ব্রাম স্টোকার একবার স্বপ্নে দেখেছিলেন যে অক্টোপাসের মতো দেখতে একটি প্রাণী তাকে আষ্ঠেপৃষ্ঠে জড়িয়ে ধরেছে, তার ঘাড়ে শ্বদন্ত বসিয়ে রক্ত চুষে খাচ্ছে। স্বপ্ন দেখে ধরফর করে উঠে বসেই তিনি লেখা শুরু করে দেন, কারণ স্বপ্নের স্মৃতি মানুষ সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে ভুলতে থাকে। এই স্বপ্নের সারাংশ থেকেই স্টোকার ড্রাকুলা গল্পটির প্লট দাড় করিয়েছিলেন এবং টানা পাঁচ বছর পরিশ্রম করে, বিভিন্ন বই পত্র, মিউজিয়ামের নথি ঘেঁটে এবং স্থানীয় রূপকথা ইত্যাদি একসঙ্গে করে বিখ্যাত "ড্রাকুলা" বইটি লিখেছিলেন। দুঃস্বপ্ন থেকে গল্প লেখার এই ধারণাটি আমার খুব ভালো লেগেছিল। আমি নিজের কিছু দুঃস্বপ্নকে পরিমার্জিত করে কয়েকটি গল্প লিখেছি। ভাবছি, ধারাবাহিক ভাবে, বিভিন্ন পর্বে বিভিন্ন দুঃস্বপ্ন নিয়ে লিখব। তবে বলে রাখি, এই লেখাগুলো আমি ঘুম থেকে উঠে লিখিনি, ঘুম থেকে উঠে এক-দুই লাইনে টুকে রেখেছি, পরে ঠান্ডা মাথায় ভেবে চিনতে লিখেছি।
অবসেশন
শিহাবের কথা
ঝিরঝিরে হাওয়া বইছে, হাওয়ায় অহনার চুল উড়ছে, শাড়ীর আঁচল বেসামাল হয়ে লুটোপুটি খাচ্ছে এদিক সেদিক, অহনার সেদিকে ভ্রুক্ষেপ নেই। সে তার বিষণ্ণ চোখ দু’টো দিয়ে সমুদ্র দেখছে গভীর মনোযোগে। একটা দু’টো পাখি যখন ডেকে উঠছে অনিয়মিত সুরে, অহনা তখন শরীর স্থির রেখে চোখ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খোঁজার চেষ্টা করছে পাখিগুলোকে। সাগরের তীরে “কিয়ায়া কিয়ায়া” শব্দে কোন পাখি ডাকে জানি না। ডাকগুলো একটু অদ্ভুত, আগে শুনিনি আমি। অহনাও শোনেনি বোধহয়। তবে ডাকটা শ্রুতিমধুরও বেশ। কানে লেগে থাকে অনেকক্ষণ।
অনেকক্ষণ সাগরের তীরে বসে থাকার পর আমরা হাত ধরাধরি করে বালুচরি ধরে হাটতে লাগলাম। চোখের মতো, অহনার হাত দু’টোও বেশ শীতল। দুর্বলভাবে আমার হাত ধরে রেখেছে সে। হাটছে আস্তে আস্তে পা ফেলে। তাল মিলাতে আমাকেও হাটার গতি কমিয়ে দিতে হয়েছে অনেক।
অহনার অদ্ভুত রোগটা ধরা পড়ে চার মাস আগে। অহনা খুব দুর্বল হয়ে পড়ে হঠাৎ করে। চা বানাতে গিয়ে হাত থেকে চায়ের কেটলি ফস্কে যায়, হাটতে গিয়ে হাঁটু ভেঙে পড়ে যায় হঠাৎ করে, লিখতে গিয়ে হঠাৎ খাতার উপর ঘুমিয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে তার চেহারা ফ্যাকাসে-বিবর্ণ হয়ে যেতে থাকে। কলম, পেন্সিল, পেপারওয়েট ইত্যাদি বিভিন্ন ধরনের জড়বস্তু চিবোতে থাকে কারণে অকারণে।
ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাবার পর এনিমিয়া ধরা পড়ল ওর, মানে এক ধরনের রক্তশূন্যতায় ভুগছে সে। চিকিৎসা চলতে থাকে অহনার। দীর্ঘ দু’মাসের চিকিৎসায় কিছুটা সুস্থ হয় অহনা। ওকে হাসপাতালে ভর্তি করে রাখতে হয়েছিল মাঝখানে বেশ কিছুদিন। মোটামুটি সুস্থ হবার পর ডাক্তার বলল, শহরের বাইরের কোন জায়গা থেকে ঘুরে আসতে। অহনার ধুলোবালিতে এলার্জি আছে, সে কারণে শহরের বাইরে যেতে বলল নাকি এনিমিয়ার চিকিৎসার জন্য সেটা বোধগম্য হয়নি আমার! কিন্তু ডাক্তারের আদেশ শিরোধার্য, আমরা পরের সপ্তাহেই কক্সবাজারে চলে আসি। ট্যুরিস্ট স্পট থেকে একটু দূরে, সাগরের তীর ঘেঁষে একটা বাংলো বাড়িতে উঠি আমরা।
বেশ কিছুক্ষণ দুর্বল পায়ে হাটার পর অহনাকে বললাম, “চলো, ফেরা যাক। এত হাটলে দুর্বল হয়ে পড়বে তুমি।”
অহনা কিছু না বলে সামনের দিকে আঙুল তুলে দেখাল। আমি তাকিয়ে একটা বড়সড় পাহাড় দেখতে পেলাম, সাগরের অনেকটা কাছে গিয়ে থেমেছে সেটা। সাগর আর পাহাড়ের মধ্যবর্তী জায়গাটায় গোড়ালি সমান পানি আসা যাওয়া করছে। জোয়ারের পানি বোধহয়। তবে অহনার আঙুল বরাবর আরও সামনে তাকিয়ে আমি একটা গুহা দেখতে পেলাম পাহাড়ের গায়ে, চোখে পড়ে কি পড়ে না এমন একটা গুহা। দূর থেকে দেখে অন্ধকার, স্যাঁতস্যাঁতে মনে হচ্ছে। আমি অহনাকে জিজ্ঞেস করলাম-
“কি ওখানে অহনা?”
“পাখিগুলোর অদ্ভুত ডাকগুলো ওখান থেকে আসছে, শুনতে পাচ্ছ না?”
আমি একটু মনোযোগ দিয়ে শোনার চেষ্টা করলাম, হ্যা, আসলেই শোনা যাচ্ছে অল্প অল্প। কিয়া, কিয়ায়া...কেমন সুরেলা কিন্তু গম্ভীর ডাক। অহনাকে বললাম,
“পাখিগুলো বোধহয় ওখানেই থাকে। গুহার দেয়ালে বাসা বেঁধেছে হয়তো।”
“চলো, গিয়ে দেখি।”
“না অহনা, আজ নয়। আজ অনেকটা হেটেছ তুমি। কাল যাব।”
“আচ্ছা।” অহনা মাথা নাড়িয়ে সায় দিল। ইদানীং অহনা চুপচাপ রাজি হয়ে যায় সব কথায়। কেমন মায়া লাগে ওর জন্য। বেচারির শরীরের দুর্বলতা মনকেও দুর্বল করে তুলেছে।
বাংলোটা কাছেই, দু’মিনিটের পথ এখান থেকে। একতলা বাংলো। তবে পাটাতনের উপর উঁচু করে তৈরি করা। সাত আটটা সিঁড়ির ধাপ বেয়ে উঠতে হয়।
আমরা যখন সিঁড়ি পেরিয়ে আমাদের কামরার দরজা খুলতে যাব, তখন একটা অদ্ভুত জিনিস দেখতে পেলাম। জানালার পাশে ছোপ ছোপ দাগ। কিছু বিদঘুটে তরল ছড়ানো ছিটানো এখানে সেখানে। একটা বোটকা গন্ধ এসে ঝাপটা মারছে নাকে। কিসের দাগ সেটা বুঝতে পারলাম না, হয়তো আমাদের অনুপস্থিতিতে এলাকার দুষ্টু ছেলেপেলেরা কাঁদা টাঁদা মেখে খেলাধুলো করতে এসেছিল, কে জানে। তবে আমি কেয়ারটেকারকে ডেকে তখনই পরিষ্কার করতে বললাম দাগগুলো।
অহনার কথা
মাঝরাতে গোঙানির শব্দে আমার ঘুম ভাঙল। কেমন একটা চাঁপা শব্দ আসছে কোথা থেকে যেন। আর সেই পাখির ডাকের মতো শব্দটা শোনা যাচ্ছে, কিয়া, কিয়ায়া...! খুব কাছ থেকে আসছে শব্দটা। ডান দিকে তাকাতেই একটা ভয়ংকর দৃশ্য দেখতে পেলাম। সাপের মতো দেখতে একটা প্রাণী, আকারে তিন হাত হবে, কিন্তু অনেক বেশি মোটা, প্রায় ১৫ ইঞ্চি ব্যাস হবে, প্রাণীটা শিহাবের পা কামড়ে ধরেছে। মুখের ভেতর সারি সারি দাঁত প্রাণীটার, কুমীরের মতো ধারালো আর বড় বড়। প্রাণীটার লেজের দিকে তাকিয়ে দেখি আরও ভয়াবহ জিনিস দেখতে পেলাম। শামুকের মতো দেখতে দু’টো শূর বেরিয়ে এসেছে, সেগুলোর মাথায় দু’টো চোখ জ্বলজ্বল করে তাকিয়ে দেখছে শিহাবকে। ভারী একটা কাঠের ফুলদানী দিয়ে শিহাব ক্রমাগত বাড়ি মারছে প্রাণীটার গায়ে, কিন্তু সেটার কোন বিকার নেই। শিহাবের পা থেকে রক্ত ঝরছে। মুখ থেকেও।
আমি দুর্বল শরীর নিয়ে উঠে বসলাম। আমাকে উঠতে দেখে যন্ত্রণাকাতর গলায় শিহাব বলল, “অহনা, ওটার চোখ দু’টো নষ্ট করে দাও!”
ঘরের কোণের টেবিলে একটা ফল কাটার ছুরি পড়ে ছিল কয়েকদিন ধরে। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে ছুরিটা তুলে নিলাম হাতে। দুর্বল হাতে সময় নিয়ে লক্ষ্যস্থির করলাম প্রাণীটার চোখ বরাবর। আঘাত করলাম, কিন্তু লাগল না ঠিক জায়গায়। প্রাণীটা গলা দিয়ে হিসহিসানীর মতো আওয়াজ করল। আমি দ্বিতীয় বার আঘাত করলাম চোখের দু’টো শূরের সংযোগস্থলে। এবার লাগল। ছুরির আঘাতে চোখ দু’টো আলাদা হয়ে যেতেই প্রাণীটা শিহাবের পা ছেড়ে দিয়ে অদ্ভুত শব্দ করে মোচড়াতে লাগল। দেখতে দেখতে নিথর হয়ে গেল ওটার শরীর।
আমি শিহাবের হাত ধরে ভয়ার্ত গলায় বললাম, “কি ছিল এটা শিহাব?”
“জানি না, অদ্ভুত কোন প্রজাতির প্রাণী! তবে যেটাই হোক, সেই পাহাড়ের গুহায় বোধহয় এরা থাকে। আমরা পাখি ভেবেছিলাম এগুলোকেই। ভাগ্যিস গুহায় ঢুকিনি আমরা।”
বলেই শিহাব হুংকার ছেড়ে কেয়ারটেকারকে ডাকল, “রমিজ, রমিজ!”
কথোপকথন
পরদিন সকালে শিহাবের পা ব্যান্ডেইজ করে দিল স্থানীয় ডাক্তার। ভাগ্যিস দাঁতে বিষ ছিল না, শুধু আহত হয়েছে শিহাব। বিষ থাকলে আরো বড় ক্ষতি হতে পারত।
ডাক্তার চলে যেতে অহনা শিহাবকে একটা অদ্ভুত প্রশ্ন করে বসল, “আচ্ছা শিহাব, তুমি কি কাল রাতে জেগেছিলে, যখন সেই প্রাণীটা এসেছিল?”
“হ্যা, ছিলাম।”
“কি করছিলে?”
“তেমন কিছু না, মস্কুইটো স্টিকগুলো নিয়ে যে আর্টিকেলটা লিখছিলাম গত ক’মাস ধরে, সেটা দেখছিলাম বসে বসে।”
“তোমার বাক্স ভর্তি মস্কুইটো স্টিক, যেগুলো তুমি আফ্রিকার এক জঙ্গল থেকে এনেছ?”
“হ্যা।”
“আমি স্টিকগুলো দেখেছি, খুব সরু আর লম্বা, মশার রক্ত চোষার শূরের মতো, তাই না? সে জন্যই নাম মস্কুইটো স্টিক!”
“হ্যা। ঠিক বলেছ।”
“এই শূরগুলো দিয়েই কি এতদিন আমার রক্ত পান করতে?”
শিহাব ভূত দেখার মতো চমকে উঠল।
“মানে, কি বলতে চাও?”
“কাল রাতে যখন ঘুম থেকে উঠলাম ধস্তাধস্তির শব্দে, তোমার ঠোঁটে রক্ত লেগেছিল। দু’য়ে দু’য়ে চার মেলালাম। আমার এনিমিয়া হবার পেছনে আসলে তোমার হাত ছিল। তুমি এত দিন ধরে একটু একটু করে আমার রক্ত পান করছিলে। মস্কুইটো স্টিকগুলো দু’বছর আগে যখন তুমি যখন আফ্রিকাতে পাও, তখন তুমি খেলাটা শুরু করো। আমার শিরায় স্টিক বসিয়ে রক্ত চুষে খেতে তুমি, তাই না? আমি ঘুমের মধ্যে হালকা টের পেতাম। সন্দেহ ছিল সামান্য, কাল রাতে পরিষ্কার হলো!”
“মাই গড! কি বলছ তুমি অহনা। আমি এমন কেন করতে যাব?”
‘কারণ তুমি একটা সাইকো! তোমার রক্তের প্রতি নেশা আছে। আমি নেট ঘেঁটেছি সকালে, এটাকে বলে রেনফিল্ড’স সিনড্রম, রক্ত পান করার তীব্র নেশা আছে তোমার মধ্যে।”
শিহাব কিছু না বলে কেমন ভাবলেশ চোখে তাকিয়ে রইল অহনার দিকে।
“ওভাবে তাকিয়ো না শিহাব, আমি রেগে নেই তোমার উপর। রোগ আর রোগীকে ঘৃণা করা এক নয়। তোমাকে ডাক্তার দেখাতে হবে শিহাব। শিগগিরি...”
সর্বশেষ এডিট : ২৮ শে অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১১:৩৬