নিরাপত্তা, জনপ্রিয়তা এবং সহকর্মীদের আনুগত্য একজন নেতার জন্য খুবই দরকার। দীর্ঘদিনের নিবেদিতপ্রাণ নেতৃত্বের জন্য এগুলোকে নেতার অর্জন বলেই বিবেচনা করা উচিত। অথচ শুরুতে এগুলো প্রলোভন হয়েই আসে। প্রতিষ্ঠানের গুরুত্বপূর্ণ পদে থাকা ব্যক্তিদের জন্য এগুলো ফাঁদ হিসেবে কাজ করে। নিরাপত্তাকর্মীই নিরাপত্তার জন্য একনম্বর হুমকি হয়ে দাঁড়ায়। সবচেয়ে অনুগত কর্মীটি কর্তৃপক্ষের আস্থার সুযোগে হয়ে ওঠে সবচেয়ে দুর্নীতিবাজ। নিজের নিরাপত্তার জন্য নিযুক্ত ‘আত্মীয় সহকর্মীটি’ অন্যান্য পেশাদার কর্মীদের জন্য ফ্রাংকেনস্টাইন হয়ে পুরো প্রতিষ্ঠানকে ধ্বংসের মুখে ফেলে। অতিরিক্ত নিরাপত্তাবোধ, তথা জনপ্রিয়তা লাভের আকাঙক্ষা, তথা নিজেকে সকলের মনযোগের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখার ইচ্ছা দায়িত্বশীল মানুষদেরকে নিষ্ক্রীয় করে তোলে। এগুলো দায়িত্ব পালন, সিদ্ধান্ত গ্রহণ অথবা পক্ষপাতহীনভাবে কাজ করার প্রধান প্রতিবন্ধকতা। এসবই নেতার জন্য প্রলোভন। এরকম সাতটি প্রলোভন নিয়ে আজকের লেখাটি।
প্রলোভন ১/ নিজের নিরাপত্তা... কমফোর্ট জোন
নিরাপত্তা একটি ফাঁদের নাম। আরাম একটি ভণ্ড প্রেমিকার (প্রেমিকের) নাম। নিরাপত্তাবোধ একটি কারপুরুষোচিত অনুভবের নাম। কথাগুলো গড়পরতা কোন মানুষের জন্য নয়। বলছি, নেতার কথা। নেতা যতক্ষণ নিজের নিরাপত্তা আর আরামের বিষয়ে ব্যস্ত থাকেন, ঠিক ততক্ষণ তার দল বা প্রতিষ্ঠান থাকে অবহেলিত। কমফোর্ট জোন একটি দল বা প্রতিষ্ঠানের জন্য মঙ্গলজনক, কিন্তু নেতার জন্য বিপদজনক। নেতার জন্য প্রথম প্রলোভন হলো, নিজের নিরাপত্তায় মগ্ন থাকা। এই বাক্স থেকে বের না হওয়া পর্যন্ত নেতা কোন ‘আউট-অভ-দ্য-বক্স’ চিন্তা করতে পারেন না, কিন্তু দূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিতে পারেন না, কোন সাহসী গন্তব্যের দিকে দলকে পরিচালনা দিতে পারেন না। ম্যাকিয়াভেলি বলেছেন, বিপদের মুখোমুখি না হয়ে মহৎ কিছু অর্জিত হয় নি।
প্রলোভন ২/ প্রাপ্তির প্রয়োজনীয়তা... সবকিছুতে বিশেষ হবার আকাঙ্ক্ষা
অতিরিক্ত প্রাপ্তির লোভ নেতাকে দিকভ্রষ্ট করে। অতিরিক্ত শ্রদ্ধাবোধ, দলের সদস্যদের পক্ষ থেকে অতিরিক্ত মনযোগ, অতিরিক্ত সেবা ও অতিরিক্ত অর্থের আকাঙ্ক্ষা - এসবই নেতার জন্য প্রলোভন। অর্থ ও বস্তুগত প্রয়োজনীয়তার কোন অন্ত নেই। মাসলো’র চাহিদা বিধি অনুসারে, মানুষের প্রয়োজনীয়তা ক্রমবর্ধমান। একটি পাবার সাথে সাথে এরচেয়ে উচ্চতর আরেকটি পাবার ইচ্ছা হয়। মোটরবাইকের মালিক হবার পর, গাড়ির মালিক হবার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। গাড়ির মালিক হবার পর দেখা যায়, সেটি অন্যান্য গাড়ির মতো আকর্ষণীয় নয়। তখন গাড়ির ব্রান্ড পরিবর্তন করার ইচ্ছে হয়। ইত্যাদি। এটি হতেই পারে। অভাব অনুভব করা, আর যেকোনভাবে সে অভাবকে পূরণ করার জন্য বেপরোয়া হলেই সেটি অপরাধের দিকে নিয়ে যায়।
প্রলোভন ৩/ সম্পর্কের সুবিধা... একই সাথে ফাঁদ এবং সুযোগ
অনৈতিক সুবিধা। পদ ও সুখ্যাতির কারণে অনেক লোভনীয় সম্পর্কের সুযোগ হয়। বিপরীত লিঙ্গের এমন কাওকে পেয়ে যাবেন, যাকে দেখেই মনে হবে তাকে কাছে টানি; তার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ি। হয়তো চাইলেই পেয়ে যাবেন। নেতাকে মনে রাখতে হবে, এটি শুধু ক্ষমতার অপব্যবহার নয়, এটি শুধু অনৈতিকতা নয়, এটি শুধু আপনার জনপ্রিয়তাকে কমিয়েই ছাড়বে না - এটি আপনার অতীত ও বর্তমানকে ধূলিস্যাৎ করে ছাড়বে। তিলে তিলে গড়া ব্যক্তি ইমেজকে, আপনার প্রতিষ্ঠানকে, আপনার কর্মীদলকে পরিচালনা দেবার আত্মবিশ্বাসকে, আপনার হুকুম দেবার শক্তিকে নিমিষে শেষ করে দেবে। পরদিন সকালে আপনি বের হবার শক্তিটুকু পাবেন না। এটি নেতৃত্বের প্রধান এবং প্রাচীণতম প্রলোভন, ইতিহাসে এবিষয়ে দৃষ্টান্তের অভাব নেই। কিন্তু অতিক্রম করতে পারলে এখান থেকে অপরিমেয় সম্ভাবনার দরজা খুলে যায়।
প্রলোভন ৪/ জনপ্রিয়তা... এর মিষ্টতাকে উপেক্ষা করাটা একটু কঠিনই
জনপ্রিয়তার প্রয়োজন আছে। এটি সম্পর্ককে ঘনিষ্ঠ করে, যোগাযোগকে সহজ করে। প্রতিষ্ঠান ও বৃহৎ স্বার্থকে অক্ষুণ্ন রেখেও জনপ্রিয়তা পাওয়া গেলে, সেটি সোনায় সোহাগা। কিন্তু সেটি যদি না হয়, তবে জনপ্রিয়তা নেতার জন্য একটি বিষের পেয়ালা মাত্র। এতে আসক্ত হবার মানে হলো নেতার অপমৃত্যু। ভক্ত ও সাগরেদ প্রাপ্তির লোভ এবং তাদের প্রতি আপনার বাড়তি দায়বদ্ধতা আপনার অগ্রগতিকে আটকে দেয়। নেতার প্রধান কাজ হলো সংশ্লিষ্টদের আস্থা অর্জন, জনপ্রিয়তা এর স্বাভাবিক পরিণতি। জনপ্রিয়তাকে উপযুক্ত মাত্রায় প্রয়োগ এবং প্রয়োজনে জনপ্রিয়তাকে এড়িয়ে যাবার মধ্যেই নেতার সফলতা। জনপ্রিয়তা লাভের প্রতিযোগিতায় অংশ নেওয়া নেতার কাজ নয়। নীতিতে অটল থাকতে চাইলে জনপ্রিয়তাকে বিসর্জন দিয়েই নেতাকে এগুতে হয়। যারা ভবিষ্যতকে দেখতে পায় না, তাদের সাথে নেতার ঐক্যমত সম্ভব নয়।
প্রলোভন ৫/ পরিবার ও আত্মীয়... নেতার প্রধান প্রতিপক্ষ তার নিজের লোক
নেতার নিরাপত্তার জন্য এমন সময় আসে, যখন নিজের লোককে পদ বা সুযোগ দেবার প্রয়োজন হয়। নিজের মানুষদের জন্য বা আত্মীয়ের জন্য তার একটি দায় থাকেই। কাছের মানুষকে সুবিধা দেবার দায় সবারই থাকে। এমন সময় আসে যে, নেতা ইচ্ছে করলেই সেটি পারেন। এটি তখনই প্রলোভন হয়ে যায়, যখন নিজের পদের ক্ষমতার অপপ্রয়োগ করতে হয়। পরিবার, আত্মীয় বা বন্ধুবান্ধবকে নিয়মবহির্ভুত সুযোগ পাইয়ে দেবার আকাঙ্ক্ষা নেতার জন্য বড় একটি প্রলোভন। এই প্রলোভনে পড়ে অনেকেই আস্থা হারিয়েছে এবং পদচ্যুত হয়েছে। সিদ্ধান্তগ্রহণ থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সকল পর্যায়ে প্রতিবন্ধতা সৃষ্টি করবে আপনার নিকটজনেরা। তাদের উপস্থিতি অন্যান্য সহকর্মীদের মধ্যে আপনার পক্ষপাতহীনতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে। আপনার নেতৃত্বকে করবে বিপদসংকুল।
প্রলোভন ৬/ অযাচিত আনুগত্য... বস নাকি প্রতিষ্ঠান?
কর্মীর আচরণে অতিরিক্ত আনুগত্য দেখা গেলে প্রথমেই সন্দেহ করা উচিত - কোন অতিরিক্ত বা অনৈতিক প্রাপ্তির পূর্বপ্রস্তুতি হিসেবে সেটি করে থাকতে পারে। আদর্শ নেতা ব্যক্তিগত আনুগত্যের অপেক্ষায় থাকতে পারেন না, কারণ সেটি তার নিরপেক্ষতাকে ক্ষতিগ্রস্ত করতে পারে। তিনি হয়তো অতিরিক্ত অনুগতদের প্রতি পক্ষপাতিত্ব করে প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি করে বসতে পারেন। আদর্শ নেতা চান, কর্মী প্রথমত দল বা প্রতিষ্ঠানের প্রতি অনুগত হোক। সেটিই নেতার প্রতি প্রকৃত আনুগত্য।
প্রলোভন ৭/ কথা বলার আকুলতা... কথা কাজের প্রতিবন্ধকতা
শ্রোতা পেলে কথা বলার আকুলতায় আসবেই। পদবির খাতিরে কিছু দর্শকশ্রোতা জুটবেই। তারা শুনতেই চাইবে আপনার কথা, কারণ এই কথা থেকে তারা কিছু সিদ্ধান্ত পাবে; দিকনির্দেশনা পাবে। ঠিক একারণেই কথায় নিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত, যেন অতিরিক্ত কিছু না বলা হয়। সবাই আগ্রহভরে আপনার কথা শুনবে, অন্তত দেখতে সেরকম দেখাবে। দেখবেন, তারা শুনেই যাচ্ছে। তাতে আপনি হয়তো আরও আগ্রহ পাবেন কথা বলার। কথা থেকে কথার শাখা প্রশাখা বের হয়ে বাক্য থেকে অনুচ্ছেদ, অনুচ্ছেদ থেকে গল্পে পরিণত হবে। তাতে অনিচ্ছাকৃত কিছু ভুল, কিছু অসর্তক অসত্য, অসময়ের অযাচিত কথা, কিছু মানবিক দুর্বলতার বিষয় বের হয়ে আসবে। এটি আপনাকে সবার সামনে বিপদাপন্ন করবে। শুধু তা-ই নয়, ভবিষ্যৎ কর্মপ্রক্রিয়াকেও করে তুলবে বাধাগ্রস্ত। কাজ করতে চাইলে বক্তৃতা বন্ধ করতে হবে। বক্তৃতা করতে চাইলে কাজ বন্ধ করতে হবে।
----------------------------------------------
এলোমেলো লেখাটি ছুটির দিনের অলস চিন্তার ফসল। ক্রমান্বয়ে পরিমার্জিত হতে থাকবে। ঢাকায় ফিরলাম ৫দিন পর। সবাইকে বাংলা ব্লগ দিবসের শুভেচ্ছা...
পরবর্তি পর্ব: নেতার শক্তির উৎস।
সর্বশেষ এডিট : ২৩ শে ডিসেম্বর, ২০১৭ রাত ৮:৪৫