somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

ডা. মোহাম্মদ মোমিনুজ্জামান খান
আমি, নিতান্তই একজন সাধারণ বাংলাদেশি। এই ব্লগে আমি আমার গল্প বলি — আমার কথা, আমার ভাবনা, একজন সাধারণ মানুষের, যে তার আয়নায় অসাধারণ স্বপ্ন দেখে। চলুন, একসঙ্গে খুঁজে দেখি আমার আয়নার সেই প্রতিচ্ছবি, যেখানে আমি শুধু আমি নই, আমি আমার বাংলাদেশ।

রাস্তা আটকে জনভোগান্তির সংস্কৃতি বনাম সভ্য বাংলাদেশের স্বপ্ন

০৮ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ৯:৫৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


বাংলাদেশের রাস্তাঘাটে একটা অদ্ভুত সংস্কৃতি গড়ে উঠেছে; যখন তখন, যেখানে সেখানে রাস্তা আটকে মিছিল, সভা-সমাবেশ, কিংবা কোনো না কোনো বিক্ষোভ। এটা এমন একটা দৃশ্য যা আমাদের প্রতিটি শহর, জেলা, এমনকি উপজেলার রাস্তাগুলোতে নিত্যদিনের সঙ্গী। সকালে অফিসে যাওয়ার তাড়া, স্কুলের বাচ্চাকে নিয়ে যাওয়ার ব্যস্ততা, কিংবা হাসপাতালে জরুরি রোগী নিয়ে ছুটে যাওয়ার মুহূর্তে, হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে একটা মিছিল! ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, মাইক হাতে স্লোগান, আর পেছনে শত শত গাড়ির জটলা। এই দৃশ্য কি আমাদের ‘সভ্য সমাজের’ পরিচয়? নাকি এটা একটা অসভ্যতার সংস্কৃতি, যা আমরা বছরের পর বছর ধরে বয়ে বেড়াচ্ছি? আজকের এই লেখায় আমরা এই বিষয়টি নিয়ে একটু বিশ্লেষণধর্মী ছোঁয়ায় আলোচনা করব। কেন এই অবস্থা, কেন এটা বন্ধ হওয়া উচিত, আর কীভাবে আমরা একটা সভ্য বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখতে পারি; চলুন, ডুবে যাই।

রাস্তা আটকানো: একটি ‘জাতীয় সংস্কৃতি’?

একটা দৃশ্য কল্পনা করুন, আপনি সকাল সকাল অফিসে যাচ্ছেন। বাসে, রিকশায়, কিংবা নিজের গাড়িতে। হঠাৎ রাস্তার মাঝখানে একটা মিছিল। পতাকা-ব্যানার- প্ল্যাকার্ড হাতে, স্লোগানে মুখরিত কিছু মানুষ। আপনার যান থেমে গেছে, পেছনে অ্যাম্বুলেন্সের সাইরেন বাজছে, কিন্তু কেউ নড়ছে না। মিছিলের নেতারা মাইকে চিৎকার করে বলছেন, “আমাদের দাবি মানতে হবে!” কিন্তু আপনার মনে প্রশ্ন জাগে, “আমার অফিসে যাওয়ার দাবি কে মানবে? আমার বাচ্চার স্কুলে পৌঁছানোর দাবি কে মানবে? হাসপাতালে রোগীর জীবন বাঁচানোর দাবি কে মানবে?” এই প্রশ্নগুলোর উত্তর কেউ দেয় না। কারণ, আমাদের দেশে রাস্তা আটকানো যেন একটা ‘অধিকার’ হয়ে দাঁড়িয়েছে।

আমরা বাঙালিরা অনেক কিছুতেই গর্ব করি; আমাদের ভাষা, সংস্কৃতি, সাহিত্য, ঐতিহ্য আর স্বাধীনতার ইতিহাস। কিন্তু এই যে যখন তখন রাস্তা আটকে সভা-সমাবেশ আর মিছিল করা, এটা কি আমাদের জাতীয় সংস্কৃতির অংশ হয়ে উঠেছে? একটু ভেবে দেখুন, কোনো রাজনৈতিক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী, কোনো নেতার জন্মদিন, কোনো ব্যক্তিগত বা দলীয় বা জাতীয় উদযাপন, কিংবা কোনো সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ, সবকিছুর জন্যই রাস্তা বন্ধ! আর এই সভা-সমাবেশ এবং মিছিলের নামে যে জনভোগান্তি হয়, তা যেন কারোরই মাথাব্যথার বিষয় নয়। দিনে দিনে অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে ভবিষ্যতে বাবা-মা পকেটমানি না দিলে অথবা পারিবারিক কথা কাটাকাটির জেরে রাস্তা আটকালেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না!

জনভোগান্তির মূল্য কে দেবে?

একটা মজার বিষয় লক্ষ্য করেছেন? যারা রাস্তা আটকে সভা-সমাবেশ-মিছিল করে, তারা সবাই বলে, “আমরা জনগণের অধিকারের জন্য লড়ছি!” কিন্তু এই ‘জনগণ’ কারা? রাস্তায় আটকে থাকা সেই বাসের যাত্রী? পেছনে অ্যাম্বুলেন্সে শুয়ে থাকা রোগী? নাকি স্কুলে দেরি হয়ে যাওয়া বাচ্চার বাবা-মা? এই ‘জনগণ’ যদি ভোগান্তির শিকার হয়, তাহলে কার জন্য এই সভা-সমাবেশ-মিছিল? এটা কি জনগণের জন্য, নাকি শুধু একটা দলের, একটা গোষ্ঠীর, কিংবা একটা ব্যক্তির স্বার্থের জন্য? উপরন্তু এই সভা-সমাবেশ-মিছিল আয়োজনকারীরা কখনো-সখনো এর জন্য বিবেকহীন দুঃখ প্রকাশ করে হাসিমুখে জনগণকে এই ভোগান্তি মেনে নিতে বলে। আহা, কি নিদারুন উপহাস!

একটু পরিসংখ্যানের দিকে তাকাই। বাংলাদেশে প্রতিদিন কত মানুষ শুধু ঢাকা শহরেই যানজটে আটকে থাকে? একটি গবেষণা বলছে, ঢাকার মানুষ গড়ে প্রতিদিন ৩-৪ ঘণ্টা যানজটে নষ্ট করে। এর মধ্যে মিছিল-সভা-সমাবেশের কারণে সৃষ্ট যানজটের অংশ কতটা, তা নিয়ে সুনির্দিষ্ট তথ্য না থাকলেও, আমরা সবাই জানি, এটা একটা বড় অংশ। এই সময়ের অর্থনৈতিক ক্ষতি, মানসিক চাপ, আর সামাজিক অস্থিরতার মূল্য কে দেবে? সভা-সমাবেশ-মিছিলকারীরা? নাকি সরকার? নাকি আমরা, সাধারণ মানুষ, যারা এই ভোগান্তির নীরব শিকার?

সভ্য সমাজে এটা কোন কালচার?

একটা সভ্য সমাজের সংজ্ঞা কী? আমরা যদি বলি, সভ্য সমাজ হলো এমন একটা সমাজ, যেখানে প্রত্যেকে একে অপরের অধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল, তাহলে রাস্তা আটকে সভা-সমাবেশ-মিছিল করা কি সভ্যতার লক্ষণ? বিশ্বের উন্নত দেশগুলোতে বিক্ষোভ বা সভা-সমাবেশ হয় না? অবশ্যই হয়। কিন্তু সেখানে একটা নির্দিষ্ট নিয়ম মানা হয়। নির্দিষ্ট জায়গায়, নির্দিষ্ট সময়ে, এবং সরকারের অনুমতি নিয়ে এসব সমাবেশ হয়। ফ্রান্সে বিক্ষোভ হয়, লন্ডনে মিছিল হয়, কিন্তু আপনি কি কখনো শুনেছেন, লন্ডনের অক্সফোর্ড স্ট্রিটের মাঝখানে মিছিল করে পুরো শহর অচল করে দেওয়া হয়েছে? নাকি প্যারিসের চ্যাম্পস-এলিসিসে বিক্ষোভ করে অ্যাম্বুলেন্স আটকে রাখা হয়েছে?

আমাদের দেশে এই ‘যখন তখন, যেখানে সেখানে’ সভা-সমাবেশ-মিছিলের সংস্কৃতি কেন? এটা কি আমাদের রাজনৈতিক অস্থিরতার প্রতিফলন? নাকি আমাদের নাগরিক সচেতনতার অভাব? নাকি এটা শুধুই একটা অভ্যাস, যা আমরা বিনা প্রশ্নে মেনে নিয়েছি? যাই হোক, এটা কোনো সভ্য সমাজের বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।

সমাধানের পথ: নির্দিষ্ট স্থান, নির্দিষ্ট নিয়ম

এই সমস্যার সমাধান কী? খুব সহজ। প্রতিটি শহর, জেলা, উপজেলায় নির্দিষ্ট স্থান বরাদ্দ করা হোক, যেখানে সভা-সমাবেশ, মিছিল, বা বিক্ষোভ হবে। এই স্থানগুলো হতে হবে এমন, যেখানে জনসাধারণের চলাচল ব্যাহত না হয়। উদাহরণস্বরূপ, ঢাকায় সোহরাওয়ার্দী উদ্যান বা কোনো স্টেডিয়াম হতে পারে এমন জায়গা। কিন্তু সেজন্য আশেপাশের রাস্তায় বা এলাকায় অথবা সেখানে আসা-যাওয়ার পথে কোন ধরনের প্রতিবন্ধকতা বা অসুবিধা সৃষ্টি করা যাবে না, এমন কোনো কিছু করা যাবে না যা সাধারণ জনগণের ভোগান্তি বা দৈনন্দিন চলাফেরায় ব্যঘাত ঘটায়। প্রয়োজনে আইন করে এটা বাধ্যতামূলক করা হোক। যে কোনো সভা-সমাবেশ-মিছিলের জন্য সরকারের কাছ থেকে পূর্বানুমতি নিতে হবে, এবং রাস্তা আটকে সভা-সমাবেশ-মিছিল করলে কঠোর শাস্তির বিধান রাখা হোক।

এটা কি খুব কঠিন? একেবারেই না। বিশ্বের অনেক দেশেই এমন নিয়ম আছে। আমাদের দেশেও এটা করা সম্ভব। কিন্তু এর জন্য দরকার রাজনৈতিক সদিচ্ছা, নাগরিক সচেতনতা, আর জনগণের সহযোগিতা। আমরা যদি সত্যিই একটা সভ্য বাংলাদেশ গড়তে চাই, তাহলে এই অসভ্য সংস্কৃতির অবসান ঘটাতে হবে।

শেষ কথা: সভ্য বাংলাদেশের স্বপ্ন

আমরা সবাই একটা সুন্দর, সভ্য, উন্নত, এবং সাম্যের বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখি। কিন্তু সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য আমাদের নিজেদেরও কিছু করতে হবে। রাস্তা আটকে সভা-সমাবেশ-মিছিল করা কোনো অধিকার নয়, এটা অন্যের অধিকার কেড়ে নেওয়ার একটা অসভ্য প্রকাশ। আসুন, আমরা সবাই মিলে এই সংস্কৃতির বিরুদ্ধে কথা বলি। আসুন, আমরা একটা এমন বাংলাদেশ গড়ি, যেখানে রাস্তা থাকবে চলাচলের জন্য, সভা-সমাবেশ-মিছিলের জন্য নয়। যেখানে জনগণের ভোগান্তি হবে না, বরং জনগণের সুবিধা নিশ্চিত করা হবে।

তাহলে, প্রিয় পাঠক, আপনি কি বলেন? এই অসভ্য সংস্কৃতির অবসান হোক? নাকি আমরা আরও কয়েক দশক রাস্তায় আটকে থাকব, সভা-সমাবেশ-মিছিলের স্লোগান শুনতে শুনতে? পছন্দটা আপনার। কিন্তু আমি বলব, চলুন, আমাদের সভ্য বাংলাদেশের স্বপ্নকে ছড়িয়ে দিই আর একটা সভ্য বাংলাদেশের জন্য একসঙ্গে কাজ করি।
সর্বশেষ এডিট : ০৮ ই আগস্ট, ২০২৫ রাত ৯:৫৮
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

দ্যা এডামেন্ট আনকম্প্রোমাইজিং লিডার : বেগম খালেদা জিয়া

লিখেছেন ডি এম শফিক তাসলিম, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ সকাল ১০:০৪

১৯৪৫ সালে জন্ম নেয়া এই ভদ্রমহিলা অন্য দশজন নারীর মতই সংসার নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, বিয়ে করেছিলেন স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সুশাসক শহিদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান কে! ১৯৭১সালে এ... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছি , অবৈধ দখলদার॥ আজকের প্রতিটি অন‍্যায়ের বিচার হবে একদিন।

লিখেছেন ক্লোন রাফা, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:১০



ধিক ‼️বর্তমান অবৈধভাবে দখলদার বর্তমান নরাধমদের। মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশে । বীর মুক্তিযোদ্ধাদের ক্ষমা চাইতে হলো ! রাজাকার তাজুলের অবৈধ আদালতে। এর চাইতে অবমাননা আর কিছুই হোতে পারেনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

আম্লিগকে স্থায়ীভাবে নিষিদ্ধে আর কোন বাধা নেই

লিখেছেন সৈয়দ মশিউর রহমান, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ দুপুর ১২:২২


মঈন উদ্দিন ফখর উদ্দিনের ওয়ান-ইলেভেনে সরকারের ২০০৮ সালের ডিসেম্বরে ভারতের সহায়তায় পাতানো নির্বাচনে হাসিনা ক্ষমতায় বসে। এরপরই পরিকল্পিত উপায়ে মাত্র দুই মাসের মধ্যে দেশপ্রেমিক সেনা অফিসারদের পর্যায়ক্রমে বিডিআরে পদায়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মিশন: কাঁসার থালা–বাটি

লিখেছেন কলিমুদ্দি দফাদার, ০৪ ঠা ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ৯:২৭

বড় ভাই–ভাবীর ম্যারেজ ডে। কিছু একটা উপহার দেওয়া দরকার। কিন্তু সমস্যা হলো—ভাই আমার পোশাক–আশাক বা লাইফস্টাইল নিয়ে খুবই উদাসীন। এসব কিনে দেওয়া মানে পুরো টাকা জ্বলে ঠালা! আগের দেওয়া অনেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামী লীগের পাশাপাশি জামায়াতে ইসলামীকেও নিষিদ্ধ করা যেতে পারে ।

লিখেছেন সৈয়দ কুতুব, ০৫ ই ডিসেম্বর, ২০২৫ রাত ১২:৪৫


বাংলাদেশে আসলে দুইটা পক্ষের লোকজনই মূলত রাজনীতিটা নিয়ন্ত্রণ করে। একটা হলো স্বাধীনতার পক্ষের শক্তি এবং অন্যটি হলো স্বাধীনতার বিপক্ষ শক্তি। এর মাঝে আধা পক্ষ-বিপক্ষ শক্তি হিসেবে একটা রাজনৈতিক দল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×