somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আইবুড়ো মেয়ে

০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১২:৩৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আইবুড়ো মেয়ে অনেকটা বাসি খাবারের মত। খাবার বাসি হলে লোকে যেমন ভীষণ ভাবে, এত খাবার শুধু শুধু নষ্ট হবে, একটা বিহিত যদি করা যেত। বাসি ভাত আছে, আচ্ছা তেল মরিচ দিয়ে ভেজে ফেল, তরকারী আছে গরম দিয়ে ফেল। ভাজা হলে, খাওয়া গেলে লোকের স্বস্তি আর তা না হলে যতক্ষণ না বিহিত হচ্ছে লোকের ভারী চিন্তা। এত মজার খাবার যদি টাটকা টাটকা খাওয়া যেত। এই টাটকা টাটকা খাওয়া মানে অল্প বয়সে মেয়েটির বিয়ে হয়ে যাওয়া।

আইবুড়ো মেয়ে বলতে সমাজে বাস করে আমি এটাই বুঝেছি। বিয়ের আগে আমি অনেকদিন আইবুড়ো ছিলাম। বিয়ের পর যখন দেখলাম এই তোমার কবে গতি হবে এই নিয়ে লোকে ভাবছেনা, ব্যাচেলররা আমাকে নিয়ে আড়ালে অশ্লীল রসিকতা করছে না, বিবাহিত সুখী পুরুষেরা গায়ের একটু কাছে সরে এসে গলা খাদে নামিয়ে কথা বলছে না, তখন আমি বুঝলাম তাহলে আমি বোধ হয় আর আইবুড়ো নেই। একটা স্বামী থাকার কারনে বুড়ো শব্দটা যেহেতু আমার ঘাড় থেকে নেমে গেছে, তাহলে নিশ্চয়ই আমি ধীরে ধীরে আবার তরুণী হয়ে উঠছি।

আমার আইবুড়ো বয়সটা কবে থেকে শুরু হয়েছিল ঠিক মনে নেই। তবে পাস করার পর থেকে এই শব্দটা আমাকে ঘন ঘন শুনতে হত। আমার সাথে যে ছেলেগুলো বেরিয়েছিল তারা এসব শুনত না। আমার চেয়ে যারা বছর পাঁচ-সাতের বড় এমনকি তারাও শুনত না। কারন তারা ছেলে, নিজের পায়ে দাঁড়াবে, স্বনির্ভর হবে, এজন্য সময় লাগবে। এটাই যেন স্বাভাবিক। তবে আমি যেহেতু মেয়ে, আমার জন্য এটি স্বাভাবিক নয়। আমি দাঁড়াবো অন্যের পায়ে, স্বনির্ভর হবার জন্য যে সময়ের প্রয়োজন তার দরকার আমার নেই। পরনির্ভর হলেও আমার বেশ চলবে। স্বামীর ঘাড়ে চড়ব আর দুটাকার সুচ কিনতেও করুন চোখে হাত পাতব।

অথচ দু’কলম লেখাপড়া যা শিখেছি, ছেলেগুলোর মতই তো শিখেছি আমি। এমন তো নয়, ছেলেগুলোর চেয়ে মেয়ে বলে ক’নম্বরের বেশি সুবিধা আমাকে দেওয়া হয়েছে। ওরা ঘাড় গুঁজে পড়লে ঘাড় আমিও গুঁজেছি, ওরা সারাদিন স্কুল কোচিং করলে আমিও করেছি। তবে ওদের কেন স্বনির্ভর হবার প্রয়োজন। একই লেখাপড়া করে আমার কেন সে প্রয়োজন নেই! তাহলে বোধ হয় একটা ভাল বর জোটাতেই আমার এই লেখাপড়া। আর তা যদি নাই হয় পাস করার আগে থেকেই সারাক্ষন লোকে এত বিয়ে বিয়ে করত না, আমার আত্মীয় নয় স্বজন নয়, তবুও কবে আমার বিয়ে, এই ভেবে মাথার চুল ছিঁড়ত না। ব্যাপারটা তাহলে এই; তুমি যদি ডাক্তার হও, নিশ্চিত ডাক্তার জুটবে, ইঞ্জিনিয়ার হলে ইঞ্জিনিয়ার জুটবে। ইউনিভার্সিটি গ্রাজুয়েট হও গুণী পাত্র জুটবে। আর যদি কিছুই না হও, তবুও জুটবে। তবে সে জোটায় অনিশ্চয়তা আছে। সেই অনিশ্চয়তা কাটাতেই এতদিনের লেখাপড়া। এইম ইন লাইফ রচনায় অমুক তমুক হতে চাই কথাটাও শুধু শুধু লিখেছি। বরং সেখানে লেখা উচিৎ ছিল আমার জীবনের লক্ষ্য অল্প বয়সে একটি ভাল বিয়ে হওয়া।

অনেকে যুক্তি খণ্ডনে বসবে বিয়ে করেও তো পড়া যায়, চাকরি করা যায়। হুম সে তো যায়ই, তবে আমার সংসারের কাজ, রান্নাঘরের কাজগুলো কে করবে। স্বামীকে পানির গ্লাসটা কে এগিয়ে দেবে। ভাল মেহমানদারি করে কে সংসারের মুখ উজ্জ্বল করবে। সমাজের নিয়মে সংসারের পাতিলের কালি যদি আমাকেই তুলতে হয়, তবে আমাকে আর একটু সময় দাও। একটু ক্যারিয়ারটা গুছাতে দাও। ঝকঝকে অফিসের চেয়ারে বসে দু’ একটা ফাইল আমাকেও সাইন করতে দাও। আমাদের ক্লাসের ‘ক’ এর মায়ের মত ঢাকা মেডিক্যাল থেকে পড়ে হাউজয়াইফ হতে তো আমি চাই না। আর আমার জীবন দর্শন অন্যের সাথে না মিলতেও পারে। পছন্দের সঙ্গী চাইলেই তৎক্ষণাৎ সেটাও না মিলতে পারে। আর বিয়ের কি এমনই বা দেরী হয়েছে আমার। মেয়েদের আর কত অল্প বয়সে বিয়ে হতে হয়। এখন তো সবাই পাস করে বাইশে-তেইশে। এ দেশে যখন পড়তে এসেছি তখন তো পঁচিশও হয়নি।

যখন দেশে ছিলাম, পাস করার পর নিজের টাকাই খেয়েছি পরেছি। তবুও যতদিন বিয়ে না হয়েছিল নিজের বাবা-মায়ের অভিব্যাক্তি এমন ছিল যেন তাদের ঘাড়ে চেপে বসেছি আমি। তারপর বিয়েটা হল। তারা স্বস্তি পেল, যেন তাদের ঘাড় থেকে নেমে আমি স্বামীর ঘাড়ে উঠলাম। তাদেরকে আমি দোষ দিচ্ছি না। দুশ্চিন্তারা আসতেই পারে। কিন্তু অতিরিক্ত দুশ্চিন্তা মাঝেই মাঝেই প্রচণ্ড বিরক্তিকর, সেইসাথে বিব্রতকর তো বটেই। এ দেশে যখন প্রথম পড়তে এলাম, সবাই একটা বিরাট হা করল যেন আমিই নারী কলম্বাস, যে এ দেশে প্রথম একা এসেছি। আমি অন্তত বারোটি মেয়েকে চিনি যারা দেশের বাইরে একা একা পড়তে এসেছে। আর একা আসলে কি হয়? আমাদের দেশের চেয়ে অনেক বেশি নিরাপত্তা এই দেশে আছে। না কিছুই হয় না, তবুও তো স্বামী সাথে নেই, বিপদে আপদে চেপে বসার জন্য স্বামীর মজবুত ঘাড় নেই। এ দেশে এসে ভাবলাম এখানকার বাঙালীরা বুঝি আলাদা। কিন্তু ঢেঁকি তো স্বর্গেও ধান ভানে।

দেশ বলতে এখানে শুধু বাঙালিদের সাথে আড্ডা। সেখানেও দেখি একই প্রশ্ন। অনেকের তো বদ্ধ মুল ধারনাই ছিল, ছেলে পাওয়া যাচ্ছে না। কোন ছেলেই আমাকে বিয়ে করতে চাচ্ছে না এবং সার কথা বিবাহের জন্য একটি ছেলে পাবার যোগ্যতাও আমার নেই। ছেলে পাওয়া যাচ্ছিল না, এ কথা অবশ্য সত্যিই ঠিক। যার সাথে আমার কথা বলে আরাম হবে, শুয়ে আরাম হবে, বসে আরাম হবে, খিলখিলিয়ে আরাম হবে বলে আমি মনে করি ঠিক সেই ছেলেটি পাওয়া যাচ্ছিল না। অনেককে পাওয়া যাচ্ছিল, নর্থ আমেরিকাতেই থাকত তারা। এদের অনেকে আমার জন্য দেবদাস হবে বলে পরবর্তীতে ছেলের বাবা হয়েছিল, আদর্শ স্বামী হয়েছিল। তবে সেসব আমার ভীষণ ব্যাক্তিগত কথা কাউকে বলার প্রয়োজন মনে করতাম না, সাথের মেয়েটা হয়ত কিছু জানত কিন্তু এতে আমার অনাত্মীয়দের দুশ্চিন্তা ভীষণ বাড়ত আর বাকিদেরটা দিব্যি বুঝতাম, এসব ব্যক্তিগত কথা শোনার জন্য এদের মন কতটা টন টন করত।

এখন আমার বিয়ে হয়েছে। টন টন থেকে আমি রক্ষা পেয়েছি। তবে আমার চেয়ে বয়সে কিছুটা ছোট বড় আর সমবয়সী কিছু মেয়ে আছে, এরা এখনও রক্ষা পায়নি। সমাজের টনটনে চোখ এখন এদের দিকে। লোকে এখন বিভিন্ন ইস্যু সমাধানের চেয়ে এগুলো নিয়ে আলোচনা করতে ভালবাসে। এরা কেন বিয়ে করছে না এটাও এখন একটা ইস্যু। দেশে ফোন করলেই অমুকের তমুকের বিয়ের কথা আসে। আমি যেহেতু এখন বিবাহিত সেই ইস্যুতে আমিও বসি। তবে এই ইস্যুর বিষয়টি আসলে আমি যেন আমার আগেরদিনগুলো দেখতে পাই। অথচ যে মেয়েগুলো নিয়ে এত আলোচনা হয়। এদের অনেকের বাড়ির গল্পটা আমি জানি। অনেকের বাবা নেই, ছোট ভাইবোন আছে তাদের দেখতে হয়। মা নেই, বাবাকে দেখতে হয়। যেখানে মেয়েটির সম্মান ও প্রশংসা পাবার কথা সেখানে কেন বারবার একই প্রশ্ন করে মেয়েটিকে বিব্রত করা হয় আমি বুঝি না। আর অনেক মেয়েই আছে সৌন্দর্যে শিক্ষায় যোগ্যতায় ব্যক্তিত্তে মননে তাদের ধারে কাছে যাবার মত কোন ছেলে তো আমি দেখি না। জীবনে সঙ্গীর প্রয়োজনীয়তা অবশ্যই আছে। তবে মূল্যবোধ আর ব্যাক্তিত্তের সংঘাত যেন সেখানে না হয়, সেটাই কাম্য। আমার মনে হয় শিক্ষিত মেয়েরা এই বিষয়টা নিয়ে খুব বেশি ভাবে। আর ছেলেরা খুব সহজেই বিয়ের কথা বলে ফেলে। মেয়েরা বলতে পারে না, হয়ত চাই ও না। অনেক মেয়ের পরিবারেই অভিভাবক নেই, হয়ত বাবা মারা গেছেন। তাদেরকে সে ক্ষেত্রে এ ব্যাপারে সহযোগিতা করতে পারেন, তবে অবশ্যই সেটা নির্দিষ্ট ভদ্রতা বজায় রেখে করলেই ভাল। সারাক্ষণ বিয়ে কেন করছনা বলে মাথা ব্যাথা করে নয়।

এদের কারো কারো পছন্দের কেউ থাকতেও পারে, তার যখন ইচ্ছা তাকে তখন বিয়ে করতে দিন। ক্যারিয়ার পরিবার নিয়ে নিশ্চয়ই তার আলাদা ভাবনা আছে। ধৈর্য ধরে সে থাকলে আজাইড়া পাবলিক হিসেবে কিছু ধৈর্য আপনিও ধরুন। আর মেয়েদের শুধু শুধু আইবুড়ো বলবেন না। কিছু ঝানু বুড়ো আছে যারা বিয়ের জন্য বিশ একুশের মেয়ে খোঁজে তাদের বেশি বেশি করে আইবুড়ো বলুন। শেষ কথা, আমার বিয়ে আমি করব, যখন খুশি তখন করব, যাকে খুশি তাকে করব।
সর্বশেষ এডিট : ০২ রা অক্টোবর, ২০১৫ রাত ১২:৩৫
৩২টি মন্তব্য ২৯টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

প্রতি মাসে সামু-ব্লগে ভিজিটর কত? মার্চ ২০২৪ Update

লিখেছেন জে.এস. সাব্বির, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:০৮

মার্চ ২০২৪ সালে আমাদের প্রিয় সামু ব্লগে ভিজিটর সংখ্যা কত ছিল? জানতে হলে চোখ রাখুন-

গত ৬ মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি ভিউ ছিল জানুয়ারি মাসে। ওই মাসে সর্বমোট ভিজিট ছিল ১৬... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রোএক্টিভিটি এবং কম্পাউন্ড ইফেক্ট: আমার গুরুত্বপূর্ণ দুইটি শিক্ষা

লিখেছেন মাহদী হাসান শিহাব, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:১১



আমার গুরুত্বপূর্ন দুইটা লার্নিং শেয়ার করি। এই দুইটা টুল মাথায় রাখলে দৈনন্দিন কাজ করা অনেক সহজ হয়। টুল দুইটা কাজ করতে ও কাজ শেষ করতে ম্যাজিক হিসাবে কাজ করে।

এক.

স্টিফেন কোভের... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

লিখেছেন সায়েমার ব্লগ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৩

প্রসঙ্গ রূপান্তরঃ
ট্রান্সজেন্ডার, সমকামিতা এবং যৌনতা বিষয়ক কিছু আবশ্যিক আলাপ

১।
যৌন প্রাকৃতিক, জেন্ডার নয়।জেন্ডার মানুষের সৃষ্টি (social, cultural construction)। যৌনকে বিভিন্ন সমাজ বিভিন্ন সময়ে যেভাবে ডিল করে, তাঁকে ঘিরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরান-ইজরায়েল দ্বৈরথঃ পানি কতোদূর গড়াবে??

লিখেছেন ভুয়া মফিজ, ১৯ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১১:২৬



সারা বিশ্বের খবরাখবর যারা রাখে, তাদের সবাই মোটামুটি জানে যে গত পহেলা এপ্রিল ইজরায়েল ইরানকে ''এপ্রিল ফুল'' দিবসের উপহার দেয়ার নিমিত্তে সিরিয়ায় অবস্থিত ইরানের কনস্যুলেট ভবনে বিমান হামলা চালায়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্মৃতির ঝলক: প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের অনুভূতি এবং মনের শান্তির খোঁজে

লিখেছেন নাহল তরকারি, ২০ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:০১



সরল প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের সংমিশ্রণে একটি ঘূর্ণায়মান পথ জুড়ে ঘুরে বেড়ানোর অবস্থানে আমি খুব শান্তি অনুভব করি। নদীর জল ছুঁয়ে পথ ধরে হাঁটতে হাঁটতে নৈসর্গিক সৌন্দর্যের সঙ্গে এক আন্তরিক সংযোগ অনুভব... ...বাকিটুকু পড়ুন

×