল জানতে উৎসুক সবাই। এক মায়ের কোলে ঘুমন্ত বাচ্চা জেগে উঠে ট্যা করে কান্না জুড়ে দিল। বাইরে বৃষ্টিও থেমে গেছে। সব মিলিয়ে নরক গুলজার।

"শিহাব ভাই, কিছু বুঝতে পারছেন?"

শিহাব হেসে বলল,"এটুকু বুঝতে পারছি যে ট্রেনে ডাকাত পড়েনি।"

সেতু জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে বলল,"ডাকাত পড়লে অবশ্য মন্দ হয় না, ডাকাত দেখার খুব শখ আমার।"

শিহাব স্থির হয়ে গেল। মাথা ঘুরে উঠল ওর। ঠিক এই ভঙ্গীতে এই কথাগুলো কেউ ওকে আগেও বলেছে, কিন্তু কে বলেছে ঠিক মনে করতে পারল না ও।
"...আমার খুব শখ ডাকাত দেখার..." কত পরিচিত উচ্চারণ! কিন্তু কোথায় শুনেছিল কথাগুলো? আর অমনভাবে মাথাটাই বা কেন ঘুরে উঠল?

সেতু চমকে উঠল শিহাবের দিকে তাকিয়ে।

"আপনাকে এমন দেখাচ্ছে কেন? আপনি ঠিক আছেন তো?"
শিহাব হেসে বলল,"ঠিক আছি। ট্রেন থামল কেন সেটা নিয়ে ভাবছি।"

শিহাবের ভাবনার অবসান ঘটাল ট্রেনের এক কর্মচারী এসে।

"...আমরা আন্তরিকভাবে দুঃখিত। ট্রেন এক ঘন্টা লেট করবে। ইঞ্জিনে সমস্যা দেখা দিয়েছে।..."

সেতু দাঁত দিয়ে নখ কাটতে কাটতে বলল, "এক ঘন্টা লেট? তার মানে চিটাগাং পৌঁছুতে পৌঁছুতে প্রায় সন্ধ্যা হয়ে যাবে।"
"অসুবিধা নেই, বেশি রাত হলে আমি তোমাকে পৌঁছে দেব বাসায়।"

সেতু শিহাবের দিকে তাকিয়ে মিষ্টি করে হাসল। বলল,"শিহাব ভাই, এক ঘন্টা ট্রেনে বসে থাকবেন? চলেন, এক কাপ চা খেয়ে আসি।"

শিহাব ব্যঙ্গাত্মক সুরে বলল,
"চা? এই নো ম্যান'স ল্যান্ডে তুমি চা পাবে কোথায়?"

"আরে, ঐ যে তালগাছটার নিচে দেখেন। একটা ঝুপড়ির মতো চায়ের দোকান দেখা যাচ্ছে।"

শিহাব জানালা দিয়ে উকি দিয়ে দেখল দোকানটা। খুবই নড়বড়ে চেহারার একটা দোকান। মনে হচ্ছে দোকানের চালে একটা নাদুস নুদুস সাইজের কাক বসলেও টালিটা হুরমুর করে ভেঙে পড়বে।

"এই দোকানে চা খাবে তুমি? কোন ভদ্রমহিলার চা খাওয়ার জন্য উপযুক্ত জায়গা নয় এটা। গিয়ে দেখবে একদঙ্গল চাষা-ভূষা মানুষ বিচ্ছিরি ভাবে পান খেয়ে দাঁত লাল করে বসে আছে, এখানে ওখানে পানের চিক। শস্তা বিড়ির গন্ধে আকাশ-বাতাস ভারী...!"
সেতু শিহাবের বাহুতে আলতো করে চাটি মেরে বলল, "থামেন তো শিহাব ভাই। এইসব জায়গায় চা খাওয়ার অভ্যেস আছে আমার। কি জানেন? শাহবাগ থেকে গুলিস্তান পর্যন্ত এমন কোন টঙ নেই, যেখানে আমি কখনো চা-ঝালমুড়ি-ফুঁচকা খাইনি।"

"রিয়েলি? সবগুলো টঙে গিয়েছ?"

"সব্বগুলো! কানে কানে বলি শুনুন..." সেতু ফিসফিস করে বলল, "...একবার বন্ধুদের সাথে বাজি ধরে সিগারেটও খেয়েছিলাম...হি হি হি!"

শিহাবের মাথাটা আবার ঘুরে উঠল ভীষণভাবে। সিগারেট খাওয়ার কথা শুনে নয়, অন্য কারণে! "...বাজি ধরে সিগারেটও খেয়েছিলাম..." এই কথাগুলো ঠিক এইভাবে কেউ ওকে বলেছে আগেও। ঠিক একই ভঙ্গীতে। এমনকি খিলখিলে হাসিটাও শিহাবের কাছে অত্যন্ত পরিচিত ঠেকল। রিওয়াইন্ড করা টেপ-রেকর্ডারের মতই কথাগুলো বাজতে থাকল শিহাবের কানে।

কি হচ্ছে শিহাবের সঙ্গে? এমন কেন হচ্ছে? শিহাব সর্বস্ব বাজি ধরে বলতে পারবে সেতুর সঙ্গে আজকের আগে কখনো দেখা হয়নি ওর। তাহলে মাঝেমধ্যেই সেতুর কথা, হাসি, কথা বলার ভঙ্গী এত চেনা চেনা লাগছে কেন?

ওর চমক ভাঙল সেতুর কথায়,"আরে ভাইয়া, এত কি ভাবছেন? চলেন তো চা-টা খেয়ে আসি!"

শিহাবের হাত ধরে একরকম জোর করেই ট্রেনের দরজার কাছে নিয়ে এল সেতু। দরজায় দাড়াতেই ঝড়ো হাওয়ায় ঝাপটা লাগল চোখেমুখে। বৃষ্টি নেই, কিন্তু আকাশে মেঘ জমেছে ভীষণ। যে কোন সময় ঝুম বৃষ্টি নামতে পারে।

"দেখো সেতু, কেমন মেঘ করেছে আকাশে। বৃষ্টি নামতে পারে। এই সময়ে চা খেতে যাওয়া কি ঠিক হবে?"

সেতু কিছু একটা বলার জন্য মুখ খুলল। কিন্তু কিছু বলার আগেই ভীষণরকম চক্কর দিয়ে উঠল শিহাবের মাথাটা। কে যেন মাথার ভিতর থেকে বলে উঠল-"...বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চা খাওয়ার মজাই আলাদা, মাথার উপর ঠান্ডা বৃষ্টির পরশ, মুখে গরম চা। অন্যরকম অনুভূতি! মাঝেমধ্যে এক ফোঁটা-দু'ফোঁটা বৃষ্টির পানি মিশে যাবে চায়ের কাপে। স্বর্গীয় স্বাদ হবে চায়ে...।"

শিহাব জোরে মাথা ঝাঁকি দিল। পরিস্কার হয়ে গেল মাথাটা। সেতু ওকে কি যেন বলছে। শিহাব শুনতে লাগল-
"বৃষ্টি নামলে ভয় কি ভাইয়া? কি জানেন? বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চা খাওয়ার মজাই আলাদা, মাথার উপর ঠান্ডা বৃষ্টির পরশ, মুখে গরম চা। অন্যরকম অনুভূতি! মাঝেমধ্যে এক ফোঁটা-দু'ফোঁটা বৃষ্টির পানি মিশে যাবে চায়ের কাপে। স্বর্গীয় স্বাদ হবে চায়ে।"

শিহাব কিছু ভাবতে পারছিল না। বুদ্ধি ঘোলা হয়ে যাচ্ছিল বারবার। কি হচ্ছে ওর সাথে কিছুই বুঝতে পারছে না।

তালগাছের নিচে এসে ওরা দেখল, দোকানটা একদম ফাঁকা। ওরা ছাড়া আর কোন কাস্টমার নেই। দোকানে পনের-ষোল বছরের এক কিশোর বসে আছে গালে হাতে দিয়ে। সেই সম্ভবত দোকানী।
সেতু গিয়ে বলল, "ভাইয়া, দু'টো চা দাও তো। লিকার বেশি দেবে, চিনি কম।"

দোকানের সামনে একটা নিচু টুলে বসে বসে চা খেতে লাগল শিহাব আর সেতু। টুলটার একটা পায়া অর্ধেক ভাঙা। ইট দিয়ে এডজাস্ট করা হয়েছে ভাঙা পায়াটাকে।

"চায়ে শব্দ করে চুমুক দিতে কেমন লাগে আপনার শিহাব ভাই?"

সেতু নিজেও শব্দ করে চায়ে চুমুক দিচ্ছিল। সে কারণেই হয়ত প্রশ্নটা করল সে।

"খুবই বিচ্ছিরি লাগে।"

"ধূর, দুনিয়ার সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং জিনিসগুলো আপনার কাছে বিচ্ছিরি লাগে। আচ্ছা, আপনার ভাল লাগে কি করতে?"

"গান শুনতে অনেক ভাল লাগে, বই পড়তে ভাল লাগে, তবে সবচেয়ে ভাল লাগে লেখালেখি করতে।"

"লেখালেখি করতে? আপনি কি লেখক?"

"ঠিক তা- না! লেখক আর হতে পারলাম কই? মাঝে মধ্যে পত্র-পত্রিকায় একটা দু'টো গল্প-কবিতা লেখি!"

"রিয়েলি? আপনি আগে বলবেন না। লেখক মানুষদের আমার খুব পছন্দ। খুব সাধারণ বিষয়গুলোকেও অসাধারণভাবে দেখতে পারেন লেখকরা। তাই না?"

"হ্যা, সত্যিকার লেখকরা নিশ্চয়ই পারেন। আমি পারি কি না জানি না। আমি খুবই নিচুস্তরের লেখক।"

ঠিক এই সময়ে কাছেকোথাও বিকট শব্দে বজ্রপাত হল।আকাশ ভেঙে বৃষ্টির বড় বড় ফোঁটা পড়তে শুরু করল। আরো দু'টো বজ্রপাত হল ধারে কাছে কোথাও।

"সেতু, তোমার বজ্রপাতের শব্দে ভয় করে না?"

"আরে না! বজ্রপাতের শব্দ আমার খুব ভাল লাগে। কারণ মনে হয়...।"

সেতুর কথা কেড়ে নিয়ে শিহাব বলল,"কারণ মনে হয় বজ্রপাত তোমাকে কাছে ডাকছে। বলছে, দেখো তোমার জন্য স্নানের জল এনেছি আমি। তুমি কই? এসো, ভিজে যাও। ধুয়ে ফেল সমস্ত পাপ, মুছে ফেল মনের কালিমা...!"

"আরে আরে আমি তো ঠিক এই কথাগুলোই বলতে যাচ্ছিলাম!"

"আচ্ছা সেতু, তোমার কি মনে হয় না যে আমাদের আগে কখনো দেখা হয়েছে?"

"না তো। কেন মনে হবে?" "আচ্ছা বাদ দাও তো, বৃষ্টিতে ভিজে ভিজে চা খাওয়ার কথা বললে না? চলো, ভিজি।"
সেতু লাফ দিয়ে উঠে দাড়াল। বৃষ্টির মধ্যে নেমে গেল এক পা দু'পা করে। চোখ বন্ধ করে আকাশের দিকে মুখ করে দাড়াল। পাশে এগিয়ে এল শিহাব!
বৃষ্টির ফোঁটাগুলো চোখেমুখে পড়ায় অদ্ভূত সুন্দর দেখাচ্ছে সেতুকে। শিহাব মুগ্ধ চোখে দেখতে লাগল। ট্রেনের যাত্রীরাও জানালা দিয়ে উকি মেরে ওদের দেখছিল। তাদের চেহারায় ছিল বিস্ময়।
এক ঘন্টা লেট করার কথা ছিল ট্রেনের। কিন্তু ট্রেন ছাড়ল ৪৩ মিনিট পরে-ই।

চিটাগাং খুব একটা দূরে ছিল না। ফিরতি পথে তেমন কথা হল না দু'জনের। সেতু অবশ্য একা একা অনেকক্ষণ বকবক করছিল। কিন্তু যখন বুঝতে পারল শিহাব ঘুমিয়ে পড়েছে, তখন চুপ মেরে গেল।
ট্রেনে চট্টগ্রামে পৌঁছল বিকেল পাঁচটায়। বিচ্ছিন্ন হবার সময় হয়ে এসেছে। কারণ সেতু যাবে চট্টেশ্বরী রোড আর শিহাব যাবে আগ্রাবাদ। দু'জন দু'টো ট্যাক্সি ক্যাব নিল। সেতুর ভারী স্যুটকেসটা ক্যাবে তুলে দিল শিহাব।
"সেতু, এখন দু'জন দু'দিকে যাব। আজকের মত বিদায়।"

"হুম, ট্রেনে কম্পানী দেওয়ার জন্য থ্যাংকস ভাইয়া। ঢাকায় ফিরবেন কখন?"

"বেশি দেরি হবে না, এই সপ্তাহখানেক থাকব এখানে।"
"ঢাকায় আপনাদের বাসা কোথায়?"

"কলাবাগানে। কখনো ওদিকটায় এলে অবশ্যই দেখা করো।"

"ঠিক আছে। আপনিও ক্যাম্পাসে এলে দেখা করতে ভুলবেন না। রোকেয়া হলে থাকি আমি।"

"আচ্ছা|"

*** *** ***
শিহাবদের বাড়িটা আগ্রাবাদের সিডিএ এলাকায়, তের নম্বরে। রাত এগারোটার দিকে এলাকাটা প্রায় নির্জন হয়ে যায়।
এই মূহুর্তে ল্যামপোস্টের নিচে কুন্ডলী পাকিয়ে বসে আছে একটা কুকুর। ওটা ছাড়া আর কেউ নেই রাস্তায়।
পাঁচতলার বারান্দায় দাড়িয়ে সিগারেট ফুঁকতে ফুঁকতে কুকুরটাকে দেখছিল শিহাব। তাকিয়ে আছে ঠিকই,কিন্তু ঠিক দেখছে না। মাথায় অন্য চিন্তা। সেতুকে নিয়ে ভাবছে শিহাব। আজকের ঘটনাগুলো নিয়েও ভাবছে। সেতুর কথা, এটিটিউড, গল্প বলার ভঙ্গী এই বিষয়গুলো খুব বেশি পরিচিত শিহাবের, অথচ সেতুকে এর আগে জীবনে কখনো দেখেনি, তাহলে? এই ঘটনাগুলো যদি ওর সাথে না হয়ে কোন হিন্দি সিনেমায় ঘটত, তাহলে ধরে নিত, পুনর্জন্ম নিয়ে কোন গল্প দাড় করানো হয়ছে। কিন্তু একে তো ও হিন্দু নয়, দ্বিতীয়ত ওর চিন্তা ভাবনা অনেকটা নাস্তিক টাইপের, কোন কিছু সহজে বিশ্বাস করতে চায় না। তাই আজকের ঘটনাটাকে অতিপ্রাকৃত হিসেবে ধরে নেওয়ার প্রশ্নই আসে না।
সবকিছুর পিছনেই কারণ আছে, লজিক আছে।
লজিক? আচ্ছা, এটা প্যারাসাইকোলজিক্যাল কোন ঘটনা না তো? সেক্ষেত্রে তো ভাল কোন সায়কায়াট্রিস্টের সাথে দেখা করা দরকার। হঠাৎ রিমার কথা মনে পড়ল ওর। আরো আগেই মনে পডা উচিত ছিল অবশ্য!
রিমা ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি নিয়ে পড়ছে। পড়াশোনাও শেষ পর্যায়ে। নিশ্চয়ই ও কিছু না বলতে পারবে ঘটনাটা শুনলে।
রিমাকে ফোন করল শিহাব।

"শিহাব তুমি? সেই ন'টার সময় না ঘুমুতে যেতে বললাম? সারাদিন জার্নি করে আবার রাত জাগছ কেন? নিশ্চয় সিগারেট ফুঁকছ...."
"উফফ! বাদ দাও তো রিমা। কিছু ইম্পরট্যান্ট কথা ছিল তোমার সাথে।"

"শুনছি, বলো!"

সবিস্তারে পুরো ট্রেনের ঘটনাটা বলল শিহাব। সেতুর প্রতিটি আচরণ ব্যাখ্যা করল। শেষে বলল,
"এখন বলো রিমা, আমার সাথে আসলে কি ঘটছে?"
রিমা কিছুক্ষণ চুপচাপ ভাবল। তারপর বলল, "অনেকভাবে ব্যাখ্যা দেওয়া যায় এসব ঘটনার। যেমন- তুমি প্রচুর লেখালেখি করো। লেখালেখি করতে গেলে হিউম্যান ক্যারেকটারিসটিকস সম্পর্কে খুব ভাল ধারণা চলে আসে। সেতু যখন তোমার সাথে ট্রেনে বসে গল্প করছিল, তখনই সেতুর চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য, পছন্দ-অপছন্দ ইত্যাদি সম্পর্কে তোমার অবচেতন মন একটা ধারণা পেয়ে গিয়েছিল। তাই কোন কথার উত্তরে কি বলবে সেতু, কোন বিষয়ে তার পছন্দ-অপছন্দ কি হবে সেটা আগে থেকে অবচেতনভাবে এজিউম করে নিয়েছিলে তুমি। সে কারণেই সেতুর কথাগুলো তোমার কাছে পরিচিত মনে হয়েছে। কিছু কিছু বিষয় কাকতালীয় ভাবে মিলে গেছে, আর কিছু কিছু বিষয় তোমার অবচেতন মন আগে থেকে হিসেব করে বের করে ফেলছে। সব মিলিয়ে তোমার মনে হয়েছে যে, মেয়েটা তোমার পূর্ব-পরিচিত।"

শিহাব মনে মনে রিমার কথাগুলো নেড়েচেড়ে দেখল। দূরে বসে ব্যাখ্যা দেওয়া যতটা সহজ, এক্সপেরিয়েন্স করা ততটা সহজ নয়। রিমার ব্যাখ্যা মেনে নেওয়া যায় না, কারণ শিহাবের সেই সময়ের অনুভূতিগুলো শুধু শিহাবই জানে। তবে ব্যাখ্যা যদি থেকেই থাকে, রিমার ব্যাখ্যাটাই সবচেয়ে গ্রহণযোগ্য।

রিমার সাথে কথা বলার পর শিহাব আরো গভীর চিন্তায় ডুবে গেল।


*** *** ***
দু'মাস কেটে গেছে। শিহাব অফিসের কাজ নিয়ে খুব ব্যস্ত। সেতুকে নিয়ে চিন্তা ভাবনা করার ফুরসত নেই।

অন্যান্য দিনের চেয়ে আজকে অফিসে কাজের চাপ একটু বেশি-ই ছিল। বিকেলের দিকে অফিস শেষে শিহাব যখন ঘরে ফিরল,তখন ও ভীষণ ক্লান্ত। বাসায় ঢুকেই ড্রয়িং রুমের সোফায় গা এলিয়ে দিল। গলার টাই ঢিলে করে যেই না একটু চোখ বুজেছে,অমনি জ্যান্ত হয়ে উঠল পুরো বাড়িটা।

"হ্যাপি বার্থ ডে টু ইউ, হ্যাপি বার্থ ডে টু ডিয়ার শিহাব...।"

চমকে উঠে চোখ খুলল ও,রীতিমত বার্থডে পার্টি মনে হচ্ছে!

কলাগাবাগানের বাড়িটা শিহাবের খালুর। খালা-খালুর সাথে থাকে শিহাব। রিমা আর শিহাবের খালাত ভাই-বোন সবাই মিলে শিহাবের জন্মদিনে সারপ্রাইজ পার্টি দিয়েছে। পরিবারের সবার সাথে রিমার আবার খুব ভাব।

যাই হোক, শিহাব হঠাৎ এমন একটা সারপ্রাইজ পার্টি পেয়ে কিছুটা ভ্যাবাচাকা খেল। তবে তারপরেই শরীরের ক্লান্তি দূর হয়ে গেল রিমাকে দেখতে পেয়ে।
কেক কাটা হল,আনন্দ করা হল। পার্টি প্রায় শেষ,এমন সময় দরজা নক করল কে যেন। শিহাবের খালাত ভাই অপু গিয়ে খুলে দিল দরজা। বাইরে একজন মেইলম্যান দাড়িয়ে আছে।

"এখানে শিহাব হাসান নামের কেউ আছেন? আপনার একটা পার্সেল এসেছে।"

শিহাব এগিয়ে গেল। পার্সেলটা নিল ফর্মে সই করে।
শিহাবের পাশে এসে দাড়াল রিমা।
"কে পাঠিয়েছে?"

শিহাব পার্সেলের প্যাকেটটা খুলল। গিফট প্যাকেটে মোড়ানো বই জাতীয় কিছু। উপরে সাঁটা চিরকূটে মেয়েলী হাতে লেখা দু'টো লাইন,

"শিহাব ভাইয়ের জন্মদিনে একরাশ শুভেচ্ছা ও ভালবাসা।
-সেতু"

"সেতু পাঠিয়েছে।" রিমাকে বলল শিহাব।

"সেতু তোমার বার্থ ডেইট জানে?"

"জানে বলেই তো মনে হচ্ছে। তবে আমি কখনো বলিনি।"

শিহাবের খালাত ভাই অপু এসে বলল,"কি এটা ভাইয়া? কিসের পার্সেল?"

"বার্থ ডে গিফট। এক ফ্রেন্ড পাঠিয়েছে।"

"ও আচ্ছা।"

রিমাকে নিয়ে শিহাব স্টাডিরুমে গেল। গিফট প্যাকেটটা খুলল দুজন মিলে। ভিতর থেকে বেরোল পুরনো, জরাজীর্ণ,মলিন রংয়ের একটা ডায়েরি। ভিতরের পাতাগুলো হলুদ হয়ে গেছে! সাদা খামে ভরা একটা চিঠিও রয়েছে সাথে।
প্রথমেই চিঠিটা খুলল শিহাব । রিমাকে শুনিয়ে শুনিয়ে পড়তে লাগল।

"শুভ জন্মদিন শিহাব ভাই! ভাল আছেন? আপনার জন্মদিন কিভাবে জানতে পারলাম ভাবছেন? খুবই সহজ। ফেসবুক থেকে। ঢাকায় থাকলে আপনার বাসায়-ই যেতাম, কিন্তু একটা কাজে সিলেট এসেছি, তাই আসতে পারলাম না!
শিহাব ভাই, ট্রেনে আপনার সাথে মজা করেছিলাম একটু। আপনি কিছু মনে করেননি তো? নাকি বুঝতেই পারেননি আমার দুষ্টুমীটুকু? যাই হোক, খুলেই বলি। আপনারা কলাবাগানে যাওয়ার আগে কোথায় ছিলেন মনে আছে নিশ্চয়ই? মালিবাগের একটা ফ্ল্যাটে। নাম ছিল-আফজাল ম্যানসন। আপনারা যে ফ্ল্যাটে থাকতেন সেই ফ্ল্যাটেই আমরা উঠি, আপনাদের যাওয়ার পর।
বাসা শিফট করার সময় আপনারা কিছু বাতিল জিনিস ফেলে গিয়েছিলেন। তার মধ্যে এই পুরনো ডায়েরিটাও ছিল, যেটা আপনাকে পার্সেল করে পাঠালাম। ডায়েরিটা ভর্তি ছিল কবিতা দিয়ে। অনেকগুলো কবিতা। আমি আবার কবিতা ভালবাসি। আপনার কবিতাগুলো প্রায়ই পড়তাম, খুব মনোযোগ দিয়ে। তবে তখনও জানি না আপনি কে। শুধু নামটা জানতাম- শিহাব হাসান। ডায়েরির শুরুতে লেখা ছিল নামটা। একদিন ঈদ ম্যাগাজিনে একটা গল্প পড়লাম, নাম ছিল "কাঠমালতির কান্না"। লেখক- শিহাব হাসান। তখন সন্দেহ হল আপনিই সেই শিহাব হাসান কি না!
ফেসবুকে আপনার নাম সার্চ করতেই পেয়ে গেলাম আপনাকে। আপনার ফেসবুক প্রোফাইল পুরোটাই ভর্তি ছিল গল্প কবিতা দিয়ে। কবিতাগুলো দেখে নিশ্চিত হলাম, আপনিই ডায়েরির শিহাব হাসান।
ট্রেনে যখন আপনাকে দেখলাম, তখনও চিনতে পারিনি। যখন বললেন আপনার নাম শিহাব, তখন ফেসবুকে দেখা ছবিগুলো মনে পড়ে গেল। আরো ভাল লাগল যখন জানলাম আপনি আমার ডিপার্টমেন্টের-ই বড় ভাই। ঠিক করলাম, একটু দুষ্টুমী করব আপনার সাথে। গল্প করার ছুতোয় মাঝে মধ্যে আমি এমন সব কথা বলছিলাম, যেগুলো হুবহু আপনার কবিতার বিভিন্ন লাইন থেকে নেওয়া। সেই কবিতা, যেগুলো আপনি মালিবাগের ফ্ল্যাটে ফেলে আসা ডায়েরিতে লিখেছিলেন।
আপনি আমাকে জিজ্ঞেস করেছিলেন যে আমাদের এর আগে কখনো দেখা হয়েছে কি না। মনে আছে? এখন বুঝতে পারছেন এমন একটা প্রশ্ন আপনার মাথায় এসেছিল কেন?
যাই হোক, জন্মদিনে আপনাকে অনেক অনেক শুভেচ্ছা জানাই আরো একবার। আর ডায়েরিটা আমার পক্ষ থেকে ছোট্ট একটা উপহার।
ভাল থাকবেন।
-সেতু"

শিহাব পড়া শেষ করতেই রিমা অট্টহাসিতে ফেঁটে পড়ল। হাসতে হাসতে বলল,"কত সিম্পল একটা ট্রিক! আর তুমি পুনর্জন্ম,প্যারাসাইকোলজি কি সব বলছিলে। আসলে কি জানো? সবকিছুর পিছনেই কোন না কোন ব্যাখ্যা থাকে...!"

কিন্তু শিহাব শুনছে না রিমার কথা, ওর মুখ মেঘের মত গম্ভীর। দ্রুত ডায়েরিটার পাতা উল্টে যাচ্ছে। একেকটা পাতা একটু করে পড়ছে,তারপর আবার দ্রুত উল্টে যাচ্ছে পরের অনেকগুলো পাতা। চেহারা কেমন যেন ফ্যাকাশে হয়ে গেছে। একসময় বলল,
"রিমা, এগুলো আমার কবিতা নয়!"

"মানে? হাতের লেখা...!"

"হাতের লেখা আমার। ভাষার ব্যবহারটাও আমার মতই। কবিতাগুলোও খুব পরিচিত ঠেকছে। কিন্তু আমি এসব লিখিনি!"
"হোয়াট? তা কি করে হয়?"

"জানি না। কবিতার লাইনগুলো যেন সাত জনমের চেনা। হাতের লেখাটাও নিঃসন্দেহে আমার। কিন্তু আমি এসব কবিতা লিখিনি।"

"অনেক আগে লিখেছিলে, তাই হয়ত ভুলে গেছ।"

"প্রশ্নই আসে না। মালিবাগের ফ্ল্যাটটা ছেড়েছি তিন বছর আগে। অথচ দশ বছর আগে স্কুল ম্যাগাজিনে আমার যে লেখাটা বের হয়েছিল, সেটাও হুবহু মনে আছে আমার। একজন লেখকের কাছে নিজের লেখাগুলো হচ্ছে সন্তানের মত। আমি আমার সন্তানের চেহারা ভুলে যাব?"

রিমা বুঝতে পারল না কি হচ্ছে। ডায়েরির লেখাগুলো শিহাবের না হয়ে যায় কি করে?
দু'জনেই হতবিহব্বল।


*** *** ***

শিহাবের শেষ জন্মদিনের পর ছ'মাস কেটে গেছে। রিমা আর শিহাবের বিয়ে হয়েছে মাসখানেক আগে।

সেই ডায়েরি রহস্য নিয়ে শিহাব এখন আর ভাবছে না। তার জীবনে নতুন একটা সমস্যার আবির্ভাব হয়েছে।

ঈদানিং কেমন যেন পরিবর্তন এসেছে রিমার আচরণে। শিহাবের দিকে কেমন যেন সন্দেহের চোখে তাকায়। কি যেন ভাবে সারাক্ষণ।

বিয়ের প্রথম দিকে ঠিকই ছিল সবকিছু। সমস্যাটা দেখা দিয়েছে গত সপ্তাহ থেকে। জিজ্ঞেস করলে রিমা বলে, কিছু হয়নি তার। সব ঠিক আছে।

কিন্তু শিহাব জানে, সব ঠিক নেই। কোথাও একটা সমস্যা হয়েছে। বড় ধরণের সমস্যা।

এক সকালে রেডি হয়ে অফিসে যাচ্ছিল, এমন সময় শিহাবকে থামাল রিমা।

"আচ্ছা শিহাব, আজকে তোমার অফিসে না গেলে হয়না?"

"কেন? কোন কাজ ছিল?"

"হ্যা। আজকে অফিসে না গেলে তোমার যদি খুব অসুবিধা না হয় তাহলে আমি তোমাকে এক জায়গায় নিয়ে যেতে চাই।"

"কোথায়?"

"বলছি, তুমি এখানে এসে আমার পাশে বসো তো একটু।"

অফিসের ব্যাগটা টি টেবিলের উপর রেখে রিমার পাশে বসে পড়ল শিহাব।

"কি হয়েছে রিমা?"

"আমি তোমাকে কিছু জিনিস দেখাব।"

"কি?"

রিমা টি টেবিলের নিচ থেকে একটা কাপড়ের ব্যাগ বের করল। ব্যাগের ভিতর থেকে বের করল তিনটে ডায়েরি।

"ডায়েরিগুলো চিনতে পারো শিহাব?" চিনতে পারল না ও। তবে একটা ডায়েরি নিয়ে কয়েকটা পাতা উল্টাতেই ওর চোখমুখ ফ্যাকাশে হয়ে গেল।

"হাতের লেখাটা আমার...খুব পরিচিত কবিতা...কিন্তু আমি লিখিনি।"

"জানি শিহাব। এবার বাকিগুলোও উল্টে দেখো।"

শিহাব একটার পর একটা ডায়েরির পাতা উল্টে যেতে লাগল।

"হলি কাউ! রিমা, এসব কি? প্রত্যেকটা ডায়েরিতে একই রকম কবিতায় ভর্তি, আমার হাতের লেখা...?"

রিমা লম্বা দম নিয়ে বলল, "বলছি শিহাব, শোনো। সাতদিন আগে, গত সোমবার, মাঝরাতে উঠে দেখি তুমি বিছানায় নেই

। ভেবেছিলাম বারান্দায় গিয়ে স্মোক করছ বোধহয়। কিন্তু না, খুঁজে দেখি সেখানেও তুমি নেই। খুঁজতে খুঁজতে স্টাডিরুমে গেলাম। প্রতিদিন ঘুমানোর আগে তুমি সব রুমের বাতি নিভিয়ে দাও। কিন্তু স্টাডিরুমের বাতি নিভাও না। বিষয়টা আগেও খেয়াল করেছি। কিন্তু তেমন সিগনিফিক্যান্ট কিছু মনে হয়নি। যাই হোক, স্টাডিরুমে গিয়ে দেখি, তুমি পাগলের মত ডায়েরিতে কি যেন লিখছ। তোমার পাশে গিয়ে তোমাকে ডাকলাম, শুনলে না তুমি। ঠিক পনের মিনিট পর ডায়েরি শেলফে গুজে রেখে রোবটের মত হাটতে হাটতে বেরিয়ে গেলে রুম থেকে। খুব ভয় পেয়েছিলাম সে রাতে।

পরের দিন রাত জেগে থাকলাম কি হয় দেখার জন্য। কিছুই হল না। সে রাতে মরার মত ঘুমোলে তুমি। ঠিক দু'রাত পর একই জিনিস হল। তুমি বিছানায় নেই। স্টাডিরুমে বসে বসে কবিতা লিখছ। বুঝলাম, 'সোমনামবুলিজম' নামের রোগ আছে তোমার। ঘুমের মধ্যে জেগে উঠে লেখালেখি করাটা তোমার অবচেতন মনের অভ্যেস হয়ে দাড়িয়েছে। সে জন্য অবচেতন ভাবেই তুমি স্টাডিরুমের লাইট কখনো নিভাও না। বুঝতে পারছ আমি কি বলছি?"

"তুমি কি বলতে চাও ঘুমের মধ্যে আমি লেখালেখি করি? এও সম্ভব?"

"হ্যা, সম্ভব। তোমাকে ঐ অবস্থায় দেখে আমি গুগল করেছিলাম অনেকক্ষণ। নেটে দেখলাম, সোমনামবুলিজম যাদের হয়,তাদের ক্ষেত্রে এর চেয়েও বিচিত্র ধরণের অভ্যেস দেখা যায়।"

"যেমন?"

"ক্যানাডার এক প্রিস্টের এই রোগ ছিল। তিনি ঘুমের মধ্যে গাড়ি ড্রাইভ করে পুরো টরেন্টো শহরটা চষে বেড়াতেন। অস্ট্রেলিয়ার এক স্কুল টিচার ঘুমের মধ্যে হাটতে হাটতে স্কুলে চলে যেতেন। তারপর ব্ল্যাকবোর্ডে অংক কষতেন। এক ক্যারিবিয়ান এথলেট মাঝরাতে লনে নেমে ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে সাতার কাটতেন। এমন উদাহরণ আরো অনেক আছে..!"

"কিন্তু এতক্ষণ কি স্লিপ ওয়াকিং হয় মানুষের?"

"জানা গেছে,তিরিশ সেকেন্ড থেকে তিরিশ মিনিট পর্যন্ত হতে পারে।"

শিহাব স্থানুর মত বসে রইল। ওর নিজের এত জটিল একটা রোগ আছে অথচ নিজেও সেটা জানত না?

"এখন কি করবে রিমা?"


"এই রোগের একজন স্পেশালিস্ট ডক্টরের সঙ্গে কথা বলেছি আমি শিহাব। আজকে তিনি সময় দেবার কথা বলেছেন। তাই বলছিলাম, আজ একদিন অফিস কামাই দাও।"

"ঠিক আছে, আমি অফিসে ফোন করে বলে দিচ্ছি, আজ যেতে পারব না।"

শিহাব ল্যান্ডলাইন-টেলিফোনটা কোলের উপর টেনে নিল। রিমা শিহাবের দিকে তাকিয়ে রইল সহানুভূতি মাখা দৃষ্টি নিয়ে।

(সমাপ্ত)
সর্বশেষ এডিট : ২৯ শে নভেম্বর, ২০১৩ বিকাল ৫:২৫
১৬টি মন্তব্য ১৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

লালনের বাংলাদেশ থেকে শফি হুজুরের বাংলাদেশ : কোথায় যাচ্ছি আমরা?

লিখেছেন কাল্পনিক সত্ত্বা, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৪



মেটাল গান আমার নিত্যসঙ্গী। সস্তা, ভ্যাপিড পপ মিউজিক কখনোই আমার কাপ অফ টি না। ক্রিয়েটর, ক্যানিবল কর্পস, ব্লাডবাথ, ডাইং ফিটাস, ভাইটাল রিমেইনস, ইনফ্যান্ট এনাইহিলেটর এর গানে তারা মৃত্যু, রাজনীতি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিনেতা

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:১৫



বলতে, আমি নাকি পাক্কা অভিনেতা ,
অভিনয়ে সেরা,খুব ভালো করবো অভিনয় করলে।
আমিও বলতাম, যেদিন হবো সেদিন তুমি দেখবে তো ?
এক গাল হেসে দিয়ে বলতে, সে সময় হলে দেখা যাবে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমেরিকার গ্র্যান্ড কেনিয়ন পৃথিবীর বুকে এক বিস্ময়

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৪১


প্রচলিত কিংবদন্তি অনুসারে হাতে গাছের ডাল আর পরনে সাধা পোশাক পরিহিত এক মহিলার ভাটাকতে হুয়ে আতমা গ্র্যান্ড কেনিয়নের নীচে ঘুরে বেড়ায়। লোকমুখে প্রচলিত এই কেনিয়নের গভীরেই মহিলাটি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

চুরি! চুরি! সুপারি চুরি। স্মৃতি থেকে(১০)

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ০৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৪


সে অনেকদিন আগের কথা, আমি তখন প্রাইমারি স্কুলে পড়ি। স্কুলে যাওয়ার সময় আব্বা ৩ টাকা দিতো। আসলে দিতো ৫ টাকা, আমরা ভাই বোন দুইজনে মিলে স্কুলে যেতাম। আপা আব্বার... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাবলীগ এর ভয়ে ফরজ নামাজ পড়ে দৌড় দিয়েছেন কখনো?

লিখেছেন লেখার খাতা, ০৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:২৬


আমাদের দেশের অনেক মসজিদে তাবলীগ এর ভাইরা দ্বীন ইসলামের দাওয়াত দিয়ে থাকেন। তাবলীগ এর সাদামাটাভাবে জীবনযাপন খারাপ কিছু মনে হয়না। জামাত শেষ হলে তাদের একজন দাঁড়িয়ে বলেন - °নামাজের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×