ছোটবেলা থেকেই পায়ুসৈনিকদের বিভিন্ন ধর্মীয় নৈশ সার্কাস পার্টিগুলোতে হুমায়ুন আজাদ সম্পর্কে প্রচুর কুৎসা শুনতে শুনতে বড় হয়েছি, কারণ হিসেবে ঐসব অনুর্বর মস্তিষ্কের ভাঁড়গুলো ব্যাখ্যা করতো উনি যৌনতা, নারী, ধর্ম, এবং ধর্মান্ধ ছাগুদের নিয়ে লেখতেন এজন্য নিন্দনীয়। কিন্তু কখনোই ওনাকে সরাসরি পড়ার সুযোগ হয়নি, তাই সবসময়ই ওনাকে একজন খারাপ লোক হিসেবেই জানতাম। এমনকি আমি বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পাঠদানে অযোগ্য, স্থুল মস্তিষ্কের যেসব নিম্নরুচিসম্পন্ন এবং অশিক্ষিত শিক্ষকদের পেয়েছি যারা কিনা সর্বোচ্চ গ্রামের কোন ফোরকানিয়া মাদ্রাসার শিক্ষক হওয়ার মতো যোগ্যতা রাখেন, তারাও দেখতাম হুমায়ুন আজাদকে নিয়ে প্রচুর সমালোচনা করতো।
এই বিখ্যাত "খারাপ" লোকটাকে প্রথম জানার সুযোগ হয় ওনার বিখ্যাত গ্রন্থ "নারী" পাঠের মাধ্যমে, তখন আমি বিশ্ববিদ্যালয় ভর্তি কোচিং করার জন্য ঢাকায় আসছি, আমার পাশের রুমেই থাকতো বন্ধু মাহাথির মোহাম্মদ, ও দেখতাম প্রচুর বই পড়তো, তখন ওর কাছ থেকে আনু মোহাম্মদ স্যারের কয়েকটা বই নিয়ে পড়েছি আর আমার পড়ার আগ্রহ দেখে একদিন নারী পড়তে দিলো। এভাবেই শুরু হয় ওনার প্রতি ভালোবাসা, ভালোলাগা এবং মুগ্ধতা। এই বইটা পড়ার পর ওনার প্রতি প্রচন্ড রকমের মুগ্ধতা কাজ করা শুরু হয়। এর পর যে বইটা পড়ার সুযোগ হয় সেটা হলো "মাতাল তরনী" এই বইটি পড়ার পর তো আমার চিন্তার জগৎ অনেকটুকুই বদলে যায়। আস্তে আস্তে সবকিছু বুঝতে শিখি, কেন ওনাকে নিয়ে ধর্মান্ধ জঙ্গিগুলোর এতো ভীতি। তারপর এক এক করে ওনার প্রায় সমস্ত বই' ই একাধিক বার করে পড়ার সৌভাগ্য হয়।
বাংলা সাহিত্যে ওনার মতো এতটা স্পষ্টবাদী আর কেউ ছিলেন না। ওনি যেভাবে ধর্মান্ধ জঙ্গিগুষ্টি এবং সর্বশক্তিমান ক্ষমতসীনদের রক্তচক্ষুর উপেক্ষা করে সত্য উচ্চারণ করে গেছেন, এভাবে আর কেউ বলেননি। ছাপ্পান্ন হাজার বর্গমাইলের এই পবিত্র উপত্যকা জুড়ে যেখানে সকাল থেকে সন্ধা অবধি মরুভূমি, উট, খুর্মা খেজুর, প্রাগৈতিহাসিকতা এবং আদিমতার স্তুতি ও শ্লোক গাওয়া হয়, সেখানে কেউ যুক্তি আর মুক্তচিন্তার আলো হাতে এগিয়ে আসলে তার জন্য এই বঙ্গস্থানে সবসময়ই আসমানী চাপাতি প্রস্তুত থাকে! ২০০৪ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারী এমনিই আসমানী রামদা আর চাপাতির আঘাতে গুরুতর আহত হয়ে জার্মানিতে চিকিৎসা নিতে গিয়েছিলেন, সুস্থও হয়েছিলেনও বটে কিন্তু ঐবছরেরই ১২ আগস্ট নিজ ফ্ল্যাটে হার্ট অ্যাটাক করে মারা যান, বাংলা সাহিত্যে হারায় তার সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্রকে।
তাঁর ভাষার প্রয়োগ, উপমার ব্যবহার একেবারেই আলাদা, মনস্বিতার দ্যুতিতে প্রোজ্জ্বল। তার মতো এতটা শক্তিশালী ভাষা কেউ ব্যবহার করেন নি, আততায়ীর চাপাতির বিরুদ্ধে ওনার কলম সবসময়ই মহাবিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। শব্দের আঘাতে ধর্মান্ধ ছাগুদের বুক কেঁপে ওঠেছে বারবার। স্বরবর্ণ আর ব্যাঞ্জনবর্ণের শৈল্পিক ব্যবহারে তৈরি হয়েছে বাংলা সাহিত্যের অসংখ্য কালজয়ী সব উপাখ্যান, যেগুলো মুগ্ধতা ছড়িয়ে যাবে হাজার হাজার বছর ধরে।
ওনার প্রতিটা লেখাই আমার প্রিয়, এর মধ্যে খুবই প্রিয় ওনার কিছু লাইন......
“ আমি জানি ,ভালো করেই জানি, কিছু অপেক্ষা করে নেই আমার জন্যে; কোনো বিস্মৃতির অতল জলধারা,কোনো প্রেতলোক,কোনো পুনরুথ্থান,কোনো বিচারক,কোনো স্বর্গ, কোনো নরক; আমি আছি ,আমি থাকবো না ,মিশে যাবো ,অপরিচিত হয়ে যাবো,জানবো না আমি ছিলাম । নিরর্থক সব পুণ্যশ্লোক,তাৎপযহীন সমস্ত প্রার্থনা, হাস্যকর উদ্ধত সমাধি; মৃত্যুর পর যে-কোনো জায়গায়ই আমি পড়ে থাকতে পারি-,জঙ্গলে,জলাভূমিতে,পথের পাশে,পাহাড়ের চূড়োয়,নদীতে মরুভুমিতে, তুষার স্তুপে । চলে যাওয়ার পর কিছু চাই না আমি,দেহ বা দ্রাক্ষা,ওষ্ঠ বা অমৃত,বা অমরতা"
শ্রদ্ধেয় হুমায়ুন আজাদ এর প্রয়াণ দিবসে তার প্রতি অনেক অনেক শ্রদ্ধা আর ভালোবাসা রইলো❤️❤ আপনি আমাদের মাঝে হাজার হাজার বছর ধরে আলে ছড়াবেন আপনার লেখার মাধ্যমে।