somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অনুবাদ গল্পঃ ভূমিকম্পের পর (হারুকি মুরাকামি)

১৭ ই জানুয়ারি, ২০১৯ দুপুর ১২:০০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মূল গল্পঃ Ufo in Kushiro (গ্রন্থঃ After the Quake)
লেখকঃ হারুকি মুরাকামি
অনুবাদকঃ মোহাইমিনুল ইসলাম বাপ্পী

কমুরার স্ত্রী পুরো পাঁচ দিন টিভির সামনে বসে কাটিয়েছে। বসে বসে দেখেছে বিধ্বস্ত শহর, ভাঙা রেলপথ, ভেঙে যাওয়া নদীর পাড় আর হাসপাতাল উপচে পরা রোগী! একটা কথাও বলেনি সে। সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে, মুখে একদম ছিপি এঁটে বসেছিল। কমুরা কিছু জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দেয়নি, মাথা পর্যন্ত নাড়ায়নি একবারের জন্য। কমুরার একসময় সন্দেহ হলো, তার কথাগুলো মেয়েটার কানে পৌঁছচ্ছে কি!
ভূমিকম্পটি হয়েছিল কোবে শহরে। কমুরা যতদূর জানে, তার স্ত্রীর সেখানে কোন বন্ধু-বান্ধব বা আত্মীয় স্বজন নেই। সে উত্তরের মেয়ে, ইয়ামাগাতা প্রদেশে বড় হয়েছে। অথচ ভূমিকম্পের পর সকাল থেকে রাত পর্যন্ত টেলিভিশনের সামনে বসে কাটিয়ে দিচ্ছে ক’দিন ধরে। কমুরা যতক্ষণ ঘরে ছিল, একবারের জন্যও সে কিছু খায়নি, জায়গা থেকে ওঠেনি, বাথরুমে যায়নি পর্যন্ত। রিমোটের সুইচ টেপা ছাড়া অন্য কোন কাজে মুহূর্তের জন্য নড়েনি সে।
সকালে উঠে কমুরা নিজে নিজে কফি এবং টোস্ট খেয়ে অফিসে গিয়েছে। ফিরে এসে ফ্রিজে যা ছিল, তাই দিয়ে সেরেছে বিকেলের নাস্তা। তার স্ত্রী তখনও টিভির পর্দায় এঁটেছিল। কমুরা তার মৌনতা ভাঙার চেষ্টা বাদ দিয়ে ঘুমিয়ে পড়ত একসময়। পরদিন সকালে আবার অফিসে যেত, সেই একই রুটিনের পুনরাবৃত্তি হতো তাদের।
৬ দিনের দিন কমুরা ফিরে এসে স্ত্রীকে পেল না।
কমুরা টোকিওর একটা ইলেকট্রনিক্সের দোকানে সেলসম্যানের কাজ করে। নিজের কাজে সে বেশ দক্ষ এবং দোকানটাও শহরের অন্যতম পুরনো একটা দোকান বলে পসার ভাল হয়, ভাল কামায় সে। তার দোকানের ক্রেতারা ছিল ডাক্তার, ব্যবসায়ী এবং ধনী-প্রভাবশালী ব্যক্তিবর্গ। সে ৮ বছর ধরে সেখানে কাজ করছে এবং একদম শুরু থেকেই ভাল আয় ছিল তার। জাপানের অর্থনীতি তখন দারুণ শক্তপোক্ত। রিয়েল এস্টেটের দাম বেড়েছে। টাকা উপচে পড়ছে মানুষের পকেটে এবং তা খরচ করার জন্যও উন্মুখ হয়েছিল লোকজন। সবচেয়ে দামী পণ্যগুলো বিক্রি হতো সবার আগে।
কমুরা লম্বা, কৃশকায়, এবং সুদর্শন মানুষ। অন্যরা বেশ পছন্দ করে তাকে। বিয়ের আগে অনেক মেয়ের সঙ্গে প্রেম করেছে সে। কিন্তু বিয়ের পর, আশ্চর্যজনকভাবে নতুন নতুন মেয়ের সঙ্গে তার শারীরিক রোমাঞ্চের ইচ্ছে একদমই মরে যায়। পাঁচ বছরের বিবাহিত জীবনে নিজের স্ত্রী ছাড়া অন্য কারো সঙ্গে বিছানায় যায়নি সে। এমন নয় যে সুযোগ আসেনি। যথেষ্টই এসেছিল, আগ্রহ হয়নি তার। সে বরং একটু তাড়াতাড়ি ঘরে ফিরে, বউয়ের সঙ্গে রাতের খাবার খেয়ে, কিছুক্ষণ গল্প করে, বউকে আদর করে, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে যাওয়াতেই বেশি আনন্দ পেত। এর বাইরে কোন চাওয়া পাওয়া ছিল না তার।
কমুরার বন্ধু এবং সহকর্মীদের কাছে তার বিয়ে একটা রহস্য ছিল। ওর সুদর্শন চেহারা এবং জৌলুসের কাছে স্ত্রীকে বরং ফিকে মনে হতো। কারণ মেয়েটা ছিল বেঁটে, দেখতে শুনতেও ভাল নয়। শুধু বাহ্যিক সৌন্দর্যে ঘাটতি ছিল মেয়েটার, এমনও নয়; ব্যক্তিত্বও খুব দুর্বল ছিল। কথা খুব কম বলতো, গোমড়া করে রাখত মুখটা সারাক্ষণ।
তারপরও কমুরা যখন স্ত্রীর সঙ্গে একই ছাদের নিচে থাকত, তার সকল দুঃশ্চিন্তা যেন উধাও হয়ে যেত, প্রশান্ত হতো দেহ-মন। তার সঙ্গে ঘুমলে ওর দুঃস্বপ্নগুলো বিরক্ত করত না ওকে, অতীত জীবনের কোন সমস্যা মনকে অশান্ত করে তুলত না। উষ্ণ সম্পর্ক ছিল দু’জনের, বিছানাতেও। পুরোটা সময় একবারের জন্যও তাকে মহাবিশ্বের কোন সমস্যা স্পর্শ পর্যন্ত করত না।
তার স্ত্রী টোকিওর ভিড়-ব্যস্ততা পছন্দ করত না একদমই। তার মনে পড়ে থাকত ইয়ামাগাতা প্রদেশে। বাবা-মা এবং দুই বড়বোনের কথা খুব মনে পড়ত তার, যখনই ইচ্ছে হতো গিয়ে দেখে আসত সে তাদের। তার বাবা-মা দু’জন মিলে একটা সরাইখানা চালায় সেখানে, সেই আয়ে ভাল চলে যায় তাদের। ওর বাবা খুবই স্নেহ করত তাকে। মেয়ে বাড়িতে আসার কথা বললে সানন্দে তার যাতায়াত ভাড়া বহন করত। প্রায়ই অফিস থেকে ফিরে এসে কমুরা দেখত, তার স্ত্রী বাসায় নেই এবং রান্নাঘরে একটি চিরকুট পড়ে আছে, লেখা- তার স্ত্রী কিছুদিন তার বাবা মায়ের সঙ্গে থাকবে। কমুরা কখনো প্রতিবাদ করেনি। সে স্ত্রীর ফেরার অপেক্ষা করত এবং যখন সপ্তাহ খানেক বা দিন দশেক পর স্ত্রী ফিরত, তখন বেশ ভাল মেজাজে থাকত মেয়েটা।
তবে আজকের ব্যাপারটা ভিন্ন। আজকের চিরকুটে সে স্পষ্ট লিখে রেখেছে, সে আর ফিরবে না কখনো। কেন ফিরবে না সেটাও ব্যাখ্যা করেছে সবিস্তারে।
সে লিখেছে, “সমস্যা হলো তুমি কখনো আমায় কিছু দাও না। আরও স্পষ্টভাবে বলতে গেলে, তোমার ভেতর আমাকে দেওয়ার মতো কিছুই নেই। হ্যা, তুমি ভাল, দয়ালু এবং সুদর্শন। তবে তোমার সাথে থাকা মানে একতাল হাওয়ার সঙ্গে বসবাস করা। যদিও এটা তোমার দোষ নয়। অনেক মেয়েই আছে যারা নির্দ্বিধায় তোমার প্রেমে পড়ে যাবে। তবে আমাকে আর ডেকো না তোমার কাছে। আর আমার জিনিসপত্র যা ফেলে গেছি, সেগুলো ফেলে দিও যেখানে খুশী।”
যদিও তার জিনিসপত্র বলতে তেমন কিছু ছিল না; কাপড়চোপড়, জুতো, ছাতা, কফি মগ, হেয়ার ড্রায়ার ইত্যাদি সে সঙ্গে করেই নিয়ে গিয়েছিল। আজ সকালে কমুরা বের হবার পরপরই হয়তো সেগুলো প্যাক করেছে সে। বাড়িতে তার জিনিসপত্র বলতে একটা পুরনো বাইক ছিল শুধু, যেটাতে চেপে তার বউ কেনাকাটা করতে যেত। বহুবছর ধরে কমুরার সংগ্রহ করা বিল ইভানের গানের সিডিগুলোও উধাও হয়ে গেছে স্ত্রীর সঙ্গে সঙ্গে।
পরের দিন শ্বশুরবাড়ি ফোন করল কমুরা। তার শাশুড়ি ধরে বলল, কমুরার স্ত্রী তার সঙ্গে কথা বলতে মোটেও আগ্রহী নয়। শাশুড়ির কণ্ঠে অস্পষ্ট ক্ষমা প্রার্থনা ছিল। অবশ্য সে এটাও বলল যে বিবাহ বিচ্ছেদের জরুরী কাগজপত্র তারা অতিসত্বর পাঠিয়ে দেবে, সেও যেন দ্রুত সাইন করে ফেরত পাঠায় ওগুলো।
কমুরা বলল, “আমার পক্ষে এখনই সেটা করা সম্ভব নয়। আমি একটু ভাবতে চাই।”
তার শাশুড়ি বলল, “তুমি ভাবতে পারো যতখুশী। কিন্তু আমি জানি তাতে বদলাবে না কিছু।”
কমুরা ভাবল, তার শাশুড়ি হয়তো ঠিকই বলছে। যতই ভাবাভাবি করা হোক, ঘটনা তাতে কখনো বদলে যায় না।
কাগজপত্রের ঝামেলা শেষে সে অফিসে কিছুদিনের ছুটি চাইল। তার বস জানত কি ঘটেছে কমুরার সঙ্গে। তার উপর ফেব্রুয়ারিতে দোকানে বেচা-বিক্রিও কম হয়। তাই কমুরাকে ছুটি দিতে দ্বিধা করল না সে। বসের চেহারা দেখে কমুরার মনে হচ্ছিল, সে কিছু একটা বলতে চায় কমুরাকে। তবে শেষ পর্যন্ত বলল না কিছুই।
সে দিন মধ্যাহ্নভোজনের বিরতিতে কমুরার কলিগ, সাসাকি দেখা করতে এলো ওর সঙ্গে। বলল, “শুনলাম ছুটি নিচ্ছ তুমি, ছুটিতে বিশেষ কিছু করার কথা ভাবছ?”
“জানি না, কি করব?”
সাসাকি কমুরার চেয়ে ৩ বছরে ছোট এবং অবিবাহিত। শক্তপোক্ত শরীর তার, ছোট করে ছাঁটা চুল এবং চোখে গোল সোনালী ফ্রেমের চশমা। অনেকেই ভাবত সাসাকি বাচাল এবং গোঁয়ার প্রকৃতির লোক, তবে কমুরার সাথে ভাল বনত তার।
সাসাকি বলল, “কি বলো! ছুটি যখন নিচ্ছই, কোথাও হতে ঘুরে আসো না কেন?”
“ঠিক বলেছ। মন্দ হবে না কোথাও বেড়াতে গেলে।”
চশমার কাঁচ মুছতে মুছতে সাসাকি বলল, “হক্কাইদোতে গিয়েছ কখনো?”
“নাহ!”
“যেতে চাও?”
“কেন? গিয়ে কি হবে?”
সাসাকি চোখ কুঁচকে গলা খাঁকারি দিয়ে বলল, “সত্যি বলতে, আমার কাছে একটা ছোট প্যাকেট আছে, যেটা হক্কাইদোতে পাঠাতে হবে। তাই আশা করছি, তুমি হয়তো ওখানে নিয়ে যাবে সেটা আমার জন্য। খুবই কৃতজ্ঞ হবো কাজটা করে দিলে। আমি তোমার যাতায়াত এবং হোটেল খরচও দেব।”
“কেমন প্যাকেট? ছোট?”
“এই এতটুকুন। ভারী কিছু নয়।”
“অফিসের কিছু?”
“না না, একদমই ব্যক্তিগত! মেইলে পাঠাতে ভরসা পাচ্ছি না তাই হাতে হাতে পাঠানো। তুমি জিনিসটা পৌঁছে দিলে খুবই খুশী হবো।”
“খুব গুরুত্বপূর্ণ কিছু?”
“চিন্তা করো না। এটা বিপজ্জনক কিছু নয়, কোন ক্ষতিকারক বস্তু নয়। এয়ারপোর্টে এক্স-রে করার সময় বিপদে পড়বে না। কোন ঝামেলায় পড়বে না এর কারণে। এর ওজনও খুব কম। অন্যান্য জিনিসপত্রের সাথে নিলে বুঝতেই পারবে না। তোমার হাতে পাঠাচ্ছি কারণ আমার মেইলে পাঠাতে ইচ্ছে করছে না জিনিসটা, তাই।”
এই সময় হক্কাইদোতে বেশ শীত পড়বে, সেটা জানে কমুরা। তবে ঠান্ডা গরম, সব সমান তার কাছে এই মুহূর্তে।
“তো কাকে দেব আমি প্যাকেটটা?”
“আমার ছোটবোনকে, ওখানেই থাকে সে।”
কমুরা ঠিক করল সে সাসাকির অনুরোধ রাখবে। এমনিতে তার ছুটি কাটানোর জন্য বিশেষ কোন পরিকল্পনাও নেই। হক্কাইদোতে যেতেও আপত্তি নেই তার। সাসাকি বিমানের টিকেট ঠিক করে দিল ওর জন্য, দু’দিন পর কমুরার ফ্লাইট।
পরের দিন সাসাকি কমুরাকে ম্যানিলা পেপার দিয়ে মোড়ানো একটা ছোট প্যাকেট দিল। হাতে নিয়ে কমুরার মনে হলো, ভেতরের জিনিসটা কাঠের তৈরি। পুরো প্যাকেটটি টেপ দিয়ে মোড়ানো আষ্টেপৃষ্ঠে। সাসাকি যেমনটা বলেছিল, এর ওজন প্রায় নেই বললেই চলে। কমুরা হাতে নিয়ে পরীক্ষা করে দেখল প্যাকেটটা। হালকা ঝাঁকি দিয়ে দেখল ভেতরে কিছু নড়ে ওঠে কিনা, ওঠে না।
সাসাকি বলল, “আমার বোন তোমাকে এয়ারপোর্ট থেকে পিক আপ করবে। তোমার হোটেল রুমের ব্যবস্থাও সে-ই করবে। তোমাকে শুধু প্যাকেটটা হাতে নিয়ে এয়ারপোর্টের বাইরে দাড়াতে হবে, যাতে করে সে দেখতে পায় তোমাকে। ওখানকার এয়ারপোর্ট বেশি বড় নয়, কোন অসুবিধে হবে না তোমার।”
পরের দিন কমুরা জামাকাপড়ের মধ্যে সাসাকির প্যাকেটটি নিয়ে রওয়ানা দিল হক্কাইদোর উদ্দেশে। যতটা আশা করেছিল, প্লেনে সে তার চেয়ে অনেক বেশি যাত্রী দেখতে পেল। প্লেন যাবে হক্কাইদো প্রদেশের কুশিরো শহরে। টোকিও টু কুশিরো ফ্লাইটে এত বেশি যাত্রী, তাও এই ফেব্রুয়ারির শীতে, এটা মোটেও আশা করেনি কমুরা।
পুরো প্লেনে বসে বসে ও ভোরের কাগজ পড়ে কাটাল। কাগজ ভর্তি ভূমিকম্পের খবর। মৃতের সংখ্যা বাড়ছে দিন দিন। অনেক জায়গায় এখনও বিচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ, নীড়হারা হয়েছে বহু মানুষ। খবরগুলো পড়তে পড়তে একঘেয়েমি পেয়ে বসল কমুরার। তার মন শুধু ঘুরে ফিরে স্ত্রীর কথা ভাবছিল। কেন হারিয়ে গেল মেয়েটা তার জীবন থেকে? কেন সে শুধু বসে বসে ভূমিকম্পের খবর দেখত? কি দেখত সে ওখানে?
এয়ারপোর্টে নামতে একই রকম ওভারকোট পরা দু’টো মেয়ে এগিয়ে এলো ওর দিকে। প্রথম জন বেশ ফর্সা; উচ্চতা হবে ৫ ফুট ৬, ছোট চুল, বেশ ধারাল চোয়াল। দ্বিতীয় জনের উচ্চতা হবে ৫ ফুট ১, দীর্ঘ চুল ঘাড় পেরিয়ে নিচে নেমেছে, নাকটা একটু ছোট না হলে বেশ সুন্দরী বলা যেত তাকে। কানে দুল পরাতে কানের লতিতে থাকা তিল দু’টো বেশ চোখে পড়ে। মেয়ে দু’টো কমুরাকে এয়ারপোর্টের ক্যাফেতে নিয়ে গেল।
ক্যাফেতে বসে প্রথম মেয়েটা বলল, “আমার নাম কাইকো সাসাকি। আমার ভাই বলেছে আপনি কতটা বন্ধুবৎসল ও উপকারী মানুষ। আর ও হলো আমার বান্ধবী শিমাও।”
“হাই!” শিমাও বলল।
কমুরা জবাব দিল, “খুশী হলাম পরিচিত হয়ে।”
কাইকো সাসাকি বেশ নম্রভাবে কমুরাকে বলল, “আমার ভাই বলছিল, আপনার স্ত্রী সম্প্রতি মারা গিয়েছে!”
কমুরা এক মুহূর্ত তাকিয়ে থেকে বলল, “না, সে মারা যায়নি।”
“আমি পরশু দিন ভাইয়ার সাথে কথা বলেছি। আমার স্পষ্ট মনে আছে যে সে বলেছিল আপনি সম্প্রতি আপনার স্ত্রীকে হারিয়েছেন।”
“ঠিক বলেছে তোমার ভাই। আমাকে ত্যাগ করেছে আমার স্ত্রী। তবে যতদূর জানি, সে বহাল তবিয়তেই বেঁচে আছে।”
কাইকো বিভ্রান্ত দৃষ্টিতে তাকিয়ে থেকে বলল, “ব্যাপারটা অদ্ভুত! আমি সাধারণত এমন গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ভুল শুনি না!”
কমুরা কফিতে চিনি মিশিয়ে চুমুক দিল। বিস্বাদ লাগল তার। ভাবল, কি করছে সে এই অচেনা শহরে!
কাইকো লম্বা শ্বাস নিয়ে বলল, “তাহলে বোধহয় আমি ভুলই শুনেছি। আমাকে ক্ষমা করবেন! আমি খুবই অভদ্রের মতো কথা বলেছি আপনার সঙ্গে।”
“না, অসুবিধে নেই। যেভাবেই দেখি না কেন, আমি হারিয়েছি স্ত্রীকে!”
অস্বস্তিকর নীরবতা নেমে এলো ওদের তিনজনকে ঘিরে। শিমাও কোন কথা বলেনি পুরো সময়ে। তবে হাসিমুখে কথা শুনছিল কমুরার। তার চোখের দৃষ্টি, অঙ্গভঙ্গি দেখে কমুরা নিশ্চিত হলো, মেয়েটা পছন্দ করেছে ওকে।
ব্যাগ থেকে সাসাকির দেওয়া প্যাকেটটা বের করে কমুরা বলল, “যাক, কাজের কথায় আসি। এই প্যাকেটটা সাসাকি দিয়েছে আমাকে, তোমাকে দেবার জন্য।” বলতেই একটা ভাবনা উঁকি দিল ওর মাথায়। কমুরার তো প্যাকেটটা হাতে নিয়ে এয়ারপোর্টে দাড়ানোর কথা ছিল, সে দাড়ায়নি। তাহলে মেয়ে দু’টো তাকে চিনল কি করে!
কাইকো টেবিলের ওপাশ থেকে হাত বাড়িয়ে নিল প্যাকেটটা। হাতে নিয়ে নেড়েচেড়ে সন্তুষ্ট হলো। তারপর সেটা পুরে নিল কাঁধে ঝোলানো ব্যাগে। তারপর বলল, “আমাকে একটা ফোন করতে হবে। কিছুক্ষণের জন্য বিদায় নিচ্ছি, কিছু মনে করবেন না।”
“না, ঠিক আছে।”
টেবিল ছেড়ে ফোন বুথের দিকে পা বাড়াল কাইকো। তার গমনপথের দিকে চেয়ে রইল কমুরা। মেয়েটার ঊর্ধ্বাঙ্গ সম্পূর্ণ স্থির, কিন্তু শরীরের নিচের অংশ বেশ ছন্দে ছন্দে দুলছে হাটার তালে। কমুরার মনে হলো, এই দৃশ্যটি সে আগেও কোথাও দেখেছে। যেন অতীত হতে কোন ঘটনা সময়ের ফাঁক গলে বর্তমানে চলে এসেছে!
শিমাও এই প্রথম কথা বলল, “আপনি হক্কাইদোতে এসেছেন এর আগে?”
কমুরা মাথা নাড়ল।
“হ্যা জানি জানি, আপনার বাড়ি থেকে অনেক দূরে জায়গাটা!”
সম্মতি জানিয়ে মাথা দোলাল কমুরা। আশেপাশে তাকিয়ে বলল, “মজার বিষয়, আমার মনে হচ্ছে না এতদূর এসেছি আমি বাড়ি হতে।”
“কারণ উড়ে এসেছেন আপনি। এখনকার প্লেনগুলো অসম্ভব দ্রুতগামী! আপনার মন শরীরের সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে পারে না।”
“ঠিক বলেছ তুমি।”
“আপনি এত দীর্ঘ ভ্রমণে বেরোতে চেয়েছিলেন?”
“হ্যা, বোধহয়।”
“আপনার স্ত্রী চলে গিয়েছে বলে?”
“হু।”
“আপনি যতই দূরে যান না কেন, নিজের থেকে তো আর পালাতে পারবেন না।”
“ঠিক বলেছ। এ যেন ছায়া, এর থেকে পালানো অসম্ভব!”
“আপনি আপনার স্ত্রীকে খুব ভালোবাসতেন, তাই না?”
“হু। তুমি কাইকোর বান্ধবী?”
“হ্যা, আমরা একসঙ্গে অনেক কিছু করি।”
“যেমন?”
উত্তর না দিয়ে শিমাও বলল, “আপনার খিদে পায়নি?”
“জানি না, খিদে পেয়েছে আবার পায়নি!”
“চলুন তিনজন মিলে কিছু খেয়ে নেওয়া যাক। খেলে ভাল লাগবে আপনার।”
শিমাওর ছোট একটা গাড়ি ছিল। সেখানে চেপে বসল তিন জন। সামনের সিটে বসল সাসাকি এবং কিয়াও, পেছনের সিট জুড়ে কমুরা একা বসল। গাড়িটা পুরনো। অল্পতেই ঝাঁকি খাচ্ছিল। শব্দ হচ্ছিল বেশ। এয়ারকন্ডিশন কখনো গরম, কখনো শীতল বাতাস দিচ্ছিল। কমুরার মনে হলো, তাকে একটা ওয়াশিং মেশিনে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে।
তুষার পড়ছিল বাইরে। তবে কুশিরোর রাস্তায় বরফ জমতে দেওয়া হয়নি। এখানে ওখানে বেশ কিছু বরফচাক দেখা যাচ্ছিল অবশ্য, তাও বিচ্ছিন্নভাবে। ঘন মেঘ জমেছিল আকাশে। সূর্যাস্তের সময় হয়নি, কিন্তু অন্ধকার হয়ে এসেছিল পথঘাট। ঠান্ডা হাওয়া বইছে বাইরে। রাস্তায় মানুষজন একদমই নেই। ট্রাফিকের বাতিগুলোও যেন জমে গেছে বরফে।
পেছনের দিকে তাকিয়ে কাইকি কমুরাকে বলল, “এখানে সাধারণত বেশি তুষারপাত হয় না। জায়গাটা উপকূলের কাছাকাছি। বাতাস এখানে শক্তিশালী, বরফ জমার সুযোগ পায় না। তবে ভীষণ ঠান্ডা! কান পর্যন্ত জমে যায় ঠান্ডায়!”
শিমাও যোগ করল, “আপনি হয়তো শুনেছেন, মাতালরা মদ খেয়ে রাস্তায় ঘুমোতে গিয়ে ঠান্ডায় জমে মরে গেছে।”
কমুরা যেন ব্যঙ্গ করল, “কি বলো! ভালুক নেই তো তোমাদের এখানে!”
কাইকি হেসে উঠে শিমাওর দিকে তাকাল। “ভালুক!”
শিমাও-ও হেসে উঠল শুনে। ওদের হাসি দেখে কমুরা যেন ব্যাখ্যা করল এমনটা বলার কারণ, “আসলে ভাই, আমি তো হক্কাইদো প্রদেশ সম্পর্কে তেমন কিছু জানি না!”
কাইকো বলল, “আমি ভালুক সম্পর্কে খুব ভাল একটা গল্প জানি, ঠিক বলেছি না শিমাও?”
“দারুণ গল্প!” শিমাও উত্তর দিল।
অদ্ভুতভাবে, দু’জনের কেউই ভালুকের গল্পটা বলল না। জিজ্ঞেস করল না কমুরাও। কিছুক্ষণের মধ্যে তারা পৌঁছে গেল খাবারের দোকানে। গাড়ি পার্ক করে দোকানে ঢুকল তারা।
কমুরা নুডলস এবং বিয়ার খেল। জায়গাটা নোংরা, চেয়ার টেবিলগুলো পুরনো। তবে নুডলস খুবই ভাল খেতে। খাবার পর সত্যিই ভাল লাগল কমুরার।
কাইকো বলল, “মি. কমুরা, আপনার এখানে কিছু করার প্ল্যান আছে? আমার ভাই বলছিল আপনি সপ্তাহখানেক থাকবেন এখানে।”
কমুরা একটু ভাবল, তবে বলল না কিছু।
কাইকো আবার বলল, “চলুন ঘুরে আসা যাক। আমি একটা ভাল জায়গা চিনি। বেশি দূরে নয় এখান থেকে।”
“মন্দ নয়, যাওয়া যায়।”
“আপনার আসলেই ভাল লাগবে। সুন্দর জায়গা, ভালুক-টালুকও নেই।”
মেয়ে দু’টো একে অপরের দিকে তাকিয়ে হেসে উঠল আবারও।
কাইকো বলল, “আপনার স্ত্রী সম্পর্কে জানতে চাইলে কিছু কি মনে করবেন?”
“নাহ!”
“সে কেন আপনাকে ছেড়ে চলে গিয়েছে?”
“ভূমিকম্পের পাঁচ দিন পর চলে গেছে সে। দু’সপ্তাহ আগের কথা।”
“ভূমিকম্পের সাথে এর কোন যোগসাজশ আছে?”
“বোধহয় নেই, আমার যতদূর মনে হয়।”
“তবুও, কোন না কোন ভাবে ঘটনা দু’টো এক সূত্রে গাঁথা মনে হচ্ছে আমার।” শিমাও বলল এবার।
কাইকি উত্তর দিল, “হ্যা, তবে কিভাবে, সেটা হচ্ছে প্রশ্ন।”
শিমাও বলল, “এই ধরনের ঘটনা সব সময় ঘটে।”
“কোন ধরনের?” কমুরা জানতে চাইল।
“এই আমার পরিচিত একজনের সঙ্গে যেমনটা ঘটেছে।” উত্তর দিল কাইকি।
শিমাও বলল, “মি. সায়কির কথা বলছ?”
“ঠিক ধরেছ। ভদ্রলোক কুশিরোতে থাকে। চল্লিশ বছর বয়স। নাপিত। এক বছর আগে তার স্ত্রী এলিয়েনদের স্পেসশীপ দেখেছিল। সে ড্রাইভ করছিল রাস্তায়। হঠাৎ দেখে, এক মস্ত স্পেসশীপ ল্যান্ড করেছে রাস্তার পাশে, একটি মাঠের মধ্যে। ব্যস! সে ঘরে ফিরল এবং এক সপ্তাহ পর চলে গেল ঘর ছেড়ে, একদম উধাও হয়ে গেল। আর কখনো ফিরে আসেনি। তাদের মধ্যে কোন রকমের দাম্পত্য কলহ ছিল না।”
কমুরা বলল, “ঘটনাটা ঘটেছিল সেই স্পেসশীপের কারণে?”
“তা তো ঠিক বলতে পারব না। দু’টো ছেলেমেয়ে ছিল তার, স্কুলে পড়ত। সব কিছু ছেড়েছুড়ে চলে গেল। কোন নোটও রেখে যায়নি কেন গেল তা জানিয়ে। উধাও হবার এক সপ্তাহ আগ পর্যন্ত সে শুধু ঐ স্পেসশীপের ব্যাপারে বলত মানুষকে। কতটা বড় ছিল, কত সুন্দর ছিল সেটা, এসব!”
“ও। তবে আমার স্ত্রী একটা নোট রেখে গিয়েছে। আর আমাদের কোন ছেলেমেয়েও নেই!”
“আপনার অবস্থা সায়কির চেয়ে ভাল তাহলে।”
শিমাও বলল, “হ্যা, বাচ্চা কাচ্চা থাকলে অনেক পিছুটান তৈরি হয়।”
শিমাওর কথা শুনে কাইকো কমুরাকে বলল, “শিমাওর বাবা ওকে ছেড়ে চলে যায় ৭ বছর বয়সে, বউয়ের ছোটবোনের সঙ্গে পালিয়ে যায় সে।”
নিস্তব্ধতা নেমে এলো এই কথায়।
কমুরা ভাঙল নীরবতা। “হয়তো মি. সায়কির স্ত্রী ঘর ছেড়ে পালায়নি, বরং এলিয়েনরা ধরে নিয়ে গেছে তাকে।”
শিমাও বলল, “অসম্ভব নয়। এই ধরনের গল্প তো প্রায়ই শোনা যায়।”
কাইকো বলল, “তুমি বলতে চাও তুমি রাস্তা দিয়ে হেটে যাচ্ছিলে এবং একটা ভালুক এসে তোমায় খেয়ে ফেলল এই ধরনের গল্প?”
হাসিতে ভেঙে পরল মেয়ে দু’টো।
খাবারের পর হোটেলে গেল ওরা। শহরের শেষ মাথায় অবস্থিত একটি হোটেল, দেখতে প্রাচীন ইউরোপীয় দূর্গের মতো। দূর্গের মাথায় একটা ত্রিকোণ আকারের পতাকা উড়ছে।
কাইকি চাবি সংগ্রহ করে নিল ডেস্ক থেকে। যে কামরাটা দেওয়া হয়েছে কমুরাকে, তার বিছানা মস্ত, কিন্তু সে তুলনায় জানালাগুলো সংকীর্ণ। জ্যাকেট হ্যাঙারে ঝুলিয়ে টয়লেটে ঢুকল কমুরা। ওর কয়েক মিনিটের অনুপস্থিতিতে মেয়ে দু’জন মিলে বাথটাব পূর্ণ করল গরম পানিতে, কামরার বাতি ক্ষীণ করে দিল, হিটার এবং টেলিভিশন অন করল, কাছের রেস্তোরাঁতে কি কি খাবার আছে দেখল, কামরায় থাকা ছোট মদের বারে কি কি রয়েছে চেক করল সেটাও এবং বিছানার ধারের বাতিটা জ্বেলে দিল।
কমুরা ফিরে আসতে ওকে কাইকি বলল, “হোটেলের মালিক আমার বন্ধু। ওকে বলে আপনার জন্য এই বড়সড় কামরাটা নিয়েছি। এটা মূলত কপোত-কপোতীদের জায়গা, তবে আশা করি তাতে আপনার অসুবিধে হবে না। হবে কি?”
“মোটেও না।”
“ছোটখাট গিঞ্জি রুমের চেয়ে এই ব্যবস্থা আশা করি বেশ ভালো হবে।”
“আলবাৎ!”
“আপনি গোসল সেরে নিতে পারেন। আমি বাথটাবে পানি পুরে দিয়েছি।”
তাই করল কমুরা। বাথটাবটা বেশ বড়। একটু অস্বস্তিই লাগল তার এত বড় বাথটাবে একা একা স্নান করতে। যুগলদের জন্য বানানো হয়েছে এটা, বোঝাই যায়।
বাথরুম থেকে বেরিয়ে অবাক হলো কমুরা। কাইকি চলে গেছে। শিমাও একা একা বসে টিভি দেখছে আর বিয়ার খাচ্ছে।
ওকে দেখে সে বলল, “কাইকি বাড়ি চলে গেছে, ক্ষমা চেয়েছে সে আপনার কাছে। বলেছে কাল আবার আসবে। আমি কিছুক্ষণ এখানে বসে বিয়ার পান করলে আপত্তি আছে আপনার?”
“নাহ!”
“আপনি নিশ্চিত? আপনি হয়তো একা থাকতে চাচ্ছেন কিংবা আশেপাশে কেউ থাকলে বিশ্রাম নিতে হয়তো অসুবিধে হবে আপনার!”
“না, কোন সমস্যা নেই।”
কমুরা তোয়ালে দিয়ে মাথা মুছতে মুছতে টিভি দেখতে লাগল শিমাওর সঙ্গে। টিভি জুড়ে কোবে শহরের ভূমিকম্পের খবর। ভাঙা ভবন, পথঘাট, আহত মানুষজন, মানুষের আহাজারি এসব দৃশ্য। বিজ্ঞাপন বিরতি এলে টিভি অফ করে দিল কমুরা।
শিমাও বলল, “আসুন, যতক্ষণ আছি এখানে, গল্প করা যাক।”
“আচ্ছা।”
“কি নিয়ে গল্প করতে চান আপনি?”
“গাড়িতে বসে ভালুকের ব্যাপারে বলছিলে তোমরা। ভালুকের গল্পটা আসলে কি?”
শিমাও মাথা নেড়ে বলল, “ও হ্যা, ভালুকের গল্প!”
“বলবে আমায়?”
“হ্যা নিশ্চয়ই!”
শিমাও ফ্রিজ খুলে তাদের খালি গ্লাসগুলো ভরে নিল। ফিরে এসে বলল, “গল্পটা একটু বাজে। আপনার শুনতে খারাপ লাগবে না তো?”
“নাহ, বলো!”
“না মানে কিছু কিছু পুরুষ হয়তো মেয়েদের মুখ থেকে এই ধরনের গল্প শুনতে পছন্দ করে না!”
“আমি তেমন মানুষ নই।”
“এই ঘটনাটা আসলে আমার সঙ্গে ঘটেছে। তাই একটু বিব্রত আমি।”
“তোমার অসুবিধে না থাকলে বলতে পারো।”
“আমার অসুবিধে নেই।”
“বেশ!”
“তিন বছর আগের কথা। আমি সবেমাত্র কলেজ শুরু করেছি তখন। এক ছেলের সঙ্গে প্রেম ছিল আমার। সে ছিল আমার জীবনে প্রথম পুরুষ। এক শরতে আমরা উত্তরের পাহাড়ে গিয়েছিলাম হাইকিঙয়ে। শরৎকালের ওখানে বেশ ভালুকের আনাগোনা ছিল। তাই আমাদের সবার সাথে একটা করে ঘণ্টা নিয়েছিলাম। যখনই কেউ ভালুক দেখবে, ঘণ্টা বাজাবে। না দেখলেও বাজাবে। ভালুক তৃণভোজী, তারা মানুষকে আক্রমণ করে না অকারণে। হুট করে সামনে মানুষ পড়ে গেলে ভড়কে গিয়ে হামলা চালায় শুধু। তাই ঘণ্টা বাজানোর কথা ভেবেছিলাম আমরা। যাতে করে ঘণ্টার আওয়াজ শুনে ভালুক আগে থেকেই বুঝতে পারে এখানে মানুষ আছে, চলে যায় দূরে কিংবা হুট করে মানুষ দেখে ভয় না পায়। বুঝেছেন?”
“হ্যা। তারপর?”
“তো আমরা তাই করছিলাম। হাটছিলাম আর ঘণ্টা বাজাচ্ছিলাম। হঠাৎ আমার প্রেমিক, কাছে আসতে চাইল আমার। একটু অবাক হলেও ভালই লাগল আমার। পরিবেশটা সুন্দর, তবে ভালুকের ভয়ও ছিল। আমরা দু’জন একটা ঝোপের আড়ালে চলে গেলাম, যেখান থেকে অন্য কেউ দেখতে পাবে না আমাদের। তবে এই অবস্থায় যদি ভালুক আক্রমণ করে, কেমন লাগবে ব্যাপারটা, সেটা ভেবেও গায়ে কাঁটা দিল! কেউ নিশ্চয়ই এই অবস্থায় মরতে চায় না! তাই পুরোটা সময় আমরা ঘণ্টা বাজানোর সিদ্ধান্ত নিলাম।”
“কে ঘণ্টা বাজাচ্ছিল দু’জনের মধ্যে?”
“আমরা ভাগাভাগি করে বাজাচ্ছিলাম। যখন যে ক্লান্ত হচ্ছিল বাজাতে বাজাতে, হাত বদল করছিল ঘণ্টা। কি বিদঘুটে ব্যাপার! এখনও কারো কাছাকাছি হই যখন, ঘটনাটা মনে পড়ে আমার। হাসি পায়! কল্পনা করতে পারেন? টিং টিং টিং...পুরো সময়!”
কমুরা হাসি দমাতে পারল না আর। হেসে উঠল প্রাণখুলে।
হাতে তালি দিয়ে উঠল শিমাও। “চমৎকার! আপনি হাসতেও পারেন তাহলে!”
“অবশ্যই, হাসতে পারব না কেন!” বলেই কমুরা ভাবল, শেষ কবে হেসেছিল সে? অনেক দিন হবে নির্ঘাত!
“আমি এখানে স্নান সেরে নিলে কিছু মনে করবেন?”
“নাহ!”
অনেকক্ষণ সময় নিয়ে স্নান করল শিমাও। বসে বসে টিভিতে কমেডি শো দেখল কমুরা তখন। একদমই হাসি পেল না তার। সে বুঝতে পারল না সমস্যাটা কার, তার নাকি কমেডি শো-গুলোর! বার থেকে এক প্যাকেট বাদাম বের করল সে বিয়ারের সঙ্গে। অনেকক্ষণ পর শিমাও যখন বের হলো, তার পরনে তখন শুধু দীর্ঘ একটা তোয়ালে। তোয়ালেটা ছেড়ে দিয়ে বিড়ালের মতো চাদরের নিচে ঢুকে গেল সে, শুয়ে পড়ল কমুরার পাশে। জিজ্ঞেস করল-“শেষ কবে স্ত্রীর সঙ্গে এক হয়েছ?”
“ডিসেম্বরের শেষের দিকে হবে।”
“ব্যস, এরপর আর হয়নি?”
“না।”
“কারো সঙ্গেই না?”
“উহু!”
“তুমি জানো আমার কি মনে হয়? আমার মনে হয় জীবনটাকে উপভোগ করা উচিত তোমার। কাল হয়তো আরেকটা ভূমিকম্প হবে, কিংবা এলিয়েন এসে তুলে নিয়ে যাবে আমাদের, কিংবা ভালুকের পেটে চলে যাব আমরা, কেউ জানে না কি হতে যাচ্ছে সামনে!”
“হ্যা, কেউ জানে না কাল কি হবে!”
বেশ কয়েক বার শিমাওর সঙ্গে ব্যর্থ চেষ্টার পর একসময় হাল ছেড়ে দিল কমুরা। এমনটা আগে কখনো হয়নি তার। শিমাও বলল-“তুমি বোধহয় তোমার স্ত্রীর কথা ভাবছ!”
“হ্যা।”
তবে কমুরা আসলে ভাবছিল ভূমিকম্পের কথা। সেখানকার ভাঙন, ধোঁয়া, আগুন, ধ্বংসস্তূপ ইত্যাদি ভাসছিল তার চোখের সামনে। ওদের দু’জনের মাঝে নীরবতা নেমে এলো। সেটা ভাঙল না কমুরা। ওর বুকে কান পেতে দিল শিমাও। বলল- “ব্যাপার না, এমন হয়।”
“হু।”
“তোমার এসব চিন্তা মাথা থেকে বের করে দেওয়া উচিত।”
কমুরা কিছু বলল না। শিমাও হাত বোলাতে লাগল ওর বুকে। “তুমি বলেছিল, তোমার স্ত্রী একটা নোট রেখে গিয়েছে।”
“হ্যা।”
“কি বলেছিল সে ওখানে।”
“বলেছিল, আমার সঙ্গে থাকা মানে একতাল হাওয়ার সঙ্গে বসবাস করা।”
শিমাও মাথা তুলে তাকাল ওর দিকে। “এক তাল হাওয়া! কি বুঝিয়েছে সে এটা দিয়ে?”
“বোধহয় এটাই যে আমার ভেতর কিছু নেই। অন্তঃসারশূন্য আমি।”
“সেটা কি সত্যি?”
“হতে পারে। জানি না। তবে থাকবেই বা কি ভেতরে?”
“হ্যা, কিই বা থাকবে মানুষের ভেতর! আমার মায়ের কথা ধরো। আমার মা সালমন মাছের চামড়া খুব পছন্দ করত। মা প্রায়ই ভাবত, যদি এমন একটা সালমন মাছ পাওয়া যায়, যেটাতে শুধু চামড়াই থাকবে, অন্যকিছু নয়, তবে দারুণ হতো! মাঝে মাঝে বোধহয় চামড়া থাকাই গুরুত্বপূর্ণ, মাঝে মাঝে বোধহয় অন্তঃসারশূন্য হওয়াই ভাল! কি বলো?”
কমুরা কিছু বলল না। সে ভাবতে লাগল এমন একটা সালমন মাছের কথা, যার ভেতর চামড়া ছাড়া কিছু নেই। পুরো শরীর চামড়ায় ভর্তি। কিন্তু সেক্ষেত্রেও তো এক চামড়ার ভেতর আরেক চামড়ার পরত থাকবে। সেটাকে অন্তঃসারশূন্য বলা যায় কি?
সে শিমাওর মাথাটা নিজের বুকে চেপে ধরল।
শিমাও বলল, “আমি জানি না তোমার ভেতর কিছু আছে কি নেই! কিন্তু তুমি অসাধারণ একজন মানুষ। দুনিয়াভর্তি অনেক মেয়ে পাবে, যারা তোমার প্রেমে পড়বে নির্দ্বিধায়! যারা বুঝতে পারবে তোমাকে।”
“হ্যা, সেটাও লেখা ছিল।”
“কোথায়? তোমার স্ত্রীর রেখে যাওয়া চিরকুটে?”
“হ্যা।”
“কি বলো!” নিজের কানের দুলটা কমুরার বুকে ঘষতে ঘষতে বলল সে।
“এ প্রসঙ্গ থেকে মনে পড়ল, যে প্যাকেটটা আজ দিয়েছি আমি কাইকিকে, কি ছিল সেটার ভেতর?”
“প্রশ্নটা বিরক্ত করছে তোমাকে?”
“আগে করেনি, এখন করছে।”
“কখন থেকে?”
“এই এখন থেকে!”
“হঠাৎ করেই?”
“হ্যা, হঠাৎ করেই!”
“হঠাৎ করেই এই প্রশ্নটা বিরক্ত করছে কেন তোমাকে?”
“জানি না, মনে হলো।”
দু’জন কিছুক্ষণ চুপচাপ নিজেদের নিঃশ্বাসের আওয়াজ শুনল।
শিমাও নিচু গলায় তাকে বলল-“আমি বলি কেন তোমাকে ভাবাচ্ছে প্রশ্নটা। তুমি ঐ প্যাকেটের ভেতর এমন কিছু নিয়ে এসেছিলে, যেটা তোমার নিজের ভেতরে ছিল। কিন্তু বাক্সটা তুমি দিয়ে দিয়েছ কাইকিকে, আর কখনো ফেরত পাবে না। তোমার ভেতরের অংশটুকুও তাই ঐ বাক্সের সঙ্গে হারিয়ে গেছে।”
কমুরা উঁচু হয়ে মেয়েটার দিকে ঝুঁকল। তাকাল তার নগ্ন শরীরের দিকে। দেখল তার ছোট নাক, কানের লতিতে থাকা তিল। নিজের বুকের ধুকপুকুনি শুনতে পেল সে। এক মুহূর্তের জন্য তার মনে হলো, সে ভয়াবহ হিংস্র কিছু করতে যাচ্ছে। ওর মুখেও নিশ্চয়ই সেই হিংস্র, সহিংস ভাবটা ফুটে উঠেছিল! শিমাও সেটা লক্ষ্য করে বলল, “মজা করেছি। কিছু মনে করো না। মাথায় যা এসেছে, বলে দিয়েছি। বোকার মতো হয়েছে কাজটা। মনে নিও না কথাটা। আমি তোমাকে কষ্ট দিতে চাইনি।”
কমুরা নিজের উপর জোর খাটিয়ে শান্ত হবার চেষ্টা করল, বিছানায় এলিয়ে দিল শরীরটা আবার। নিশাচর সমুদ্রের মতো যেন বিছানাটা ছেঁকে ধরল তাকে। বুক ধড়ফড় করছিল তখনও তার।
শিমাও জিজ্ঞেস করল- “তোমার এখনও মনে হচ্ছে না, বাড়ি থেকে অনেক দূরে চলে এসেছ তুমি?”
“হ্যা, এখন মনে হচ্ছে আসলেই অনেক দূরে এসেছি।”
ওর বুকে আঙুল দিয়ে আঁকিবুঁকি করতে করতে শিমাও বলল, “তবে সত্যি বলতে, সবকিছুর শুরু হলো মাত্র! তুমি ঠিক প্রারম্ভে দাঁড়িয়ে আছো!”

লেখক পরিচিতিঃ হারুকি মুরাকামি
১৯৪৯ সালে জাপানে জন্ম নেওয়া বিখ্যাত এক কথা সাহিত্যিক। তার মৌলিক রচনার মধ্যে আ ওয়াইল্ড শিপ চেজ (১৯৮২), নরওয়েজিয়ান উড (১৯৮৭), দি উইন্ড আপ বার্ড ক্রনিকল (১৯৯৫), কাফকা অন্য দি শোর (২০০২) এবং ওয়ানকিউএইটফোর (২০১০) অন্যতম। তিনি জাপানি ভাষায় অনুবাদ করেছেন অনেক বিদেশী সাহিত্য। পেয়েছেন ওয়ার্ল্ড ফ্যান্টাসি এওয়ার্ড, ফ্রান্‌ৎস কাফকা পুরষ্কার সহ আরও অনেক পুরষ্কার। তিনি অত্যন্ত শক্তিশালী একজন লেখক বর্তমান সময়ে। তার লেখা জুড়ে থাকে উন্মাদনা, শূন্যতা, অর্থহীনতা এবং গভীর জীবনবোধ। জীবিত লেখকদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ লেখক হিসেবে তাকে আখ্যা দেয় দা গার্ডিয়ান পত্রিকা।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জানুয়ারি, ২০১৯ সকাল ১০:৫০
১২টি মন্তব্য ১২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা ও পদ্মশ্রী পুরস্কার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ সকাল ১১:৫৬



এ বছরের পদ্মশ্রী (ভারতের চতুর্থ সর্বোচ্চ অসামরিক সম্মাননা) পদকে ভূষিত করা হয়েছে, বাংলাদেশের রবীন্দ্র সংগীত এর কিংবদন্তি শিল্পী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যাকে।

আমরা গর্বিত বন্যাকে নিয়ে । ...বাকিটুকু পড়ুন

কষ্ট থেকে আত্মরক্ষা করতে চাই

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৯



দেহটা মনের সাথে দৌড়ে পারে না
মন উড়ে চলে যায় বহু দূর স্থানে
ক্লান্ত দেহ পড়ে থাকে বিশ্রামে
একরাশ হতাশায় মন দেহে ফিরে।

সময়ের চাকা ঘুরতে থাকে অবিরত
কি অর্জন হলো হিসাব... ...বাকিটুকু পড়ুন

রম্য : মদ্যপান !

লিখেছেন গেছো দাদা, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১২:৫৩

প্রখ্যাত শায়র মীর্জা গালিব একদিন তাঁর বোতল নিয়ে মসজিদে বসে মদ্যপান করছিলেন। বেশ মৌতাতে রয়েছেন তিনি। এদিকে মুসল্লিদের নজরে পড়েছে এই ঘটনা। তখন মুসল্লীরা রে রে করে এসে তাকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

= নিরস জীবনের প্রতিচ্ছবি=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৪১



এখন সময় নেই আর ভালোবাসার
ব্যস্ততার ঘাড়ে পা ঝুলিয়ে নিথর বসেছি,
চাইলেও ফেরত আসা যাবে না এখানে
সময় অল্প, গুছাতে হবে জমে যাওয়া কাজ।

বাতাসে সময় কুঁড়িয়েছি মুঠো ভরে
অবসরের বুকে শুয়ে বসে... ...বাকিটুকু পড়ুন

Instrumentation & Control (INC) সাবজেক্ট বাংলাদেশে নেই

লিখেছেন মায়াস্পর্শ, ২৩ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৫




শিক্ষা ব্যবস্থার মান যে বাংলাদেশে এক্কেবারেই খারাপ তা বলার কোনো সুযোগ নেই। সারাদিন শিক্ষার মান নিয়ে চেঁচামেচি করলেও বাংলাদেশের শিক্ষার্থীরাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশে সার্ভিস দিয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×